জাহাঙ্গীর আলম
অন্যের আবেগ অনুভব করা, আবেগের মূল্য দেওয়া এবং সহানুভূতি দেখানোকে অত্যন্ত সুন্দর মানবিক গুণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই ধরনের মানসিকতাই সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা, আগ্রাসন এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মতো মানসিক বিকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অন্তত কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এ আশঙ্কা প্রবল।
শিশুদের অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও পদক্ষেপের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইউরোপ আমেরিকায় অনেক কর্মসূচি রয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত কারও প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য নিজেকে তাঁর স্থানে কল্পনা করার কৌশলটি প্রশংসনীয়। শিশুদের শেখানো হয়, অন্য লোকদের অনুভূতি বোঝা তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে প্রাপ্তবয়স্কদের জগতে সহানুভূতির গুণাবলি কম স্পষ্ট। অবশ্য মহামারির মধ্যে মানুষের যে বিচ্ছিন্নতা, সংস্কৃতির সংঘাতজনিত ক্রোধ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষ্ঠুরতার অবাধ চর্চার অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে সময় অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করাটা হয়তো মানুষ সহজে নিতে পারবে না।
কিন্তু একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, অস্থানে সহানুভূতি প্রদর্শন অন্যদের জন্য খারাপ হতে পারে। এটি আপনাকে একপর্যায়ে ক্লান্তি এবং উদাসীনতার দিকে পরিচালিত করতে পারে। দেখা যাবে, যাদের সত্যিই প্রয়োজন আপনি তাদের আর সাহায্য করতে পারছেন না। আরও খারাপ বিষয় হলো—জনগণের সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রবণতা এমনকি তাদের আক্রমণাত্মক এবং নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইংরেজি ইমপ্যাথি (সহানুভূতি) শব্দটি এসেছে জার্মান শব্দ আইনফুলং (Einfühlung) থেকে। ১৮০০-এর দশকের শেষ দিকে এটি ইংরেজিতে আত্মীকৃত হয়। ব্যাপক অর্থে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘গভীরে অনুভব’। তবে নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী জুডিথ হল গত বছরের সেপ্টেম্বরে সায়েন্টিফিক আমেরিকান সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘সহানুভূতি মৌলিকভাবে একটি কমল শব্দ।’ কেউ কেউ অন্যের মন পড়ার ক্ষমতা হিসেবেও দেখেন। এই অনুভূতি মানুষের সঙ্গে সংযুক্তির বোধ তৈরি করে। অন্যরা এটিকে অন্যের জন্য উদ্বেগ (মনোযোগ) প্রদর্শনের বিষয়ে একটি নৈতিক অবস্থান হিসেবেও দেখে। তবে গবেষকদের এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
ধারণাগত কমলতা সত্ত্বেও, বেশির ভাগ মানুষ সহানুভূতিকে দেখেন অন্য লোকদের অবস্থা, ভোগান্তি এবং জটিলতা বোঝার চেষ্টা করা এবং উদ্বিগ্ন হওয়া বোঝাতে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী পল ব্লুম বলছেন, সহানুভূতি হলো কারও অনুভূতি অনুভব করার জন্য উদ্যোগী হওয়া। অন্যের সমস্যাকে নিজের বলে বোধ করা।
এই সংকীর্ণ অর্থে, সহানুভূতি ভালোর জন্য একটি সুস্পষ্ট শক্তি বলেই মনে হতে পারে। সাধারণ জ্ঞান আমাদের বলে, অন্য কারও ব্যথা অনুভব করা আমাদের সেই ব্যক্তির যত্ন নিতে এবং সাহায্য করতে অনুপ্রাণিত করে। ‘ট্রেন্ডস ইন কগনিটিভ সায়েন্সেস’ জার্নালে এমনটাই লিখেছেন পল ব্লুম।
তবে যাই হোক, এটি কিছু ক্ষেত্রে কপট নৈতিক দ্বিধা বাড়িয়ে দিতে পারে।
এর ব্যাখ্যায় ব্লুম ১০ বছর বয়সী শেরি সামারস নামে এক বালিকার গল্প বলেন। শেরির মারাত্মক রোগ। কিন্তু সে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে। চিকিৎসা পেলেই রোগ সেরে যাবে এবং তার জীবনও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এই অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং খুব সাহসী মেয়েটিও জানতে পেরেছে তাকে চিকিৎসা পেতে সপ্তাহ বা মাস অপেক্ষা করতে হবে।
এখন আপনি যদি তাকে তালিকার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান তাহলে কী করবেন?
একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সামনে শেরির কাল্পনিক গল্প উপস্থাপন করা হয়েছিল। এমনভাবে গল্পটি বলা হয়েছিল যাতে শেরির প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতিতে আর্দ্র হয়ে ওঠে মন। দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ তাকেই সবার আগে চিকিৎসা দিতে তালিকার শীর্ষে রেখেছে।
এর আগে পল ব্লুম তাঁর গবেষণায় যেমনটি উল্লেখ করেছেন, মানুষের এমন সিদ্ধান্তের অর্থ হতে পারে প্রথম তালিকায় শেরির ওপরে থাকা প্রতিটি শিশুকে আরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো তাদের অনেকে আছে যাদের আরও জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া জরুরি।
এই ধরনের ঘটনাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন ‘শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগী প্রভাব’। তাকেই সহযোগিতা করার জন্য মানুষের উদ্যোগী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যার ভোগান্তি তাদের কাছে দৃশ্যমান। যে দাতব্য প্রতিষ্ঠান একটি নামধারী শিশুর আবেগঘন গল্প নিয়ে প্রচারণা চালায় তারা যেভাবে সাড়া পাবে, সে তুলনায় ১ হাজার বেনামী শিশুর বর্ণনা দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে ততোটা সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
অবশ্য সত্যিই কাউকে সাহায্য করার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করতে ব্যক্তিগত করুণ গল্প ব্যবহার করার মধ্যে কোনো ভুল বা দোষ নেই। তবে ‘শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগী প্রভাব’-এর কারণে হয়তো বিলিয়ন ডলার অনুদান থেকে সেই মানুষগুলো বঞ্চিত হবে যাদের সংখ্যা ও প্রয়োজন আরো অনেক বেশি।
লক্ষ্য যদি হয় যতটা সম্ভব শিশুদের সাহায্য করা তাহলে উন্নয়নশীল বিশ্বে কৃমিনাশক বা এমন কর্মসূচিতে ব্যয় করা একটি ডলার অনেক মূল্যবান। একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ১০ ডলার দান করার চেয়ে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং যেখানে ‘শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগী’ সেখানে প্রকৃত সমস্যাগুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা বেশ কঠিন হতে পারে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যাদের বর্তমানে কোনো অস্তিত্বই নেই, তাদের নিয়ে মানুষ কি সেভাবে ভাবছে?
মানুষের মনে বিমূর্ত অপরিচিতদের প্রতি সহানুভূতি প্রসারিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। কয়েক হাজার বছর আগে স্টোয়িকরা এই জিনিসটিকে ‘ওইকিওসিস’ ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। কীভাবে আমাদের সান্নিধ্য থেকে দূরবর্তীতের প্রতি আমাদের সহানুভূতি এবং সখ্য ক্রমে হ্রাস পায়। ওইকিওসিসের রিংগুলোর একটি সিরিজ কল্পনা করুন: গবাক্ষে দর্শক স্বয়ং, সবচেয়ে ভেতরের রিংটি একজনের পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করে, পরবর্তী রিংটি তার বন্ধুদের, তার পরে প্রতিবেশী, তারপরে একজনের গোত্র বা সম্প্রদায়, তারপরে দেশ এবং পরে আরও অনেক কিছু।
পল ব্লুম বলছেন, সহানুভূতি জাগানো বা দেখানো খারাপ কিছু নয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু সমস্যাটি তখন হাজির হয় যখন বদ অভিনেতারা আমাদের আচরণ এবং বিশ্বাসকে প্রভাবিত করার জন্য এই ‘সহানুভূতির বৃত্তগুলো’ হাইজ্যাক করে। এভাবে যারা আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং সমরূপ তাদের জন্য আমাদের স্বাভাবিক সহানুভূতিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার যারা এমন নয় তাদের প্রতি বিদ্বেষ উসকেও দিতে পারে।
রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মীরা প্রায়শই ‘আমরা এবং তারা’ ধারণা নিয়ে খেলেন। রাজনৈতিক অবস্থান তৈরিতে তাঁরা সহানুভূতি এবং শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগীদের আমাদের সামনে এনে হাজির করেন। এর মোক্ষম উদারহরণ হিসেবে আমরা ভারতে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমার কথা উল্লেখ করতে পারি। এই সিনেমার গল্প ও দৃশ্যায়ন ভারতে মুসলিম বিদ্বেষকেই উসকে দিচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক প্রেক্ষাগৃহে মানুষ উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
এ ধরনের অসৎ আবেগের খেলা একটি জনগোষ্ঠীকে ‘বাতিল’ করার জন্য কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যেমন: অভিবাসীদের দানব/খারাপ হিসেবে উপস্থাপন এবং আপাত বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে।
পল ব্লুম লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে গণপিটুনির ঘটনাগুলো কখনও কখনও কিছু খবর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ঘটেছিল। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের অপরাধের শিকার হচ্ছেন শ্বেতাঙ্গরা—এমন নানা খবরের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
১৯৪১ সালে পার্ল হারবার আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা পারমাণবিক হামলার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে মানুষের স্বাভাবিক সহানুভূতিশীলতার প্রবণতাকে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন, ১০ লাখ মার্কিন সৈন্য—যারা আমাদের ছেলে—তাদের জীবন রক্ষা পাবে যদি আমরা দূর দেশ জাপানের জনগণের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করি। এভাবেই ১৯৪৫ সালের আগস্টে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার ন্যায্যতার ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল।
সহানুভূতির একটি চূড়ান্ত নেতিবাচক দিক হলো— মাঝে মাঝে এর অক্ষম মানসিক প্রভাব। দার্শনিক সুজান ল্যাঙ্গার একবার সহানুভূতিকে ‘ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতার অনিচ্ছাকৃত লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য বলে মনে হয় যখন আমরা কাউকে কষ্ট পেতে দেখি, বিশেষ করে কোনো প্রিয়জন।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটির স্নায়ুবিজ্ঞানী তানিয়া সিঙ্গার তাঁর গবেষণায় বলেছেন, যদিও সুখ ভাগাভাগি করা অবশ্যই খুব আনন্দদায়ক, তবে দুঃখ ভাগ করে নেওয়া অনেক সময় কঠিন হতে পারে।
এদিকে সিঙ্গার এবং তাঁর সহকর্মী জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী ওলগা ক্লিমেকি গবেষণা প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে কষ্ট অনুভব করা কর্মের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। এই ধরনের যন্ত্রণা উদাসীনতা, বিচ্ছিন্নতা এবং অসহায়ত্বের অনুভূতির দিকে পরিচালিত করে। এমনকি স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হতে পারে। করোনা মহামারীতে সহানুভূতির ক্লান্তির এই অনুভূতি সেবাদাতাদের মধ্যে বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সদের মধ্যে এটি দেখা গেছে।
গবেষণাটিতে পরামর্শ দেওয়া হয়, আমাদের সহানুভূতি (ইমপ্যাথি) এবং এর আপাত প্রতিশব্দ—‘সমবেদনা’ (কমপ্যাশন)-এর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য করা উচিত। সহানুভূতি যদি কারো জুতায় পা গলানোর বিষয় হয়, তাহলে সহানুভূতি হলো ‘অন্যের কষ্ট দেখে উদ্বেগের অনুভূতি, যেখানে সাহায্য করার অনুপ্রেরণাও থাকে’।
সিঙ্গার এবং ক্লিমেকির মতে, সহানুভূতিশীল হতে হবে, এর মানে এই নয় যে আপনাকে কারো অনুভূতি শেয়ার করতে হবে। এটা অন্যদের প্রতি দয়ার হাত প্রসারিত করা।
অন্যের আবেগ অনুভব করা, আবেগের মূল্য দেওয়া এবং সহানুভূতি দেখানোকে অত্যন্ত সুন্দর মানবিক গুণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই ধরনের মানসিকতাই সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা, আগ্রাসন এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মতো মানসিক বিকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অন্তত কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এ আশঙ্কা প্রবল।
শিশুদের অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও পদক্ষেপের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইউরোপ আমেরিকায় অনেক কর্মসূচি রয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত কারও প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য নিজেকে তাঁর স্থানে কল্পনা করার কৌশলটি প্রশংসনীয়। শিশুদের শেখানো হয়, অন্য লোকদের অনুভূতি বোঝা তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে প্রাপ্তবয়স্কদের জগতে সহানুভূতির গুণাবলি কম স্পষ্ট। অবশ্য মহামারির মধ্যে মানুষের যে বিচ্ছিন্নতা, সংস্কৃতির সংঘাতজনিত ক্রোধ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষ্ঠুরতার অবাধ চর্চার অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে সময় অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করাটা হয়তো মানুষ সহজে নিতে পারবে না।
কিন্তু একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, অস্থানে সহানুভূতি প্রদর্শন অন্যদের জন্য খারাপ হতে পারে। এটি আপনাকে একপর্যায়ে ক্লান্তি এবং উদাসীনতার দিকে পরিচালিত করতে পারে। দেখা যাবে, যাদের সত্যিই প্রয়োজন আপনি তাদের আর সাহায্য করতে পারছেন না। আরও খারাপ বিষয় হলো—জনগণের সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রবণতা এমনকি তাদের আক্রমণাত্মক এবং নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইংরেজি ইমপ্যাথি (সহানুভূতি) শব্দটি এসেছে জার্মান শব্দ আইনফুলং (Einfühlung) থেকে। ১৮০০-এর দশকের শেষ দিকে এটি ইংরেজিতে আত্মীকৃত হয়। ব্যাপক অর্থে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘গভীরে অনুভব’। তবে নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী জুডিথ হল গত বছরের সেপ্টেম্বরে সায়েন্টিফিক আমেরিকান সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘সহানুভূতি মৌলিকভাবে একটি কমল শব্দ।’ কেউ কেউ অন্যের মন পড়ার ক্ষমতা হিসেবেও দেখেন। এই অনুভূতি মানুষের সঙ্গে সংযুক্তির বোধ তৈরি করে। অন্যরা এটিকে অন্যের জন্য উদ্বেগ (মনোযোগ) প্রদর্শনের বিষয়ে একটি নৈতিক অবস্থান হিসেবেও দেখে। তবে গবেষকদের এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
ধারণাগত কমলতা সত্ত্বেও, বেশির ভাগ মানুষ সহানুভূতিকে দেখেন অন্য লোকদের অবস্থা, ভোগান্তি এবং জটিলতা বোঝার চেষ্টা করা এবং উদ্বিগ্ন হওয়া বোঝাতে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী পল ব্লুম বলছেন, সহানুভূতি হলো কারও অনুভূতি অনুভব করার জন্য উদ্যোগী হওয়া। অন্যের সমস্যাকে নিজের বলে বোধ করা।
এই সংকীর্ণ অর্থে, সহানুভূতি ভালোর জন্য একটি সুস্পষ্ট শক্তি বলেই মনে হতে পারে। সাধারণ জ্ঞান আমাদের বলে, অন্য কারও ব্যথা অনুভব করা আমাদের সেই ব্যক্তির যত্ন নিতে এবং সাহায্য করতে অনুপ্রাণিত করে। ‘ট্রেন্ডস ইন কগনিটিভ সায়েন্সেস’ জার্নালে এমনটাই লিখেছেন পল ব্লুম।
তবে যাই হোক, এটি কিছু ক্ষেত্রে কপট নৈতিক দ্বিধা বাড়িয়ে দিতে পারে।
এর ব্যাখ্যায় ব্লুম ১০ বছর বয়সী শেরি সামারস নামে এক বালিকার গল্প বলেন। শেরির মারাত্মক রোগ। কিন্তু সে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে। চিকিৎসা পেলেই রোগ সেরে যাবে এবং তার জীবনও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এই অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং খুব সাহসী মেয়েটিও জানতে পেরেছে তাকে চিকিৎসা পেতে সপ্তাহ বা মাস অপেক্ষা করতে হবে।
এখন আপনি যদি তাকে তালিকার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান তাহলে কী করবেন?
একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সামনে শেরির কাল্পনিক গল্প উপস্থাপন করা হয়েছিল। এমনভাবে গল্পটি বলা হয়েছিল যাতে শেরির প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতিতে আর্দ্র হয়ে ওঠে মন। দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ তাকেই সবার আগে চিকিৎসা দিতে তালিকার শীর্ষে রেখেছে।
এর আগে পল ব্লুম তাঁর গবেষণায় যেমনটি উল্লেখ করেছেন, মানুষের এমন সিদ্ধান্তের অর্থ হতে পারে প্রথম তালিকায় শেরির ওপরে থাকা প্রতিটি শিশুকে আরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো তাদের অনেকে আছে যাদের আরও জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া জরুরি।
এই ধরনের ঘটনাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন ‘শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগী প্রভাব’। তাকেই সহযোগিতা করার জন্য মানুষের উদ্যোগী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যার ভোগান্তি তাদের কাছে দৃশ্যমান। যে দাতব্য প্রতিষ্ঠান একটি নামধারী শিশুর আবেগঘন গল্প নিয়ে প্রচারণা চালায় তারা যেভাবে সাড়া পাবে, সে তুলনায় ১ হাজার বেনামী শিশুর বর্ণনা দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে ততোটা সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
অবশ্য সত্যিই কাউকে সাহায্য করার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করতে ব্যক্তিগত করুণ গল্প ব্যবহার করার মধ্যে কোনো ভুল বা দোষ নেই। তবে ‘শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগী প্রভাব’-এর কারণে হয়তো বিলিয়ন ডলার অনুদান থেকে সেই মানুষগুলো বঞ্চিত হবে যাদের সংখ্যা ও প্রয়োজন আরো অনেক বেশি।
লক্ষ্য যদি হয় যতটা সম্ভব শিশুদের সাহায্য করা তাহলে উন্নয়নশীল বিশ্বে কৃমিনাশক বা এমন কর্মসূচিতে ব্যয় করা একটি ডলার অনেক মূল্যবান। একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ১০ ডলার দান করার চেয়ে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং যেখানে ‘শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগী’ সেখানে প্রকৃত সমস্যাগুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা বেশ কঠিন হতে পারে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যাদের বর্তমানে কোনো অস্তিত্বই নেই, তাদের নিয়ে মানুষ কি সেভাবে ভাবছে?
মানুষের মনে বিমূর্ত অপরিচিতদের প্রতি সহানুভূতি প্রসারিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। কয়েক হাজার বছর আগে স্টোয়িকরা এই জিনিসটিকে ‘ওইকিওসিস’ ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। কীভাবে আমাদের সান্নিধ্য থেকে দূরবর্তীতের প্রতি আমাদের সহানুভূতি এবং সখ্য ক্রমে হ্রাস পায়। ওইকিওসিসের রিংগুলোর একটি সিরিজ কল্পনা করুন: গবাক্ষে দর্শক স্বয়ং, সবচেয়ে ভেতরের রিংটি একজনের পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করে, পরবর্তী রিংটি তার বন্ধুদের, তার পরে প্রতিবেশী, তারপরে একজনের গোত্র বা সম্প্রদায়, তারপরে দেশ এবং পরে আরও অনেক কিছু।
পল ব্লুম বলছেন, সহানুভূতি জাগানো বা দেখানো খারাপ কিছু নয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু সমস্যাটি তখন হাজির হয় যখন বদ অভিনেতারা আমাদের আচরণ এবং বিশ্বাসকে প্রভাবিত করার জন্য এই ‘সহানুভূতির বৃত্তগুলো’ হাইজ্যাক করে। এভাবে যারা আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং সমরূপ তাদের জন্য আমাদের স্বাভাবিক সহানুভূতিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার যারা এমন নয় তাদের প্রতি বিদ্বেষ উসকেও দিতে পারে।
রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মীরা প্রায়শই ‘আমরা এবং তারা’ ধারণা নিয়ে খেলেন। রাজনৈতিক অবস্থান তৈরিতে তাঁরা সহানুভূতি এবং শনাক্তযোগ্য ভুক্তভোগীদের আমাদের সামনে এনে হাজির করেন। এর মোক্ষম উদারহরণ হিসেবে আমরা ভারতে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমার কথা উল্লেখ করতে পারি। এই সিনেমার গল্প ও দৃশ্যায়ন ভারতে মুসলিম বিদ্বেষকেই উসকে দিচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক প্রেক্ষাগৃহে মানুষ উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
এ ধরনের অসৎ আবেগের খেলা একটি জনগোষ্ঠীকে ‘বাতিল’ করার জন্য কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যেমন: অভিবাসীদের দানব/খারাপ হিসেবে উপস্থাপন এবং আপাত বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে।
পল ব্লুম লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে গণপিটুনির ঘটনাগুলো কখনও কখনও কিছু খবর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ঘটেছিল। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের অপরাধের শিকার হচ্ছেন শ্বেতাঙ্গরা—এমন নানা খবরের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
১৯৪১ সালে পার্ল হারবার আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা পারমাণবিক হামলার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে মানুষের স্বাভাবিক সহানুভূতিশীলতার প্রবণতাকে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন, ১০ লাখ মার্কিন সৈন্য—যারা আমাদের ছেলে—তাদের জীবন রক্ষা পাবে যদি আমরা দূর দেশ জাপানের জনগণের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করি। এভাবেই ১৯৪৫ সালের আগস্টে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার ন্যায্যতার ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল।
সহানুভূতির একটি চূড়ান্ত নেতিবাচক দিক হলো— মাঝে মাঝে এর অক্ষম মানসিক প্রভাব। দার্শনিক সুজান ল্যাঙ্গার একবার সহানুভূতিকে ‘ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতার অনিচ্ছাকৃত লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য বলে মনে হয় যখন আমরা কাউকে কষ্ট পেতে দেখি, বিশেষ করে কোনো প্রিয়জন।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটির স্নায়ুবিজ্ঞানী তানিয়া সিঙ্গার তাঁর গবেষণায় বলেছেন, যদিও সুখ ভাগাভাগি করা অবশ্যই খুব আনন্দদায়ক, তবে দুঃখ ভাগ করে নেওয়া অনেক সময় কঠিন হতে পারে।
এদিকে সিঙ্গার এবং তাঁর সহকর্মী জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী ওলগা ক্লিমেকি গবেষণা প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে কষ্ট অনুভব করা কর্মের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। এই ধরনের যন্ত্রণা উদাসীনতা, বিচ্ছিন্নতা এবং অসহায়ত্বের অনুভূতির দিকে পরিচালিত করে। এমনকি স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হতে পারে। করোনা মহামারীতে সহানুভূতির ক্লান্তির এই অনুভূতি সেবাদাতাদের মধ্যে বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সদের মধ্যে এটি দেখা গেছে।
গবেষণাটিতে পরামর্শ দেওয়া হয়, আমাদের সহানুভূতি (ইমপ্যাথি) এবং এর আপাত প্রতিশব্দ—‘সমবেদনা’ (কমপ্যাশন)-এর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য করা উচিত। সহানুভূতি যদি কারো জুতায় পা গলানোর বিষয় হয়, তাহলে সহানুভূতি হলো ‘অন্যের কষ্ট দেখে উদ্বেগের অনুভূতি, যেখানে সাহায্য করার অনুপ্রেরণাও থাকে’।
সিঙ্গার এবং ক্লিমেকির মতে, সহানুভূতিশীল হতে হবে, এর মানে এই নয় যে আপনাকে কারো অনুভূতি শেয়ার করতে হবে। এটা অন্যদের প্রতি দয়ার হাত প্রসারিত করা।
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৭ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১৫ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে