বিজন সাহা

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা হতো বলে রাশিয়া ও চীন অভিযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটা স্বীকার করছে না। কিন্তু জর্জিয়ায় অনেকের অকস্মাৎ মৃত্যু, দাগিস্তানে বিরল প্রাণীদের দল বেঁধে মৃত্যু—এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, ওসব ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু জীবাণু তৈরি হতো, যা পাখির মাধ্যমে ছড়ানো যায়। ইদানীং পাওয়া কিছু তথ্য বলছে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে এমন কিছু ড্রোন অর্ডার দিতে চেয়েছিল, যা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্প্রে ছড়াতে পারে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন, জর্জিয়া, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য এক্স-সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোয় এমন অনেক ল্যাবরেটরি আছে, যা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পেন্টাগনের অর্থ সহায়তায় চালিত। ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভব ২০০৫ সালে তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার অংশগ্রহণে। পরে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, এসব ল্যাবরেটরিতে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো, যা নিরাপদ ছিল না। রাশিয়া ও চীনের চারদিকে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি এ ধরনের ল্যাবরেটরির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আজ হোক, আর কাল হোক এই সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে তখন সেটা হতো আরও কঠিন যুদ্ধ।
আজ যারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁরা যদি একইভাবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন; ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতেন; দেশে দেশে রং-বেরঙের বিপ্লবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন; পৃথিবী আজ এই মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারে এসে দাঁড়াত না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, হান্টার বাইডেন এসব ল্যাবরেটরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যখন ইউক্রেনে এসব ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়, তখন সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক উলিয়ানা সুপ্রুম, যাঁর পিতামহ স্তেপান বান্দেরার সহযোগী ছিলেন।
উল্লেখ্য, বিদেশি নাগরিকের মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনে সাংবিধানিক বাধানিষেধ থাকার পরও সুপ্রুম কিন্তু নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের আসল শাসক কারা। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হান্টার বাইডেন আলোচনায় আসেন। তাঁর ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম একে রাশিয়ার চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিককালে তারা স্বীকার করেছে, ল্যাপটপের ঘটনায় রাশিয়া জড়িত ছিল না। কিছু কিছু নথি প্রমাণ করে যে, জো বাইডেন শুধু হান্টারের পিতাই নন, বিজনেস পার্টনারও বটে। অন্তত তিনি ছেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতেন। তাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি যে বাইডেন ফ্যামিলির স্বার্থও জড়িত—এটা বলা অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড—এদের শিকড় ইউক্রেনের ওদেসায়। এই দুই পরিবারই কয়েক প্রজন্ম আগে জারের রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যায় ভাগ্যের সন্ধানে। তাই এদের মধ্যেও যে অন্ধ রুশ বিরোধিতা নেই, সেটাই-বা কে জানে?
বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। অনেক সময় ওরা অপেক্ষা করত ছোট ভাই বা বোন কখন আঘাত পেয়ে কাঁদবে, তারপর ওকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেবে। যদিও চাইলে আগেই ওরা বাচ্চাটা যাতে আঘাত না পায়, সেটা করতে পারত, যা সাধারণত বড়রা করে। মনে হয় প্রথমত কিউরিওসিটি থেকে—দেখি কী হয় পড়ে কি পড়ে না। আবার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে বাহবা পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রন্দনরত বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়। আজ রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দনবাসে তাণ্ডব চালানোর পর সেখানে আসত, হয়তো এতটা সমালোচনার মুখে পড়ত না। বরং অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেত। যেমন হয়েছে সিরিয়ায়। কিন্তু আমরা কি এ জন্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষের জীবন বলিদান করতে প্রস্তুত? মনে হয় তাই। আমরা আমাদের কাজের যুক্তি খুঁজি কোনো ঘটনা ঘটার পর, কেন ঘটল সেটা প্রায়ই বিবেচনায় না এনে।
মানুষের চরিত্রই এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে, সে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু যখন সেই বিপদগ্রস্ত মানুষ মারা যাবে, তখন তার প্রতি সমবেদনার অন্ত থাকবে না। কিন্তু সেই একই লোক যদি জীবন বাঁচাতে অন্যায় কিছু করে, তখন সবাই মিলে তাকে অপরাধী সাজিয়ে ছাড়বে। আর এটা সে করে সব সময় শুধু খণ্ডচিত্র বিবেচনায় আনে বলে। যেকোনো বিষয়ে কম-বেশি নিরপেক্ষ ও সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য দরকার পূর্ণ চিত্র বিবেচনা করা। বর্তমান পৃথিবী এত বেশি স্বার্থান্ধ যে, সে কাউকে পূর্ণ চিত্র দেখতে শেখায় না। সবাই দেখায় শুধু সেই চিত্রটাই, অনেক সময় ফেইক চিত্র, যেটা তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। এখন সত্য খোঁজা হয় না। যে ভাষ্য স্বার্থ উদ্ধার করতে সাহায্য করে, সেটাকেই ছলে-বলে-কৌশলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকম চেষ্টা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক আইন-কানুন আজ কাজ করে না। অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও সামাজিক চুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
দনবাসের সংকট ছড়াল যে কারণে
অনেককেই বলতে শুনি দনবাসে যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাহলে রুশ আক্রমণ এখানে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো হতো। এখানে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের আগে সমস্ত ইউরোপ পদানত করে। আর এসব দেশ প্রায় বিনা প্রতিরোধে জার্মানির অধীনতা মেনে নেয়। ফলে সেসব দেশে পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়। এসব দেশের সৈন্যরা জার্মান সৈন্যের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে। পরাজিত জার্মান বাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন আসে সোভিয়েত সীমান্ত ত্যাগের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে কি হবে না। যদি সেটা না হতো বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের সমর্থনকারী সরকার ক্ষমতায় থাকত। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মানি নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধ শুরু করত। তাই সে সময় ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বিকল্প ছিল না। আর যেহেতু প্রায় প্রতিটি দেশেই যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়েছিল সেসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসব এলাকা মুক্ত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শুধু গায়ের জোর ছিল না, ছিল অবজেকটিভ রিয়্যালিটিও।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেছেন। হিটলার ও মুসোলিনির মতো না হলেও তিনি এদের চেয়ে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৯৪৫ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ দেখেনি। সেই একই কারণে ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ আজ যুগের দাবি। তা না করলে অচিরেই নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে, আর তা হবে আরও ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এটাই বলার চেষ্টা করে যে, এই যুদ্ধের পেছনে ভারতের হাত আছে, আর দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাই এ জন্যে দায়ী। ফলে একাত্তরে তারা নির্বিচারে হিন্দু নিধন করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা। এমনকি এখন যে জামায়াত-হেফাজতসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, সেটা তখনকার রাগ থেকেও। একইভাবে যদি ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎপাটন না করা হয়, তাহলে সেখানকার রুশদের সেই একই রকম বিপদের মধ্যে রাখা হবে।
কারণ, এসব ফ্যাসিবাদী দল প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করবে স্থানীয় রুশদের, আর রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের ওপর। এরই মধ্যে সেখানে অনেকেই ডাক দিচ্ছে রুশ হত্যার, বিশেষ করে রুশ শিশু হত্যার, যাতে করে উত্তরসূরিরা পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। মনে করিয়ে দিতে চাই যে,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, রাজাকার-আলবদর নয়। শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে, রাজাকাররা নয়। একাত্তরের বিজয়ের পরে প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া, দেশকে আক্ষরিক অর্থেই রাজাকারমুক্ত করা। তখন সেটা হয়নি বলেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হয়েছে, তখন সেটা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে নতুন করে পাকিস্তানের জুতা পরতে হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটা দিক ছিল—পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী হবে এসব কেন্দ্রের। চেরনোবিলের স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো গড়ে (১) ৩০ কিলোপাসকেল শক্তির শকওয়েভের চাপ সহ্য করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে-মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এর ওপর পড়লেও এগুলো ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে এগুলো; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে চেরনোবিলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভেতর থেকে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সেখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যখন দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন। ইউক্রেন সেই চেষ্টা করেছিল চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। যদিও রুশ সৈন্যরা প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে, পরে বেলারুশ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সে সমস্যার সমাধান করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপারোঝিয়ায় তারা প্রভোকেশন করেছিল। যদিও রুশ সৈন্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে উগ্রবাদীদের হাতে যেকোনো অস্ত্রই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই প্রমাণ তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট নিকট অতীতে বারবার দিয়েছে।
রুশোফোবিয়া: শুনব নাকি শুনব না
যুদ্ধ শুরুর পর রুশোফোবিয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পোল্যান্ডের এক মন্ত্রী শিকার করেছেন—রুশোফোবিয়া এখন পশ্চিমা বিশ্বের মেইন স্ট্রিম আইডিয়া। আর এটা শুধু যারা রাশিয়ার নাগরিক তাদের সাথেই ঘটছে না, যারা যুগ যুগ ধরে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছে, তারাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অধ্যয়নরত শত শত রুশ ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দস্তইয়েভস্কি, চাইকোভস্কি—মানে রুশ সাহিত্য, রুশ মিউজিক আজ পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ। ভালেরি গিওর্গিয়েভ, আন্না নিত্রেপকাসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী, যারা ওখানে কাজ করতেন বা রেগুলার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে—এই আক্রমণের বিরোধিতা করতে। কিন্তু এঁরা তো জানেন, দনবাসের মানুষের কষ্টের কথা। সমস্ত খেলাধুলায় এদের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। শত শত রুশ ড্রাইভার আটকা পড়েছেন পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে। এখন বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের ট্রাক ও অন্যান্য মালবাহী গাড়ি আটকে দিচ্ছে।
এটা আসলে রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বই কিছু নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল রুশ রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার রুশ রোগীদের স্যাম্পল টেস্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এরাই নিজেদের মানবতার ধারক ও বাহক বলে ভাবে। অনেকে রুশদের কাছে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না বা যারা অনেক দিন বাসা ভাড়া করে আছে, তাদের উঠে যেতে বলছে। এটা অনেকটা আমাদের সব দেশে ধর্ম দেখে বাসা ভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার মত। স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাদের রুশবিরোধী কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলোয় রুশ ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম পূরণ করতে বলা হচ্ছে, যেখানে বাবা-মার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, যেমন তারা এই যুদ্ধের ব্যাপারে কোন পক্ষ সমর্থন করে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ইউরোপের কোন না কোন দেশে শুধু রুশ হওয়ার অপরাধে অনেকের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবসর যাপনকারী রুশ নারী ও শিশুদের হত্যার ডাক দিচ্ছে।
এ কারণে এ দেশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। পোল্যান্ড দূতাবাসে গেছি ভিসার জন্য। খুব ভোরে গেছি, দূতাবাস তখনো খোলেনি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে জানলাম ও পাকিস্তান থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকজনকে আসতে দেখলাম। পোশাক দেখে বুঝলাম শিখ। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি ছেলেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধ—ও ভারতীয়। এই দুজন লোক কোনো দিন একে অন্যকে দেখেনি, কেউ কারও ক্ষতি করেনি, অথচ বিনা কারণে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালাল। তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন দেখছি সভ্য ইউরোপের মানুষও এ ব্যাপারে খুব একটা এগিয়ে যায়নি। আসলে কী বলব। মাত্র তিন বছরে জার্মানির শিক্ষিত, সভ্য মানুষেরা হিটলারের ডাকে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘৃণা করতে শেখানো খুব সহজ, কিন্তু একদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু একদিনে এই ঘৃণা চলে যাবে না। বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে মানুষ তখন কী সমাজ গড়বে?
এরই মধ্যে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যেভাবে পারছে দেশটির সম্পদ লুটপাট করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটাকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে। করছে নিজেরাই এদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। এখানে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে। একটা দিনের কথাও মনে পড়ে না, যখন এদের ওপর একটা না একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল না। আসলে কারও উদ্দেশ্য যদি হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা, সে অজুহাত খুঁজে বের করবেই।
সেই নব্বইয়ের দশকে, যখন বরিস (ইয়েলৎসিন) আর বিল (ক্লিনটন) নিজেদের বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন, তখনো সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা কাজ করত। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো—‘যখন নেকড়ে ভাঁটিতে জলপানরত ভেড়াকে খেতে চায় জল ঘোলা করার অপরাধে। ভেড়া ভাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করলে নেকড়ে বলে, তুই না হলে তোর দাদা নিশ্চয়ই আমার জল ঘোলা করেছিল। তাই তোকেই সে ঋণ শোধ করতে হবে।’ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশদের নিয়ে যা ঘটছে, সেটা আমায় মনে করিয়ে দেয় ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলোর কথা, যখন অনেক মার্কিন মুসলিম নাগরিকও ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছিল। যদিও ইউরোপের মাল্টি-কালচারাল আইডিয়া অনেক আগেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ছিল, বর্তমান ঘটনা খুব সম্ভব তার জন্য শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। টলারেন্স বা পরমত সহিষ্ণুতা এভাবেই বেঘোরে মারা গেল। যুদ্ধে যাই ঘটুক ইউরোপ যে আর কোনো দিন আগের ইউরোপ থাকবে না, সেটা জোরেশোরেই বলা যায়।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত পড়ুন:

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা হতো বলে রাশিয়া ও চীন অভিযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটা স্বীকার করছে না। কিন্তু জর্জিয়ায় অনেকের অকস্মাৎ মৃত্যু, দাগিস্তানে বিরল প্রাণীদের দল বেঁধে মৃত্যু—এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, ওসব ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু জীবাণু তৈরি হতো, যা পাখির মাধ্যমে ছড়ানো যায়। ইদানীং পাওয়া কিছু তথ্য বলছে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে এমন কিছু ড্রোন অর্ডার দিতে চেয়েছিল, যা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্প্রে ছড়াতে পারে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন, জর্জিয়া, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য এক্স-সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোয় এমন অনেক ল্যাবরেটরি আছে, যা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পেন্টাগনের অর্থ সহায়তায় চালিত। ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভব ২০০৫ সালে তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার অংশগ্রহণে। পরে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, এসব ল্যাবরেটরিতে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো, যা নিরাপদ ছিল না। রাশিয়া ও চীনের চারদিকে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি এ ধরনের ল্যাবরেটরির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আজ হোক, আর কাল হোক এই সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে তখন সেটা হতো আরও কঠিন যুদ্ধ।
আজ যারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁরা যদি একইভাবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন; ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতেন; দেশে দেশে রং-বেরঙের বিপ্লবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন; পৃথিবী আজ এই মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারে এসে দাঁড়াত না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, হান্টার বাইডেন এসব ল্যাবরেটরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যখন ইউক্রেনে এসব ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়, তখন সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক উলিয়ানা সুপ্রুম, যাঁর পিতামহ স্তেপান বান্দেরার সহযোগী ছিলেন।
উল্লেখ্য, বিদেশি নাগরিকের মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনে সাংবিধানিক বাধানিষেধ থাকার পরও সুপ্রুম কিন্তু নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের আসল শাসক কারা। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হান্টার বাইডেন আলোচনায় আসেন। তাঁর ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম একে রাশিয়ার চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিককালে তারা স্বীকার করেছে, ল্যাপটপের ঘটনায় রাশিয়া জড়িত ছিল না। কিছু কিছু নথি প্রমাণ করে যে, জো বাইডেন শুধু হান্টারের পিতাই নন, বিজনেস পার্টনারও বটে। অন্তত তিনি ছেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতেন। তাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি যে বাইডেন ফ্যামিলির স্বার্থও জড়িত—এটা বলা অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড—এদের শিকড় ইউক্রেনের ওদেসায়। এই দুই পরিবারই কয়েক প্রজন্ম আগে জারের রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যায় ভাগ্যের সন্ধানে। তাই এদের মধ্যেও যে অন্ধ রুশ বিরোধিতা নেই, সেটাই-বা কে জানে?
বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। অনেক সময় ওরা অপেক্ষা করত ছোট ভাই বা বোন কখন আঘাত পেয়ে কাঁদবে, তারপর ওকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেবে। যদিও চাইলে আগেই ওরা বাচ্চাটা যাতে আঘাত না পায়, সেটা করতে পারত, যা সাধারণত বড়রা করে। মনে হয় প্রথমত কিউরিওসিটি থেকে—দেখি কী হয় পড়ে কি পড়ে না। আবার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে বাহবা পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রন্দনরত বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়। আজ রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দনবাসে তাণ্ডব চালানোর পর সেখানে আসত, হয়তো এতটা সমালোচনার মুখে পড়ত না। বরং অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেত। যেমন হয়েছে সিরিয়ায়। কিন্তু আমরা কি এ জন্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষের জীবন বলিদান করতে প্রস্তুত? মনে হয় তাই। আমরা আমাদের কাজের যুক্তি খুঁজি কোনো ঘটনা ঘটার পর, কেন ঘটল সেটা প্রায়ই বিবেচনায় না এনে।
মানুষের চরিত্রই এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে, সে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু যখন সেই বিপদগ্রস্ত মানুষ মারা যাবে, তখন তার প্রতি সমবেদনার অন্ত থাকবে না। কিন্তু সেই একই লোক যদি জীবন বাঁচাতে অন্যায় কিছু করে, তখন সবাই মিলে তাকে অপরাধী সাজিয়ে ছাড়বে। আর এটা সে করে সব সময় শুধু খণ্ডচিত্র বিবেচনায় আনে বলে। যেকোনো বিষয়ে কম-বেশি নিরপেক্ষ ও সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য দরকার পূর্ণ চিত্র বিবেচনা করা। বর্তমান পৃথিবী এত বেশি স্বার্থান্ধ যে, সে কাউকে পূর্ণ চিত্র দেখতে শেখায় না। সবাই দেখায় শুধু সেই চিত্রটাই, অনেক সময় ফেইক চিত্র, যেটা তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। এখন সত্য খোঁজা হয় না। যে ভাষ্য স্বার্থ উদ্ধার করতে সাহায্য করে, সেটাকেই ছলে-বলে-কৌশলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকম চেষ্টা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক আইন-কানুন আজ কাজ করে না। অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও সামাজিক চুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
দনবাসের সংকট ছড়াল যে কারণে
অনেককেই বলতে শুনি দনবাসে যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাহলে রুশ আক্রমণ এখানে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো হতো। এখানে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের আগে সমস্ত ইউরোপ পদানত করে। আর এসব দেশ প্রায় বিনা প্রতিরোধে জার্মানির অধীনতা মেনে নেয়। ফলে সেসব দেশে পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়। এসব দেশের সৈন্যরা জার্মান সৈন্যের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে। পরাজিত জার্মান বাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন আসে সোভিয়েত সীমান্ত ত্যাগের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে কি হবে না। যদি সেটা না হতো বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের সমর্থনকারী সরকার ক্ষমতায় থাকত। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মানি নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধ শুরু করত। তাই সে সময় ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বিকল্প ছিল না। আর যেহেতু প্রায় প্রতিটি দেশেই যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়েছিল সেসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসব এলাকা মুক্ত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শুধু গায়ের জোর ছিল না, ছিল অবজেকটিভ রিয়্যালিটিও।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেছেন। হিটলার ও মুসোলিনির মতো না হলেও তিনি এদের চেয়ে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৯৪৫ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ দেখেনি। সেই একই কারণে ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ আজ যুগের দাবি। তা না করলে অচিরেই নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে, আর তা হবে আরও ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এটাই বলার চেষ্টা করে যে, এই যুদ্ধের পেছনে ভারতের হাত আছে, আর দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাই এ জন্যে দায়ী। ফলে একাত্তরে তারা নির্বিচারে হিন্দু নিধন করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা। এমনকি এখন যে জামায়াত-হেফাজতসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, সেটা তখনকার রাগ থেকেও। একইভাবে যদি ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎপাটন না করা হয়, তাহলে সেখানকার রুশদের সেই একই রকম বিপদের মধ্যে রাখা হবে।
কারণ, এসব ফ্যাসিবাদী দল প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করবে স্থানীয় রুশদের, আর রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের ওপর। এরই মধ্যে সেখানে অনেকেই ডাক দিচ্ছে রুশ হত্যার, বিশেষ করে রুশ শিশু হত্যার, যাতে করে উত্তরসূরিরা পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। মনে করিয়ে দিতে চাই যে,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, রাজাকার-আলবদর নয়। শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে, রাজাকাররা নয়। একাত্তরের বিজয়ের পরে প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া, দেশকে আক্ষরিক অর্থেই রাজাকারমুক্ত করা। তখন সেটা হয়নি বলেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হয়েছে, তখন সেটা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে নতুন করে পাকিস্তানের জুতা পরতে হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটা দিক ছিল—পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী হবে এসব কেন্দ্রের। চেরনোবিলের স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো গড়ে (১) ৩০ কিলোপাসকেল শক্তির শকওয়েভের চাপ সহ্য করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে-মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এর ওপর পড়লেও এগুলো ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে এগুলো; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে চেরনোবিলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভেতর থেকে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সেখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যখন দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন। ইউক্রেন সেই চেষ্টা করেছিল চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। যদিও রুশ সৈন্যরা প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে, পরে বেলারুশ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সে সমস্যার সমাধান করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপারোঝিয়ায় তারা প্রভোকেশন করেছিল। যদিও রুশ সৈন্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে উগ্রবাদীদের হাতে যেকোনো অস্ত্রই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই প্রমাণ তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট নিকট অতীতে বারবার দিয়েছে।
রুশোফোবিয়া: শুনব নাকি শুনব না
যুদ্ধ শুরুর পর রুশোফোবিয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পোল্যান্ডের এক মন্ত্রী শিকার করেছেন—রুশোফোবিয়া এখন পশ্চিমা বিশ্বের মেইন স্ট্রিম আইডিয়া। আর এটা শুধু যারা রাশিয়ার নাগরিক তাদের সাথেই ঘটছে না, যারা যুগ যুগ ধরে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছে, তারাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অধ্যয়নরত শত শত রুশ ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দস্তইয়েভস্কি, চাইকোভস্কি—মানে রুশ সাহিত্য, রুশ মিউজিক আজ পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ। ভালেরি গিওর্গিয়েভ, আন্না নিত্রেপকাসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী, যারা ওখানে কাজ করতেন বা রেগুলার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে—এই আক্রমণের বিরোধিতা করতে। কিন্তু এঁরা তো জানেন, দনবাসের মানুষের কষ্টের কথা। সমস্ত খেলাধুলায় এদের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। শত শত রুশ ড্রাইভার আটকা পড়েছেন পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে। এখন বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের ট্রাক ও অন্যান্য মালবাহী গাড়ি আটকে দিচ্ছে।
এটা আসলে রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বই কিছু নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল রুশ রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার রুশ রোগীদের স্যাম্পল টেস্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এরাই নিজেদের মানবতার ধারক ও বাহক বলে ভাবে। অনেকে রুশদের কাছে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না বা যারা অনেক দিন বাসা ভাড়া করে আছে, তাদের উঠে যেতে বলছে। এটা অনেকটা আমাদের সব দেশে ধর্ম দেখে বাসা ভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার মত। স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাদের রুশবিরোধী কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলোয় রুশ ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম পূরণ করতে বলা হচ্ছে, যেখানে বাবা-মার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, যেমন তারা এই যুদ্ধের ব্যাপারে কোন পক্ষ সমর্থন করে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ইউরোপের কোন না কোন দেশে শুধু রুশ হওয়ার অপরাধে অনেকের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবসর যাপনকারী রুশ নারী ও শিশুদের হত্যার ডাক দিচ্ছে।
এ কারণে এ দেশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। পোল্যান্ড দূতাবাসে গেছি ভিসার জন্য। খুব ভোরে গেছি, দূতাবাস তখনো খোলেনি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে জানলাম ও পাকিস্তান থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকজনকে আসতে দেখলাম। পোশাক দেখে বুঝলাম শিখ। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি ছেলেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধ—ও ভারতীয়। এই দুজন লোক কোনো দিন একে অন্যকে দেখেনি, কেউ কারও ক্ষতি করেনি, অথচ বিনা কারণে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালাল। তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন দেখছি সভ্য ইউরোপের মানুষও এ ব্যাপারে খুব একটা এগিয়ে যায়নি। আসলে কী বলব। মাত্র তিন বছরে জার্মানির শিক্ষিত, সভ্য মানুষেরা হিটলারের ডাকে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘৃণা করতে শেখানো খুব সহজ, কিন্তু একদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু একদিনে এই ঘৃণা চলে যাবে না। বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে মানুষ তখন কী সমাজ গড়বে?
এরই মধ্যে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যেভাবে পারছে দেশটির সম্পদ লুটপাট করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটাকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে। করছে নিজেরাই এদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। এখানে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে। একটা দিনের কথাও মনে পড়ে না, যখন এদের ওপর একটা না একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল না। আসলে কারও উদ্দেশ্য যদি হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা, সে অজুহাত খুঁজে বের করবেই।
সেই নব্বইয়ের দশকে, যখন বরিস (ইয়েলৎসিন) আর বিল (ক্লিনটন) নিজেদের বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন, তখনো সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা কাজ করত। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো—‘যখন নেকড়ে ভাঁটিতে জলপানরত ভেড়াকে খেতে চায় জল ঘোলা করার অপরাধে। ভেড়া ভাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করলে নেকড়ে বলে, তুই না হলে তোর দাদা নিশ্চয়ই আমার জল ঘোলা করেছিল। তাই তোকেই সে ঋণ শোধ করতে হবে।’ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশদের নিয়ে যা ঘটছে, সেটা আমায় মনে করিয়ে দেয় ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলোর কথা, যখন অনেক মার্কিন মুসলিম নাগরিকও ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছিল। যদিও ইউরোপের মাল্টি-কালচারাল আইডিয়া অনেক আগেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ছিল, বর্তমান ঘটনা খুব সম্ভব তার জন্য শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। টলারেন্স বা পরমত সহিষ্ণুতা এভাবেই বেঘোরে মারা গেল। যুদ্ধে যাই ঘটুক ইউরোপ যে আর কোনো দিন আগের ইউরোপ থাকবে না, সেটা জোরেশোরেই বলা যায়।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত পড়ুন:
বিজন সাহা

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা হতো বলে রাশিয়া ও চীন অভিযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটা স্বীকার করছে না। কিন্তু জর্জিয়ায় অনেকের অকস্মাৎ মৃত্যু, দাগিস্তানে বিরল প্রাণীদের দল বেঁধে মৃত্যু—এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, ওসব ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু জীবাণু তৈরি হতো, যা পাখির মাধ্যমে ছড়ানো যায়। ইদানীং পাওয়া কিছু তথ্য বলছে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে এমন কিছু ড্রোন অর্ডার দিতে চেয়েছিল, যা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্প্রে ছড়াতে পারে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন, জর্জিয়া, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য এক্স-সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোয় এমন অনেক ল্যাবরেটরি আছে, যা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পেন্টাগনের অর্থ সহায়তায় চালিত। ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভব ২০০৫ সালে তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার অংশগ্রহণে। পরে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, এসব ল্যাবরেটরিতে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো, যা নিরাপদ ছিল না। রাশিয়া ও চীনের চারদিকে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি এ ধরনের ল্যাবরেটরির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আজ হোক, আর কাল হোক এই সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে তখন সেটা হতো আরও কঠিন যুদ্ধ।
আজ যারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁরা যদি একইভাবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন; ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতেন; দেশে দেশে রং-বেরঙের বিপ্লবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন; পৃথিবী আজ এই মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারে এসে দাঁড়াত না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, হান্টার বাইডেন এসব ল্যাবরেটরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যখন ইউক্রেনে এসব ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়, তখন সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক উলিয়ানা সুপ্রুম, যাঁর পিতামহ স্তেপান বান্দেরার সহযোগী ছিলেন।
উল্লেখ্য, বিদেশি নাগরিকের মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনে সাংবিধানিক বাধানিষেধ থাকার পরও সুপ্রুম কিন্তু নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের আসল শাসক কারা। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হান্টার বাইডেন আলোচনায় আসেন। তাঁর ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম একে রাশিয়ার চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিককালে তারা স্বীকার করেছে, ল্যাপটপের ঘটনায় রাশিয়া জড়িত ছিল না। কিছু কিছু নথি প্রমাণ করে যে, জো বাইডেন শুধু হান্টারের পিতাই নন, বিজনেস পার্টনারও বটে। অন্তত তিনি ছেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতেন। তাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি যে বাইডেন ফ্যামিলির স্বার্থও জড়িত—এটা বলা অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড—এদের শিকড় ইউক্রেনের ওদেসায়। এই দুই পরিবারই কয়েক প্রজন্ম আগে জারের রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যায় ভাগ্যের সন্ধানে। তাই এদের মধ্যেও যে অন্ধ রুশ বিরোধিতা নেই, সেটাই-বা কে জানে?
বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। অনেক সময় ওরা অপেক্ষা করত ছোট ভাই বা বোন কখন আঘাত পেয়ে কাঁদবে, তারপর ওকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেবে। যদিও চাইলে আগেই ওরা বাচ্চাটা যাতে আঘাত না পায়, সেটা করতে পারত, যা সাধারণত বড়রা করে। মনে হয় প্রথমত কিউরিওসিটি থেকে—দেখি কী হয় পড়ে কি পড়ে না। আবার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে বাহবা পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রন্দনরত বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়। আজ রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দনবাসে তাণ্ডব চালানোর পর সেখানে আসত, হয়তো এতটা সমালোচনার মুখে পড়ত না। বরং অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেত। যেমন হয়েছে সিরিয়ায়। কিন্তু আমরা কি এ জন্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষের জীবন বলিদান করতে প্রস্তুত? মনে হয় তাই। আমরা আমাদের কাজের যুক্তি খুঁজি কোনো ঘটনা ঘটার পর, কেন ঘটল সেটা প্রায়ই বিবেচনায় না এনে।
মানুষের চরিত্রই এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে, সে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু যখন সেই বিপদগ্রস্ত মানুষ মারা যাবে, তখন তার প্রতি সমবেদনার অন্ত থাকবে না। কিন্তু সেই একই লোক যদি জীবন বাঁচাতে অন্যায় কিছু করে, তখন সবাই মিলে তাকে অপরাধী সাজিয়ে ছাড়বে। আর এটা সে করে সব সময় শুধু খণ্ডচিত্র বিবেচনায় আনে বলে। যেকোনো বিষয়ে কম-বেশি নিরপেক্ষ ও সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য দরকার পূর্ণ চিত্র বিবেচনা করা। বর্তমান পৃথিবী এত বেশি স্বার্থান্ধ যে, সে কাউকে পূর্ণ চিত্র দেখতে শেখায় না। সবাই দেখায় শুধু সেই চিত্রটাই, অনেক সময় ফেইক চিত্র, যেটা তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। এখন সত্য খোঁজা হয় না। যে ভাষ্য স্বার্থ উদ্ধার করতে সাহায্য করে, সেটাকেই ছলে-বলে-কৌশলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকম চেষ্টা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক আইন-কানুন আজ কাজ করে না। অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও সামাজিক চুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
দনবাসের সংকট ছড়াল যে কারণে
অনেককেই বলতে শুনি দনবাসে যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাহলে রুশ আক্রমণ এখানে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো হতো। এখানে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের আগে সমস্ত ইউরোপ পদানত করে। আর এসব দেশ প্রায় বিনা প্রতিরোধে জার্মানির অধীনতা মেনে নেয়। ফলে সেসব দেশে পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়। এসব দেশের সৈন্যরা জার্মান সৈন্যের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে। পরাজিত জার্মান বাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন আসে সোভিয়েত সীমান্ত ত্যাগের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে কি হবে না। যদি সেটা না হতো বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের সমর্থনকারী সরকার ক্ষমতায় থাকত। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মানি নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধ শুরু করত। তাই সে সময় ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বিকল্প ছিল না। আর যেহেতু প্রায় প্রতিটি দেশেই যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়েছিল সেসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসব এলাকা মুক্ত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শুধু গায়ের জোর ছিল না, ছিল অবজেকটিভ রিয়্যালিটিও।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেছেন। হিটলার ও মুসোলিনির মতো না হলেও তিনি এদের চেয়ে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৯৪৫ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ দেখেনি। সেই একই কারণে ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ আজ যুগের দাবি। তা না করলে অচিরেই নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে, আর তা হবে আরও ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এটাই বলার চেষ্টা করে যে, এই যুদ্ধের পেছনে ভারতের হাত আছে, আর দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাই এ জন্যে দায়ী। ফলে একাত্তরে তারা নির্বিচারে হিন্দু নিধন করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা। এমনকি এখন যে জামায়াত-হেফাজতসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, সেটা তখনকার রাগ থেকেও। একইভাবে যদি ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎপাটন না করা হয়, তাহলে সেখানকার রুশদের সেই একই রকম বিপদের মধ্যে রাখা হবে।
কারণ, এসব ফ্যাসিবাদী দল প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করবে স্থানীয় রুশদের, আর রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের ওপর। এরই মধ্যে সেখানে অনেকেই ডাক দিচ্ছে রুশ হত্যার, বিশেষ করে রুশ শিশু হত্যার, যাতে করে উত্তরসূরিরা পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। মনে করিয়ে দিতে চাই যে,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, রাজাকার-আলবদর নয়। শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে, রাজাকাররা নয়। একাত্তরের বিজয়ের পরে প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া, দেশকে আক্ষরিক অর্থেই রাজাকারমুক্ত করা। তখন সেটা হয়নি বলেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হয়েছে, তখন সেটা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে নতুন করে পাকিস্তানের জুতা পরতে হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটা দিক ছিল—পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী হবে এসব কেন্দ্রের। চেরনোবিলের স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো গড়ে (১) ৩০ কিলোপাসকেল শক্তির শকওয়েভের চাপ সহ্য করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে-মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এর ওপর পড়লেও এগুলো ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে এগুলো; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে চেরনোবিলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভেতর থেকে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সেখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যখন দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন। ইউক্রেন সেই চেষ্টা করেছিল চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। যদিও রুশ সৈন্যরা প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে, পরে বেলারুশ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সে সমস্যার সমাধান করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপারোঝিয়ায় তারা প্রভোকেশন করেছিল। যদিও রুশ সৈন্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে উগ্রবাদীদের হাতে যেকোনো অস্ত্রই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই প্রমাণ তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট নিকট অতীতে বারবার দিয়েছে।
রুশোফোবিয়া: শুনব নাকি শুনব না
যুদ্ধ শুরুর পর রুশোফোবিয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পোল্যান্ডের এক মন্ত্রী শিকার করেছেন—রুশোফোবিয়া এখন পশ্চিমা বিশ্বের মেইন স্ট্রিম আইডিয়া। আর এটা শুধু যারা রাশিয়ার নাগরিক তাদের সাথেই ঘটছে না, যারা যুগ যুগ ধরে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছে, তারাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অধ্যয়নরত শত শত রুশ ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দস্তইয়েভস্কি, চাইকোভস্কি—মানে রুশ সাহিত্য, রুশ মিউজিক আজ পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ। ভালেরি গিওর্গিয়েভ, আন্না নিত্রেপকাসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী, যারা ওখানে কাজ করতেন বা রেগুলার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে—এই আক্রমণের বিরোধিতা করতে। কিন্তু এঁরা তো জানেন, দনবাসের মানুষের কষ্টের কথা। সমস্ত খেলাধুলায় এদের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। শত শত রুশ ড্রাইভার আটকা পড়েছেন পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে। এখন বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের ট্রাক ও অন্যান্য মালবাহী গাড়ি আটকে দিচ্ছে।
এটা আসলে রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বই কিছু নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল রুশ রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার রুশ রোগীদের স্যাম্পল টেস্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এরাই নিজেদের মানবতার ধারক ও বাহক বলে ভাবে। অনেকে রুশদের কাছে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না বা যারা অনেক দিন বাসা ভাড়া করে আছে, তাদের উঠে যেতে বলছে। এটা অনেকটা আমাদের সব দেশে ধর্ম দেখে বাসা ভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার মত। স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাদের রুশবিরোধী কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলোয় রুশ ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম পূরণ করতে বলা হচ্ছে, যেখানে বাবা-মার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, যেমন তারা এই যুদ্ধের ব্যাপারে কোন পক্ষ সমর্থন করে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ইউরোপের কোন না কোন দেশে শুধু রুশ হওয়ার অপরাধে অনেকের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবসর যাপনকারী রুশ নারী ও শিশুদের হত্যার ডাক দিচ্ছে।
এ কারণে এ দেশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। পোল্যান্ড দূতাবাসে গেছি ভিসার জন্য। খুব ভোরে গেছি, দূতাবাস তখনো খোলেনি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে জানলাম ও পাকিস্তান থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকজনকে আসতে দেখলাম। পোশাক দেখে বুঝলাম শিখ। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি ছেলেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধ—ও ভারতীয়। এই দুজন লোক কোনো দিন একে অন্যকে দেখেনি, কেউ কারও ক্ষতি করেনি, অথচ বিনা কারণে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালাল। তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন দেখছি সভ্য ইউরোপের মানুষও এ ব্যাপারে খুব একটা এগিয়ে যায়নি। আসলে কী বলব। মাত্র তিন বছরে জার্মানির শিক্ষিত, সভ্য মানুষেরা হিটলারের ডাকে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘৃণা করতে শেখানো খুব সহজ, কিন্তু একদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু একদিনে এই ঘৃণা চলে যাবে না। বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে মানুষ তখন কী সমাজ গড়বে?
এরই মধ্যে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যেভাবে পারছে দেশটির সম্পদ লুটপাট করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটাকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে। করছে নিজেরাই এদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। এখানে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে। একটা দিনের কথাও মনে পড়ে না, যখন এদের ওপর একটা না একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল না। আসলে কারও উদ্দেশ্য যদি হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা, সে অজুহাত খুঁজে বের করবেই।
সেই নব্বইয়ের দশকে, যখন বরিস (ইয়েলৎসিন) আর বিল (ক্লিনটন) নিজেদের বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন, তখনো সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা কাজ করত। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো—‘যখন নেকড়ে ভাঁটিতে জলপানরত ভেড়াকে খেতে চায় জল ঘোলা করার অপরাধে। ভেড়া ভাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করলে নেকড়ে বলে, তুই না হলে তোর দাদা নিশ্চয়ই আমার জল ঘোলা করেছিল। তাই তোকেই সে ঋণ শোধ করতে হবে।’ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশদের নিয়ে যা ঘটছে, সেটা আমায় মনে করিয়ে দেয় ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলোর কথা, যখন অনেক মার্কিন মুসলিম নাগরিকও ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছিল। যদিও ইউরোপের মাল্টি-কালচারাল আইডিয়া অনেক আগেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ছিল, বর্তমান ঘটনা খুব সম্ভব তার জন্য শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। টলারেন্স বা পরমত সহিষ্ণুতা এভাবেই বেঘোরে মারা গেল। যুদ্ধে যাই ঘটুক ইউরোপ যে আর কোনো দিন আগের ইউরোপ থাকবে না, সেটা জোরেশোরেই বলা যায়।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত পড়ুন:

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা হতো বলে রাশিয়া ও চীন অভিযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটা স্বীকার করছে না। কিন্তু জর্জিয়ায় অনেকের অকস্মাৎ মৃত্যু, দাগিস্তানে বিরল প্রাণীদের দল বেঁধে মৃত্যু—এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, ওসব ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু জীবাণু তৈরি হতো, যা পাখির মাধ্যমে ছড়ানো যায়। ইদানীং পাওয়া কিছু তথ্য বলছে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে এমন কিছু ড্রোন অর্ডার দিতে চেয়েছিল, যা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্প্রে ছড়াতে পারে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন, জর্জিয়া, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য এক্স-সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোয় এমন অনেক ল্যাবরেটরি আছে, যা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পেন্টাগনের অর্থ সহায়তায় চালিত। ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভব ২০০৫ সালে তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার অংশগ্রহণে। পরে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, এসব ল্যাবরেটরিতে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো, যা নিরাপদ ছিল না। রাশিয়া ও চীনের চারদিকে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি এ ধরনের ল্যাবরেটরির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আজ হোক, আর কাল হোক এই সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে তখন সেটা হতো আরও কঠিন যুদ্ধ।
আজ যারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁরা যদি একইভাবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন; ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতেন; দেশে দেশে রং-বেরঙের বিপ্লবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন; পৃথিবী আজ এই মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারে এসে দাঁড়াত না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, হান্টার বাইডেন এসব ল্যাবরেটরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যখন ইউক্রেনে এসব ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়, তখন সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক উলিয়ানা সুপ্রুম, যাঁর পিতামহ স্তেপান বান্দেরার সহযোগী ছিলেন।
উল্লেখ্য, বিদেশি নাগরিকের মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনে সাংবিধানিক বাধানিষেধ থাকার পরও সুপ্রুম কিন্তু নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের আসল শাসক কারা। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হান্টার বাইডেন আলোচনায় আসেন। তাঁর ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম একে রাশিয়ার চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিককালে তারা স্বীকার করেছে, ল্যাপটপের ঘটনায় রাশিয়া জড়িত ছিল না। কিছু কিছু নথি প্রমাণ করে যে, জো বাইডেন শুধু হান্টারের পিতাই নন, বিজনেস পার্টনারও বটে। অন্তত তিনি ছেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতেন। তাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি যে বাইডেন ফ্যামিলির স্বার্থও জড়িত—এটা বলা অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড—এদের শিকড় ইউক্রেনের ওদেসায়। এই দুই পরিবারই কয়েক প্রজন্ম আগে জারের রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যায় ভাগ্যের সন্ধানে। তাই এদের মধ্যেও যে অন্ধ রুশ বিরোধিতা নেই, সেটাই-বা কে জানে?
বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। অনেক সময় ওরা অপেক্ষা করত ছোট ভাই বা বোন কখন আঘাত পেয়ে কাঁদবে, তারপর ওকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেবে। যদিও চাইলে আগেই ওরা বাচ্চাটা যাতে আঘাত না পায়, সেটা করতে পারত, যা সাধারণত বড়রা করে। মনে হয় প্রথমত কিউরিওসিটি থেকে—দেখি কী হয় পড়ে কি পড়ে না। আবার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে বাহবা পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রন্দনরত বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়। আজ রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দনবাসে তাণ্ডব চালানোর পর সেখানে আসত, হয়তো এতটা সমালোচনার মুখে পড়ত না। বরং অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেত। যেমন হয়েছে সিরিয়ায়। কিন্তু আমরা কি এ জন্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষের জীবন বলিদান করতে প্রস্তুত? মনে হয় তাই। আমরা আমাদের কাজের যুক্তি খুঁজি কোনো ঘটনা ঘটার পর, কেন ঘটল সেটা প্রায়ই বিবেচনায় না এনে।
মানুষের চরিত্রই এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে, সে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু যখন সেই বিপদগ্রস্ত মানুষ মারা যাবে, তখন তার প্রতি সমবেদনার অন্ত থাকবে না। কিন্তু সেই একই লোক যদি জীবন বাঁচাতে অন্যায় কিছু করে, তখন সবাই মিলে তাকে অপরাধী সাজিয়ে ছাড়বে। আর এটা সে করে সব সময় শুধু খণ্ডচিত্র বিবেচনায় আনে বলে। যেকোনো বিষয়ে কম-বেশি নিরপেক্ষ ও সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য দরকার পূর্ণ চিত্র বিবেচনা করা। বর্তমান পৃথিবী এত বেশি স্বার্থান্ধ যে, সে কাউকে পূর্ণ চিত্র দেখতে শেখায় না। সবাই দেখায় শুধু সেই চিত্রটাই, অনেক সময় ফেইক চিত্র, যেটা তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। এখন সত্য খোঁজা হয় না। যে ভাষ্য স্বার্থ উদ্ধার করতে সাহায্য করে, সেটাকেই ছলে-বলে-কৌশলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকম চেষ্টা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক আইন-কানুন আজ কাজ করে না। অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও সামাজিক চুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
দনবাসের সংকট ছড়াল যে কারণে
অনেককেই বলতে শুনি দনবাসে যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাহলে রুশ আক্রমণ এখানে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো হতো। এখানে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের আগে সমস্ত ইউরোপ পদানত করে। আর এসব দেশ প্রায় বিনা প্রতিরোধে জার্মানির অধীনতা মেনে নেয়। ফলে সেসব দেশে পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়। এসব দেশের সৈন্যরা জার্মান সৈন্যের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে। পরাজিত জার্মান বাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন আসে সোভিয়েত সীমান্ত ত্যাগের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে কি হবে না। যদি সেটা না হতো বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের সমর্থনকারী সরকার ক্ষমতায় থাকত। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মানি নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধ শুরু করত। তাই সে সময় ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বিকল্প ছিল না। আর যেহেতু প্রায় প্রতিটি দেশেই যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়েছিল সেসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসব এলাকা মুক্ত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শুধু গায়ের জোর ছিল না, ছিল অবজেকটিভ রিয়্যালিটিও।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেছেন। হিটলার ও মুসোলিনির মতো না হলেও তিনি এদের চেয়ে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৯৪৫ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ দেখেনি। সেই একই কারণে ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ আজ যুগের দাবি। তা না করলে অচিরেই নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে, আর তা হবে আরও ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এটাই বলার চেষ্টা করে যে, এই যুদ্ধের পেছনে ভারতের হাত আছে, আর দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাই এ জন্যে দায়ী। ফলে একাত্তরে তারা নির্বিচারে হিন্দু নিধন করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা। এমনকি এখন যে জামায়াত-হেফাজতসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, সেটা তখনকার রাগ থেকেও। একইভাবে যদি ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎপাটন না করা হয়, তাহলে সেখানকার রুশদের সেই একই রকম বিপদের মধ্যে রাখা হবে।
কারণ, এসব ফ্যাসিবাদী দল প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করবে স্থানীয় রুশদের, আর রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের ওপর। এরই মধ্যে সেখানে অনেকেই ডাক দিচ্ছে রুশ হত্যার, বিশেষ করে রুশ শিশু হত্যার, যাতে করে উত্তরসূরিরা পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। মনে করিয়ে দিতে চাই যে,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, রাজাকার-আলবদর নয়। শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে, রাজাকাররা নয়। একাত্তরের বিজয়ের পরে প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া, দেশকে আক্ষরিক অর্থেই রাজাকারমুক্ত করা। তখন সেটা হয়নি বলেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হয়েছে, তখন সেটা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে নতুন করে পাকিস্তানের জুতা পরতে হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটা দিক ছিল—পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী হবে এসব কেন্দ্রের। চেরনোবিলের স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো গড়ে (১) ৩০ কিলোপাসকেল শক্তির শকওয়েভের চাপ সহ্য করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে-মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এর ওপর পড়লেও এগুলো ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে এগুলো; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে চেরনোবিলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভেতর থেকে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সেখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যখন দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন। ইউক্রেন সেই চেষ্টা করেছিল চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। যদিও রুশ সৈন্যরা প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে, পরে বেলারুশ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সে সমস্যার সমাধান করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপারোঝিয়ায় তারা প্রভোকেশন করেছিল। যদিও রুশ সৈন্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে উগ্রবাদীদের হাতে যেকোনো অস্ত্রই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই প্রমাণ তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট নিকট অতীতে বারবার দিয়েছে।
রুশোফোবিয়া: শুনব নাকি শুনব না
যুদ্ধ শুরুর পর রুশোফোবিয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পোল্যান্ডের এক মন্ত্রী শিকার করেছেন—রুশোফোবিয়া এখন পশ্চিমা বিশ্বের মেইন স্ট্রিম আইডিয়া। আর এটা শুধু যারা রাশিয়ার নাগরিক তাদের সাথেই ঘটছে না, যারা যুগ যুগ ধরে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছে, তারাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অধ্যয়নরত শত শত রুশ ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দস্তইয়েভস্কি, চাইকোভস্কি—মানে রুশ সাহিত্য, রুশ মিউজিক আজ পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ। ভালেরি গিওর্গিয়েভ, আন্না নিত্রেপকাসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী, যারা ওখানে কাজ করতেন বা রেগুলার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে—এই আক্রমণের বিরোধিতা করতে। কিন্তু এঁরা তো জানেন, দনবাসের মানুষের কষ্টের কথা। সমস্ত খেলাধুলায় এদের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। শত শত রুশ ড্রাইভার আটকা পড়েছেন পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে। এখন বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের ট্রাক ও অন্যান্য মালবাহী গাড়ি আটকে দিচ্ছে।
এটা আসলে রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বই কিছু নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল রুশ রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার রুশ রোগীদের স্যাম্পল টেস্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এরাই নিজেদের মানবতার ধারক ও বাহক বলে ভাবে। অনেকে রুশদের কাছে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না বা যারা অনেক দিন বাসা ভাড়া করে আছে, তাদের উঠে যেতে বলছে। এটা অনেকটা আমাদের সব দেশে ধর্ম দেখে বাসা ভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার মত। স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাদের রুশবিরোধী কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলোয় রুশ ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম পূরণ করতে বলা হচ্ছে, যেখানে বাবা-মার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, যেমন তারা এই যুদ্ধের ব্যাপারে কোন পক্ষ সমর্থন করে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ইউরোপের কোন না কোন দেশে শুধু রুশ হওয়ার অপরাধে অনেকের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবসর যাপনকারী রুশ নারী ও শিশুদের হত্যার ডাক দিচ্ছে।
এ কারণে এ দেশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। পোল্যান্ড দূতাবাসে গেছি ভিসার জন্য। খুব ভোরে গেছি, দূতাবাস তখনো খোলেনি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে জানলাম ও পাকিস্তান থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকজনকে আসতে দেখলাম। পোশাক দেখে বুঝলাম শিখ। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি ছেলেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধ—ও ভারতীয়। এই দুজন লোক কোনো দিন একে অন্যকে দেখেনি, কেউ কারও ক্ষতি করেনি, অথচ বিনা কারণে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালাল। তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন দেখছি সভ্য ইউরোপের মানুষও এ ব্যাপারে খুব একটা এগিয়ে যায়নি। আসলে কী বলব। মাত্র তিন বছরে জার্মানির শিক্ষিত, সভ্য মানুষেরা হিটলারের ডাকে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘৃণা করতে শেখানো খুব সহজ, কিন্তু একদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু একদিনে এই ঘৃণা চলে যাবে না। বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে মানুষ তখন কী সমাজ গড়বে?
এরই মধ্যে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যেভাবে পারছে দেশটির সম্পদ লুটপাট করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটাকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে। করছে নিজেরাই এদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। এখানে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে। একটা দিনের কথাও মনে পড়ে না, যখন এদের ওপর একটা না একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল না। আসলে কারও উদ্দেশ্য যদি হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা, সে অজুহাত খুঁজে বের করবেই।
সেই নব্বইয়ের দশকে, যখন বরিস (ইয়েলৎসিন) আর বিল (ক্লিনটন) নিজেদের বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন, তখনো সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা কাজ করত। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো—‘যখন নেকড়ে ভাঁটিতে জলপানরত ভেড়াকে খেতে চায় জল ঘোলা করার অপরাধে। ভেড়া ভাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করলে নেকড়ে বলে, তুই না হলে তোর দাদা নিশ্চয়ই আমার জল ঘোলা করেছিল। তাই তোকেই সে ঋণ শোধ করতে হবে।’ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশদের নিয়ে যা ঘটছে, সেটা আমায় মনে করিয়ে দেয় ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলোর কথা, যখন অনেক মার্কিন মুসলিম নাগরিকও ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছিল। যদিও ইউরোপের মাল্টি-কালচারাল আইডিয়া অনেক আগেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ছিল, বর্তমান ঘটনা খুব সম্ভব তার জন্য শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। টলারেন্স বা পরমত সহিষ্ণুতা এভাবেই বেঘোরে মারা গেল। যুদ্ধে যাই ঘটুক ইউরোপ যে আর কোনো দিন আগের ইউরোপ থাকবে না, সেটা জোরেশোরেই বলা যায়।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত পড়ুন:

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১০ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১০ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির প
২৬ এপ্রিল ২০২২
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১০ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১০ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেজাহীদ রেজা নূর

হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে, কিন্তু ব্যারিস্টার বা উকিল হলেই দেশের ইতিহাস ভালো জানবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের দেশের কিছু আইন ব্যবসায়ী আমাদের বিজয় নিয়ে, বিজয়ের নায়কদের নিয়ে যেসব কথা বলে চলেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তাঁদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা কটাক্ষের ব্যাপারে তেমন কোনো কড়া কথা আমি অন্তত বলতে শুনিনি।
যতদূর স্মরণ করতে পারি, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানটি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসকে ছোট করার জন্য সংঘটিত হয়নি। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে শামিল হয়েছিল দেশের আপামর মানুষ। এদের সবাই একই ভাবনা নিয়ে সামনের পথে এগোয়নি। সরকার পতন হলে কী হতে পারে কৌশল—এ রকম ভাবনাও কারও মাথায় ছিল বলে মনে হয় না। দেশের ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল প্রাণের তাগিদে। যখন লাশ পড়ছিল একের পর এক, তখন রাজপথকেই বেছে নিয়েছিল তারা। কিন্তু এই প্রচণ্ড আলোড়নে সরকার পড়ে যাবে—এ রকম ভাবনা হয়তো তাদের ছিল না। ছিল না সে রকম কোনো প্রস্তুতি। তাই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় কিছু প্রগাঢ় নীতিকথার জন্ম দিলেও রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কোনো দিশা দেয়নি। শুধু কি নীতিকথা? অশ্রাব্য উচ্চারণ করে লাইক-কমেন্টে ছেয়ে যাওয়া একদল নেতার সন্ধান আজকাল পাওয়া যাচ্ছে, যাঁরা টিনের চালে কাউয়ার পাশাপাশি আরও কত কিছু দেখছেন! বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে করতে চাঁদাবাজি করার পথে শামিল হচ্ছেন। আর এই ধরনের অরাজকতা চালানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রচার করছেন গণমাধ্যমে। তাঁরা ভাবছেন, স্বাধীনতার সব অর্জনকে কটাক্ষ করতে পারলে এ দেশের মানুষ একদিন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর সহযাত্রী হয়ে উঠবে আবারও।
কী হতে কী হয়ে গেল, এখন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় মানুষ। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বা বিজয় শব্দগুলো কি নিষিদ্ধ হয়ে গেল নাকি? গত বছর শিল্পকলা একাডেমি যখন বিজয় উৎসব পালন করছিল, তখন ভয়ে ভয়ে তারা ‘বিজয় উৎসব’কে ‘ডিসেম্বর উৎসব’ লিখেছিল, সে কথা কি মনে আছে কারও? পরে প্রবল আপত্তির মুখে আবার তারা ‘বিজয় উৎসব’-এ ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতা আর বিজয় শব্দ দুটি উচ্চারণ করার মতো বুকের পাটা নেই একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের—এটা যে কত বড় দুর্ভাবনার ব্যাপার, তা কি বলে বোঝানো যাবে?
১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল এই ভূখণ্ডে, তার ছাপ পাওয়া যায় সারা বিশ্বে। সে সময়কার বিশ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কোন কোন ব্যাপার নিয়ে অস্থিরতা চলছিল। মনে করিয়ে দিই, রাশিয়া-চীনের দ্বন্দ্বের কারণে কমিউনিস্ট দুনিয়ার ভাঙন, পরাশক্তি হিসেবে মার্কিনদের বিজয়যাত্রা, সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ, উপনিবেশগুলো ভেঙে নতুন নতুন স্বাধীন দেশ গঠন এবং তার কোনো কোনো দেশের বাম দিকে ঘেঁষা রাজনীতি, কিছু কিছু দেশে নব্য স্বৈরাচারের আবির্ভাব ইত্যাদি নানা প্যাঁচে পড়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক রাজনীতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন আলোচনায় রয়েছে। এ রকমই একটা অবস্থায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন ৬ দফা। সেই ৬ দফা নতুন কিছু ছিল না। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে কিংবা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারেও এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টির দেখা মেলে। ১৯৬৬ সালের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চালানো শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি আমূল প্রকাশিত হয়ে পড়লে তা বাঙালির আবেগকে তাড়িত করেছিল। ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ জানান দিয়েছিল, মাথায় হাত বোলানোর রাজনীতি আর চলবে না এখানে।
এত বড় বড় দল থাকতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কী করে আওয়ামী লীগ এত বড় বিজয় পেল, সে ইতিহাস নানাভাবে লেখা হয়েছে। এটাই ছিল বাংলার রায়। দেশের জনগণ সেই রায়ে ক্ষমতা দিয়েছিল ক্যারিশম্যাটিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। সলিমুল্লাহ খানদের গুরু আহমদ ছফার বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রযোজ্য। ছফা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যারা এই সত্য অস্বীকার করবে, তাদের সঙ্গে কোনো রকমের বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ করতেও আমরা রাজি হব না।’ ভুল শোনেননি, ছফা এ কথাই বলেছেন। এবং এখানেই তা শেষ করেননি। তিনি যোগ করেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম এমন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যত পণ্ডিত হোন না কেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নিপুণতা এবং যুক্তির মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি একটা থেকে আর একটাকে পৃথক করতে পারবেন না।’
ছফাকে এসব কথা বলতে হলো কেন? তিনি তো তাঁর শিষ্যদের মতোই শেখ মুজিবকে অগ্রাহ্য করে অথবা জাতির ভিলেন বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। কেন ছফা সেটা করেননি? আমার মনে হয়, ছফা ভেবে দেখেছেন, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিলে ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে তা ধরা পড়বেই। তখন আত্মপরিচয়েই টান পড়বে। শেখ মুজিব সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করলেও ছফা স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নির্মোহ মতামত দিয়েছেন।
ইতিহাসবিমুখ পাকিস্তানপ্রেমী অর্বাচীনেরা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসে ইতিহাস বিকৃতি করে চলেছেন। এতে আমাদের তরুণসমাজ কতটা বিভ্রান্ত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এত দ্রুত পাওয়া যাবে না।
বিষয়টি বুঝতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। আমাদের সমাজে এই প্রতীকগুলো কীভাবে আছে, তা বুঝতে পারলেই স্বাধীনতা বা বিজয় আমাদের দেশে এখন কোন মর্যাদায় আছে, তা বোঝা যাবে। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেমকে হুমকির মুখে ফেলতে হলে এমন কিছু কাজ করতে হয়, যাতে শুরুতেই ভয় আর আতঙ্ককে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তারপর প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে বাজে কথা বলা—এভাবেই আস্তে আস্তে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাদের পায়ের নিচে মাটি খোঁজে।
পাঠক, আপনি মনে করুন একটি পরীক্ষা দিতে বসেছেন। আমি কিছু প্রশ্ন রেখে যাব, পাঠক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিজেই এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলোয় নম্বর দেবেন। তাঁরাই নির্ধারণ করবেন, কেমন আছে আজকের বাংলাদেশ।
প্রশ্নগুলো এমন: কেমন আছে দেশের বিচারব্যবস্থা? কেমন আছে নির্বাচন কমিশন? তারা কি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোন অবস্থায় আছে? সাংবাদিক-লেখক-গবেষকেরা কি নির্দ্বিধায় নির্বিঘ্নে কাজ করার মতো পরিবেশ পাচ্ছেন?
সমাজে কোনো বড় সংঘাত নেই তো? ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে সব জায়গা থেকে। দেশের ডাকসাইটে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সেই ঐক্য কি দেখা যাচ্ছে? বিভাজনের রাজনীতিকে কি সরিয়ে দেওয়া গেছে? সন্দেহ-অবিশ্বাসের রাজনীতি কি আছে, নাকি বিদায় নিয়েছে?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ জনগণ কি সন্তুষ্ট? মব বলুন আর চাপ প্রয়োগের রাজনীতি বলুন, সেগুলো কি জনমনে ভীতি ছড়াচ্ছে?
আপনি কি এমন কিছু লক্ষ করছেন, যেখানে সত্য ও মিথ্যাকে কাছাকাছি রেখে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয়?
আপনি কি সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলার প্রবণতা লক্ষ করেছেন? আউল-বাউলের দেশে গানবাজনা কি হুমকির মুখে পড়েছে? ‘তৌহিদি জনতা’ আদতে কাদের কোন লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে? সরকার কি এদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে? উত্তেজনা ছড়ায় যারা, তাদের পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে, আর যারা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে—এ রকম কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে?
সমষ্টিগত শক্তি ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো বাঁশিওয়ালা কি বাঁশি বাজাচ্ছে? আপনি কি লক্ষ করেছেন শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নয়, নানাভাবে যাঁরা সংখ্যালঘু, তাঁদের মারধর করে সংখ্যাগুরু অংশ আখের গুছিয়ে নিচ্ছে?
আপনি কি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো অঙ্গীকার দেখতে পাচ্ছেন, যাতে তাদের ইশতেহার অনুযায়ী জনগণ একটি ‘সোনার বাংলা’য় বসবাস করবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজে লিখুন। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ করুন। যোগফল মেলান, তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসুন।
আপনি তখন বুঝতে পারবেন, গণ-অভ্যুত্থানকে কেউ কেউ স্বাধীনতাবিরোধিতার জায়গায় সুকৌশলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যে তরুণেরা সেই অপচেষ্টা রুখে দিতে পারে, সে তরুণদের প্রতীক্ষায় আছি।

হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে, কিন্তু ব্যারিস্টার বা উকিল হলেই দেশের ইতিহাস ভালো জানবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের দেশের কিছু আইন ব্যবসায়ী আমাদের বিজয় নিয়ে, বিজয়ের নায়কদের নিয়ে যেসব কথা বলে চলেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তাঁদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা কটাক্ষের ব্যাপারে তেমন কোনো কড়া কথা আমি অন্তত বলতে শুনিনি।
যতদূর স্মরণ করতে পারি, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানটি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসকে ছোট করার জন্য সংঘটিত হয়নি। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে শামিল হয়েছিল দেশের আপামর মানুষ। এদের সবাই একই ভাবনা নিয়ে সামনের পথে এগোয়নি। সরকার পতন হলে কী হতে পারে কৌশল—এ রকম ভাবনাও কারও মাথায় ছিল বলে মনে হয় না। দেশের ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল প্রাণের তাগিদে। যখন লাশ পড়ছিল একের পর এক, তখন রাজপথকেই বেছে নিয়েছিল তারা। কিন্তু এই প্রচণ্ড আলোড়নে সরকার পড়ে যাবে—এ রকম ভাবনা হয়তো তাদের ছিল না। ছিল না সে রকম কোনো প্রস্তুতি। তাই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় কিছু প্রগাঢ় নীতিকথার জন্ম দিলেও রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কোনো দিশা দেয়নি। শুধু কি নীতিকথা? অশ্রাব্য উচ্চারণ করে লাইক-কমেন্টে ছেয়ে যাওয়া একদল নেতার সন্ধান আজকাল পাওয়া যাচ্ছে, যাঁরা টিনের চালে কাউয়ার পাশাপাশি আরও কত কিছু দেখছেন! বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে করতে চাঁদাবাজি করার পথে শামিল হচ্ছেন। আর এই ধরনের অরাজকতা চালানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রচার করছেন গণমাধ্যমে। তাঁরা ভাবছেন, স্বাধীনতার সব অর্জনকে কটাক্ষ করতে পারলে এ দেশের মানুষ একদিন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর সহযাত্রী হয়ে উঠবে আবারও।
কী হতে কী হয়ে গেল, এখন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় মানুষ। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বা বিজয় শব্দগুলো কি নিষিদ্ধ হয়ে গেল নাকি? গত বছর শিল্পকলা একাডেমি যখন বিজয় উৎসব পালন করছিল, তখন ভয়ে ভয়ে তারা ‘বিজয় উৎসব’কে ‘ডিসেম্বর উৎসব’ লিখেছিল, সে কথা কি মনে আছে কারও? পরে প্রবল আপত্তির মুখে আবার তারা ‘বিজয় উৎসব’-এ ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতা আর বিজয় শব্দ দুটি উচ্চারণ করার মতো বুকের পাটা নেই একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের—এটা যে কত বড় দুর্ভাবনার ব্যাপার, তা কি বলে বোঝানো যাবে?
১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল এই ভূখণ্ডে, তার ছাপ পাওয়া যায় সারা বিশ্বে। সে সময়কার বিশ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কোন কোন ব্যাপার নিয়ে অস্থিরতা চলছিল। মনে করিয়ে দিই, রাশিয়া-চীনের দ্বন্দ্বের কারণে কমিউনিস্ট দুনিয়ার ভাঙন, পরাশক্তি হিসেবে মার্কিনদের বিজয়যাত্রা, সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ, উপনিবেশগুলো ভেঙে নতুন নতুন স্বাধীন দেশ গঠন এবং তার কোনো কোনো দেশের বাম দিকে ঘেঁষা রাজনীতি, কিছু কিছু দেশে নব্য স্বৈরাচারের আবির্ভাব ইত্যাদি নানা প্যাঁচে পড়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক রাজনীতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন আলোচনায় রয়েছে। এ রকমই একটা অবস্থায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন ৬ দফা। সেই ৬ দফা নতুন কিছু ছিল না। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে কিংবা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারেও এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টির দেখা মেলে। ১৯৬৬ সালের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চালানো শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি আমূল প্রকাশিত হয়ে পড়লে তা বাঙালির আবেগকে তাড়িত করেছিল। ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ জানান দিয়েছিল, মাথায় হাত বোলানোর রাজনীতি আর চলবে না এখানে।
এত বড় বড় দল থাকতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কী করে আওয়ামী লীগ এত বড় বিজয় পেল, সে ইতিহাস নানাভাবে লেখা হয়েছে। এটাই ছিল বাংলার রায়। দেশের জনগণ সেই রায়ে ক্ষমতা দিয়েছিল ক্যারিশম্যাটিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। সলিমুল্লাহ খানদের গুরু আহমদ ছফার বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রযোজ্য। ছফা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যারা এই সত্য অস্বীকার করবে, তাদের সঙ্গে কোনো রকমের বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ করতেও আমরা রাজি হব না।’ ভুল শোনেননি, ছফা এ কথাই বলেছেন। এবং এখানেই তা শেষ করেননি। তিনি যোগ করেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম এমন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যত পণ্ডিত হোন না কেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নিপুণতা এবং যুক্তির মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি একটা থেকে আর একটাকে পৃথক করতে পারবেন না।’
ছফাকে এসব কথা বলতে হলো কেন? তিনি তো তাঁর শিষ্যদের মতোই শেখ মুজিবকে অগ্রাহ্য করে অথবা জাতির ভিলেন বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। কেন ছফা সেটা করেননি? আমার মনে হয়, ছফা ভেবে দেখেছেন, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিলে ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে তা ধরা পড়বেই। তখন আত্মপরিচয়েই টান পড়বে। শেখ মুজিব সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করলেও ছফা স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নির্মোহ মতামত দিয়েছেন।
ইতিহাসবিমুখ পাকিস্তানপ্রেমী অর্বাচীনেরা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসে ইতিহাস বিকৃতি করে চলেছেন। এতে আমাদের তরুণসমাজ কতটা বিভ্রান্ত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এত দ্রুত পাওয়া যাবে না।
বিষয়টি বুঝতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। আমাদের সমাজে এই প্রতীকগুলো কীভাবে আছে, তা বুঝতে পারলেই স্বাধীনতা বা বিজয় আমাদের দেশে এখন কোন মর্যাদায় আছে, তা বোঝা যাবে। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেমকে হুমকির মুখে ফেলতে হলে এমন কিছু কাজ করতে হয়, যাতে শুরুতেই ভয় আর আতঙ্ককে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তারপর প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে বাজে কথা বলা—এভাবেই আস্তে আস্তে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাদের পায়ের নিচে মাটি খোঁজে।
পাঠক, আপনি মনে করুন একটি পরীক্ষা দিতে বসেছেন। আমি কিছু প্রশ্ন রেখে যাব, পাঠক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিজেই এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলোয় নম্বর দেবেন। তাঁরাই নির্ধারণ করবেন, কেমন আছে আজকের বাংলাদেশ।
প্রশ্নগুলো এমন: কেমন আছে দেশের বিচারব্যবস্থা? কেমন আছে নির্বাচন কমিশন? তারা কি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোন অবস্থায় আছে? সাংবাদিক-লেখক-গবেষকেরা কি নির্দ্বিধায় নির্বিঘ্নে কাজ করার মতো পরিবেশ পাচ্ছেন?
সমাজে কোনো বড় সংঘাত নেই তো? ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে সব জায়গা থেকে। দেশের ডাকসাইটে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সেই ঐক্য কি দেখা যাচ্ছে? বিভাজনের রাজনীতিকে কি সরিয়ে দেওয়া গেছে? সন্দেহ-অবিশ্বাসের রাজনীতি কি আছে, নাকি বিদায় নিয়েছে?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ জনগণ কি সন্তুষ্ট? মব বলুন আর চাপ প্রয়োগের রাজনীতি বলুন, সেগুলো কি জনমনে ভীতি ছড়াচ্ছে?
আপনি কি এমন কিছু লক্ষ করছেন, যেখানে সত্য ও মিথ্যাকে কাছাকাছি রেখে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয়?
আপনি কি সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলার প্রবণতা লক্ষ করেছেন? আউল-বাউলের দেশে গানবাজনা কি হুমকির মুখে পড়েছে? ‘তৌহিদি জনতা’ আদতে কাদের কোন লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে? সরকার কি এদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে? উত্তেজনা ছড়ায় যারা, তাদের পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে, আর যারা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে—এ রকম কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে?
সমষ্টিগত শক্তি ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো বাঁশিওয়ালা কি বাঁশি বাজাচ্ছে? আপনি কি লক্ষ করেছেন শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নয়, নানাভাবে যাঁরা সংখ্যালঘু, তাঁদের মারধর করে সংখ্যাগুরু অংশ আখের গুছিয়ে নিচ্ছে?
আপনি কি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো অঙ্গীকার দেখতে পাচ্ছেন, যাতে তাদের ইশতেহার অনুযায়ী জনগণ একটি ‘সোনার বাংলা’য় বসবাস করবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজে লিখুন। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ করুন। যোগফল মেলান, তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসুন।
আপনি তখন বুঝতে পারবেন, গণ-অভ্যুত্থানকে কেউ কেউ স্বাধীনতাবিরোধিতার জায়গায় সুকৌশলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যে তরুণেরা সেই অপচেষ্টা রুখে দিতে পারে, সে তরুণদের প্রতীক্ষায় আছি।

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির প
২৬ এপ্রিল ২০২২
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১০ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেড. মঞ্জুরে খোদা

গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মোদি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন। এই আস্থা ও হৃদ্যতা ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গভীর মাত্রাকেই নির্দেশ করে। পুতিন তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের ২৫ বছরে ১০ বার ভারত সফর করেছেন। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম ভারত সফর।
পুতিনের এই ভারত সফর নিছক কোনো রুটিন বিষয় ছিল না। ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ধারাবাহিকতা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে। তাঁদের সাক্ষাৎ ছিল বিশ্বরাজনীতির আগ্রহের বিষয়, কেননা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শুল্ক নিয়ে মোদির সঙ্গে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল ও বরফ গলছিল, তখনই পুতিন ভারত সফর করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-রাশিয়া এই বৈঠকে কে কী অর্জন করল, তার কয়েকটি দিক আলোচনা করা যাক।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
পুতিনের এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করল। রাশিয়া এখনো ভারতের প্রধান সমরাস্ত্রের সরবরাহকারী। যদিও ১৯৭০-৮০-এর দশকে ভারতের অস্ত্রের প্রায় ৮০ ভাগই রাশিয়া সরবরাহ করত। পুতিন এবারের সফরে ভারতকে এস ৫০০ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম হস্তান্তর, অতিরিক্ত সামরিক প্ল্যাটফর্ম, হেলিকপ্টার ও ইঞ্জিন কো-প্রোডাকশনসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো নিয়ে আবারও তাদের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেছে। ‘প্রিভিলেজ কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিকস পার্টনারশিপ’ চুক্তির আওতায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী ভারতের যেকোনো স্থল, বিমান ও নৌবন্দরকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। সামরিক প্রয়োজনে একে অন্যের ভূমিও ব্যবহার করতে পারবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে এই প্রতিরক্ষা বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভারত তাদের কৌশলগত নিজস্বতা নিশ্চিত করল।
জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সুবিধা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারত রাশিয়া থেকে অনেক কম মূল্যে বিপুল তেল আমদানি করছে। এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের জ্বালানিনিরাপত্তা, পরিশোধন সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি তেল-গ্যাস চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করল। রাশিয়ার সস্তা অপরিশোধিত তেল ভারতের মুদ্রাস্ফীতি কমাতে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ও সঞ্চয় করতে এবং পরিশোধন মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হলে রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতেও ভূমিকা রাখবে।
বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৬৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও এই বাণিজ্য ভারসাম্যমূলক নয়। রাশিয়ায় ভারতীয় আমদানি প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে পুতিন-মোদি শীর্ষ সম্মেলনে উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যপণ্যের তালিকা সম্প্রসারণ ঘটবে।
রাশিয়া ভারতীয় সরঞ্জাম, কাঁচামাল এবং খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় করার উপায়গুলো অনুসন্ধান করবে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ওপর ভারত-রাশিয়া আন্তসরকারি কমিশনও গঠিত হবে। মহাকাশ গবেষণা ও ভারত-রাশিয়ার যৌথ সামরিক যন্ত্রাংশ নির্মাণ এবং ভারত তা তৃতীয় কোনো দেশে নিজের উৎপাদিত পণ্য বলে বিক্রিও করার সুবিধা পাবে। ভারতে রুশ নকশায় দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।
ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি
রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য চীন-রাশিয়া ব্লকের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করবে। ভবিষ্যতে চীন সীমান্ত সমস্যায় রাশিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়া, আর্কটিক, নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর—এইসব কৌশলগত এলাকায় সহযোগিতা বাড়ানো ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষায় সহজ হবে।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়া চীনের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং একে অন্যের বন্ধুত্ব ও আস্থার সম্পর্ক তারা নিজেরাই ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখার মাধ্যমে চীনকেও জানিয়ে দেওয়া যে, রাশিয়া এখনো ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।
রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের আগে ভারতের সাংবাদিকেরা পুতিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে যদি কোনো সংঘাত ও যুদ্ধ হয়, সে ক্ষেত্রে ভারত কি আশা করতে পারে যে রাশিয়া তাদের পাশে দাঁড়াবে? তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করি, ভারতের সঙ্গে চীনের যে বিরোধগুলো আছে, সেগুলো তারা মিটিয়ে ফেলবে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটি প্রস্তাবও দিয়েছিল হিমালয়ের ওপর দিয়ে সীমান্ত রেখা নিয়ে যে সমস্যা, সেটাকে তারা জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাধান করতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া সহায়তা করতে পারে।’
পাকিস্তান রাশিয়া থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সামরিক ও জ্বালানি সুবিধা নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। পুতিনের ভারত সফর পরিষ্কার করে দিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার মূল অংশীদার এখনো ভারতই। এটি ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে।
ব্রিকস সম্প্রসারণের সময় ভারত-রাশিয়া সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রিকসের নেতৃত্বে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদের ভারতের আকাঙ্ক্ষাকে রাশিয়ার সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির কথাও জানা গেছে। গ্লোবাল সাউথে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ভারত দেখাতে চায় যে তার পশ্চিমা ও অ-পশ্চিমা উভয় ব্লকের ওপর প্রভাব আছে।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার হলেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে এই সংযোগ ও সম্পর্কের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে মিত্রতা মানেই নির্ভরতা নয়, নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেওয়া নয়। ভারতের এই অবস্থান ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট
বার্তা দেয় যে ‘India will cooperate, but not at the cost of its autonomy.’ ভারত-রাশিয়ার এই কৌশলগত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সমীকরণে নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে দেখিয়েছে যে ভারত কারও বা কোনো বলয়ে আবদ্ধ বা দায়বদ্ধ নয়। ভারতের এই স্বতন্ত্র অবস্থান বলে দেয়, জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এবং এটি তাদের একটি মূলনীতির দৃঢ় প্রকাশ।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
পুতিনের ভারত সফর একটি ভূকৌশলগত বার্তা—ভারত তার বহুমুখী বৈদেশিক নীতি ও কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে। পুতিনের এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ থাকবে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বও বজায় রাখবে। অর্থাৎ ভারত কারও পরনির্ভর নয়; বরং নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি করবে। রাশিয়া এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে পশ্চিমা, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার একচেটিয়া কূটনীতির বিকল্প হিসেবে ভারতকে দেখছে।
কয়েক মাস ধরে আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতকে রাশিয়ার তেল আমদানি ও রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের চাপ তৈরি করেছে শুল্ক বৃদ্ধির অস্ত্রকে ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও ভারত তাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের নিজস্ব নীতিতে অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষা অংশীদার—পাকিস্তান যত আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে, ভারত তত কাছে পেয়েছে রাশিয়াকে। এ জন্যই দেশ দুটি সামরিক ও সামরিক প্রযুক্তিগত অংশীদারত্বের অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। পুতিনের সফরের আগে এক ব্রিফিংয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, তার সবই ভাগ করে নেওয়া হবে। পুতিনও এই সফরের মাধ্যমে রাশিয়াকে একঘরে করার যে পশ্চিমা প্রচার ছিল, তার অনেকটা ভুল প্রমাণ করেছেন।

গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মোদি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন। এই আস্থা ও হৃদ্যতা ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গভীর মাত্রাকেই নির্দেশ করে। পুতিন তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের ২৫ বছরে ১০ বার ভারত সফর করেছেন। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম ভারত সফর।
পুতিনের এই ভারত সফর নিছক কোনো রুটিন বিষয় ছিল না। ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ধারাবাহিকতা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে। তাঁদের সাক্ষাৎ ছিল বিশ্বরাজনীতির আগ্রহের বিষয়, কেননা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শুল্ক নিয়ে মোদির সঙ্গে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল ও বরফ গলছিল, তখনই পুতিন ভারত সফর করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-রাশিয়া এই বৈঠকে কে কী অর্জন করল, তার কয়েকটি দিক আলোচনা করা যাক।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
পুতিনের এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করল। রাশিয়া এখনো ভারতের প্রধান সমরাস্ত্রের সরবরাহকারী। যদিও ১৯৭০-৮০-এর দশকে ভারতের অস্ত্রের প্রায় ৮০ ভাগই রাশিয়া সরবরাহ করত। পুতিন এবারের সফরে ভারতকে এস ৫০০ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম হস্তান্তর, অতিরিক্ত সামরিক প্ল্যাটফর্ম, হেলিকপ্টার ও ইঞ্জিন কো-প্রোডাকশনসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো নিয়ে আবারও তাদের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেছে। ‘প্রিভিলেজ কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিকস পার্টনারশিপ’ চুক্তির আওতায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী ভারতের যেকোনো স্থল, বিমান ও নৌবন্দরকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। সামরিক প্রয়োজনে একে অন্যের ভূমিও ব্যবহার করতে পারবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে এই প্রতিরক্ষা বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভারত তাদের কৌশলগত নিজস্বতা নিশ্চিত করল।
জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সুবিধা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারত রাশিয়া থেকে অনেক কম মূল্যে বিপুল তেল আমদানি করছে। এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের জ্বালানিনিরাপত্তা, পরিশোধন সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি তেল-গ্যাস চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করল। রাশিয়ার সস্তা অপরিশোধিত তেল ভারতের মুদ্রাস্ফীতি কমাতে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ও সঞ্চয় করতে এবং পরিশোধন মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হলে রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতেও ভূমিকা রাখবে।
বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৬৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও এই বাণিজ্য ভারসাম্যমূলক নয়। রাশিয়ায় ভারতীয় আমদানি প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে পুতিন-মোদি শীর্ষ সম্মেলনে উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যপণ্যের তালিকা সম্প্রসারণ ঘটবে।
রাশিয়া ভারতীয় সরঞ্জাম, কাঁচামাল এবং খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় করার উপায়গুলো অনুসন্ধান করবে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ওপর ভারত-রাশিয়া আন্তসরকারি কমিশনও গঠিত হবে। মহাকাশ গবেষণা ও ভারত-রাশিয়ার যৌথ সামরিক যন্ত্রাংশ নির্মাণ এবং ভারত তা তৃতীয় কোনো দেশে নিজের উৎপাদিত পণ্য বলে বিক্রিও করার সুবিধা পাবে। ভারতে রুশ নকশায় দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।
ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি
রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য চীন-রাশিয়া ব্লকের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করবে। ভবিষ্যতে চীন সীমান্ত সমস্যায় রাশিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়া, আর্কটিক, নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর—এইসব কৌশলগত এলাকায় সহযোগিতা বাড়ানো ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষায় সহজ হবে।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়া চীনের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং একে অন্যের বন্ধুত্ব ও আস্থার সম্পর্ক তারা নিজেরাই ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখার মাধ্যমে চীনকেও জানিয়ে দেওয়া যে, রাশিয়া এখনো ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।
রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের আগে ভারতের সাংবাদিকেরা পুতিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে যদি কোনো সংঘাত ও যুদ্ধ হয়, সে ক্ষেত্রে ভারত কি আশা করতে পারে যে রাশিয়া তাদের পাশে দাঁড়াবে? তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করি, ভারতের সঙ্গে চীনের যে বিরোধগুলো আছে, সেগুলো তারা মিটিয়ে ফেলবে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটি প্রস্তাবও দিয়েছিল হিমালয়ের ওপর দিয়ে সীমান্ত রেখা নিয়ে যে সমস্যা, সেটাকে তারা জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাধান করতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া সহায়তা করতে পারে।’
পাকিস্তান রাশিয়া থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সামরিক ও জ্বালানি সুবিধা নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। পুতিনের ভারত সফর পরিষ্কার করে দিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার মূল অংশীদার এখনো ভারতই। এটি ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে।
ব্রিকস সম্প্রসারণের সময় ভারত-রাশিয়া সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রিকসের নেতৃত্বে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদের ভারতের আকাঙ্ক্ষাকে রাশিয়ার সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির কথাও জানা গেছে। গ্লোবাল সাউথে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ভারত দেখাতে চায় যে তার পশ্চিমা ও অ-পশ্চিমা উভয় ব্লকের ওপর প্রভাব আছে।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার হলেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে এই সংযোগ ও সম্পর্কের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে মিত্রতা মানেই নির্ভরতা নয়, নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেওয়া নয়। ভারতের এই অবস্থান ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট
বার্তা দেয় যে ‘India will cooperate, but not at the cost of its autonomy.’ ভারত-রাশিয়ার এই কৌশলগত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সমীকরণে নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে দেখিয়েছে যে ভারত কারও বা কোনো বলয়ে আবদ্ধ বা দায়বদ্ধ নয়। ভারতের এই স্বতন্ত্র অবস্থান বলে দেয়, জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এবং এটি তাদের একটি মূলনীতির দৃঢ় প্রকাশ।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
পুতিনের ভারত সফর একটি ভূকৌশলগত বার্তা—ভারত তার বহুমুখী বৈদেশিক নীতি ও কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে। পুতিনের এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ থাকবে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বও বজায় রাখবে। অর্থাৎ ভারত কারও পরনির্ভর নয়; বরং নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি করবে। রাশিয়া এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে পশ্চিমা, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার একচেটিয়া কূটনীতির বিকল্প হিসেবে ভারতকে দেখছে।
কয়েক মাস ধরে আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতকে রাশিয়ার তেল আমদানি ও রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের চাপ তৈরি করেছে শুল্ক বৃদ্ধির অস্ত্রকে ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও ভারত তাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের নিজস্ব নীতিতে অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষা অংশীদার—পাকিস্তান যত আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে, ভারত তত কাছে পেয়েছে রাশিয়াকে। এ জন্যই দেশ দুটি সামরিক ও সামরিক প্রযুক্তিগত অংশীদারত্বের অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। পুতিনের সফরের আগে এক ব্রিফিংয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, তার সবই ভাগ করে নেওয়া হবে। পুতিনও এই সফরের মাধ্যমে রাশিয়াকে একঘরে করার যে পশ্চিমা প্রচার ছিল, তার অনেকটা ভুল প্রমাণ করেছেন।

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির প
২৬ এপ্রিল ২০২২
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১০ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
এই দেড় বছরে মেট্রোরেল লাইনে কাপড়, ব্যাগ, ড্রোন, তার নিক্ষেপের কারণে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। এখনই যদি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটা ভালো ব্যাপার যে, মেট্রোরেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা এমন যে রেললাইনে সামান্যতম বাধা সৃষ্টি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যায়। এটি দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ভালো দিক হলেও, মানবসৃষ্ট কারণে ঘন ঘন এই থমকে যাওয়া আধুনিক এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
জনগণ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে করণীয় নিয়ে এখনই ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তবে প্রযুক্তিগত সমস্যাও যে আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিছুদিন আগে ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি এই আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে। বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম বারবার বিকল হওয়া বা খুলে পড়ার ঘটনাটি মেট্রোরেলের কারিগরি তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এক সূত্র থেকে জানা যায়, এই নিহতের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেলে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ যাত্রী কমে গেছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন মেট্রোরেলের লাইনে বস্তু শনাক্ত করতে ‘অবজেক্ট ডিটেকশন সেন্সর’ ও ‘এআই-চালিত সিসিটিভি’ স্থাপন করা, ড্রোন পড়া প্রতিরোধে ‘ড্রোন ডিটেকশন রাডার’ ও ‘জিওফেন্সিং সিস্টেম’ ব্যবহার করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইনে সুরক্ষা নেট বসালে বাইরে থেকে তার বা বস্তু নিক্ষেপ ঠেকানো সম্ভব।
মেট্রোরেল দেশের সম্পদ। জনগণের মধ্যে সে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। ডিএমটিসিএলকে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান এবং রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের সামান্য ভুল বা অসচেতনতা হাজার হাজার যাত্রীর ভোগান্তি এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সুরক্ষা—এই দুইয়ের সমন্বয়েই কেবল মেট্রোরেলের মসৃণ ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব। এই আধুনিক পরিষেবা যেন মাঝে মাঝে থমকে যাওয়ার দুর্নাম থেকে মুক্তি পায়, সেই প্রত্যাশা আমাদের।

ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
এই দেড় বছরে মেট্রোরেল লাইনে কাপড়, ব্যাগ, ড্রোন, তার নিক্ষেপের কারণে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। এখনই যদি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটা ভালো ব্যাপার যে, মেট্রোরেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা এমন যে রেললাইনে সামান্যতম বাধা সৃষ্টি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যায়। এটি দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ভালো দিক হলেও, মানবসৃষ্ট কারণে ঘন ঘন এই থমকে যাওয়া আধুনিক এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
জনগণ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে করণীয় নিয়ে এখনই ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তবে প্রযুক্তিগত সমস্যাও যে আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিছুদিন আগে ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি এই আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে। বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম বারবার বিকল হওয়া বা খুলে পড়ার ঘটনাটি মেট্রোরেলের কারিগরি তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এক সূত্র থেকে জানা যায়, এই নিহতের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেলে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ যাত্রী কমে গেছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন মেট্রোরেলের লাইনে বস্তু শনাক্ত করতে ‘অবজেক্ট ডিটেকশন সেন্সর’ ও ‘এআই-চালিত সিসিটিভি’ স্থাপন করা, ড্রোন পড়া প্রতিরোধে ‘ড্রোন ডিটেকশন রাডার’ ও ‘জিওফেন্সিং সিস্টেম’ ব্যবহার করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইনে সুরক্ষা নেট বসালে বাইরে থেকে তার বা বস্তু নিক্ষেপ ঠেকানো সম্ভব।
মেট্রোরেল দেশের সম্পদ। জনগণের মধ্যে সে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। ডিএমটিসিএলকে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান এবং রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের সামান্য ভুল বা অসচেতনতা হাজার হাজার যাত্রীর ভোগান্তি এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সুরক্ষা—এই দুইয়ের সমন্বয়েই কেবল মেট্রোরেলের মসৃণ ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব। এই আধুনিক পরিষেবা যেন মাঝে মাঝে থমকে যাওয়ার দুর্নাম থেকে মুক্তি পায়, সেই প্রত্যাশা আমাদের।

এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির প
২৬ এপ্রিল ২০২২
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১০ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১০ ঘণ্টা আগে