মারুফ ইসলাম
যুদ্ধের দামামা শেষ পর্যন্ত বেজেই উঠল। পুতিনের বাহিনী সামরিক অভিযান শুরু করে দিয়েছে ইউক্রেনে। দফায় দফায় বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে কিয়েভ। বিবিসির সাংবাদিক পল অ্যাডামস বলেছেন, তিনি পাঁচ-ছয়টি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অবস্থা ওদিকে টালমাটাল। ইউরোপের বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর দ্বারস্থ হচ্ছেন তিনি। টেলিফোন করেছিলেন ‘বিশ্বমোড়ল’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। তিনি রাশিয়ার ওপর কঠোর অবরোধ আরোপের আশ্বাস দিয়েছেন বটে, কিন্তু আশ্বাসে কি আর চিড়ে ভেজে?
জেলেনস্কি টেলিফোন করেছিলেন পুতিনকেও। কিন্তু টেলিফোন তোলেননি ভ্লাদিমির পুতিন। যদিও তিনি এখানে-সেখানে বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলে যাচ্ছেন, ‘আলোচনার দরজা খোলা আছে’, ‘ইউক্রেনে হামলার কোনো ইচ্ছা নেই আমাদের’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
পুতিনের এই ‘কথায় ও কাজে মিল না থাকা’ বক্তৃতা-বিবৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১৫ সালকে। তখন সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছিল। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে হটানোর আন্দোলন করছিল সিরীয় বিদ্রোহীরা। অভিযোগ আছে, বিদ্রোহীদের অস্ত্রপাতি দিয়ে উসকে দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘চিরশত্রু’ রাশিয়ার কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না বাশার আল আসাদের।
আসাদের আবেদনে সানন্দেই সাড়া দিয়েছিলেন পুতিন। লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করেছিলেন সিরিয়ায়।
মাস দুয়েক আগে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করেছে রাশিয়া। পুতিনের এই সৈন্যসমাবেশ দেখে অনেকেই বলছিলেন, মস্কো কি সিরিয়া নীতি অনুসরণ করতে যাচ্ছে ইউক্রেনে? অর্থাৎ, যে কৌশলে সিরিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন, সেই একই কৌশলে ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন কি না? সামরিক অভিযান অবশেষে শুরুই করে দেওয়ায় এখন সেসব প্রশ্ন আরও জোরেশোরে উঠছে।
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৫ সালে। তখন সিরিয়ার ক্ষেত্রে কী নীতি-কৌশল অবলম্বন করেছিলেন কৌশলী পুতিন? আসুন, সেগুলো একটু মিলিয়ে দেখা যাক।
প্রথমত, এটা মনে রাখা দরকার যে স্থলবাহিনী দিয়ে সিরিয়া দখল করা উদ্দেশ্য ছিল না রাশিয়ার। পুতিনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাশারের গদি রক্ষা করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কবজা থেকে সিরিয়াকে উদ্ধার করা। পুতিনের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আপাতত সিরিয়াকে তিনি মার্কিন কবজা থেকে বের করতে পেরেছেন এবং নিজের কবজায় নিতে পেরেছেন।
এখন যদি আমরা ইউক্রেনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, সেখানে জো বাইডেনের নিয়ন্ত্রণ আছে। পুতিনের মনে এই খায়েশ জন্মেছে, সিরিয়ার মতো ইউক্রেনকেও মার্কিনমুক্ত করে নিজের কবজায় নেওয়া। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দুটি ভূখণ্ড দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছে মস্কো। সেখানে সৈন্যও পাঠিয়ে দিয়েছে। এর একটাই অর্থ, তিনি আস্তে আস্তে কিয়েভে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপের দিকে অগ্রসর হবেন।
দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সিরিয়ার ভূখণ্ড দখলের পরিবর্তে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও কি একই পথ অনুসরণ করবেন পুতিন? এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ সিরিয়ার ক্ষেত্রে পুতিনের পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তিনি বাশার আল আসাদ। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তো তাঁর পছন্দের ব্যক্তি নন। সে ক্ষেত্রে জেলেনস্কিকে উৎখাত করে কাকে ক্ষমতায় বসাবেন পুতিন, সেই উত্তরটা জানার জন্য সম্ভবত আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বিশ্ববাসীকে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আমল থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অন্যতম শরিক দেশ সিরিয়া। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত লাটাকিয়ায় রয়েছে রাশিয়ার নৌঘাঁটি। কয়েক বছর ধরে রাশিয়া সেখানে জঙ্গি বিমান, ট্যাংকসহ সাঁজোয়া সৈন্যবাহী যান মোতায়েন করেছে। এত সব আয়োজনের কারণ হিসেবে বলা যেতেই পারে যে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়াকে প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখতে চায় ক্রেমলিন।
কিন্তু ইউক্রেন দখলের মাধ্যমে কী নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রাশিয়া? ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ভূখণ্ড দখল করার ইচ্ছা সম্ভবত পুতিনের নেই। পুতিনের বাহিনী আপাতত দূরবর্তী অবস্থানে থেকেই সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম, বিশেষ করে ড্রোনের মজুত ধ্বংস করছে রুশ বাহিনী। ঠিক একই কাজ সিরিয়াতেও শুরুতে করেছিল রাশিয়া।
এই হামলার ধরন সুস্পষ্ট ধারণা দিচ্ছে যে, ইউক্রেনের সামরিক শক্তি দুর্বল করাই রাশিয়ার উদ্দেশ্য। সামরিক শক্তি দুর্বল হলে জেলেনস্কি দুর্বল হবেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো নিশ্চয় চুপচাপ বসে থাকবে না। সব ধরনের সামরিক শক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়াবে জেলেনস্কির। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালে পুতিন কী করবেন? সংশ্লিষ্ট খাতের বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে পুতিনের পরিকল্পনা এখনো অস্পষ্ট।
তৃতীয়ত, শক্তি প্রদর্শনের ইচ্ছা। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করার একটি বড় কারণ ছিল, রাশিয়ার সামরিক শক্তি কত বড় তা বিশ্বকে দেখানো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে দেখানো। কাস্পিয়ান সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে রাশিয়া দেখাতে চেয়েছিল, প্রাণঘাতী হামলা চালানোর সক্ষমতায় তারাও পিছিয়ে নেই।
সেই দেখনদারির ইচ্ছা ইউক্রেন হামলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পশ্চিমারা ভেবেছিল, সিরিয়ায় সেনা পাঠানোর পর রাশিয়ার শক্তি খর্ব হয়েছে। পুতিন এই ধারণা ভেঙে দিতে চান। এবং সেই চাওয়া থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে পুতিন সৈন্য জড়ো করেছেন বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, সিরিয়াকে কবজায় নেওয়ার পর রাশিয়ার সমরশক্তি আরও কত বেড়েছে, সেটা মূলত দেখাতে চান ভ্লাদিমির পুতিন।
সিরিয়ায় রুশ বাহিনীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এটা অন্তত বলা যায় যে, রুশ বাহিনী চেষ্টা করবে যাতে ইউক্রেনীয়রা সীমান্ত অতিক্রম না করে। অর্থাৎ সীমান্তজুড়ে বিশাল সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখতে পারে ক্রেমলিন। এরই মধ্যে চেচেন প্রেসিডেন্ট রমজান কারিদভ বলেছেন, ‘ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ধরন দেখে আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে সিরিয়া, লিবিয়া ও মালির কথা। সেই সব দেশের ভাগ্যেও এমন পরিণতি ঘটেছিল।’
সিরিয়া উত্তেজনায় রাশিয়া যখন নাক গলাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর মতো ভুল করবে না রাশিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যদ্বাণী নাকচ করে দিয়ে মস্কো ঠিকই সৈন্য পাঠিয়েছিল। ইউক্রেন ইস্যুতেও পশ্চিমারা বলছিল, ইউক্রেনে হামলা করার মতো বোকামি করবে না রাশিয়া। কিন্তু তাদের ভবিষ্যদ্বাণীও নস্যাৎ করে এরই মধ্যে হামলা করে বসেছে রাশিয়া। সুতরাং রাশিয়া হামলা চালাবে না—বিশ্ববাসীর এমন ধারণা বদলে দিতে চাইছে পুতিনের দেশ।
এদিকে রাশিয়ার চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ বলেছেন, রাশিয়া ‘চার অনুপাত এক’ নীতিতে বিশ্বাসী। এর মানে হচ্ছে, তারা যেকোনো সমস্যা কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে, তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে অথবা সামরিক উপায়ে সমাধান করে থাকে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সর্বশেষ অস্ত্রটিই বেছে নিয়েছে রাশিয়া, কোনো আলাপ-আলোচনাতেই কর্ণপাত করেনি।
পুতিনের সিরিয়া বিজয়ের পর ইউক্রেনে আগ্রাসন দেখে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে ২০০৬ সালের কথা। সে বছর মার্কিন-রাশিয়া সংলাপে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই ইভানভ বলেছিলেন, ইরাক ও আফগানিস্থানে মার্কিন অভিযান খুব গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছে রুশ সেনাবাহিনী। সেখান থেকে তারা শিক্ষাও নিয়েছে।
সের্গেই ইভানভের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাক ও আফগানিস্তান দখল করেছিল, ঠিক সেভাবেই ইউক্রেন দখলে অগ্রসর হতে পারে রাশিয়া। যদিও পুতিন তাঁর আস্তিনে কী কী অস্ত্র ও কৌশল লুকিয়ে রেখেছেন, তা পূর্বানুমান করা বেশ কঠিন। যদিও অনেকেই বলছেন, ইউক্রেন হবে ‘পুতিনের সিরিয়া’। এমন কথা অবশ্য রাশিয়া যখন সিরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছিল তখনো উঠেছিল। অনেক বিশ্লেষক তখন বলেছিলেন, সিরিয়া হবে ‘পুতিনের আফগানিস্তান’।
আসলেই কী হবে, তা বুঝতে সময় লাগবে আরও। তবে সিরিয়ার পর পুতিনের ঘোষণাতেই বিশ্ব যে আবার যুদ্ধের সংকটে পড়ল, সেটি অনুধাবনে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যুদ্ধ শুরু করার দায় মেটানো কিন্তু কঠিনই হবে রাশিয়ার জন্য।
তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন ও দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট
যুদ্ধের দামামা শেষ পর্যন্ত বেজেই উঠল। পুতিনের বাহিনী সামরিক অভিযান শুরু করে দিয়েছে ইউক্রেনে। দফায় দফায় বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে কিয়েভ। বিবিসির সাংবাদিক পল অ্যাডামস বলেছেন, তিনি পাঁচ-ছয়টি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অবস্থা ওদিকে টালমাটাল। ইউরোপের বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর দ্বারস্থ হচ্ছেন তিনি। টেলিফোন করেছিলেন ‘বিশ্বমোড়ল’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। তিনি রাশিয়ার ওপর কঠোর অবরোধ আরোপের আশ্বাস দিয়েছেন বটে, কিন্তু আশ্বাসে কি আর চিড়ে ভেজে?
জেলেনস্কি টেলিফোন করেছিলেন পুতিনকেও। কিন্তু টেলিফোন তোলেননি ভ্লাদিমির পুতিন। যদিও তিনি এখানে-সেখানে বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলে যাচ্ছেন, ‘আলোচনার দরজা খোলা আছে’, ‘ইউক্রেনে হামলার কোনো ইচ্ছা নেই আমাদের’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
পুতিনের এই ‘কথায় ও কাজে মিল না থাকা’ বক্তৃতা-বিবৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১৫ সালকে। তখন সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছিল। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে হটানোর আন্দোলন করছিল সিরীয় বিদ্রোহীরা। অভিযোগ আছে, বিদ্রোহীদের অস্ত্রপাতি দিয়ে উসকে দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘চিরশত্রু’ রাশিয়ার কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না বাশার আল আসাদের।
আসাদের আবেদনে সানন্দেই সাড়া দিয়েছিলেন পুতিন। লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করেছিলেন সিরিয়ায়।
মাস দুয়েক আগে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করেছে রাশিয়া। পুতিনের এই সৈন্যসমাবেশ দেখে অনেকেই বলছিলেন, মস্কো কি সিরিয়া নীতি অনুসরণ করতে যাচ্ছে ইউক্রেনে? অর্থাৎ, যে কৌশলে সিরিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন, সেই একই কৌশলে ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন কি না? সামরিক অভিযান অবশেষে শুরুই করে দেওয়ায় এখন সেসব প্রশ্ন আরও জোরেশোরে উঠছে।
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৫ সালে। তখন সিরিয়ার ক্ষেত্রে কী নীতি-কৌশল অবলম্বন করেছিলেন কৌশলী পুতিন? আসুন, সেগুলো একটু মিলিয়ে দেখা যাক।
প্রথমত, এটা মনে রাখা দরকার যে স্থলবাহিনী দিয়ে সিরিয়া দখল করা উদ্দেশ্য ছিল না রাশিয়ার। পুতিনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাশারের গদি রক্ষা করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কবজা থেকে সিরিয়াকে উদ্ধার করা। পুতিনের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আপাতত সিরিয়াকে তিনি মার্কিন কবজা থেকে বের করতে পেরেছেন এবং নিজের কবজায় নিতে পেরেছেন।
এখন যদি আমরা ইউক্রেনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, সেখানে জো বাইডেনের নিয়ন্ত্রণ আছে। পুতিনের মনে এই খায়েশ জন্মেছে, সিরিয়ার মতো ইউক্রেনকেও মার্কিনমুক্ত করে নিজের কবজায় নেওয়া। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দুটি ভূখণ্ড দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছে মস্কো। সেখানে সৈন্যও পাঠিয়ে দিয়েছে। এর একটাই অর্থ, তিনি আস্তে আস্তে কিয়েভে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপের দিকে অগ্রসর হবেন।
দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সিরিয়ার ভূখণ্ড দখলের পরিবর্তে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও কি একই পথ অনুসরণ করবেন পুতিন? এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ সিরিয়ার ক্ষেত্রে পুতিনের পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তিনি বাশার আল আসাদ। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তো তাঁর পছন্দের ব্যক্তি নন। সে ক্ষেত্রে জেলেনস্কিকে উৎখাত করে কাকে ক্ষমতায় বসাবেন পুতিন, সেই উত্তরটা জানার জন্য সম্ভবত আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বিশ্ববাসীকে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আমল থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অন্যতম শরিক দেশ সিরিয়া। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত লাটাকিয়ায় রয়েছে রাশিয়ার নৌঘাঁটি। কয়েক বছর ধরে রাশিয়া সেখানে জঙ্গি বিমান, ট্যাংকসহ সাঁজোয়া সৈন্যবাহী যান মোতায়েন করেছে। এত সব আয়োজনের কারণ হিসেবে বলা যেতেই পারে যে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়াকে প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখতে চায় ক্রেমলিন।
কিন্তু ইউক্রেন দখলের মাধ্যমে কী নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রাশিয়া? ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ভূখণ্ড দখল করার ইচ্ছা সম্ভবত পুতিনের নেই। পুতিনের বাহিনী আপাতত দূরবর্তী অবস্থানে থেকেই সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম, বিশেষ করে ড্রোনের মজুত ধ্বংস করছে রুশ বাহিনী। ঠিক একই কাজ সিরিয়াতেও শুরুতে করেছিল রাশিয়া।
এই হামলার ধরন সুস্পষ্ট ধারণা দিচ্ছে যে, ইউক্রেনের সামরিক শক্তি দুর্বল করাই রাশিয়ার উদ্দেশ্য। সামরিক শক্তি দুর্বল হলে জেলেনস্কি দুর্বল হবেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো নিশ্চয় চুপচাপ বসে থাকবে না। সব ধরনের সামরিক শক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়াবে জেলেনস্কির। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালে পুতিন কী করবেন? সংশ্লিষ্ট খাতের বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে পুতিনের পরিকল্পনা এখনো অস্পষ্ট।
তৃতীয়ত, শক্তি প্রদর্শনের ইচ্ছা। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করার একটি বড় কারণ ছিল, রাশিয়ার সামরিক শক্তি কত বড় তা বিশ্বকে দেখানো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে দেখানো। কাস্পিয়ান সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে রাশিয়া দেখাতে চেয়েছিল, প্রাণঘাতী হামলা চালানোর সক্ষমতায় তারাও পিছিয়ে নেই।
সেই দেখনদারির ইচ্ছা ইউক্রেন হামলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পশ্চিমারা ভেবেছিল, সিরিয়ায় সেনা পাঠানোর পর রাশিয়ার শক্তি খর্ব হয়েছে। পুতিন এই ধারণা ভেঙে দিতে চান। এবং সেই চাওয়া থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে পুতিন সৈন্য জড়ো করেছেন বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, সিরিয়াকে কবজায় নেওয়ার পর রাশিয়ার সমরশক্তি আরও কত বেড়েছে, সেটা মূলত দেখাতে চান ভ্লাদিমির পুতিন।
সিরিয়ায় রুশ বাহিনীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এটা অন্তত বলা যায় যে, রুশ বাহিনী চেষ্টা করবে যাতে ইউক্রেনীয়রা সীমান্ত অতিক্রম না করে। অর্থাৎ সীমান্তজুড়ে বিশাল সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখতে পারে ক্রেমলিন। এরই মধ্যে চেচেন প্রেসিডেন্ট রমজান কারিদভ বলেছেন, ‘ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ধরন দেখে আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে সিরিয়া, লিবিয়া ও মালির কথা। সেই সব দেশের ভাগ্যেও এমন পরিণতি ঘটেছিল।’
সিরিয়া উত্তেজনায় রাশিয়া যখন নাক গলাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর মতো ভুল করবে না রাশিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যদ্বাণী নাকচ করে দিয়ে মস্কো ঠিকই সৈন্য পাঠিয়েছিল। ইউক্রেন ইস্যুতেও পশ্চিমারা বলছিল, ইউক্রেনে হামলা করার মতো বোকামি করবে না রাশিয়া। কিন্তু তাদের ভবিষ্যদ্বাণীও নস্যাৎ করে এরই মধ্যে হামলা করে বসেছে রাশিয়া। সুতরাং রাশিয়া হামলা চালাবে না—বিশ্ববাসীর এমন ধারণা বদলে দিতে চাইছে পুতিনের দেশ।
এদিকে রাশিয়ার চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ বলেছেন, রাশিয়া ‘চার অনুপাত এক’ নীতিতে বিশ্বাসী। এর মানে হচ্ছে, তারা যেকোনো সমস্যা কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে, তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে অথবা সামরিক উপায়ে সমাধান করে থাকে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সর্বশেষ অস্ত্রটিই বেছে নিয়েছে রাশিয়া, কোনো আলাপ-আলোচনাতেই কর্ণপাত করেনি।
পুতিনের সিরিয়া বিজয়ের পর ইউক্রেনে আগ্রাসন দেখে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে ২০০৬ সালের কথা। সে বছর মার্কিন-রাশিয়া সংলাপে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই ইভানভ বলেছিলেন, ইরাক ও আফগানিস্থানে মার্কিন অভিযান খুব গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছে রুশ সেনাবাহিনী। সেখান থেকে তারা শিক্ষাও নিয়েছে।
সের্গেই ইভানভের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাক ও আফগানিস্তান দখল করেছিল, ঠিক সেভাবেই ইউক্রেন দখলে অগ্রসর হতে পারে রাশিয়া। যদিও পুতিন তাঁর আস্তিনে কী কী অস্ত্র ও কৌশল লুকিয়ে রেখেছেন, তা পূর্বানুমান করা বেশ কঠিন। যদিও অনেকেই বলছেন, ইউক্রেন হবে ‘পুতিনের সিরিয়া’। এমন কথা অবশ্য রাশিয়া যখন সিরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছিল তখনো উঠেছিল। অনেক বিশ্লেষক তখন বলেছিলেন, সিরিয়া হবে ‘পুতিনের আফগানিস্তান’।
আসলেই কী হবে, তা বুঝতে সময় লাগবে আরও। তবে সিরিয়ার পর পুতিনের ঘোষণাতেই বিশ্ব যে আবার যুদ্ধের সংকটে পড়ল, সেটি অনুধাবনে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যুদ্ধ শুরু করার দায় মেটানো কিন্তু কঠিনই হবে রাশিয়ার জন্য।
তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন ও দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
৭ ঘণ্টা আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
১৩ ঘণ্টা আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
১ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ দিন আগে