ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন /বাংলাদেশ-পাকিস্তান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে ভারতের কী হবে

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ২৯
আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ৫৮
Thumbnail image
বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভারতের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক ও সামরিক সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার পরিস্থিতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। এই বিষয়টি নয়াদিল্লির কৌশলগত স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত আগস্টে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ঢাকা ও ইসলামাবাদ পুনরায় নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে মিসরের রাজধানী কায়রোতে এক সম্মেলনের (ডি-৮ জোট) সাইডলাইনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সবক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারে সম্মত হন।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তখন থেকেই দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক যোগাযোগ সীমিত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের এক ঐতিহাসিক বরফ গলানোর ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর দাবি করেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তান থেকে আসা কার্গোর ফিজিক্যাল ইন্সপেকশন বা সরাসরি পরিদর্শনের ওপর আরোপিত পূর্বের বাধ্যবাধকতা বাতিল করেছে। এ ছাড়া, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি দুই দেশের সামরিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। এর বাইরে করাচি বন্দরে বাংলাদেশ ‘আমান-২০২৫’ যৌথ নৌ-মহড়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করবে।

ভারতীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তান যখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, তখন এই অঞ্চলের সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে এবং ভারত এ ধরনের পরিবর্তনগুলো ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারত মনে করে, দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির সম্পর্কে অবনতি হয়েছে। হাসিনা ভারতের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন এবং দেশত্যাগের পর থেকেই তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিকরা বলছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে দিয়ে জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ মোকাবিলা করতে হবে। নয়াদিল্লি যখন এই পরিবর্তনগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, তখন তারা বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করছে।

ভারতীয় থিংক ট্যাংক মন্ত্রয়া ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা শান্তি ম্যারিয়েট ডি’সুজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সামগ্রিকভাবে উন্নত হয়েছে। এই পরিবর্তন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য নিরাপত্তার প্রভাব ফেলবে।’

ভারত দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে মানবপাচার, অনুপ্রবেশ এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের মতো ভারতীয় রাজ্যের সঙ্গে সীমানা ভাগ করায় ভারতের কেন্দ্র সরকার বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ, এসব রাজ্য ব্যাপকভাবে সহিংস অস্থিরতার জন্য পরিচিত।

ডি’সুজা বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই শক্তিশালী সম্পর্ক কী শুধুই ভারতের কৌশলগত চাপের প্রতিক্রিয়া, নাকি এটি ভারতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ? যদি পরেরটি সত্য হয়, তাহলে ঢাকার বর্তমান সরকার কি এ ধরনের নীতি অনুসরণ করার সামর্থ্য রাখে? এর উত্তর হলো, না।’

ভারতীয় এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেছেন, ‘এটি এখনো স্পষ্ট নয় যে, ড. ইউনূসের নীতিগুলো বাংলাদেশের প্রশাসনের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হবে কি না। কারণ, এই অন্তর্বর্তী সরকার একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা।’ তিনি আরও বলেন, ‘নয়াদিল্লিকে দেশের দ্রুত পরিবর্তিত অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নীতি তৈরি করতে সবদিকে নজর রাখতে হবে।’

পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে—বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে—দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবিলার বিনিময়ে তাদের (বাংলাদেশের) সমৃদ্ধি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু ভারতের এই বোঝাপড়া ঢাকায় নতুন রেজিম থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।’

বিসারিয়া বলেন, ‘পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক স্থাপন এবং ভারতের প্রভাব মোকাবিলা করার চেষ্টা করলে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ভারসাম্য অস্থিতিশীল হতে পারে। যেহেতু ভারত এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, তাই নয়াদিল্লিকে পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানের বর্ধিত প্রভাব নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় সামরিক অবস্থান এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হতে পারে।’

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নতুন মৈত্রী ভারতের কৌশলগত স্বার্থের ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপালের মাঝে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি করিডরের জন্য—যা চিকেন নেক নামে পরিচিত। এটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল একটি পথ। যা উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোকে ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে। এই করিডরের সর্বাধিক সংকীর্ণ অংশের প্রস্থ ২০-২২ কিলোমিটার।

ভারত আশঙ্কা করছে যে, চীন বাংলাদেশে উন্নয়নকাজের আড়ালে এই করিডরের কাছে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইতে পারে। এদিকে, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা মোতায়েন করছে এবং বেআইনি সীমান্ত পারাপার এবং চোরাচালান রোধে উচ্চ স্তরের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কাছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক স্থানান্তরের ব্যাপারে ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ থাকবে। বিশেষ করে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যারা মুক্তি পেয়েছেন তাদের তরফ থেকে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা আছে।’ তাঁর দাবি, ইসলামপন্থীদের কাছে যদি কোনো অস্ত্র যায় এবং সেগুলো কোনোভাবে ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে চলে যায় তা গুরুতর নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি করতে পারে।

তবে, জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যদিও বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা কঠিন সময় পার করছে, তবে একবার বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতি শান্ত হবে। যদিও বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান সম্পর্ক তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে, তবুও ভারতই বাংলাদেশে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে।’

শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, ‘উভয় পক্ষকেই বর্তমান ভাষাগত বিতর্ক পেছনে ফেলে কাজ শুরু করতে হবে। একবার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনরায় শুরু হলে, ভারতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ অবশ্যই মাথায় রাখা হবে এবং এটি ঘটবে কেবল তখনই যখন প্রতিবেশী দেশগুলো অপ্রয়োজনীয় সমস্যা সৃষ্টি না করে বিষয়গুলো সমাধানে প্রস্তুত হবে।’

অনুবাদ: আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত