৫৭ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে না

মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৩৫
আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২: ১৬
Thumbnail image

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের আপত্তির পরেও ঢাকঢোল পিটিয়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ঘোষণা দিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। শেষ পর্যন্ত ৯৭টির উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে ৬৮টিই ছিল সরকারি। আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চাভিলাষী এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যেতে পারেনি। প্রয়োজনমতো জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ অন্যান্য পরিষেবা দিতে না পারায় বিনিয়োগ আসেনি সেখানে। এই অবস্থায় সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৭টির কার্যক্রম স্থগিত করতে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, সরকারিভাবে নেওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে ১১টি অঞ্চলকে গুরুত্ব দিয়ে সচল করার পরিকল্পনা নিয়েছে বেজা। তবে বেসরকারি ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম চলমান থাকবে। আজ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। এ বিষয়ে বেজার উপব্যবস্থাপক সেঁজুতি বড়ুয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, বেজার অগ্রগতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই তথ্য ৭ জানুয়ারি প্রকাশ করা হবে।

সরকার প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল সচল রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে: চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (আগের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর), মৌলভীবাজারে শেরপুরে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ‘জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল’, কক্সবাজারে ‘মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল’, ‘জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল’, চট্টগ্রামে ‘আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চল’, টেকনাফে ‘সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক’, চাঁদপুরে ‘চাঁদপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল’, কুষ্টিয়ায় ‘কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল’ এবং কুড়িগ্রামে ‘ভুটানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল’। এ ছাড়া চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলও করা হতে পারে।

বেজার তথ্যমতে, সচল অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে প্রথম দফায় ছয়টিতে পুরোপুরি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ ও রাস্তার নির্মাণকাজ শেষ করা হবে। এরপর বাকি ৪-৫টি অঞ্চলের কাজ করবে বেজা। কিন্তু সরকারিভাবে নেওয়া আরও ৫৭-৫৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। কারণ, এসব অঞ্চলে কোনো কার্যক্রম নেই। কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল অঞ্চলগুলো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আজকের পত্রিকাকে বলেন, সংবাদ সম্মেলনে সরকারের এই পরিকল্পনা জানানো হবে। এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য প্রথমে প্রয়োজন বিনিয়োগ বৃদ্ধি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক জোনের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু একসঙ্গে এত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না, সে কথা আগেই সরকারকে বলা হয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিগত সরকার যখন ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়, তখনই বলেছিলাম, এটা সম্ভব নয়; বরং প্রথম অবস্থায় ২-৪টি বিশেষ অঞ্চল গঠন করা যেতে পারে। তারপর সেই অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অর্থনৈতিক অঞ্চল বাড়ানো যেত। সরকার সেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার এখন ১০-১২টি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে টার্গেট করে কাজ করছে। এটা ভালো উদ্যোগ। বিনিয়োগ বাড়াতে, অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগকারীদের সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, রাস্তা, পানির সংকট দূর করে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে। এরপর এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরে আরও অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করা যাবে। তবেই এটা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।

বেজার তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ৬২ হাজার একর জমি দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ খাসজমি, বাকি কিছু অধিগ্রহণ করা।

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১২ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫২টি কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে। আর ৭২টি কারখানার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে এসব কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে।

সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো সচল হলে ৬০ হাজার মানুষের (প্রত্যক্ষ ৪৫ হাজার ও পরোক্ষ ১৫ হাজার) কর্মসংস্থান হবে। এতে নতুন করে ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অবদান রাখবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা শুরু শুনেছি, কিন্তু একটির দেখাও পাইনি। বর্তমান সরকার যদি ১০ কিংবা ১২টি অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত নেয়, আর যদি সত্যিকার অর্থেই এগুলো বাস্তবায়ন করে, তাহলে তা ব্যবসায়ী এবং দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। তবে সেসব অঞ্চলে সব সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানি, আবাসন সমস্যার সমাধান হলে দ্রুত বিনিয়োগ বাড়বে।

নির্বাচিত অঞ্চলগুলোর অগ্রগতি

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’-এর কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর ৫ হাজার ২৪৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এই অঞ্চলে ১৪৪ উদ্যোক্তা বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৩৬ কোটি ডলার। এরই মধ্যে বিনিয়োগ এসেছে ১২৩ কোটি ডলার। আশা করা হচ্ছে, বিনিয়োগ হলে এই অঞ্চলের অধীনে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯২ জনের কর্মসংস্থান হবে।

মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের ২২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রকল্পটিতে ৬ উদ্যোক্তা ১৩০ কোটি ৬১ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। বিনিয়োগ এসেছে ৩ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের। এখানে ৪৪ হাজার ৯৩১ জনের কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত ‘জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এই অঞ্চলের জন্য ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের পর ৫ জন উদ্যোক্তা ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। ৮ কোটি ২৭ লাখ ডলার বিনিয়োগও করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হবে। এখানে ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৭৭০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এতে বিনিয়োগে আগ্রহী ৪ উদ্যোক্তা। তারা ৩১২ কোটি ২৩ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে ৮ কোটি ২৭ লাখ ডলার এসেছে। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩ হাজার ৪৬০ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ১৬৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ১৬ জন উদ্যোক্তা ১৭ কোটি ৫৬ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। বিনিয়োগ এসেছে ২ কোটি ১৬ লাখ ডলার। জামালপুরে আগামী মার্চ-এপ্রিলে উৎপাদন শুরু হবে।

সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে প্রকল্পের জন্য ১০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অঞ্চলটিতে ২১ উদ্যোক্তা ৩৬ কোটি ৭৭ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। তাদের মধ্যে নেদারল্যান্ডস ও সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরই মধ্যে বিনিয়োগ এসেছে ৫৮ লাখ ডলার। অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে কারখানার উৎপাদন শুরু হবে। এই অঞ্চলের মাধ্যমে ১১ হাজার ৬৩৪ মানুষের কর্মসংস্থানের আশা করা হচ্ছে।

আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চল চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। অঞ্চলটিতে দ্রুত উৎপাদন শুরু হবে।

চাঁদপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখানে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে।

কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৪০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রামে ভুটানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ছড়িয়ে পড়ছে এইচএমপিভি ভাইরাস, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ জানুন

ওবায়দুল কাদের–শেখ হেলাল পালিয়েছেন যশোর যুবদল নেতার সহযোগিতায়, দাবি সাবেক নেতার

আবুল খায়ের গ্রুপে চাকরি, শিক্ষার্থীরাও আবেদন করতে পারবে

শেখ হাসিনাসহ ৯৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল

বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে না: ব্রিটিশ এমপি রূপা হক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত