ইশতিয়াক হাসান

রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি আমার আগ্রহটা বরাবরই প্রবল। তাই এই দিনটিতে স্যার এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর সেই অ্যাডভেঞ্চারের ঘটনা চিন্তা করে শিহরিত হই। একই সঙ্গে মন ভার হয়ে যায় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। একই সঙ্গে মাঝেমধ্যে এ প্রশ্নও মনকে খোঁচায়—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন? এভারেস্ট জয়ের ৬৯ বছর পূর্তি আজ। বিশেষ এই দিনটিতে হিলারি-তেনজিংয়ের সেই রোমাঞ্চগাথার সঙ্গে স্মরণ করব ম্যালরি ও আরভিনকেও।
এই সেই দিন
তাঁবু থেকে বের হয়ে আসা দুজন মানুষ আধবোজা চোখে তাকালেন। আশ্চর্য সুন্দর একটি দৃশ্য ধরা দিল তাঁদের চোখে। সকালের সোনা রোদে বরফে আবৃত চূড়াটি জ্বলজ্বল করছে।
পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশিখর মাউন্ট এভারেস্টের পাঁচ মাইলেরও বেশি উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। একটু আগেই ষাট মাইলের বেশি গতিতে আঘাত হানছিল কনকনে হাওয়া। এখন প্রকৃতি অনেকটাই শান্ত। তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা। যেন শরীরের হাড়-মাংসে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। দিনটা ১৯৫৩ সালের ২৯ মে। এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখার আশা করছেন।
তবে এ পর্যন্ত আসাটা মোটেই সহজ হয়নি। কয়েকবারই ভয়ানক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একবার তো হিলারি মরতে বসেছিলেন।
এক মাস আগের কথা সেটা। রশি ধরে এগোবার সময় একটি বরফ ধস পড়ল সামনে। ফাটলটা এত বড় যে হেঁটে অতিক্রম অসম্ভব। এসব ক্ষেত্রে পর্বতারোহীরা সাধারণত যা করেন, সামনে থাকা হিলারি তাই করলেন। বরফের একটা বড়সড় চাঙর এনে ফাটলের ওপর বসিয়ে দিলেন। কিন্তু বরফের চাঁইটায় পা দেওয়ামাত্র ওটা ভেঙে পড়ল। টুকরোটাসহ ফাটলের ভেতর গড়িয়ে পড়লেন হিলারি।
তবে নিচে পড়বার সময় শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেললেন হিলারি। এটা বরফের ফাটলের মাঝখানে আটকে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল তাঁকে। সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখেও মাথা ঠান্ডা রাখলেন তেনজিং। সঙ্গের কুঠারটাকে বরফে গেঁথে, দড়িটা পেঁচিয়ে ফেললেন এতে। এক মুহূর্ত পরই রশিটায় টান পড়ল। কোমরে প্যাঁচানো দড়িতে টান পড়ায় থামল হিলারির পতন। বরফের দুই দেয়ালের মাঝে শূন্যে ঘুরপাক খেতে লাগলেন। বরফের চাঙরটা ফাটলের নিচে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে বিধ্বস্ত হলো। তেনজিং তৎপর না হলে হিলারির অবস্থাও হতো ওই বরফের টুকরোটার মতোই।
দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা
দুজনে ভিন্ন দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। এডমন্ড হিলারি নিজের দেশ নিউজিল্যান্ডে মৌমাছির চাষ করতেন। অন্যদিকে তেনজিং নোরগে একজন শেরপা। নেপালের হিমালয় অঞ্চলে বাস করেন শেরপা জাতির লোকেরা। পর্বতের গাইড হিসেবে এঁদের জুড়ি মেলা ভার। তবে একটি বিষয়ে দুজনের বড় মিল, পর্বতারোহণের নেশা। হিলারি এর আগেও দুবার হিমালয় অভিযানে এসেছেন। এদিকে তেনজিং তো ছয়বার এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। চেমালুংমার (এভারেস্টের আরেক নাম) চূড়ায় পৌঁছার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি। দুটোই তাঁদের আছে। একজনের ক্ষমতার প্রতি অপরজনের আস্থাও অবিচল।
হিমবাহ ধস, প্রচণ্ড ঠান্ডায় সৃষ্ট ফ্রস্টবাইট, আচমকা শুরু হওয়া বরফ-ঝড়, অক্সিজেনের স্বল্পতা—এভারেস্ট জয়ের পথে বাধা হয়ে থাকা এসব বিপদের কথা অজানা নয় কারওরই। কয়েক দিন আগেই চূড়ায় উঠতে ব্যর্থ তিন পর্বতারোহী ফিরে এসেছেন। বিপর্যস্ত তিন অভিযাত্রী হিলারি-তেনজিংকে সতর্ক করে দিয়েছেন সামনের বিপজ্জনক পথ সম্পর্কে। তবে এত সব বিপদের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন দুজনে।
২৯ মে। সকাল ৬টা ৩০ মিনিট। হিলারি তেনজিং নোরগেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব ঠিক আছে তো?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’ আর মাত্র ১১০০ ফুট, তারপরই ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবেন তাঁরা।
ভয়ংকর পথ
তাঁদের হিমালয়ের সবচেয়ে উঁচু এই পর্বত জয়ের অভিযানের শুরু মার্চের ১০ তারিখ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল স্যার জন হান্ট ১৪ অভিযাত্রী, ৩৬ শেরপা এবং মালামাল বহন করা ৩৬০ জন কুলির দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
হিলারি, তেনজিংসহ দলের বাকি সদস্যরা নেপালের কাঠমাণ্ডু থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তাঁরা গাছপালায় ঠাসা বর্ণিল পাহাড়ি এলাকা ধরে এগোলেন। দুপাশে ছোট ছোট খামার-বাড়ি মুগ্ধ করছে অভিযাত্রীদের। ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভূ-প্রকৃতি বদলাতে লাগল। তারপরই খাড়া, দুরারোহ পর্বত সারি হঠাৎই প্রমত্ত একটা নদীকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।
নদী পেরোতে পাথর ও বাঁশ দিয়ে দুর্বল, নড়বড়ে একটা সেতু তৈরি করে নিতে হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি এবং গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে হাজির হওয়া ভিমরুলের ঝাঁক চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। হাঁটার গতি কমে গেল অভিযাত্রীদের।
পুব দিকে বেশ কিছুটা পথ এগোল দলটা। এ সময়ই দেখা দিলেন সাগরমাতা। পর্বতারোহীদের মনে হলো, আকাশের গায়ে ঝুলে আছে ওটা। ১২ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় বেজ ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। এখান থেকে পর্বতের ওপরের দিকে উঠবেন তাঁরা।
বরফ কেটে ওপরের দিকে যেতে হবে। তাই বেজ ক্যাম্পে কয়েক সপ্তাহ যাত্রাবিরতি করতে হলো দলটিকে। এরই মধ্যে একদিন হিলারির নেতৃত্বে ছোট্ট একটি দল খুমবু হিমবাহে অভিযান চালাল।
‘মানুষের দেখা সবচেয়ে বীভৎস ও নিষিদ্ধ দৃশ্যগুলোর একটি’—খুমবু হিমবাহকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালরি। পরে এই এলাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সে যাক, একপর্যায়ে সঙ্গীসহ হিলারি বরফের বড় একটা মাঠের সামনে চলে এলেন।
এখানে প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত ও ওলটপালটভাবে হিমবাহ বা বরফের চাঙরের ধস নেমে আসছে। আশপাশের বরফঢাকা জমিতে একটু পরপরই ফাটল তৈরি হচ্ছে। যেকোনো সময় পায়ের নিচের বরফ ফাঁক হয়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই ভয়ানক বিপৎসংকুল এলাকার মধ্য দিয়ে পথ করে এগোলেন হিলারি। তাঁকে অনুসরণ করল অন্যরা।
এই বিক্ষুব্ধ বরফ রাজ্যে একটা পথ খুঁজে বের করলেন হিলারি। ১৯ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় ঘাঁটি গাড়লেন সবাই। এই পথ ধরে চলার সময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দে অনবরত বরফের চাঁই স্থান বদলাচ্ছে, এমন একটি জায়গার নাম হলো, ‘অ্যাটম বম্ব’। এই সেই জায়গা যেখানে বরফের ফাটলের মধ্যে পড়ে হিলারির অভিযান এবং জীবন দুটোই সাঙ্গ হতে বসেছিল।
চূড়ান্ত যাত্রা
হিলারি এবং তেনজিং চূড়ায় পৌঁছাতে চূড়ান্তযাত্রা শুরু করলেন। আগের মতোই কোমরে বাঁধা দড়ি তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তেনজিং এবার সামনে, হিলারি পেছনে। খুব সরু, কেবল কয়েক ফুট চওড়া একটি শৈলশিরা ধরে ওপরে উঠছেন দুই পর্বতারোহী। নরম তুষার এই চলাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। একপর্যায়ে সামনে এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
একসময় নরম তুষারের রাজ্য শেষ হলো। এর জায়গা নিল তুলনামূলক শক্ত বরফ। বরফে পা ফেলে একটু নিশ্চিন্তে এগোতে পারছেন দুজনে। তবে সতর্কতায় ঢিল দেননি। তাঁদের ডানে বরফের মোচড়ানো কার্নিশ, পাশ থেকেই পর্বতের কিনারা খাড়া নেমে গেছে ৮ হাজার ফুট। বামে সংকীর্ণ পাথুরে তাক।
মৃত্যু এলাকা
দুজনেই গায়ে চাপিয়েছেন আট প্রস্থ পোশাক, হাতে দস্তানা। পিঠে ৪০ পাউন্ডের অক্সিজেন ট্যাংক। উচ্চতার কারণে বাতাস এখানে অনেক হালকা। মানে এখানে অক্সিজেনের ঘাটতি আছে। কিন্তু পর্বতারোহীদের বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি অক্সিজেন দরকার, অন্তত ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। অনেকে এই উচ্চতাকে এভারেস্টের ডেথ জোনের শুরু বলে উল্লেখ করেন।
বরফ ভেঙে এগোনোর সময় হিলারির নিশ্বাস নিতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের নলের ভেতর বরফ জমতে শুরু করেছে যে। একটু পরপরই নল পরিষ্কার করছেন দুজনেই।
অনেকটা যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলেছেন। শুধু জানেন, যেভাবে হোক চূড়ায় পৌঁছাতে হবে। পরে হিলারি অকপটে বলেছিলেন, ‘আমরা কল্পনাও করতে পারছিলাম না, কোনো মানুষের পক্ষে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব।’
বড় বাধা
দুই অভিযাত্রী এক সময় চল্লিশ ফুট উঁচু একটা পাথরের দেয়ালের সামনে চলে এলেন। তাঁদের শরীরের এমন অবস্থা, সরাসরি দেয়ালের ওপর চড়া অসম্ভব।
হিলারির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। জুতার স্পাইক ব্যবহার করে পাথরের দেয়াল এবং একটা তাকের মাঝখান দিয়ে উঠতে শুরু করলেন। এক সময় দেয়ালের ওপর পৌঁছে গেলেন। তারপর তেনজিংকে দড়ি ধরে টেনে ওপরে তুললেন। আবার শুরু হলো বরফ ভেঙে পাহাড়ের ওপর ওঠা।
একেবারে ওপরে
কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। চলার গতি ধীর হয়ে এসেছে। ধৈর্যের শেষ সীমায় যেন পৌঁছে গেছেন তাঁরা। তবে ঢাল বেয়ে শেষ অংশটা পেরিয়ে হঠাৎই পৌঁছে গেলেন একেবারে ওপরে, শিখরে। তাঁরা এখন এভারেস্টের চূড়ায়।
দুজন মানুষ পরস্পরকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলেন, একে অপরের হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন পাগলের মতো। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে হিলারি কিছু ছবি তুললেন। তেনজিং শেরপাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে বাস করা দেবতাদের জন্য বরফ খুঁড়ে কিছু চকলেট এবং বিস্কুট রাখলেন। এগুলো তাঁদের জন্য উপহার।
পনেরো মিনিট পর এভারেস্টের চূড়ার মনোমুগ্ধকর, রাজকীয় দৃশ্যকে বিদায় জানিয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন দুজনে। তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এমন এক জায়গায় গিয়েছেন, যেখানে তাঁদের আগে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। এমন দৃশ্য দেখেছেন, যা আগে কেউ দেখেনি।
ম্যালরি ও আরভিন
কারও কারও ধারণা প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন হিলারি-তেনজিং নন, ম্যালরি-আরভিন। এমন অদ্ভুত ধারণার কারণ কী, তাই জানার চেষ্টা করছি এবার। তবে শুরুতে ম্যালরি কে অল্প কথায় তা জেনে নিই আগে।
এক শ বছর আগের ঘটনা। ইংল্যান্ডের এক যাজকের ছেলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের। তিন বছর বাদে পর্বতের চূড়ার কাছাকাছি থেকে অদৃশ্য হন তিনি। তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালে। সেই সঙ্গে জর্জ ম্যালরি জন্ম দিলেন এক চিরস্থায়ী তর্কের, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় আসলে কে প্রথম পা রেখেছিলেন?
১৮৮৬ সালের জুনে মবারলেতে জর্জ ম্যালরির জন্ম। বাবা হারবার্ট লেইফ এবং মা অ্যানি ব্যারিজ। ওয়েস্ট কিরবি এবং এস্টাবর্নের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন ম্যালরি। তার পর উইনচেস্টার কলেজে গণিতে বৃত্তি পান। এখানেই পর্বত আরোহণের নেশা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাঁর, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন নিয়তির দিকে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন ম্যালরি। তারপর সেখানেই শিক্ষকতা করেন কিছুদিন। একই সঙ্গে পর্বতারোহণে আরও শাণিত করে তুলতে থাকেন নিজেকে। তারপর ব্রিটিশ সেনাদলে নাম লেখান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পরই মাউন্ট এভারেস্ট পেয়ে বসল তাঁকে। জীবনের বাকি সময়টা পর্বতটা মোহাবিষ্ট করে রাখল ম্যালরিকে।
১৯২১। নেপাল-তিব্বত সীমান্তে পর্বতটির চূড়ায় পৌঁছার একটি পথের খোঁজে প্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলে নাম লেখান জর্জ ম্যালরি। দলনেতা ছিলেন চার্লস হাওয়ার্ড বারি। আগে কখনো হিমালয় অভিযানে যাননি ম্যালরি। কিন্তু কী আশ্চর্য! অভিযান শুরুর পর দেখা গেল অলিখিতভাবে গোটা দলের নেতৃত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পর্বত এলাকাটির বহু কাঙ্ক্ষিত একটি মানচিত্রও তৈরি করা হলো এই অভিযানেই।
স্কুলের বন্ধু গাই বুলক এবং সেনা জরিপকারী অলিভার হুইলারসহ দুর্গম লাকপা লাপাস এবং পুব রংবাক উপত্যকায় অভিযান চালান ম্যালরি। এই তিন দুঃসাহসী অভিযাত্রীই প্রথম পর্বতটির উত্তর প্রান্তে পৌঁছান। এই অভিযানেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের সম্ভাব্য একটি পথ আবিষ্কারে সফল হন ম্যালরি।
১৯২২ সালের অভিযানেও ছিলেন তিনি, যেটাকে বিবেচনা করা হয় এভারেস্ট জয়ের প্রথম সত্যিকারের প্রচেষ্টা হিসেবে। দলনেতা ছিলেন জেনারেল চার্লস ব্রুস। এক বছর আগে ম্যালরি যে পথটির সন্ধান পেয়েছিলেন, ওটাই অনুসরণ করছিলেন অভিযাত্রীরা। এই অভিযানেই প্রথম বোতলজাত অক্সিজেন সঙ্গে নেন পর্বতারোহীরা। ওই সময় রেকর্ড ৮ হাজার ৩২৬ মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পরে দলটি।
তবে অভিযানটির পরিসমাপ্তি ঘটে বিয়োগান্ত এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ম্যালরির সঙ্গে থাকা সাতজন মুটে হিমবাহ পতনে মারা যান। ম্যালরিকে দল পরিচালনায় আরও বেশি সতর্ক হতে হতো—এমন অভিযোগ তোলেন তখন কোনো কোনো পর্বতারোহী। এর পর স্ত্রী রুথ এবং তিন সন্তানকে নিয়ে চমৎকার দিন কাটছিল ম্যালরির। তবে এভারেস্টের নেশা একবার যাকে পায়, তিনি এর ডাক অগ্রাহ্য করেন কীভাবে?
১৯২৪ সালে তৃতীয়বারের মতো এভারেস্ট রোমাঞ্চে শামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ম্যালরি। অভিযান শুরুর আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় মানুষ কেন এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করে? তাঁর ছোট্ট উত্তর ছিল, ‘কারণ ওটা ওখানে আছে।’ যা, পর্বতারোহণের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তিতে পরিণত হয় কালক্রমে। তবে ম্যালরির জানা ছিল না, এটাই তাঁর শেষ এভারেস্টযাত্রা। আর কখনো দেখা হবে না প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা আদরের সন্তানদের সঙ্গে। জুনের সেই বিখ্যাত অভিযানের সময় তাঁর বয়স ৩৭।
এবারের অভিযাত্রী দলের নেতাও ছিলেন জেনারেল ব্রুস। অভিযানে অন্যদের পাশাপাশি ম্যালরির সঙ্গে যোগ দেন বার্কেনহেডের অ্যান্ড্রু আরভিন। পর্বতারোহী হিসেবে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন না আরভিন। তবে ২২ বছরের এই টগবগে তরুণের অভিধানে ‘পিছু হটা’ শব্দ দুটো ছিলই না। ওই অভিযানেও অক্সিজেন ব্যবহার করেছিলেন পর্বতারোহীরা। আর তা ব্যবহারে ও পরিচালনায় দারুণ দক্ষ ছিলেন প্রকৌশলী আরভিন।
তারিখটা ছিল জুনের ৮। এভারেস্টের চূড়ার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে উঁচু ক্যাম্প ছাড়লেন ম্যালরি এবং আরভিন। কিন্তু আর ফিরে এলেন না। দ্রুতই এভারেস্টে হারিয়ে যাওয়া পর্বতারোহীদের তালিকায় নাম উঠল তাদের।
মূল অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিলেন ভূ-তাত্ত্বিক নোয়েল ওডেল। দুই পর্বতারোহীকে শেষবার দেখার দাবি তাঁরই। অল্প সময়ের জন্য যখন মেঘ সরে গিয়েছিল তখন ম্যালরি এবং আরভিনকে দেখেন তিনি, চূড়া থেকে কেবল কয়েকশ গজ দূরে।
পরে নোয়েল লিখেন, ‘৮ জুন, বেলা সাড়ে বারোটা। হঠাৎ আবহাওয়া একটু পরিষ্কার হয়ে গেল। এভারেস্টের চূড়া এবং চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল খুদে একটা কালো ছায়ায়, একটা পাথরের ওপাশে ছোট্ট একটা তুষার চূড়ায়। কালো বিন্দুটা নড়ে উঠল। অপর একটি কালো বিন্দু রওনা হলো আগেরটাকে লক্ষ্য করে।
প্রথম ছায়াটি পাথরের ধাপ ধরে ওপরে উঠে গেল। পরের ছায়ামূর্তিটাও তাই করল। তারপরই অসাধারণ এই দৃশ্যপট অদৃশ্য হলো। কারণ, আবারও মেঘ ঘিরে ধরেছে চারপাশ।’
রহস্যের সমাধান হয়নি আজও
আরভিনের বরফ কাটার কুঠারটা খুঁজে পাওয়া গেল ১৯৩৩ সালে, ৮ হাজার ৪৬০ মিটার উচ্চতায়। ১৯৭৫ সালে এ ব্রিটিশ অভিযাত্রীর মরদেহ আবিষ্কারের দাবি তোলেন এক চীনা অভিযাত্রী। এর ২২ বছর আগেই হিলারি এবং তেনজিং এভারেস্ট জয় করে বসে আছেন।
১৯৯৯ সাল। আমেরিকান পর্বতারোহী কনরাড অ্যাঙ্কার পর্বতের উত্তর ঢালে বরফে জমে যাওয়া এবং চমৎকার সংরক্ষিত এক মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। যেখানে কুঠারটা পাওয়া গিয়েছিল এর কয়েক শ মিটার নিচে পাওয়া যায় মৃতদেহটি।
মৃতদেহটির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এর কলারের একটা ট্যাগ দেখে। সেখানে লেখা ছিল জি ম্যালরি! কোমরে দড়ির শক্ত দাগ পাওয়া যায় মৃতদেহটির। এতে বোঝা যায় আছড়ে পড়ার আগে দড়িতে বেঁধে আরভিনের সঙ্গে আটকানো ছিল তাঁর শরীর। মাথায়ও একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল তাঁর। ম্যালরির সঙ্গে কিছু খুঁটিনাটি জিনিসও মেলে। এগুলোর মধ্যে ছিল একটি আল্টিমিটার, একটি চিরকুট ও পর্বতারোহণের যন্ত্রপাতির একটি রশিদ। তবে এমন কয়েকটি সূত্র পাওয়া গেল, যেটা তাঁরা সত্যি চূড়ায় পৌঁছেছিলেন কিনা, সে বিষয়টি আগাগোড়ার রহস্যের জালে আটকে দিল।
ম্যালরির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি ছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ছবিটা চূড়ায় রেখে আসবেন। কিন্তু ওই ছবিটার খুঁজে পাওয়া গেল না। ওডেলের চোখ যদি বেইমানি না করে, তবে ফিরে আসছিলেন তাঁরা। তাঁদের এই অভিযানের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করতে দুই অভিযাত্রী একটা ক্যামেরা নিয়েছিলেন সঙ্গে। ওটারও খোঁজ মেলেনি।
ম্যালরির মৃতদেহ আবিষ্কারের ২০ বছর পরও এভারেস্টের বড় এক রহস্য হয়েই রইল অভিযানটি। ম্যালরি এবং আরভিন সত্যি চূড়াজয় করেছিলেন কি না, এই নিয়ে এভারেস্টপ্রেমী এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে তর্ক বাধে নিয়মিতই।
আজও পর্বতারোহীরা হন্যে হয়ে খোঁজেন আরভিনের দেহ। তাঁদের আশা এর সঙ্গে মিলবে তাঁর ক্যামেরাখানা, যা প্রমাণ করবে এক যাজকের ছেলে এবং তার বার্কেনহেডের অভিযানসঙ্গী সত্যি প্রথম মানুষ হিসাবে পা রেখেছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের চূড়ায়।

রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি আমার আগ্রহটা বরাবরই প্রবল। তাই এই দিনটিতে স্যার এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর সেই অ্যাডভেঞ্চারের ঘটনা চিন্তা করে শিহরিত হই। একই সঙ্গে মন ভার হয়ে যায় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। একই সঙ্গে মাঝেমধ্যে এ প্রশ্নও মনকে খোঁচায়—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন? এভারেস্ট জয়ের ৬৯ বছর পূর্তি আজ। বিশেষ এই দিনটিতে হিলারি-তেনজিংয়ের সেই রোমাঞ্চগাথার সঙ্গে স্মরণ করব ম্যালরি ও আরভিনকেও।
এই সেই দিন
তাঁবু থেকে বের হয়ে আসা দুজন মানুষ আধবোজা চোখে তাকালেন। আশ্চর্য সুন্দর একটি দৃশ্য ধরা দিল তাঁদের চোখে। সকালের সোনা রোদে বরফে আবৃত চূড়াটি জ্বলজ্বল করছে।
পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশিখর মাউন্ট এভারেস্টের পাঁচ মাইলেরও বেশি উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। একটু আগেই ষাট মাইলের বেশি গতিতে আঘাত হানছিল কনকনে হাওয়া। এখন প্রকৃতি অনেকটাই শান্ত। তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা। যেন শরীরের হাড়-মাংসে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। দিনটা ১৯৫৩ সালের ২৯ মে। এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখার আশা করছেন।
তবে এ পর্যন্ত আসাটা মোটেই সহজ হয়নি। কয়েকবারই ভয়ানক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একবার তো হিলারি মরতে বসেছিলেন।
এক মাস আগের কথা সেটা। রশি ধরে এগোবার সময় একটি বরফ ধস পড়ল সামনে। ফাটলটা এত বড় যে হেঁটে অতিক্রম অসম্ভব। এসব ক্ষেত্রে পর্বতারোহীরা সাধারণত যা করেন, সামনে থাকা হিলারি তাই করলেন। বরফের একটা বড়সড় চাঙর এনে ফাটলের ওপর বসিয়ে দিলেন। কিন্তু বরফের চাঁইটায় পা দেওয়ামাত্র ওটা ভেঙে পড়ল। টুকরোটাসহ ফাটলের ভেতর গড়িয়ে পড়লেন হিলারি।
তবে নিচে পড়বার সময় শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেললেন হিলারি। এটা বরফের ফাটলের মাঝখানে আটকে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল তাঁকে। সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখেও মাথা ঠান্ডা রাখলেন তেনজিং। সঙ্গের কুঠারটাকে বরফে গেঁথে, দড়িটা পেঁচিয়ে ফেললেন এতে। এক মুহূর্ত পরই রশিটায় টান পড়ল। কোমরে প্যাঁচানো দড়িতে টান পড়ায় থামল হিলারির পতন। বরফের দুই দেয়ালের মাঝে শূন্যে ঘুরপাক খেতে লাগলেন। বরফের চাঙরটা ফাটলের নিচে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে বিধ্বস্ত হলো। তেনজিং তৎপর না হলে হিলারির অবস্থাও হতো ওই বরফের টুকরোটার মতোই।
দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা
দুজনে ভিন্ন দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। এডমন্ড হিলারি নিজের দেশ নিউজিল্যান্ডে মৌমাছির চাষ করতেন। অন্যদিকে তেনজিং নোরগে একজন শেরপা। নেপালের হিমালয় অঞ্চলে বাস করেন শেরপা জাতির লোকেরা। পর্বতের গাইড হিসেবে এঁদের জুড়ি মেলা ভার। তবে একটি বিষয়ে দুজনের বড় মিল, পর্বতারোহণের নেশা। হিলারি এর আগেও দুবার হিমালয় অভিযানে এসেছেন। এদিকে তেনজিং তো ছয়বার এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। চেমালুংমার (এভারেস্টের আরেক নাম) চূড়ায় পৌঁছার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি। দুটোই তাঁদের আছে। একজনের ক্ষমতার প্রতি অপরজনের আস্থাও অবিচল।
হিমবাহ ধস, প্রচণ্ড ঠান্ডায় সৃষ্ট ফ্রস্টবাইট, আচমকা শুরু হওয়া বরফ-ঝড়, অক্সিজেনের স্বল্পতা—এভারেস্ট জয়ের পথে বাধা হয়ে থাকা এসব বিপদের কথা অজানা নয় কারওরই। কয়েক দিন আগেই চূড়ায় উঠতে ব্যর্থ তিন পর্বতারোহী ফিরে এসেছেন। বিপর্যস্ত তিন অভিযাত্রী হিলারি-তেনজিংকে সতর্ক করে দিয়েছেন সামনের বিপজ্জনক পথ সম্পর্কে। তবে এত সব বিপদের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন দুজনে।
২৯ মে। সকাল ৬টা ৩০ মিনিট। হিলারি তেনজিং নোরগেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব ঠিক আছে তো?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’ আর মাত্র ১১০০ ফুট, তারপরই ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবেন তাঁরা।
ভয়ংকর পথ
তাঁদের হিমালয়ের সবচেয়ে উঁচু এই পর্বত জয়ের অভিযানের শুরু মার্চের ১০ তারিখ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল স্যার জন হান্ট ১৪ অভিযাত্রী, ৩৬ শেরপা এবং মালামাল বহন করা ৩৬০ জন কুলির দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
হিলারি, তেনজিংসহ দলের বাকি সদস্যরা নেপালের কাঠমাণ্ডু থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তাঁরা গাছপালায় ঠাসা বর্ণিল পাহাড়ি এলাকা ধরে এগোলেন। দুপাশে ছোট ছোট খামার-বাড়ি মুগ্ধ করছে অভিযাত্রীদের। ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভূ-প্রকৃতি বদলাতে লাগল। তারপরই খাড়া, দুরারোহ পর্বত সারি হঠাৎই প্রমত্ত একটা নদীকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।
নদী পেরোতে পাথর ও বাঁশ দিয়ে দুর্বল, নড়বড়ে একটা সেতু তৈরি করে নিতে হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি এবং গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে হাজির হওয়া ভিমরুলের ঝাঁক চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। হাঁটার গতি কমে গেল অভিযাত্রীদের।
পুব দিকে বেশ কিছুটা পথ এগোল দলটা। এ সময়ই দেখা দিলেন সাগরমাতা। পর্বতারোহীদের মনে হলো, আকাশের গায়ে ঝুলে আছে ওটা। ১২ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় বেজ ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। এখান থেকে পর্বতের ওপরের দিকে উঠবেন তাঁরা।
বরফ কেটে ওপরের দিকে যেতে হবে। তাই বেজ ক্যাম্পে কয়েক সপ্তাহ যাত্রাবিরতি করতে হলো দলটিকে। এরই মধ্যে একদিন হিলারির নেতৃত্বে ছোট্ট একটি দল খুমবু হিমবাহে অভিযান চালাল।
‘মানুষের দেখা সবচেয়ে বীভৎস ও নিষিদ্ধ দৃশ্যগুলোর একটি’—খুমবু হিমবাহকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালরি। পরে এই এলাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সে যাক, একপর্যায়ে সঙ্গীসহ হিলারি বরফের বড় একটা মাঠের সামনে চলে এলেন।
এখানে প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত ও ওলটপালটভাবে হিমবাহ বা বরফের চাঙরের ধস নেমে আসছে। আশপাশের বরফঢাকা জমিতে একটু পরপরই ফাটল তৈরি হচ্ছে। যেকোনো সময় পায়ের নিচের বরফ ফাঁক হয়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই ভয়ানক বিপৎসংকুল এলাকার মধ্য দিয়ে পথ করে এগোলেন হিলারি। তাঁকে অনুসরণ করল অন্যরা।
এই বিক্ষুব্ধ বরফ রাজ্যে একটা পথ খুঁজে বের করলেন হিলারি। ১৯ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় ঘাঁটি গাড়লেন সবাই। এই পথ ধরে চলার সময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দে অনবরত বরফের চাঁই স্থান বদলাচ্ছে, এমন একটি জায়গার নাম হলো, ‘অ্যাটম বম্ব’। এই সেই জায়গা যেখানে বরফের ফাটলের মধ্যে পড়ে হিলারির অভিযান এবং জীবন দুটোই সাঙ্গ হতে বসেছিল।
চূড়ান্ত যাত্রা
হিলারি এবং তেনজিং চূড়ায় পৌঁছাতে চূড়ান্তযাত্রা শুরু করলেন। আগের মতোই কোমরে বাঁধা দড়ি তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তেনজিং এবার সামনে, হিলারি পেছনে। খুব সরু, কেবল কয়েক ফুট চওড়া একটি শৈলশিরা ধরে ওপরে উঠছেন দুই পর্বতারোহী। নরম তুষার এই চলাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। একপর্যায়ে সামনে এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
একসময় নরম তুষারের রাজ্য শেষ হলো। এর জায়গা নিল তুলনামূলক শক্ত বরফ। বরফে পা ফেলে একটু নিশ্চিন্তে এগোতে পারছেন দুজনে। তবে সতর্কতায় ঢিল দেননি। তাঁদের ডানে বরফের মোচড়ানো কার্নিশ, পাশ থেকেই পর্বতের কিনারা খাড়া নেমে গেছে ৮ হাজার ফুট। বামে সংকীর্ণ পাথুরে তাক।
মৃত্যু এলাকা
দুজনেই গায়ে চাপিয়েছেন আট প্রস্থ পোশাক, হাতে দস্তানা। পিঠে ৪০ পাউন্ডের অক্সিজেন ট্যাংক। উচ্চতার কারণে বাতাস এখানে অনেক হালকা। মানে এখানে অক্সিজেনের ঘাটতি আছে। কিন্তু পর্বতারোহীদের বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি অক্সিজেন দরকার, অন্তত ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। অনেকে এই উচ্চতাকে এভারেস্টের ডেথ জোনের শুরু বলে উল্লেখ করেন।
বরফ ভেঙে এগোনোর সময় হিলারির নিশ্বাস নিতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের নলের ভেতর বরফ জমতে শুরু করেছে যে। একটু পরপরই নল পরিষ্কার করছেন দুজনেই।
অনেকটা যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলেছেন। শুধু জানেন, যেভাবে হোক চূড়ায় পৌঁছাতে হবে। পরে হিলারি অকপটে বলেছিলেন, ‘আমরা কল্পনাও করতে পারছিলাম না, কোনো মানুষের পক্ষে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব।’
বড় বাধা
দুই অভিযাত্রী এক সময় চল্লিশ ফুট উঁচু একটা পাথরের দেয়ালের সামনে চলে এলেন। তাঁদের শরীরের এমন অবস্থা, সরাসরি দেয়ালের ওপর চড়া অসম্ভব।
হিলারির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। জুতার স্পাইক ব্যবহার করে পাথরের দেয়াল এবং একটা তাকের মাঝখান দিয়ে উঠতে শুরু করলেন। এক সময় দেয়ালের ওপর পৌঁছে গেলেন। তারপর তেনজিংকে দড়ি ধরে টেনে ওপরে তুললেন। আবার শুরু হলো বরফ ভেঙে পাহাড়ের ওপর ওঠা।
একেবারে ওপরে
কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। চলার গতি ধীর হয়ে এসেছে। ধৈর্যের শেষ সীমায় যেন পৌঁছে গেছেন তাঁরা। তবে ঢাল বেয়ে শেষ অংশটা পেরিয়ে হঠাৎই পৌঁছে গেলেন একেবারে ওপরে, শিখরে। তাঁরা এখন এভারেস্টের চূড়ায়।
দুজন মানুষ পরস্পরকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলেন, একে অপরের হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন পাগলের মতো। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে হিলারি কিছু ছবি তুললেন। তেনজিং শেরপাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে বাস করা দেবতাদের জন্য বরফ খুঁড়ে কিছু চকলেট এবং বিস্কুট রাখলেন। এগুলো তাঁদের জন্য উপহার।
পনেরো মিনিট পর এভারেস্টের চূড়ার মনোমুগ্ধকর, রাজকীয় দৃশ্যকে বিদায় জানিয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন দুজনে। তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এমন এক জায়গায় গিয়েছেন, যেখানে তাঁদের আগে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। এমন দৃশ্য দেখেছেন, যা আগে কেউ দেখেনি।
ম্যালরি ও আরভিন
কারও কারও ধারণা প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন হিলারি-তেনজিং নন, ম্যালরি-আরভিন। এমন অদ্ভুত ধারণার কারণ কী, তাই জানার চেষ্টা করছি এবার। তবে শুরুতে ম্যালরি কে অল্প কথায় তা জেনে নিই আগে।
এক শ বছর আগের ঘটনা। ইংল্যান্ডের এক যাজকের ছেলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের। তিন বছর বাদে পর্বতের চূড়ার কাছাকাছি থেকে অদৃশ্য হন তিনি। তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালে। সেই সঙ্গে জর্জ ম্যালরি জন্ম দিলেন এক চিরস্থায়ী তর্কের, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় আসলে কে প্রথম পা রেখেছিলেন?
১৮৮৬ সালের জুনে মবারলেতে জর্জ ম্যালরির জন্ম। বাবা হারবার্ট লেইফ এবং মা অ্যানি ব্যারিজ। ওয়েস্ট কিরবি এবং এস্টাবর্নের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন ম্যালরি। তার পর উইনচেস্টার কলেজে গণিতে বৃত্তি পান। এখানেই পর্বত আরোহণের নেশা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাঁর, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন নিয়তির দিকে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন ম্যালরি। তারপর সেখানেই শিক্ষকতা করেন কিছুদিন। একই সঙ্গে পর্বতারোহণে আরও শাণিত করে তুলতে থাকেন নিজেকে। তারপর ব্রিটিশ সেনাদলে নাম লেখান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পরই মাউন্ট এভারেস্ট পেয়ে বসল তাঁকে। জীবনের বাকি সময়টা পর্বতটা মোহাবিষ্ট করে রাখল ম্যালরিকে।
১৯২১। নেপাল-তিব্বত সীমান্তে পর্বতটির চূড়ায় পৌঁছার একটি পথের খোঁজে প্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলে নাম লেখান জর্জ ম্যালরি। দলনেতা ছিলেন চার্লস হাওয়ার্ড বারি। আগে কখনো হিমালয় অভিযানে যাননি ম্যালরি। কিন্তু কী আশ্চর্য! অভিযান শুরুর পর দেখা গেল অলিখিতভাবে গোটা দলের নেতৃত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পর্বত এলাকাটির বহু কাঙ্ক্ষিত একটি মানচিত্রও তৈরি করা হলো এই অভিযানেই।
স্কুলের বন্ধু গাই বুলক এবং সেনা জরিপকারী অলিভার হুইলারসহ দুর্গম লাকপা লাপাস এবং পুব রংবাক উপত্যকায় অভিযান চালান ম্যালরি। এই তিন দুঃসাহসী অভিযাত্রীই প্রথম পর্বতটির উত্তর প্রান্তে পৌঁছান। এই অভিযানেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের সম্ভাব্য একটি পথ আবিষ্কারে সফল হন ম্যালরি।
১৯২২ সালের অভিযানেও ছিলেন তিনি, যেটাকে বিবেচনা করা হয় এভারেস্ট জয়ের প্রথম সত্যিকারের প্রচেষ্টা হিসেবে। দলনেতা ছিলেন জেনারেল চার্লস ব্রুস। এক বছর আগে ম্যালরি যে পথটির সন্ধান পেয়েছিলেন, ওটাই অনুসরণ করছিলেন অভিযাত্রীরা। এই অভিযানেই প্রথম বোতলজাত অক্সিজেন সঙ্গে নেন পর্বতারোহীরা। ওই সময় রেকর্ড ৮ হাজার ৩২৬ মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পরে দলটি।
তবে অভিযানটির পরিসমাপ্তি ঘটে বিয়োগান্ত এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ম্যালরির সঙ্গে থাকা সাতজন মুটে হিমবাহ পতনে মারা যান। ম্যালরিকে দল পরিচালনায় আরও বেশি সতর্ক হতে হতো—এমন অভিযোগ তোলেন তখন কোনো কোনো পর্বতারোহী। এর পর স্ত্রী রুথ এবং তিন সন্তানকে নিয়ে চমৎকার দিন কাটছিল ম্যালরির। তবে এভারেস্টের নেশা একবার যাকে পায়, তিনি এর ডাক অগ্রাহ্য করেন কীভাবে?
১৯২৪ সালে তৃতীয়বারের মতো এভারেস্ট রোমাঞ্চে শামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ম্যালরি। অভিযান শুরুর আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় মানুষ কেন এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করে? তাঁর ছোট্ট উত্তর ছিল, ‘কারণ ওটা ওখানে আছে।’ যা, পর্বতারোহণের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তিতে পরিণত হয় কালক্রমে। তবে ম্যালরির জানা ছিল না, এটাই তাঁর শেষ এভারেস্টযাত্রা। আর কখনো দেখা হবে না প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা আদরের সন্তানদের সঙ্গে। জুনের সেই বিখ্যাত অভিযানের সময় তাঁর বয়স ৩৭।
এবারের অভিযাত্রী দলের নেতাও ছিলেন জেনারেল ব্রুস। অভিযানে অন্যদের পাশাপাশি ম্যালরির সঙ্গে যোগ দেন বার্কেনহেডের অ্যান্ড্রু আরভিন। পর্বতারোহী হিসেবে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন না আরভিন। তবে ২২ বছরের এই টগবগে তরুণের অভিধানে ‘পিছু হটা’ শব্দ দুটো ছিলই না। ওই অভিযানেও অক্সিজেন ব্যবহার করেছিলেন পর্বতারোহীরা। আর তা ব্যবহারে ও পরিচালনায় দারুণ দক্ষ ছিলেন প্রকৌশলী আরভিন।
তারিখটা ছিল জুনের ৮। এভারেস্টের চূড়ার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে উঁচু ক্যাম্প ছাড়লেন ম্যালরি এবং আরভিন। কিন্তু আর ফিরে এলেন না। দ্রুতই এভারেস্টে হারিয়ে যাওয়া পর্বতারোহীদের তালিকায় নাম উঠল তাদের।
মূল অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিলেন ভূ-তাত্ত্বিক নোয়েল ওডেল। দুই পর্বতারোহীকে শেষবার দেখার দাবি তাঁরই। অল্প সময়ের জন্য যখন মেঘ সরে গিয়েছিল তখন ম্যালরি এবং আরভিনকে দেখেন তিনি, চূড়া থেকে কেবল কয়েকশ গজ দূরে।
পরে নোয়েল লিখেন, ‘৮ জুন, বেলা সাড়ে বারোটা। হঠাৎ আবহাওয়া একটু পরিষ্কার হয়ে গেল। এভারেস্টের চূড়া এবং চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল খুদে একটা কালো ছায়ায়, একটা পাথরের ওপাশে ছোট্ট একটা তুষার চূড়ায়। কালো বিন্দুটা নড়ে উঠল। অপর একটি কালো বিন্দু রওনা হলো আগেরটাকে লক্ষ্য করে।
প্রথম ছায়াটি পাথরের ধাপ ধরে ওপরে উঠে গেল। পরের ছায়ামূর্তিটাও তাই করল। তারপরই অসাধারণ এই দৃশ্যপট অদৃশ্য হলো। কারণ, আবারও মেঘ ঘিরে ধরেছে চারপাশ।’
রহস্যের সমাধান হয়নি আজও
আরভিনের বরফ কাটার কুঠারটা খুঁজে পাওয়া গেল ১৯৩৩ সালে, ৮ হাজার ৪৬০ মিটার উচ্চতায়। ১৯৭৫ সালে এ ব্রিটিশ অভিযাত্রীর মরদেহ আবিষ্কারের দাবি তোলেন এক চীনা অভিযাত্রী। এর ২২ বছর আগেই হিলারি এবং তেনজিং এভারেস্ট জয় করে বসে আছেন।
১৯৯৯ সাল। আমেরিকান পর্বতারোহী কনরাড অ্যাঙ্কার পর্বতের উত্তর ঢালে বরফে জমে যাওয়া এবং চমৎকার সংরক্ষিত এক মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। যেখানে কুঠারটা পাওয়া গিয়েছিল এর কয়েক শ মিটার নিচে পাওয়া যায় মৃতদেহটি।
মৃতদেহটির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এর কলারের একটা ট্যাগ দেখে। সেখানে লেখা ছিল জি ম্যালরি! কোমরে দড়ির শক্ত দাগ পাওয়া যায় মৃতদেহটির। এতে বোঝা যায় আছড়ে পড়ার আগে দড়িতে বেঁধে আরভিনের সঙ্গে আটকানো ছিল তাঁর শরীর। মাথায়ও একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল তাঁর। ম্যালরির সঙ্গে কিছু খুঁটিনাটি জিনিসও মেলে। এগুলোর মধ্যে ছিল একটি আল্টিমিটার, একটি চিরকুট ও পর্বতারোহণের যন্ত্রপাতির একটি রশিদ। তবে এমন কয়েকটি সূত্র পাওয়া গেল, যেটা তাঁরা সত্যি চূড়ায় পৌঁছেছিলেন কিনা, সে বিষয়টি আগাগোড়ার রহস্যের জালে আটকে দিল।
ম্যালরির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি ছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ছবিটা চূড়ায় রেখে আসবেন। কিন্তু ওই ছবিটার খুঁজে পাওয়া গেল না। ওডেলের চোখ যদি বেইমানি না করে, তবে ফিরে আসছিলেন তাঁরা। তাঁদের এই অভিযানের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করতে দুই অভিযাত্রী একটা ক্যামেরা নিয়েছিলেন সঙ্গে। ওটারও খোঁজ মেলেনি।
ম্যালরির মৃতদেহ আবিষ্কারের ২০ বছর পরও এভারেস্টের বড় এক রহস্য হয়েই রইল অভিযানটি। ম্যালরি এবং আরভিন সত্যি চূড়াজয় করেছিলেন কি না, এই নিয়ে এভারেস্টপ্রেমী এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে তর্ক বাধে নিয়মিতই।
আজও পর্বতারোহীরা হন্যে হয়ে খোঁজেন আরভিনের দেহ। তাঁদের আশা এর সঙ্গে মিলবে তাঁর ক্যামেরাখানা, যা প্রমাণ করবে এক যাজকের ছেলে এবং তার বার্কেনহেডের অভিযানসঙ্গী সত্যি প্রথম মানুষ হিসাবে পা রেখেছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের চূড়ায়।
ইশতিয়াক হাসান

রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি আমার আগ্রহটা বরাবরই প্রবল। তাই এই দিনটিতে স্যার এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর সেই অ্যাডভেঞ্চারের ঘটনা চিন্তা করে শিহরিত হই। একই সঙ্গে মন ভার হয়ে যায় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। একই সঙ্গে মাঝেমধ্যে এ প্রশ্নও মনকে খোঁচায়—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন? এভারেস্ট জয়ের ৬৯ বছর পূর্তি আজ। বিশেষ এই দিনটিতে হিলারি-তেনজিংয়ের সেই রোমাঞ্চগাথার সঙ্গে স্মরণ করব ম্যালরি ও আরভিনকেও।
এই সেই দিন
তাঁবু থেকে বের হয়ে আসা দুজন মানুষ আধবোজা চোখে তাকালেন। আশ্চর্য সুন্দর একটি দৃশ্য ধরা দিল তাঁদের চোখে। সকালের সোনা রোদে বরফে আবৃত চূড়াটি জ্বলজ্বল করছে।
পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশিখর মাউন্ট এভারেস্টের পাঁচ মাইলেরও বেশি উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। একটু আগেই ষাট মাইলের বেশি গতিতে আঘাত হানছিল কনকনে হাওয়া। এখন প্রকৃতি অনেকটাই শান্ত। তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা। যেন শরীরের হাড়-মাংসে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। দিনটা ১৯৫৩ সালের ২৯ মে। এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখার আশা করছেন।
তবে এ পর্যন্ত আসাটা মোটেই সহজ হয়নি। কয়েকবারই ভয়ানক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একবার তো হিলারি মরতে বসেছিলেন।
এক মাস আগের কথা সেটা। রশি ধরে এগোবার সময় একটি বরফ ধস পড়ল সামনে। ফাটলটা এত বড় যে হেঁটে অতিক্রম অসম্ভব। এসব ক্ষেত্রে পর্বতারোহীরা সাধারণত যা করেন, সামনে থাকা হিলারি তাই করলেন। বরফের একটা বড়সড় চাঙর এনে ফাটলের ওপর বসিয়ে দিলেন। কিন্তু বরফের চাঁইটায় পা দেওয়ামাত্র ওটা ভেঙে পড়ল। টুকরোটাসহ ফাটলের ভেতর গড়িয়ে পড়লেন হিলারি।
তবে নিচে পড়বার সময় শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেললেন হিলারি। এটা বরফের ফাটলের মাঝখানে আটকে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল তাঁকে। সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখেও মাথা ঠান্ডা রাখলেন তেনজিং। সঙ্গের কুঠারটাকে বরফে গেঁথে, দড়িটা পেঁচিয়ে ফেললেন এতে। এক মুহূর্ত পরই রশিটায় টান পড়ল। কোমরে প্যাঁচানো দড়িতে টান পড়ায় থামল হিলারির পতন। বরফের দুই দেয়ালের মাঝে শূন্যে ঘুরপাক খেতে লাগলেন। বরফের চাঙরটা ফাটলের নিচে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে বিধ্বস্ত হলো। তেনজিং তৎপর না হলে হিলারির অবস্থাও হতো ওই বরফের টুকরোটার মতোই।
দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা
দুজনে ভিন্ন দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। এডমন্ড হিলারি নিজের দেশ নিউজিল্যান্ডে মৌমাছির চাষ করতেন। অন্যদিকে তেনজিং নোরগে একজন শেরপা। নেপালের হিমালয় অঞ্চলে বাস করেন শেরপা জাতির লোকেরা। পর্বতের গাইড হিসেবে এঁদের জুড়ি মেলা ভার। তবে একটি বিষয়ে দুজনের বড় মিল, পর্বতারোহণের নেশা। হিলারি এর আগেও দুবার হিমালয় অভিযানে এসেছেন। এদিকে তেনজিং তো ছয়বার এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। চেমালুংমার (এভারেস্টের আরেক নাম) চূড়ায় পৌঁছার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি। দুটোই তাঁদের আছে। একজনের ক্ষমতার প্রতি অপরজনের আস্থাও অবিচল।
হিমবাহ ধস, প্রচণ্ড ঠান্ডায় সৃষ্ট ফ্রস্টবাইট, আচমকা শুরু হওয়া বরফ-ঝড়, অক্সিজেনের স্বল্পতা—এভারেস্ট জয়ের পথে বাধা হয়ে থাকা এসব বিপদের কথা অজানা নয় কারওরই। কয়েক দিন আগেই চূড়ায় উঠতে ব্যর্থ তিন পর্বতারোহী ফিরে এসেছেন। বিপর্যস্ত তিন অভিযাত্রী হিলারি-তেনজিংকে সতর্ক করে দিয়েছেন সামনের বিপজ্জনক পথ সম্পর্কে। তবে এত সব বিপদের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন দুজনে।
২৯ মে। সকাল ৬টা ৩০ মিনিট। হিলারি তেনজিং নোরগেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব ঠিক আছে তো?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’ আর মাত্র ১১০০ ফুট, তারপরই ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবেন তাঁরা।
ভয়ংকর পথ
তাঁদের হিমালয়ের সবচেয়ে উঁচু এই পর্বত জয়ের অভিযানের শুরু মার্চের ১০ তারিখ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল স্যার জন হান্ট ১৪ অভিযাত্রী, ৩৬ শেরপা এবং মালামাল বহন করা ৩৬০ জন কুলির দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
হিলারি, তেনজিংসহ দলের বাকি সদস্যরা নেপালের কাঠমাণ্ডু থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তাঁরা গাছপালায় ঠাসা বর্ণিল পাহাড়ি এলাকা ধরে এগোলেন। দুপাশে ছোট ছোট খামার-বাড়ি মুগ্ধ করছে অভিযাত্রীদের। ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভূ-প্রকৃতি বদলাতে লাগল। তারপরই খাড়া, দুরারোহ পর্বত সারি হঠাৎই প্রমত্ত একটা নদীকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।
নদী পেরোতে পাথর ও বাঁশ দিয়ে দুর্বল, নড়বড়ে একটা সেতু তৈরি করে নিতে হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি এবং গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে হাজির হওয়া ভিমরুলের ঝাঁক চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। হাঁটার গতি কমে গেল অভিযাত্রীদের।
পুব দিকে বেশ কিছুটা পথ এগোল দলটা। এ সময়ই দেখা দিলেন সাগরমাতা। পর্বতারোহীদের মনে হলো, আকাশের গায়ে ঝুলে আছে ওটা। ১২ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় বেজ ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। এখান থেকে পর্বতের ওপরের দিকে উঠবেন তাঁরা।
বরফ কেটে ওপরের দিকে যেতে হবে। তাই বেজ ক্যাম্পে কয়েক সপ্তাহ যাত্রাবিরতি করতে হলো দলটিকে। এরই মধ্যে একদিন হিলারির নেতৃত্বে ছোট্ট একটি দল খুমবু হিমবাহে অভিযান চালাল।
‘মানুষের দেখা সবচেয়ে বীভৎস ও নিষিদ্ধ দৃশ্যগুলোর একটি’—খুমবু হিমবাহকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালরি। পরে এই এলাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সে যাক, একপর্যায়ে সঙ্গীসহ হিলারি বরফের বড় একটা মাঠের সামনে চলে এলেন।
এখানে প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত ও ওলটপালটভাবে হিমবাহ বা বরফের চাঙরের ধস নেমে আসছে। আশপাশের বরফঢাকা জমিতে একটু পরপরই ফাটল তৈরি হচ্ছে। যেকোনো সময় পায়ের নিচের বরফ ফাঁক হয়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই ভয়ানক বিপৎসংকুল এলাকার মধ্য দিয়ে পথ করে এগোলেন হিলারি। তাঁকে অনুসরণ করল অন্যরা।
এই বিক্ষুব্ধ বরফ রাজ্যে একটা পথ খুঁজে বের করলেন হিলারি। ১৯ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় ঘাঁটি গাড়লেন সবাই। এই পথ ধরে চলার সময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দে অনবরত বরফের চাঁই স্থান বদলাচ্ছে, এমন একটি জায়গার নাম হলো, ‘অ্যাটম বম্ব’। এই সেই জায়গা যেখানে বরফের ফাটলের মধ্যে পড়ে হিলারির অভিযান এবং জীবন দুটোই সাঙ্গ হতে বসেছিল।
চূড়ান্ত যাত্রা
হিলারি এবং তেনজিং চূড়ায় পৌঁছাতে চূড়ান্তযাত্রা শুরু করলেন। আগের মতোই কোমরে বাঁধা দড়ি তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তেনজিং এবার সামনে, হিলারি পেছনে। খুব সরু, কেবল কয়েক ফুট চওড়া একটি শৈলশিরা ধরে ওপরে উঠছেন দুই পর্বতারোহী। নরম তুষার এই চলাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। একপর্যায়ে সামনে এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
একসময় নরম তুষারের রাজ্য শেষ হলো। এর জায়গা নিল তুলনামূলক শক্ত বরফ। বরফে পা ফেলে একটু নিশ্চিন্তে এগোতে পারছেন দুজনে। তবে সতর্কতায় ঢিল দেননি। তাঁদের ডানে বরফের মোচড়ানো কার্নিশ, পাশ থেকেই পর্বতের কিনারা খাড়া নেমে গেছে ৮ হাজার ফুট। বামে সংকীর্ণ পাথুরে তাক।
মৃত্যু এলাকা
দুজনেই গায়ে চাপিয়েছেন আট প্রস্থ পোশাক, হাতে দস্তানা। পিঠে ৪০ পাউন্ডের অক্সিজেন ট্যাংক। উচ্চতার কারণে বাতাস এখানে অনেক হালকা। মানে এখানে অক্সিজেনের ঘাটতি আছে। কিন্তু পর্বতারোহীদের বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি অক্সিজেন দরকার, অন্তত ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। অনেকে এই উচ্চতাকে এভারেস্টের ডেথ জোনের শুরু বলে উল্লেখ করেন।
বরফ ভেঙে এগোনোর সময় হিলারির নিশ্বাস নিতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের নলের ভেতর বরফ জমতে শুরু করেছে যে। একটু পরপরই নল পরিষ্কার করছেন দুজনেই।
অনেকটা যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলেছেন। শুধু জানেন, যেভাবে হোক চূড়ায় পৌঁছাতে হবে। পরে হিলারি অকপটে বলেছিলেন, ‘আমরা কল্পনাও করতে পারছিলাম না, কোনো মানুষের পক্ষে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব।’
বড় বাধা
দুই অভিযাত্রী এক সময় চল্লিশ ফুট উঁচু একটা পাথরের দেয়ালের সামনে চলে এলেন। তাঁদের শরীরের এমন অবস্থা, সরাসরি দেয়ালের ওপর চড়া অসম্ভব।
হিলারির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। জুতার স্পাইক ব্যবহার করে পাথরের দেয়াল এবং একটা তাকের মাঝখান দিয়ে উঠতে শুরু করলেন। এক সময় দেয়ালের ওপর পৌঁছে গেলেন। তারপর তেনজিংকে দড়ি ধরে টেনে ওপরে তুললেন। আবার শুরু হলো বরফ ভেঙে পাহাড়ের ওপর ওঠা।
একেবারে ওপরে
কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। চলার গতি ধীর হয়ে এসেছে। ধৈর্যের শেষ সীমায় যেন পৌঁছে গেছেন তাঁরা। তবে ঢাল বেয়ে শেষ অংশটা পেরিয়ে হঠাৎই পৌঁছে গেলেন একেবারে ওপরে, শিখরে। তাঁরা এখন এভারেস্টের চূড়ায়।
দুজন মানুষ পরস্পরকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলেন, একে অপরের হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন পাগলের মতো। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে হিলারি কিছু ছবি তুললেন। তেনজিং শেরপাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে বাস করা দেবতাদের জন্য বরফ খুঁড়ে কিছু চকলেট এবং বিস্কুট রাখলেন। এগুলো তাঁদের জন্য উপহার।
পনেরো মিনিট পর এভারেস্টের চূড়ার মনোমুগ্ধকর, রাজকীয় দৃশ্যকে বিদায় জানিয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন দুজনে। তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এমন এক জায়গায় গিয়েছেন, যেখানে তাঁদের আগে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। এমন দৃশ্য দেখেছেন, যা আগে কেউ দেখেনি।
ম্যালরি ও আরভিন
কারও কারও ধারণা প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন হিলারি-তেনজিং নন, ম্যালরি-আরভিন। এমন অদ্ভুত ধারণার কারণ কী, তাই জানার চেষ্টা করছি এবার। তবে শুরুতে ম্যালরি কে অল্প কথায় তা জেনে নিই আগে।
এক শ বছর আগের ঘটনা। ইংল্যান্ডের এক যাজকের ছেলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের। তিন বছর বাদে পর্বতের চূড়ার কাছাকাছি থেকে অদৃশ্য হন তিনি। তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালে। সেই সঙ্গে জর্জ ম্যালরি জন্ম দিলেন এক চিরস্থায়ী তর্কের, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় আসলে কে প্রথম পা রেখেছিলেন?
১৮৮৬ সালের জুনে মবারলেতে জর্জ ম্যালরির জন্ম। বাবা হারবার্ট লেইফ এবং মা অ্যানি ব্যারিজ। ওয়েস্ট কিরবি এবং এস্টাবর্নের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন ম্যালরি। তার পর উইনচেস্টার কলেজে গণিতে বৃত্তি পান। এখানেই পর্বত আরোহণের নেশা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাঁর, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন নিয়তির দিকে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন ম্যালরি। তারপর সেখানেই শিক্ষকতা করেন কিছুদিন। একই সঙ্গে পর্বতারোহণে আরও শাণিত করে তুলতে থাকেন নিজেকে। তারপর ব্রিটিশ সেনাদলে নাম লেখান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পরই মাউন্ট এভারেস্ট পেয়ে বসল তাঁকে। জীবনের বাকি সময়টা পর্বতটা মোহাবিষ্ট করে রাখল ম্যালরিকে।
১৯২১। নেপাল-তিব্বত সীমান্তে পর্বতটির চূড়ায় পৌঁছার একটি পথের খোঁজে প্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলে নাম লেখান জর্জ ম্যালরি। দলনেতা ছিলেন চার্লস হাওয়ার্ড বারি। আগে কখনো হিমালয় অভিযানে যাননি ম্যালরি। কিন্তু কী আশ্চর্য! অভিযান শুরুর পর দেখা গেল অলিখিতভাবে গোটা দলের নেতৃত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পর্বত এলাকাটির বহু কাঙ্ক্ষিত একটি মানচিত্রও তৈরি করা হলো এই অভিযানেই।
স্কুলের বন্ধু গাই বুলক এবং সেনা জরিপকারী অলিভার হুইলারসহ দুর্গম লাকপা লাপাস এবং পুব রংবাক উপত্যকায় অভিযান চালান ম্যালরি। এই তিন দুঃসাহসী অভিযাত্রীই প্রথম পর্বতটির উত্তর প্রান্তে পৌঁছান। এই অভিযানেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের সম্ভাব্য একটি পথ আবিষ্কারে সফল হন ম্যালরি।
১৯২২ সালের অভিযানেও ছিলেন তিনি, যেটাকে বিবেচনা করা হয় এভারেস্ট জয়ের প্রথম সত্যিকারের প্রচেষ্টা হিসেবে। দলনেতা ছিলেন জেনারেল চার্লস ব্রুস। এক বছর আগে ম্যালরি যে পথটির সন্ধান পেয়েছিলেন, ওটাই অনুসরণ করছিলেন অভিযাত্রীরা। এই অভিযানেই প্রথম বোতলজাত অক্সিজেন সঙ্গে নেন পর্বতারোহীরা। ওই সময় রেকর্ড ৮ হাজার ৩২৬ মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পরে দলটি।
তবে অভিযানটির পরিসমাপ্তি ঘটে বিয়োগান্ত এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ম্যালরির সঙ্গে থাকা সাতজন মুটে হিমবাহ পতনে মারা যান। ম্যালরিকে দল পরিচালনায় আরও বেশি সতর্ক হতে হতো—এমন অভিযোগ তোলেন তখন কোনো কোনো পর্বতারোহী। এর পর স্ত্রী রুথ এবং তিন সন্তানকে নিয়ে চমৎকার দিন কাটছিল ম্যালরির। তবে এভারেস্টের নেশা একবার যাকে পায়, তিনি এর ডাক অগ্রাহ্য করেন কীভাবে?
১৯২৪ সালে তৃতীয়বারের মতো এভারেস্ট রোমাঞ্চে শামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ম্যালরি। অভিযান শুরুর আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় মানুষ কেন এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করে? তাঁর ছোট্ট উত্তর ছিল, ‘কারণ ওটা ওখানে আছে।’ যা, পর্বতারোহণের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তিতে পরিণত হয় কালক্রমে। তবে ম্যালরির জানা ছিল না, এটাই তাঁর শেষ এভারেস্টযাত্রা। আর কখনো দেখা হবে না প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা আদরের সন্তানদের সঙ্গে। জুনের সেই বিখ্যাত অভিযানের সময় তাঁর বয়স ৩৭।
এবারের অভিযাত্রী দলের নেতাও ছিলেন জেনারেল ব্রুস। অভিযানে অন্যদের পাশাপাশি ম্যালরির সঙ্গে যোগ দেন বার্কেনহেডের অ্যান্ড্রু আরভিন। পর্বতারোহী হিসেবে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন না আরভিন। তবে ২২ বছরের এই টগবগে তরুণের অভিধানে ‘পিছু হটা’ শব্দ দুটো ছিলই না। ওই অভিযানেও অক্সিজেন ব্যবহার করেছিলেন পর্বতারোহীরা। আর তা ব্যবহারে ও পরিচালনায় দারুণ দক্ষ ছিলেন প্রকৌশলী আরভিন।
তারিখটা ছিল জুনের ৮। এভারেস্টের চূড়ার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে উঁচু ক্যাম্প ছাড়লেন ম্যালরি এবং আরভিন। কিন্তু আর ফিরে এলেন না। দ্রুতই এভারেস্টে হারিয়ে যাওয়া পর্বতারোহীদের তালিকায় নাম উঠল তাদের।
মূল অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিলেন ভূ-তাত্ত্বিক নোয়েল ওডেল। দুই পর্বতারোহীকে শেষবার দেখার দাবি তাঁরই। অল্প সময়ের জন্য যখন মেঘ সরে গিয়েছিল তখন ম্যালরি এবং আরভিনকে দেখেন তিনি, চূড়া থেকে কেবল কয়েকশ গজ দূরে।
পরে নোয়েল লিখেন, ‘৮ জুন, বেলা সাড়ে বারোটা। হঠাৎ আবহাওয়া একটু পরিষ্কার হয়ে গেল। এভারেস্টের চূড়া এবং চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল খুদে একটা কালো ছায়ায়, একটা পাথরের ওপাশে ছোট্ট একটা তুষার চূড়ায়। কালো বিন্দুটা নড়ে উঠল। অপর একটি কালো বিন্দু রওনা হলো আগেরটাকে লক্ষ্য করে।
প্রথম ছায়াটি পাথরের ধাপ ধরে ওপরে উঠে গেল। পরের ছায়ামূর্তিটাও তাই করল। তারপরই অসাধারণ এই দৃশ্যপট অদৃশ্য হলো। কারণ, আবারও মেঘ ঘিরে ধরেছে চারপাশ।’
রহস্যের সমাধান হয়নি আজও
আরভিনের বরফ কাটার কুঠারটা খুঁজে পাওয়া গেল ১৯৩৩ সালে, ৮ হাজার ৪৬০ মিটার উচ্চতায়। ১৯৭৫ সালে এ ব্রিটিশ অভিযাত্রীর মরদেহ আবিষ্কারের দাবি তোলেন এক চীনা অভিযাত্রী। এর ২২ বছর আগেই হিলারি এবং তেনজিং এভারেস্ট জয় করে বসে আছেন।
১৯৯৯ সাল। আমেরিকান পর্বতারোহী কনরাড অ্যাঙ্কার পর্বতের উত্তর ঢালে বরফে জমে যাওয়া এবং চমৎকার সংরক্ষিত এক মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। যেখানে কুঠারটা পাওয়া গিয়েছিল এর কয়েক শ মিটার নিচে পাওয়া যায় মৃতদেহটি।
মৃতদেহটির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এর কলারের একটা ট্যাগ দেখে। সেখানে লেখা ছিল জি ম্যালরি! কোমরে দড়ির শক্ত দাগ পাওয়া যায় মৃতদেহটির। এতে বোঝা যায় আছড়ে পড়ার আগে দড়িতে বেঁধে আরভিনের সঙ্গে আটকানো ছিল তাঁর শরীর। মাথায়ও একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল তাঁর। ম্যালরির সঙ্গে কিছু খুঁটিনাটি জিনিসও মেলে। এগুলোর মধ্যে ছিল একটি আল্টিমিটার, একটি চিরকুট ও পর্বতারোহণের যন্ত্রপাতির একটি রশিদ। তবে এমন কয়েকটি সূত্র পাওয়া গেল, যেটা তাঁরা সত্যি চূড়ায় পৌঁছেছিলেন কিনা, সে বিষয়টি আগাগোড়ার রহস্যের জালে আটকে দিল।
ম্যালরির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি ছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ছবিটা চূড়ায় রেখে আসবেন। কিন্তু ওই ছবিটার খুঁজে পাওয়া গেল না। ওডেলের চোখ যদি বেইমানি না করে, তবে ফিরে আসছিলেন তাঁরা। তাঁদের এই অভিযানের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করতে দুই অভিযাত্রী একটা ক্যামেরা নিয়েছিলেন সঙ্গে। ওটারও খোঁজ মেলেনি।
ম্যালরির মৃতদেহ আবিষ্কারের ২০ বছর পরও এভারেস্টের বড় এক রহস্য হয়েই রইল অভিযানটি। ম্যালরি এবং আরভিন সত্যি চূড়াজয় করেছিলেন কি না, এই নিয়ে এভারেস্টপ্রেমী এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে তর্ক বাধে নিয়মিতই।
আজও পর্বতারোহীরা হন্যে হয়ে খোঁজেন আরভিনের দেহ। তাঁদের আশা এর সঙ্গে মিলবে তাঁর ক্যামেরাখানা, যা প্রমাণ করবে এক যাজকের ছেলে এবং তার বার্কেনহেডের অভিযানসঙ্গী সত্যি প্রথম মানুষ হিসাবে পা রেখেছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের চূড়ায়।

রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি আমার আগ্রহটা বরাবরই প্রবল। তাই এই দিনটিতে স্যার এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর সেই অ্যাডভেঞ্চারের ঘটনা চিন্তা করে শিহরিত হই। একই সঙ্গে মন ভার হয়ে যায় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। একই সঙ্গে মাঝেমধ্যে এ প্রশ্নও মনকে খোঁচায়—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন? এভারেস্ট জয়ের ৬৯ বছর পূর্তি আজ। বিশেষ এই দিনটিতে হিলারি-তেনজিংয়ের সেই রোমাঞ্চগাথার সঙ্গে স্মরণ করব ম্যালরি ও আরভিনকেও।
এই সেই দিন
তাঁবু থেকে বের হয়ে আসা দুজন মানুষ আধবোজা চোখে তাকালেন। আশ্চর্য সুন্দর একটি দৃশ্য ধরা দিল তাঁদের চোখে। সকালের সোনা রোদে বরফে আবৃত চূড়াটি জ্বলজ্বল করছে।
পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশিখর মাউন্ট এভারেস্টের পাঁচ মাইলেরও বেশি উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। একটু আগেই ষাট মাইলের বেশি গতিতে আঘাত হানছিল কনকনে হাওয়া। এখন প্রকৃতি অনেকটাই শান্ত। তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা। যেন শরীরের হাড়-মাংসে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। দিনটা ১৯৫৩ সালের ২৯ মে। এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখার আশা করছেন।
তবে এ পর্যন্ত আসাটা মোটেই সহজ হয়নি। কয়েকবারই ভয়ানক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একবার তো হিলারি মরতে বসেছিলেন।
এক মাস আগের কথা সেটা। রশি ধরে এগোবার সময় একটি বরফ ধস পড়ল সামনে। ফাটলটা এত বড় যে হেঁটে অতিক্রম অসম্ভব। এসব ক্ষেত্রে পর্বতারোহীরা সাধারণত যা করেন, সামনে থাকা হিলারি তাই করলেন। বরফের একটা বড়সড় চাঙর এনে ফাটলের ওপর বসিয়ে দিলেন। কিন্তু বরফের চাঁইটায় পা দেওয়ামাত্র ওটা ভেঙে পড়ল। টুকরোটাসহ ফাটলের ভেতর গড়িয়ে পড়লেন হিলারি।
তবে নিচে পড়বার সময় শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেললেন হিলারি। এটা বরফের ফাটলের মাঝখানে আটকে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল তাঁকে। সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখেও মাথা ঠান্ডা রাখলেন তেনজিং। সঙ্গের কুঠারটাকে বরফে গেঁথে, দড়িটা পেঁচিয়ে ফেললেন এতে। এক মুহূর্ত পরই রশিটায় টান পড়ল। কোমরে প্যাঁচানো দড়িতে টান পড়ায় থামল হিলারির পতন। বরফের দুই দেয়ালের মাঝে শূন্যে ঘুরপাক খেতে লাগলেন। বরফের চাঙরটা ফাটলের নিচে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে বিধ্বস্ত হলো। তেনজিং তৎপর না হলে হিলারির অবস্থাও হতো ওই বরফের টুকরোটার মতোই।
দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা
দুজনে ভিন্ন দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। এডমন্ড হিলারি নিজের দেশ নিউজিল্যান্ডে মৌমাছির চাষ করতেন। অন্যদিকে তেনজিং নোরগে একজন শেরপা। নেপালের হিমালয় অঞ্চলে বাস করেন শেরপা জাতির লোকেরা। পর্বতের গাইড হিসেবে এঁদের জুড়ি মেলা ভার। তবে একটি বিষয়ে দুজনের বড় মিল, পর্বতারোহণের নেশা। হিলারি এর আগেও দুবার হিমালয় অভিযানে এসেছেন। এদিকে তেনজিং তো ছয়বার এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। চেমালুংমার (এভারেস্টের আরেক নাম) চূড়ায় পৌঁছার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি। দুটোই তাঁদের আছে। একজনের ক্ষমতার প্রতি অপরজনের আস্থাও অবিচল।
হিমবাহ ধস, প্রচণ্ড ঠান্ডায় সৃষ্ট ফ্রস্টবাইট, আচমকা শুরু হওয়া বরফ-ঝড়, অক্সিজেনের স্বল্পতা—এভারেস্ট জয়ের পথে বাধা হয়ে থাকা এসব বিপদের কথা অজানা নয় কারওরই। কয়েক দিন আগেই চূড়ায় উঠতে ব্যর্থ তিন পর্বতারোহী ফিরে এসেছেন। বিপর্যস্ত তিন অভিযাত্রী হিলারি-তেনজিংকে সতর্ক করে দিয়েছেন সামনের বিপজ্জনক পথ সম্পর্কে। তবে এত সব বিপদের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন দুজনে।
২৯ মে। সকাল ৬টা ৩০ মিনিট। হিলারি তেনজিং নোরগেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব ঠিক আছে তো?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’ আর মাত্র ১১০০ ফুট, তারপরই ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবেন তাঁরা।
ভয়ংকর পথ
তাঁদের হিমালয়ের সবচেয়ে উঁচু এই পর্বত জয়ের অভিযানের শুরু মার্চের ১০ তারিখ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল স্যার জন হান্ট ১৪ অভিযাত্রী, ৩৬ শেরপা এবং মালামাল বহন করা ৩৬০ জন কুলির দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
হিলারি, তেনজিংসহ দলের বাকি সদস্যরা নেপালের কাঠমাণ্ডু থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তাঁরা গাছপালায় ঠাসা বর্ণিল পাহাড়ি এলাকা ধরে এগোলেন। দুপাশে ছোট ছোট খামার-বাড়ি মুগ্ধ করছে অভিযাত্রীদের। ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভূ-প্রকৃতি বদলাতে লাগল। তারপরই খাড়া, দুরারোহ পর্বত সারি হঠাৎই প্রমত্ত একটা নদীকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।
নদী পেরোতে পাথর ও বাঁশ দিয়ে দুর্বল, নড়বড়ে একটা সেতু তৈরি করে নিতে হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি এবং গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে হাজির হওয়া ভিমরুলের ঝাঁক চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। হাঁটার গতি কমে গেল অভিযাত্রীদের।
পুব দিকে বেশ কিছুটা পথ এগোল দলটা। এ সময়ই দেখা দিলেন সাগরমাতা। পর্বতারোহীদের মনে হলো, আকাশের গায়ে ঝুলে আছে ওটা। ১২ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় বেজ ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। এখান থেকে পর্বতের ওপরের দিকে উঠবেন তাঁরা।
বরফ কেটে ওপরের দিকে যেতে হবে। তাই বেজ ক্যাম্পে কয়েক সপ্তাহ যাত্রাবিরতি করতে হলো দলটিকে। এরই মধ্যে একদিন হিলারির নেতৃত্বে ছোট্ট একটি দল খুমবু হিমবাহে অভিযান চালাল।
‘মানুষের দেখা সবচেয়ে বীভৎস ও নিষিদ্ধ দৃশ্যগুলোর একটি’—খুমবু হিমবাহকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালরি। পরে এই এলাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সে যাক, একপর্যায়ে সঙ্গীসহ হিলারি বরফের বড় একটা মাঠের সামনে চলে এলেন।
এখানে প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত ও ওলটপালটভাবে হিমবাহ বা বরফের চাঙরের ধস নেমে আসছে। আশপাশের বরফঢাকা জমিতে একটু পরপরই ফাটল তৈরি হচ্ছে। যেকোনো সময় পায়ের নিচের বরফ ফাঁক হয়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই ভয়ানক বিপৎসংকুল এলাকার মধ্য দিয়ে পথ করে এগোলেন হিলারি। তাঁকে অনুসরণ করল অন্যরা।
এই বিক্ষুব্ধ বরফ রাজ্যে একটা পথ খুঁজে বের করলেন হিলারি। ১৯ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় ঘাঁটি গাড়লেন সবাই। এই পথ ধরে চলার সময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দে অনবরত বরফের চাঁই স্থান বদলাচ্ছে, এমন একটি জায়গার নাম হলো, ‘অ্যাটম বম্ব’। এই সেই জায়গা যেখানে বরফের ফাটলের মধ্যে পড়ে হিলারির অভিযান এবং জীবন দুটোই সাঙ্গ হতে বসেছিল।
চূড়ান্ত যাত্রা
হিলারি এবং তেনজিং চূড়ায় পৌঁছাতে চূড়ান্তযাত্রা শুরু করলেন। আগের মতোই কোমরে বাঁধা দড়ি তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তেনজিং এবার সামনে, হিলারি পেছনে। খুব সরু, কেবল কয়েক ফুট চওড়া একটি শৈলশিরা ধরে ওপরে উঠছেন দুই পর্বতারোহী। নরম তুষার এই চলাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। একপর্যায়ে সামনে এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
একসময় নরম তুষারের রাজ্য শেষ হলো। এর জায়গা নিল তুলনামূলক শক্ত বরফ। বরফে পা ফেলে একটু নিশ্চিন্তে এগোতে পারছেন দুজনে। তবে সতর্কতায় ঢিল দেননি। তাঁদের ডানে বরফের মোচড়ানো কার্নিশ, পাশ থেকেই পর্বতের কিনারা খাড়া নেমে গেছে ৮ হাজার ফুট। বামে সংকীর্ণ পাথুরে তাক।
মৃত্যু এলাকা
দুজনেই গায়ে চাপিয়েছেন আট প্রস্থ পোশাক, হাতে দস্তানা। পিঠে ৪০ পাউন্ডের অক্সিজেন ট্যাংক। উচ্চতার কারণে বাতাস এখানে অনেক হালকা। মানে এখানে অক্সিজেনের ঘাটতি আছে। কিন্তু পর্বতারোহীদের বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি অক্সিজেন দরকার, অন্তত ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। অনেকে এই উচ্চতাকে এভারেস্টের ডেথ জোনের শুরু বলে উল্লেখ করেন।
বরফ ভেঙে এগোনোর সময় হিলারির নিশ্বাস নিতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের নলের ভেতর বরফ জমতে শুরু করেছে যে। একটু পরপরই নল পরিষ্কার করছেন দুজনেই।
অনেকটা যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলেছেন। শুধু জানেন, যেভাবে হোক চূড়ায় পৌঁছাতে হবে। পরে হিলারি অকপটে বলেছিলেন, ‘আমরা কল্পনাও করতে পারছিলাম না, কোনো মানুষের পক্ষে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব।’
বড় বাধা
দুই অভিযাত্রী এক সময় চল্লিশ ফুট উঁচু একটা পাথরের দেয়ালের সামনে চলে এলেন। তাঁদের শরীরের এমন অবস্থা, সরাসরি দেয়ালের ওপর চড়া অসম্ভব।
হিলারির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। জুতার স্পাইক ব্যবহার করে পাথরের দেয়াল এবং একটা তাকের মাঝখান দিয়ে উঠতে শুরু করলেন। এক সময় দেয়ালের ওপর পৌঁছে গেলেন। তারপর তেনজিংকে দড়ি ধরে টেনে ওপরে তুললেন। আবার শুরু হলো বরফ ভেঙে পাহাড়ের ওপর ওঠা।
একেবারে ওপরে
কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। চলার গতি ধীর হয়ে এসেছে। ধৈর্যের শেষ সীমায় যেন পৌঁছে গেছেন তাঁরা। তবে ঢাল বেয়ে শেষ অংশটা পেরিয়ে হঠাৎই পৌঁছে গেলেন একেবারে ওপরে, শিখরে। তাঁরা এখন এভারেস্টের চূড়ায়।
দুজন মানুষ পরস্পরকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলেন, একে অপরের হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন পাগলের মতো। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে হিলারি কিছু ছবি তুললেন। তেনজিং শেরপাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে বাস করা দেবতাদের জন্য বরফ খুঁড়ে কিছু চকলেট এবং বিস্কুট রাখলেন। এগুলো তাঁদের জন্য উপহার।
পনেরো মিনিট পর এভারেস্টের চূড়ার মনোমুগ্ধকর, রাজকীয় দৃশ্যকে বিদায় জানিয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন দুজনে। তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এমন এক জায়গায় গিয়েছেন, যেখানে তাঁদের আগে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। এমন দৃশ্য দেখেছেন, যা আগে কেউ দেখেনি।
ম্যালরি ও আরভিন
কারও কারও ধারণা প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন হিলারি-তেনজিং নন, ম্যালরি-আরভিন। এমন অদ্ভুত ধারণার কারণ কী, তাই জানার চেষ্টা করছি এবার। তবে শুরুতে ম্যালরি কে অল্প কথায় তা জেনে নিই আগে।
এক শ বছর আগের ঘটনা। ইংল্যান্ডের এক যাজকের ছেলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের। তিন বছর বাদে পর্বতের চূড়ার কাছাকাছি থেকে অদৃশ্য হন তিনি। তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালে। সেই সঙ্গে জর্জ ম্যালরি জন্ম দিলেন এক চিরস্থায়ী তর্কের, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় আসলে কে প্রথম পা রেখেছিলেন?
১৮৮৬ সালের জুনে মবারলেতে জর্জ ম্যালরির জন্ম। বাবা হারবার্ট লেইফ এবং মা অ্যানি ব্যারিজ। ওয়েস্ট কিরবি এবং এস্টাবর্নের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন ম্যালরি। তার পর উইনচেস্টার কলেজে গণিতে বৃত্তি পান। এখানেই পর্বত আরোহণের নেশা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাঁর, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন নিয়তির দিকে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন ম্যালরি। তারপর সেখানেই শিক্ষকতা করেন কিছুদিন। একই সঙ্গে পর্বতারোহণে আরও শাণিত করে তুলতে থাকেন নিজেকে। তারপর ব্রিটিশ সেনাদলে নাম লেখান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পরই মাউন্ট এভারেস্ট পেয়ে বসল তাঁকে। জীবনের বাকি সময়টা পর্বতটা মোহাবিষ্ট করে রাখল ম্যালরিকে।
১৯২১। নেপাল-তিব্বত সীমান্তে পর্বতটির চূড়ায় পৌঁছার একটি পথের খোঁজে প্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলে নাম লেখান জর্জ ম্যালরি। দলনেতা ছিলেন চার্লস হাওয়ার্ড বারি। আগে কখনো হিমালয় অভিযানে যাননি ম্যালরি। কিন্তু কী আশ্চর্য! অভিযান শুরুর পর দেখা গেল অলিখিতভাবে গোটা দলের নেতৃত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পর্বত এলাকাটির বহু কাঙ্ক্ষিত একটি মানচিত্রও তৈরি করা হলো এই অভিযানেই।
স্কুলের বন্ধু গাই বুলক এবং সেনা জরিপকারী অলিভার হুইলারসহ দুর্গম লাকপা লাপাস এবং পুব রংবাক উপত্যকায় অভিযান চালান ম্যালরি। এই তিন দুঃসাহসী অভিযাত্রীই প্রথম পর্বতটির উত্তর প্রান্তে পৌঁছান। এই অভিযানেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া জয়ের সম্ভাব্য একটি পথ আবিষ্কারে সফল হন ম্যালরি।
১৯২২ সালের অভিযানেও ছিলেন তিনি, যেটাকে বিবেচনা করা হয় এভারেস্ট জয়ের প্রথম সত্যিকারের প্রচেষ্টা হিসেবে। দলনেতা ছিলেন জেনারেল চার্লস ব্রুস। এক বছর আগে ম্যালরি যে পথটির সন্ধান পেয়েছিলেন, ওটাই অনুসরণ করছিলেন অভিযাত্রীরা। এই অভিযানেই প্রথম বোতলজাত অক্সিজেন সঙ্গে নেন পর্বতারোহীরা। ওই সময় রেকর্ড ৮ হাজার ৩২৬ মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পরে দলটি।
তবে অভিযানটির পরিসমাপ্তি ঘটে বিয়োগান্ত এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ম্যালরির সঙ্গে থাকা সাতজন মুটে হিমবাহ পতনে মারা যান। ম্যালরিকে দল পরিচালনায় আরও বেশি সতর্ক হতে হতো—এমন অভিযোগ তোলেন তখন কোনো কোনো পর্বতারোহী। এর পর স্ত্রী রুথ এবং তিন সন্তানকে নিয়ে চমৎকার দিন কাটছিল ম্যালরির। তবে এভারেস্টের নেশা একবার যাকে পায়, তিনি এর ডাক অগ্রাহ্য করেন কীভাবে?
১৯২৪ সালে তৃতীয়বারের মতো এভারেস্ট রোমাঞ্চে শামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ম্যালরি। অভিযান শুরুর আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় মানুষ কেন এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করে? তাঁর ছোট্ট উত্তর ছিল, ‘কারণ ওটা ওখানে আছে।’ যা, পর্বতারোহণের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তিতে পরিণত হয় কালক্রমে। তবে ম্যালরির জানা ছিল না, এটাই তাঁর শেষ এভারেস্টযাত্রা। আর কখনো দেখা হবে না প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা আদরের সন্তানদের সঙ্গে। জুনের সেই বিখ্যাত অভিযানের সময় তাঁর বয়স ৩৭।
এবারের অভিযাত্রী দলের নেতাও ছিলেন জেনারেল ব্রুস। অভিযানে অন্যদের পাশাপাশি ম্যালরির সঙ্গে যোগ দেন বার্কেনহেডের অ্যান্ড্রু আরভিন। পর্বতারোহী হিসেবে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন না আরভিন। তবে ২২ বছরের এই টগবগে তরুণের অভিধানে ‘পিছু হটা’ শব্দ দুটো ছিলই না। ওই অভিযানেও অক্সিজেন ব্যবহার করেছিলেন পর্বতারোহীরা। আর তা ব্যবহারে ও পরিচালনায় দারুণ দক্ষ ছিলেন প্রকৌশলী আরভিন।
তারিখটা ছিল জুনের ৮। এভারেস্টের চূড়ার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে উঁচু ক্যাম্প ছাড়লেন ম্যালরি এবং আরভিন। কিন্তু আর ফিরে এলেন না। দ্রুতই এভারেস্টে হারিয়ে যাওয়া পর্বতারোহীদের তালিকায় নাম উঠল তাদের।
মূল অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিলেন ভূ-তাত্ত্বিক নোয়েল ওডেল। দুই পর্বতারোহীকে শেষবার দেখার দাবি তাঁরই। অল্প সময়ের জন্য যখন মেঘ সরে গিয়েছিল তখন ম্যালরি এবং আরভিনকে দেখেন তিনি, চূড়া থেকে কেবল কয়েকশ গজ দূরে।
পরে নোয়েল লিখেন, ‘৮ জুন, বেলা সাড়ে বারোটা। হঠাৎ আবহাওয়া একটু পরিষ্কার হয়ে গেল। এভারেস্টের চূড়া এবং চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল খুদে একটা কালো ছায়ায়, একটা পাথরের ওপাশে ছোট্ট একটা তুষার চূড়ায়। কালো বিন্দুটা নড়ে উঠল। অপর একটি কালো বিন্দু রওনা হলো আগেরটাকে লক্ষ্য করে।
প্রথম ছায়াটি পাথরের ধাপ ধরে ওপরে উঠে গেল। পরের ছায়ামূর্তিটাও তাই করল। তারপরই অসাধারণ এই দৃশ্যপট অদৃশ্য হলো। কারণ, আবারও মেঘ ঘিরে ধরেছে চারপাশ।’
রহস্যের সমাধান হয়নি আজও
আরভিনের বরফ কাটার কুঠারটা খুঁজে পাওয়া গেল ১৯৩৩ সালে, ৮ হাজার ৪৬০ মিটার উচ্চতায়। ১৯৭৫ সালে এ ব্রিটিশ অভিযাত্রীর মরদেহ আবিষ্কারের দাবি তোলেন এক চীনা অভিযাত্রী। এর ২২ বছর আগেই হিলারি এবং তেনজিং এভারেস্ট জয় করে বসে আছেন।
১৯৯৯ সাল। আমেরিকান পর্বতারোহী কনরাড অ্যাঙ্কার পর্বতের উত্তর ঢালে বরফে জমে যাওয়া এবং চমৎকার সংরক্ষিত এক মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। যেখানে কুঠারটা পাওয়া গিয়েছিল এর কয়েক শ মিটার নিচে পাওয়া যায় মৃতদেহটি।
মৃতদেহটির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এর কলারের একটা ট্যাগ দেখে। সেখানে লেখা ছিল জি ম্যালরি! কোমরে দড়ির শক্ত দাগ পাওয়া যায় মৃতদেহটির। এতে বোঝা যায় আছড়ে পড়ার আগে দড়িতে বেঁধে আরভিনের সঙ্গে আটকানো ছিল তাঁর শরীর। মাথায়ও একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল তাঁর। ম্যালরির সঙ্গে কিছু খুঁটিনাটি জিনিসও মেলে। এগুলোর মধ্যে ছিল একটি আল্টিমিটার, একটি চিরকুট ও পর্বতারোহণের যন্ত্রপাতির একটি রশিদ। তবে এমন কয়েকটি সূত্র পাওয়া গেল, যেটা তাঁরা সত্যি চূড়ায় পৌঁছেছিলেন কিনা, সে বিষয়টি আগাগোড়ার রহস্যের জালে আটকে দিল।
ম্যালরির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি ছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ছবিটা চূড়ায় রেখে আসবেন। কিন্তু ওই ছবিটার খুঁজে পাওয়া গেল না। ওডেলের চোখ যদি বেইমানি না করে, তবে ফিরে আসছিলেন তাঁরা। তাঁদের এই অভিযানের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করতে দুই অভিযাত্রী একটা ক্যামেরা নিয়েছিলেন সঙ্গে। ওটারও খোঁজ মেলেনি।
ম্যালরির মৃতদেহ আবিষ্কারের ২০ বছর পরও এভারেস্টের বড় এক রহস্য হয়েই রইল অভিযানটি। ম্যালরি এবং আরভিন সত্যি চূড়াজয় করেছিলেন কি না, এই নিয়ে এভারেস্টপ্রেমী এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে তর্ক বাধে নিয়মিতই।
আজও পর্বতারোহীরা হন্যে হয়ে খোঁজেন আরভিনের দেহ। তাঁদের আশা এর সঙ্গে মিলবে তাঁর ক্যামেরাখানা, যা প্রমাণ করবে এক যাজকের ছেলে এবং তার বার্কেনহেডের অভিযানসঙ্গী সত্যি প্রথম মানুষ হিসাবে পা রেখেছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের চূড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
১৮ ঘণ্টা আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
২ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৮ দিন আগে
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর এভারেস্ট অভিযান শিহরণ জাগায়। একই সঙ্গে মন ভার হয় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। প্রশ্ন জাগে—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন?
২৯ মে ২০২২
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
২ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৮ দিন আগে
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর এভারেস্ট অভিযান শিহরণ জাগায়। একই সঙ্গে মন ভার হয় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। প্রশ্ন জাগে—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন?
২৯ মে ২০২২
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
১৮ ঘণ্টা আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৮ দিন আগে
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর এভারেস্ট অভিযান শিহরণ জাগায়। একই সঙ্গে মন ভার হয় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। প্রশ্ন জাগে—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন?
২৯ মে ২০২২
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
১৮ ঘণ্টা আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
২ দিন আগে
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।
সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।
সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের রোমাঞ্চকর এভারেস্ট অভিযান শিহরণ জাগায়। একই সঙ্গে মন ভার হয় দুঃসাহসী কিন্তু দুর্ভাগা দুই অভিযাত্রী ম্যালরি ও আরভিনের কথা ভেবে। প্রশ্ন জাগে—সত্যি হিলারি-তেনজিংই কি প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন? নাকি তাঁদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ম্যালরি-আরভিন?
২৯ মে ২০২২
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
১৮ ঘণ্টা আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
২ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৮ দিন আগে