মারুফ ইসলাম
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে ঘিরে পৃথিবীতে আরেকটি স্নায়ু যুদ্ধ ধেয়ে আসছে কি না, তা নিয়ে সারা বিশ্বে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মতামতধর্মী সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসি এক সপ্তাহে অন্তত ছয়টি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যেগুলোতে মানবাধিকার, নৌপরিবহন, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, কম্পিউটিং ও মাইক্রো চিপ নিয়ে চীনের সঙ্গে দেশটির লড়াই চলছে বলে পশ্চিমা গবেষকরা দাবি করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিভূ যুক্তরাষ্ট্র ও বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারক সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাশক্তি বা সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরস্পরবিরোধী রাষ্ট্রজোট প্রকাশ্য লড়াইয়ে না নেমে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের যুদ্ধভাব বজায় রেখেছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চলা এমন সময় ইংরেজিতে ‘কোল্ড ওয়ার’ বা স্নায়ু যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বকে ‘মোটা দাগে’ ওই স্নায়ু যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। স্নায়ু যুদ্ধ মোকাবিলায় বিশ্ব ব্যবস্থা প্রস্তুত কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তিক্ত সত্য হচ্ছে, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই যুদ্ধ বিষয়ে অসচেতন ও অপ্রস্তুত। তবে অভিজাত দেশগুলো অতটা উদাসীন নয়। একুশ শতকের পৃথিবীটা কেমন হবে তা তাঁরা ইতিমধ্যেই কল্পনা করে নিয়েছেন এবং অর্থনীতি, বুদ্ধিমত্তা, কূটনীতি—ইত্যাদির ভিত্তিতে সেই পৃথিবীর একটি রূপও দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। চূড়ান্ত যুদ্ধটা হবে এসব নিয়ামককে কেন্দ্রে রেখেই।
যা হোক, পৃথিবী আবার দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোট। অপরটি ইউরেশিয়ান নেতৃত্বাধীন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর জোট, যার মধ্যে রয়েছে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ ও ইরানসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরেশিয়ান জোটে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাও যোগ দিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
পরিস্থিতি যখন এই, সংঘাত তখন অনিবার্য। পৃথিবী যে দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেল, নিঃসন্দেহে তার ভরকেন্দ্রে থাকবে সামরিক সংঘাত। দিন যত যাচ্ছে, সেই সংঘাতের সম্ভাবনা তত তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যে গতিতে পরমাণু অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
বিশ্বের বেশিরভাগ থিংক ট্যাংক বা গবেষণা সংস্থা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ক চলছে, যার কথা স্বীকারও করেছে চীনা গণমাধ্যম ও থিংক ট্যাংকগুলো। তবে ‘এ ধরনের বিশ্রী সম্পর্কের’ জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে এককভাবে দায়ী করেছে চীন।
চীনের এ অভিযোগের আনুষ্ঠানিক জবাব না দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংকগুলোও দিবানিশি বিষোদ্গার করে যাচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—উভয়েই চীনকে কটূক্তি করার ব্যাপারে ক্রমশ একে অপরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট রাজনীতিকদের বাইরেও সাধারণ মানুষও এসব আলোচনায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা দেশেই নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এবং তাদের কণ্ঠস্বর রয়েছে। তারা বিভিন্ন আলোচনায় নিজেকে জড়াতে পারেন।
অন্যদিকে চীনসহ এশিয়ার অনেক দেশেই নাগরিকদের এই সুযোগ নেই। তাতে অবশ্য খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না হোয়াইট হাউসের। এশিয়ার অনেক দেশের ভোটবিহীন অগণতান্ত্রিক শাসকের পিঠে এখনো স্নেহের হাত বুলিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রকে চেনা খুব মুশকিল।
একইভাবে বলা যায়, চীনকে চেনাও খুব মুশকিল। কখন কী করতে চায়, তা বোঝা মুশকিল। বর্তমানে বেইজিং চাচ্ছে, তার স্বৈরাচারী শাসনের ডিস্টোপিয়ান মডেলটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে। দেশটি সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায় ও তিব্বতীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে। দুর্বল ও ছোট দেশগুলোর সঙ্গে ‘পাড়ার বড় ভাই’সুলভ আচরণ করে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশ্যে নিন্দা করে। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকেই সমর্থন দিয়েছেন। এ যুদ্ধে তিনি কায়মনোবাক্যে পুতিনের বিজয় চান।
এ ছাড়া তাইওয়ানকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে চীন। তাইওয়ান একটি স্বাধীন দেশ। গত বছর দেশটি ইকনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকের তালিকায় এশিয়ার সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু এমন একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশকে চীন নিজের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে।
ইতিহাস বলছে, সতেরো শতকের দিকে তাইওয়ান প্রথম চীনের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ১৮৯৫ সালের যুদ্ধে জাপানের কাছে হেরে যায় চীন এবং জাপানের কাছে দ্বীপটি ছেড়ে দেয়। এরপর ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যাওয়ার পর চীন আবার দ্বীপটি দখল করে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনে কয়েক বছর গৃহযুদ্ধ ছিল। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিলে চীনের জাতীয়তাবাদী দলের নেতারা তাইওয়ানে পালিয়ে যান। পরবর্তী কয়েক দশক তাঁরা তাইওয়ান শাসন করেছিলেন।
এই ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করেই চীন দাবি করে যে, তাইওয়ান মূলত চীনা প্রদেশ ছিল। অন্যদিকে তাইওয়ানও একই ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, আধুনিক চীন রাষ্ট্র, যেটি ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের হাতে গঠিত হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের কখনোই অংশ ছিল না তাইওয়ান। কিংবা ১৯১১ সালের বিপ্লবের পর স্বাধীন হয়েছিল যে তাইওয়ান, সেটিও কখনোই চীন রাষ্ট্রের অংশ ছিল না।
তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশ তাইওয়ানকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীন এখন অবধি তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের একটি বৈরী সম্পর্ক চলছে।
আগেই বলা হয়েছে, চীনের বিরুদ্ধে উইঘুর ও তিব্বতীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধেও। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘মাস্তান’ দেশ। ইরাকের কপালে চিরস্থায়ী দুর্ভাগ্যের তিলক এঁকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই ২০০৩ সালের মার্চে ইরাকে হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই হামলায় পুরো ইরাক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই যে দুর্ভাগ্য নেমে এল ইরাকের ললাটে, তা আজও ঘুচল না। যেন চিরস্থায়ী হয়ে সেঁটে গেছে।
দুর্বল দেশগুলোর জন্যও কম হুমকি নয় যুক্তরাষ্ট্র। যেমন রুয়ান্ডার কথাই ধরা যাক। দেশটির বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ জারি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পোশাকখাতে রুয়ান্ডার শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিত করেছেন, সেটি এখনো বহাল রয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং একজন ঠান্ডা মাথার স্বৈরাচারী। দূরদর্শী এবং প্রতিটি ধাপ তিনি হিসাব করে ফেলেন। তাই ৬৯ বছর বয়সী এই ‘চীনা লর্ডের’ মুঠো থেকে বের হতে চাচ্ছে পশ্চিমারা। বিশেষ করে পশ্চিমারা চেষ্টা করছে, চীনের ওপর থেকে তাদের অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে। তারা আবার শিল্প-কারখানার চাকরি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। পারস্য উপসাগর দিয়ে জ্বালানি তেল যায় চীনের প্লাস্টিক কারখানাগুলোতে। সেই অযৌক্তিক সরবরাহ শৃঙ্খলও ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে পশ্চিমারা।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এশিয়ান ঋণের প্রতি তাদের যে সীমাহীন আসক্তি রয়েছে, সেখান থেকেও তাদের বের হয়ে আসা উচিত। বর্তমানে চীন ও জাপানের কাছ থেকে ১ দশমিক ৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
চীন মিত্র হিসেবেও খুব একটা সুবিধার নয়। তাকেও তুরস্কের মতো সমস্যাপূর্ণ মিত্র মনে করা হয়। পশ্চিমারা মনে করেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ‘চীন আমাদের সামগ্রিক মূল্যবোধের জন্যই হুমকি’।
দুই দেশের এসব বাগ্যুদ্ধ, বাণিজ্যযুদ্ধ, আদর্শিক যুদ্ধ মূলত প্রচ্ছন্ন ঠান্ডাযুদ্ধেরই ইঙ্গিত দেয়। তবে পরিণতি তখনই সবচেয়ে খারাপ হবে, যখন পরাশক্তিগুলো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে।
সেই দিন সম্ভবত দুয়ারে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন কি?
সূত্র: ইনডিপেনডেন্ট, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়চে ভেলে, সিএনএন ও কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে ঘিরে পৃথিবীতে আরেকটি স্নায়ু যুদ্ধ ধেয়ে আসছে কি না, তা নিয়ে সারা বিশ্বে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মতামতধর্মী সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসি এক সপ্তাহে অন্তত ছয়টি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যেগুলোতে মানবাধিকার, নৌপরিবহন, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, কম্পিউটিং ও মাইক্রো চিপ নিয়ে চীনের সঙ্গে দেশটির লড়াই চলছে বলে পশ্চিমা গবেষকরা দাবি করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিভূ যুক্তরাষ্ট্র ও বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারক সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাশক্তি বা সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরস্পরবিরোধী রাষ্ট্রজোট প্রকাশ্য লড়াইয়ে না নেমে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের যুদ্ধভাব বজায় রেখেছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চলা এমন সময় ইংরেজিতে ‘কোল্ড ওয়ার’ বা স্নায়ু যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বকে ‘মোটা দাগে’ ওই স্নায়ু যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। স্নায়ু যুদ্ধ মোকাবিলায় বিশ্ব ব্যবস্থা প্রস্তুত কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তিক্ত সত্য হচ্ছে, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই যুদ্ধ বিষয়ে অসচেতন ও অপ্রস্তুত। তবে অভিজাত দেশগুলো অতটা উদাসীন নয়। একুশ শতকের পৃথিবীটা কেমন হবে তা তাঁরা ইতিমধ্যেই কল্পনা করে নিয়েছেন এবং অর্থনীতি, বুদ্ধিমত্তা, কূটনীতি—ইত্যাদির ভিত্তিতে সেই পৃথিবীর একটি রূপও দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। চূড়ান্ত যুদ্ধটা হবে এসব নিয়ামককে কেন্দ্রে রেখেই।
যা হোক, পৃথিবী আবার দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোট। অপরটি ইউরেশিয়ান নেতৃত্বাধীন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর জোট, যার মধ্যে রয়েছে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ ও ইরানসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরেশিয়ান জোটে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাও যোগ দিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
পরিস্থিতি যখন এই, সংঘাত তখন অনিবার্য। পৃথিবী যে দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেল, নিঃসন্দেহে তার ভরকেন্দ্রে থাকবে সামরিক সংঘাত। দিন যত যাচ্ছে, সেই সংঘাতের সম্ভাবনা তত তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যে গতিতে পরমাণু অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
বিশ্বের বেশিরভাগ থিংক ট্যাংক বা গবেষণা সংস্থা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ক চলছে, যার কথা স্বীকারও করেছে চীনা গণমাধ্যম ও থিংক ট্যাংকগুলো। তবে ‘এ ধরনের বিশ্রী সম্পর্কের’ জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে এককভাবে দায়ী করেছে চীন।
চীনের এ অভিযোগের আনুষ্ঠানিক জবাব না দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংকগুলোও দিবানিশি বিষোদ্গার করে যাচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—উভয়েই চীনকে কটূক্তি করার ব্যাপারে ক্রমশ একে অপরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট রাজনীতিকদের বাইরেও সাধারণ মানুষও এসব আলোচনায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা দেশেই নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এবং তাদের কণ্ঠস্বর রয়েছে। তারা বিভিন্ন আলোচনায় নিজেকে জড়াতে পারেন।
অন্যদিকে চীনসহ এশিয়ার অনেক দেশেই নাগরিকদের এই সুযোগ নেই। তাতে অবশ্য খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না হোয়াইট হাউসের। এশিয়ার অনেক দেশের ভোটবিহীন অগণতান্ত্রিক শাসকের পিঠে এখনো স্নেহের হাত বুলিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রকে চেনা খুব মুশকিল।
একইভাবে বলা যায়, চীনকে চেনাও খুব মুশকিল। কখন কী করতে চায়, তা বোঝা মুশকিল। বর্তমানে বেইজিং চাচ্ছে, তার স্বৈরাচারী শাসনের ডিস্টোপিয়ান মডেলটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে। দেশটি সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায় ও তিব্বতীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে। দুর্বল ও ছোট দেশগুলোর সঙ্গে ‘পাড়ার বড় ভাই’সুলভ আচরণ করে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশ্যে নিন্দা করে। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকেই সমর্থন দিয়েছেন। এ যুদ্ধে তিনি কায়মনোবাক্যে পুতিনের বিজয় চান।
এ ছাড়া তাইওয়ানকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে চীন। তাইওয়ান একটি স্বাধীন দেশ। গত বছর দেশটি ইকনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকের তালিকায় এশিয়ার সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু এমন একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশকে চীন নিজের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে।
ইতিহাস বলছে, সতেরো শতকের দিকে তাইওয়ান প্রথম চীনের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ১৮৯৫ সালের যুদ্ধে জাপানের কাছে হেরে যায় চীন এবং জাপানের কাছে দ্বীপটি ছেড়ে দেয়। এরপর ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যাওয়ার পর চীন আবার দ্বীপটি দখল করে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনে কয়েক বছর গৃহযুদ্ধ ছিল। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিলে চীনের জাতীয়তাবাদী দলের নেতারা তাইওয়ানে পালিয়ে যান। পরবর্তী কয়েক দশক তাঁরা তাইওয়ান শাসন করেছিলেন।
এই ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করেই চীন দাবি করে যে, তাইওয়ান মূলত চীনা প্রদেশ ছিল। অন্যদিকে তাইওয়ানও একই ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, আধুনিক চীন রাষ্ট্র, যেটি ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের হাতে গঠিত হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের কখনোই অংশ ছিল না তাইওয়ান। কিংবা ১৯১১ সালের বিপ্লবের পর স্বাধীন হয়েছিল যে তাইওয়ান, সেটিও কখনোই চীন রাষ্ট্রের অংশ ছিল না।
তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশ তাইওয়ানকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীন এখন অবধি তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের একটি বৈরী সম্পর্ক চলছে।
আগেই বলা হয়েছে, চীনের বিরুদ্ধে উইঘুর ও তিব্বতীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধেও। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘মাস্তান’ দেশ। ইরাকের কপালে চিরস্থায়ী দুর্ভাগ্যের তিলক এঁকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই ২০০৩ সালের মার্চে ইরাকে হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই হামলায় পুরো ইরাক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই যে দুর্ভাগ্য নেমে এল ইরাকের ললাটে, তা আজও ঘুচল না। যেন চিরস্থায়ী হয়ে সেঁটে গেছে।
দুর্বল দেশগুলোর জন্যও কম হুমকি নয় যুক্তরাষ্ট্র। যেমন রুয়ান্ডার কথাই ধরা যাক। দেশটির বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ জারি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পোশাকখাতে রুয়ান্ডার শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিত করেছেন, সেটি এখনো বহাল রয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং একজন ঠান্ডা মাথার স্বৈরাচারী। দূরদর্শী এবং প্রতিটি ধাপ তিনি হিসাব করে ফেলেন। তাই ৬৯ বছর বয়সী এই ‘চীনা লর্ডের’ মুঠো থেকে বের হতে চাচ্ছে পশ্চিমারা। বিশেষ করে পশ্চিমারা চেষ্টা করছে, চীনের ওপর থেকে তাদের অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে। তারা আবার শিল্প-কারখানার চাকরি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। পারস্য উপসাগর দিয়ে জ্বালানি তেল যায় চীনের প্লাস্টিক কারখানাগুলোতে। সেই অযৌক্তিক সরবরাহ শৃঙ্খলও ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে পশ্চিমারা।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এশিয়ান ঋণের প্রতি তাদের যে সীমাহীন আসক্তি রয়েছে, সেখান থেকেও তাদের বের হয়ে আসা উচিত। বর্তমানে চীন ও জাপানের কাছ থেকে ১ দশমিক ৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
চীন মিত্র হিসেবেও খুব একটা সুবিধার নয়। তাকেও তুরস্কের মতো সমস্যাপূর্ণ মিত্র মনে করা হয়। পশ্চিমারা মনে করেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ‘চীন আমাদের সামগ্রিক মূল্যবোধের জন্যই হুমকি’।
দুই দেশের এসব বাগ্যুদ্ধ, বাণিজ্যযুদ্ধ, আদর্শিক যুদ্ধ মূলত প্রচ্ছন্ন ঠান্ডাযুদ্ধেরই ইঙ্গিত দেয়। তবে পরিণতি তখনই সবচেয়ে খারাপ হবে, যখন পরাশক্তিগুলো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে।
সেই দিন সম্ভবত দুয়ারে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন কি?
সূত্র: ইনডিপেনডেন্ট, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়চে ভেলে, সিএনএন ও কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন
আব্রাহাম অ্যাকর্ডস মূলত একটি চটকদার বিষয়। এতে বাস্তব, স্থায়ী আঞ্চলিক শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছুই এতে ছিল না। যেসব রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেছে তারা তা করেছে—কারণ, তারা ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনে প্রভাব বিস্তারের পথ হিসেবে দেখে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসরায়েলের ওপর মার
৮ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেখেয়ালি, সেটা আগা থেকেই সবার জানা। তবে দেশটির নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে এসেও তিনি অসংলগ্ন, অশ্লীল, স্বৈরতান্ত্রিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এ থেকে অন্তত একটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে একটি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ সরকারের নেতৃত্ব দেবেন।
৮ দিন আগেএবারের আইএমইএক্স মহড়ায়ও কিছু দেশ আছে যারা আগেরবারও অংশগ্রহণ করেছিল। এসব দেশের নাম আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই মহড়ার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—ইরান ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেকে এমন দেশগুলোর কক্ষপথে নিয়ে যাচ্ছে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত
৯ দিন আগেএই শহরের সমর্থকেরা, এর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। শহরটিতে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সংযোগ সাধন করা হবে বলেও তাঁরা উল্লেখ করেন। কিন্তু এই শহরের মূল ধারণাটি আসলে জটিল। মূলত এই শহরকে এমনভাবে গড়ে তোলা হবে যাতে এটি একটি ‘অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে এবং ভারতে প্রবেশে একটি দুয়ার হি
৯ দিন আগে