তিশা-মুশতাকদের নিয়ে কেন এত আপত্তি

জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭: ০৪
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭: ৪৮

তিশা-মুশতাক দম্পতির বয়সের ফারাক কমসে কম ৪০ বছর। মধ্যবয়সী মুশতাক আবার উপন্যাস লিখেছেন তাঁর সদ্য কৈশোর পেরোনো স্ত্রীর নামে। তাঁর গল্পের নায়ক-নায়িকার নামও তিশা ও মুশতাক। এরা কিন্তু অসমবয়সী নয়। কলেজপড়ুয়া দুই তরুণ-তরুণী। কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠাজুড়ে বাস্তবের তিশা-মুশতাকের ছবি জুড়ে দেওয়ার মানে কী? স্ত্রীর হাত ধরে দাঁড়ানোর সময় মুশতাক যে তাঁর বয়স ভারাক্রান্ত শরীর নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন, উপন্যাসের ভেতরে নিজেকে এভাবে ফ্যান্টাসাইজ করা তারই নিদর্শন হতে পারে!  

কিন্তু এই দম্পতিকে নিয়ে মানুষের এত আপত্তির কারণ কী? বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে আপত্তি এতটাই তীব্র যে একপর্যায়ে তাঁদের দুয়োধ্বনি দিয়ে বইমেলা থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক তরুণকে দেখা গেছে মুশতাককে ‘লুচ্চা’ বলে গালি দিতে।  

অসমবয়সী আপাত-প্রেমময় এই দম্পতিকে নিয়ে সদ্য পৌরুষে পা দেওয়া ছেলেদের এত আপত্তি কেন? তারা কি এমন দুজন মানুষের হাত ধরাধরি করতে দেখে অথবা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃশ্য কল্পনা করে অস্বস্তি বোধ করছে? এই অস্বস্তির উৎসই-বা কী? কেনই-বা অনেকে বিপত্নীক মুশতাকের এই বিয়েটাকে অনৈতিক বলছেন?

এই আপত্তির উৎস সন্ধানে আমরা অস্বস্তির (disgust) ওপরই জোর দিতে পারি।  

দুটি উপন্যাস এনেছেন মুশতাক: তিশার ভালোবাসা এবং তিশা অ্যান্ড মুশতাক। ধরা যাক কৌতূহলবশত কোনো পাঠক এই উপন্যাস পড়তে শুরু করলেন। রোমান্টিকতায় ঠাসা গল্প পড়তে গিয়ে নায়ক-নায়িকার নামগুলো যখন বারবার এক টিনেজ মেয়ে আর ষাটোর্ধ্ব বুড়োর কথা মনে করিয়ে দেবে, তখন পাঠ আর আনন্দময় থাকতে পারে কি? উপন্যাসের পাতায় পাতায় নিজের ছবি সেঁটে দিয়ে মুশতাক নিশ্চিত অস্বস্তি উৎপাদনের আয়োজন করেছেন। 

বইমেলার তরুণ তুর্কিরা তাদের আপত্তির কিছু কারণ অবশ্য জানিয়েছে! তাতে প্রেমের বাজারে বুড়োর কাছে হেরে যাওয়ার গ্লানি স্পষ্ট। এমন বয়সে একটি অমন প্রেমিকা জোটাতে না পারার পেছনে অর্থনৈতিক দীনতাকেই বড় করে দেখছে অনেকে। ফলে মুশতাক তাদের চোখে ঘৃণ্য সুগার ড্যাডি, বাংলা পরিভাষা গুলে খাওয়া তরুণেরা বলছে—চিনি বাবা।

তিশা-মুশতাক নিয়ে আপত্তির পেছনে মোটাদাগে অস্বস্তি, বঞ্চনার অনুভূতি অথবা বিত্তের প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া আলফা মেলদের গ্লানিই মুখ্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, যৌন সক্ষম একজন ষাটোর্ধ্ব পুরুষের তরুণী সঙ্গী বেছে নেওয়ায় সমাজের কেন এমন তীব্র আপত্তি? তার মানে বিয়েকে শুধু যৌনতার সামাজিক সম্মতি বলে মনে করা হয় না? তাহলে বিয়ের মধ্যে আরও কী কী প্রত্যাশিত? অসম বিয়ে (নারী ও পুরুষের উভয়ের ক্ষেত্রে) কেন দেশ ও সংস্কৃতিনির্বিশেষে একটা ট্যাবু?

এর উৎস সন্ধানের অভিযাত্রায় এভাবেও ভাবা যেতে পারে: নারীদের ওপর পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর তাদের ভাষায় ‘অবলা নারীর’ নিরাপত্তা বিধান যখন পৌরুষের অন্যতম দায় হিসেবে মূল্যবোধের অংশ হয়ে যায়, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর নিরাপত্তার অজুহাতে কিছু অদ্ভুত অযৌক্তিক নৈতিকতা উদ্ভাবনে মাথা খাটানো শুরু করে।  

যেমন: মুরব্বিদের কাছে প্রজননক্ষম নারীদের নিরাপদ মনে করা এবং এটি সর্বজনীন নৈতিকতা বলে গৃহীত হওয়া। একইভাবে বিবাহিত পুরুষদের নারীদের জন্য অধিকতর নিরাপদ বলে মনে করা হয় এবং এই নৈতিকতার রক্ষাকবচ হিসেবে সে অর্থে কোনো সমাজে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো আইন বা বিধি বা রীতি কিন্তু নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে সাধারণত যা করা হয়, সেটিই এখানে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেটি হলো স্টিগমাটাইজ করা বা সম্মিলিত লজ্জা বা ঘৃণা বর্ষণ। আধুনিক ভূরাজনীতিতে তথাকথিত সফটপাওয়ার বিস্তারে দেওয়া হয় ঘুষ, আর সমাজ এই অতৃপ্ত বুড়ো ও বিবাহিতদের জন্য রেখেছে লজ্জা। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে: নৈতিকতার তাসের ঘর হরহামেশা ভেঙে পড়ছে।

একই যুক্তিতে আজকাল একই কর্মস্থলে সহকর্মীদের মধ্যে প্রেম কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর পেছনে লক্ষ্য মূলত প্রিডেটর বসদের থাবা থেকে নারী কর্মীদের সুরক্ষা।  

আবার এই ধরনের নৈতিকতার নিরাপত্তাপ্রাচীর তৈরির আরেকটি হাস্যকর চেষ্টা হলো, তুলনা। ‘মেয়েরা তো মায়ের মতো, বোনের মতো। তাদের দিকে কুনজরে তাকাতে লজ্জা করে না!’ আবারও নৈতিকতার প্রাচীর তোলার দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। এর একটা মোক্ষম জবাব দিয়েছেন বাংলা সিনেমার খলনায়ক কাবিলা। উত্ত্যক্তকারী খলনায়ককে নায়িকা বলছেন, ‘তোর বাড়িতে মা-বোন নেই?’ খলনায়ক বলছেন, ‘সবাই মা-বোন হইলে বউ হইবো ক্যাডা?’ স্পষ্টত পেশিশক্তিতে দুর্বল অসহায় নারীর সম্ভ্রম বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা, নৈতিকতার দোহাই!  

বোঝাই যাচ্ছে, এই নৈতিকতার দোহাই দিয়ে আসলে কাজ হচ্ছে না। এভাবে কাজ হওয়াটা জরুরি কি না, সেটিও ভাবা দরকার। নারী তো এখন সমান নাগরিক। তার নিরাপত্তার দায় নিয়ে পৌরুষ দেখানোর দিন তো আর নেই! নাগরিকেরা যদি সমান নিরাপত্তা না পান, সেই ব্যর্থতা কার? সবার সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেই ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি, দায় তারই। নারীরা সব স্থানে নিরাপদ বোধ করবেন, যাকে ভালো লাগবে তাকে ভালোবাসবেন; বিয়ে করবেন অথবা করবেন না; নারী বলেই তাঁর দায়িত্ব কেন সমাজ নামের পুরুষদের ক্লাবকে নিতে হবে।  

উদ্দিষ্টদের অস্বস্তি প্রশমনে আরেকটি কথা না বললেই নয়—অঙ্গীকার ও দায়হীন প্রেম আর বিবাহিত সম্পর্ক এক নয়। তথাকথিত সুগার ড্যাডি ও সুগার বেবিদের নিয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের দম্পতিদের মধ্যকার সম্পর্ক শুধুই পারস্পরিক স্বার্থ হাসিলের ব্যাপার নয়; অধিকাংশ সাধারণ বিয়ের মতোই এই অসম দম্পতির সম্পর্কও একপর্যায়ে দায় আর অভ্যাসে পরিণত হয়।  

সুতরাং পুরুষ যাঁরা নিজেদের সমাজের প্রতিনিধি দাবি করছেন, তাঁরা এবার নীতি পুলিশগিরি থামান!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত