Ajker Patrika

আশুরার প্রেক্ষাপট, করণীয়-বর্জনীয়

ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান
আশুরার প্রেক্ষাপট, করণীয়-বর্জনীয়

হিজরি সনের ১২ মাসের মধ্যে মহররম প্রথম। ‘মহররম’ অর্থ নিষিদ্ধ, অলঙ্ঘনীয় পবিত্রতা, সম্মানিত প্রভৃতি। মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। ‘আশুরা’ শব্দটি ‘আশারা’ শব্দ থেকে উৎকলিত, যার অর্থ দশম। আর এ দিনটি মহররম মাসের দশম দিবস হওয়ায় এ দিনকে আশুরা বলা হয়। অন্য মতে, এ দিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর দশজন নবীকে দশটি বিশেষ দানে ভূষিত করেছেন বলে এ দিনকে আশুরা বলা হয়।

১০ মহররম মুসলিম মিল্লাতের জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিবস। এ দিবসটির যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে, তা জানা আবশ্যক। অতীতকাল থেকেই এ দিবসটিকে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত মনে করে সব যুগের উম্মতরা এই দিনে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতেন। এমনকি অন্ধকার যুগেও আরবরা এই দিনকে শ্রদ্ধা করত। এ প্রসঙ্গে আয়েশা (রা.) বলেন, অন্ধকার যুগে কুরাইশরা আশুরার দিনে রোজা রাখত। অতঃপর যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করলেন, তখন তিনি আশুরার রোজা রেখেছেন এবং অন্যকে এ রোজা রাখতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো, তখন তিনি আশুরার রোজা ছেড়ে দেন এবং বলেন, যে চায় সে যেন আশুরার রোজা পালন করে, আর যে চায় না, সে যেন তা পরিত্যাগ করে।’ (বোখারি-মুসলিম)

পৃথিবীর ইতিহাসে মহররমের ১০ তারিখে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা এই দিনে আসমান, জমিন, লওহ, কলম, সাগর-পর্বত, পৃথিবীসহ বিভিন্ন কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। আশুরার দিনে আদম ও হাওয়া (আ.)-এর তওবা কবুল হয় এবং আরাফাতের ময়দানে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে, ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন, মুসা (আ.)-এর জন্য সাগর দ্বিখণ্ডিত হয়ে রাস্তা হলে সে রাস্তা দিয়েই তিনি ও তাঁর জাতি ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তিলাভ করেন। এই দিনেই আদম (আ.)-কে তৈরি করা হয় এবং ইব্রাহিম ও ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।

এই দিনে আল্লাহ তাআলা আইয়ুব (আ.)-কে তাঁর ১৮ বছরের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আরোগ্য দান করেন। এই দিনেই নুহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে নোঙর করতে সক্ষম হয়। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নুহ (আ.) ও তাঁর উম্মতগণ এবং তাঁর সঙ্গে থাকা সব হিংস্র ও চতুষ্পদ জন্তু রোজা পালন করে।

উল্লিখিত ঘটনাগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের আগে সংঘটিত হয়েছিল। তাঁর ইন্তেকালের পর যে হৃদয়বিদারক ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়, তা ছিল মুসলিম জাতির জন্য খুবই মর্মান্তিক ও স্পর্শকাতর। তা হলো, মহানবী (সা.)-এর প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত। ৬১ হিজরির আশুরার দিনে অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে এবং পৃথিবীময় সত্যের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার বজ্রকঠোর শপথ নিয়ে তিনি সপরিবারে কারবালার মরু প্রান্তরে শাহাদতবরণ করেন। তিনি মুয়াবিয়া (রা.)-এর পুত্র ইয়াজিদের খেলাফত লাভকে ইসলাম পরিপন্থী সাব্যস্ত করে তা সমর্থন করেননি।

মহানবী (সা.) পরামর্শভিত্তিক যে শাসনব্যবস্থা ও কার্যপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার বিপরীত শাসনপদ্ধতির বিরুদ্ধে ছিল তাঁর সংগ্রাম। কুসংস্কার, জুলুম-নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর জিহাদ। আশুরা দিবসের করণীয় হলো, মহররম মাসকে সম্মান প্রদর্শন করা। এ মাসে মারামারি, খুন-রাহাজানি বন্ধ করা এবং সারা বছরে তা চর্চা করা, আশুরার দিন ও তার আগের অথবা পরের এক দিনসহ মোট দুদিন রোজা রাখা।

কেননা, মহানবী (সা.) মক্কায় অবস্থানকালে শুধু আশুরার দিন রোজা রাখতেন। কিন্তু মদিনায় আগমনের পর ইহুদিদের এই দিনে রোজা রাখতে দেখে তাদের বিপরীত করার জন্য তিনি দুদিন রোজা রাখার আদেশ করেন (বোখারি)। রোজার ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজা পালন দ্বারা আমি আল্লাহর নিকট বিগত বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমার প্রত্যাশা রাখি।’ (তিরমিজি)

বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা ও কোরআন তিলাওয়াত করা, পরিবারে উত্তম খাবার পরিবেশন করারও নির্দেশ আছে। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন পরিবারের জন্য খরচ করতে হস্ত প্রসারিত করেন, আল্লাহ তাঁকে সারা বছর সচ্ছলতার ওপর রাখেন।’ (বায়হাক্বি)

এই দিনে গোসল করা ও চোখে সুরমা লাগানো, নবীদের ন্যায় বেশি বেশি তওবা করা, নুহ নবীর ন্যায় নিজে বাঁচার পাশাপাশি অন্যকে বাঁচানো, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, রোগমুক্তির জন্য তাঁর কাছে দোয়া করার কথা বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই দিনে গোসল করে ও চোখে সুরমা লাগায়, সে ওই বছর আর রোগাক্রান্ত হবে না।’

এই দিনের অন্যতম করণীয় হলো, ইমাম হোসাইনের মতো অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা, বজ্রকণ্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এই দিবসে অনেক কাজ রয়েছে, যা বর্জন করা আবশ্যক। ভারতীয় উপমহাদেশে কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহররম মাসটি শোকের মাস হিসেবে পালিত হয়। অথচ এটি শুধু শোকের মাস নয়, আনন্দেরও বটে।

আশুরার দিন শিয়া-সুন্নি সবাই মিলে অগণিত শিরক ও বিদয়াতে লিপ্ত হয়। যেমন, হোসাইন (রা.)-এর ভুয়া কবর তৈরি করে রাস্তায় শোক মিছিল বের করা, রক্তের নামে লাল রং ছিটানো, রাস্তাঘাট রংবেরং সাজে সাজানো, লাঠি-তির-বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেওয়া, সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেওয়া, শোকের নামে ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ বলে বিলাপ করা, বুক চাপড়ানো, মাতম করা, হোসাইন (রা.)-এর নামে কেক ও পাউরুটি বানিয়ে বরকতের পিঠা বলে বেশি দামে বিক্রি করা, হোসাইন (রা.)-এর নামে পুকুরে মোরগ ছুড়ে ‘বরকতের মোরগ’ মনে করে তা ধরার জন্য প্রতিযোগিতা করা, শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিবাহ-শাদি না দেওয়া, হোসাইন (রা.)-এর কারণে আশুরার দিনে পানি পান না করা, শিশুকে দুধপান না করানো।

এ ছাড়া, একটি সম্প্রদায় এই দিবস এলেই সাহাবিদের গালিগালাজ করে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে কারবালার ঘটনার জন্য কোনো কোনো সাহাবি দায়ী। তাই তারা তাঁদের সমালোচনা করে থাকে, যা চরম নিন্দনীয়। আশুরার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করা এবং কারবালার ত্যাগ ও মর্মান্তিকতার শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে দেশ ও জাতির উন্নয়ন করাই হোক এই দিবসের প্রত্যয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাওরে বিদ্যুৎ সংযোগ: বাঁশের খুঁটিতে ৩৩,০০০ ভোল্টের লাইন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি

পটুয়াখালীর কলাপাড়া: এক রাখাইন পরিবারের ৪০ একর জমি দখল

ব্রিটেনে নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে কোটি মুসলিম, বেশির ভাগই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের

ইমরান খানের জন্য ইলন মাস্কের কাছে জেমিমার আবেদন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ