অনলাইন ডেস্ক
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মাত্র এক কদম দূরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঞ্চলে এরই মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এ দুটিতেই প্রত্যক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে চীন যদি তাইওয়ানে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তবে তা শিগগিরই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে, যেখানে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র।
সংঘাত এড়ানোর সুযোগ খানিকটা পার হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান উন্নত করার সুযোগ এখনো পুরোপুরি হাতছাড়া হয়ে যায়নি বলে বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকারের সাবেক কর্মকর্তা এ ওয়েস মিচেল। সম্ভাব্য মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে নিজস্ব ভাবনা ও আশঙ্কার কথা তুলে ধরে একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। ভূরাজনীতি বিষয়ক সাময়িকী ফরেন পলিসিতে সেটি প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বেশ দীর্ঘসময় ধরেই বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশের অবস্থানে রয়েছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই জয়ী এ দেশ কাবু করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এবং আজও এ দেশের সামরিক শক্তির জুড়ি নেই।
দেড় বছর ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ লড়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই আঁটঘাট বেঁধে নামা দেখে অনেক বিশ্লেষকেরই মনে হয়েছিল, এবারও দেশটির জয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে। আর এরপরই যুক্তরাষ্ট্র ফের ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক অবস্থান মজবুত করার দিকে মন দেবে।
তবে দিন দিন এ কৌশল ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে রাশিয়া দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যেও শুরু হয়েছে সংঘাত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমান মনযোগ প্রয়োজন। এ সুযোগ কাজে লাগানোর প্রলোভনে পড়তে পারে চীন। দ্রুত গতিতে শক্তিশালী হচ্ছে দেশটির অস্ত্রাগার। যুক্তরাষ্ট্রের এ দুর্বল সময়ের ফায়দা নিয়ে আক্রমণ করতে পারে তাইওয়ানে। চীন ভালোভাবেই জানে, এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তিনটি ভূরাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
এই মুহূর্তে যদি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলেই থাকবে:
এর মধ্যে একটি হলো ভূগোল। সর্বশেষ দুটি মার্কিন জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল থেকে এটা অন্তত স্পষ্ট যে, বর্তমান মার্কিন সামরিক বাহিনী একই সঙ্গে দুটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম নয়। ইউক্রেন ও ইসরায়েলে সহযোগিতা অব্যাহত রেখে তাইওয়ানকে সহায়তা করতে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করা বেশ কঠিনই হতে যাচ্ছে।
এর মানে এ নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শক্তিশালী নয়। তবে, যাদের হয়ে লড়াই চালাতে হবে তাদের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের মতো পোক্ত নয়। চীন, রাশিয়া এবং ইরানকে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কেবল নিজেদের মাটিতে শক্তিশালী হতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্রকে কমপক্ষে তিনটি দূরবর্তী অঞ্চলে স্বল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে দুর্বল অস্ত্রসজ্জিত মিত্রের হয়ে লড়াই করতে হবে। বলতে গেলে এ তিনটি দেশই দীর্ঘ সংঘাত বজায় রাখার সংকল্প, সম্পদ ও বেপরোয়া নীতি নিয়ে বৃহৎ শিল্পশক্তি–সম্পন্ন দেশের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করতে অক্ষম। এ লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, সম্পদের একত্রীকরণ ও ত্যাগের ইচ্ছা।
যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও বহুমুখী যুদ্ধ লড়েছে। তবে আগের লড়াইগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকবারই প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন চিত্র ভিন্ন। চীনের নৌবহর এখনই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড় এবং তা বছর বছর বেড়েই চলেছে। প্রতি চার বছরে চীনের নৌবহরে যুক্ত হচ্ছে ১৩০টি জাহাজ, যা পুরো ফরাসি নৌবহরের সমান। এ তুলনায় আগামী এক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৭৫টি জাহাজ যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে।
এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিক সংকটও মোকাবিলা করতে হবে। আগের সংঘাতগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সহজেই প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে পারত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ ও জিডিপির অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ১১৩ শতাংশ। কোনো সংঘাতে জড়ানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় রাখতে হবে, এর ঋণ এরই মধ্যে জিডিপির ১০০ শতাংশ অতিক্রম করে ফেলেছে।
সম্ভাব্য মহাযুদ্ধের পরিধিও যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো হয় তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বেড়ে জিডিপির ২০০ শতাংশ বা তার বেশি হবে—এমনটি অনুমান করা খুব একটা অযৌক্তিক হবে না। কংগ্রেসনাল বাজেট কার্যালয় ও অন্যান্য সূত্রের মতে, এ পরিমাণ ঋণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বৈশ্বিক সংঘাত অন্যান্য বিপদও ডেকে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী—রাশিয়া ও ইরান— প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের পরিসীমা বাড়ার কারণে হরমুজ প্রণালি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার করে বাড়তে পারে। এতে মুদ্রাস্ফীতির ওপরও চাপ পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঋণদাতা দেশ চীন। দীর্ঘদিন ধরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ থাকলে যুক্তরাষ্ট্রেরই অর্থনৈতিক চাপ বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে ঘর–বাড়ি নির্মাণের সরঞ্জাম—সব ক্ষেত্রেই সংকট দেখা দেবে।
তবে মার্কিনরা সবচেয়ে গুরুতর যে ক্ষতির মুখোমুখি হবে তা হলো, বৈশ্বিক সংঘাতে বিপুলসংখ্যক মার্কিন সৈন্য নিহত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীগুলো পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হামলা করা তাদের জন্য অসাধ্য নয়। এ ছাড়া দেশটির পশ্চিম সীমান্তের দুর্বল অবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে, অন্য দেশগুলোর পক্ষে সহজেই যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালানো সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র শান্তি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিলেও যুদ্ধ বন্ধ করার মতো কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়নি। মার্কিনদের যেমন সংঘাতে না জড়ানোর প্রত্যাশা রাখতে হবে, তেমনি সংঘাতের মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতিও রাখতে হবে। যে কোনো আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে।
ইউক্রেন, ইসরায়েল ও তাইওয়ানের আত্মরক্ষা করার মতো অস্ত্র মজুত নিশ্চিত করাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। কারণ তারাই এ সংঘাতের সম্মুখ যোদ্ধা। এ দেশগুলো যদি আগ্রাসন এড়িয়ে চলার কৌশল অবলম্বন করতে পারে, তবে এ সহিংসতার পরিসর কমিয়ে আনার আশা করা যেতে পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিরক্ষা শিল্প সঠিক ব্যবস্থায় না আনা পর্যন্ত এটি সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিরক্ষা খাতে উৎপাদন বাড়িয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। অথচ শিল্পশক্তি–সম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের সংঘাতে বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদের প্রয়োজন।
পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যান্য বেসামরিক উৎপাদন খাতকেও সামরিক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। ভোক্তা অর্থনীতির চেয়ে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হতে হবে দেশটিকে। এর সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থাও সম্প্রসারিত করতে হবে। যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনে জটিলতা সৃষ্টি করে এমন পরিবেশগত নিয়ন্ত্রকগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে।
ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় বাড়াতে হবে তা নিশ্চিত। বাইডেন প্রশাসন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের পরিবর্তে জলবায়ু নীতি বা সামাজিক খাতে ব্য়য় করে চলেছে। এ মুহূর্তে এ কৌশল কোনো সুফল এনে দেবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেরও নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্য দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি। এরপরও এদের এক–তৃতীয়াংশ দেশও তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার শর্ত পূরণ করছে না। ন্যাটোর প্রধান পশ্চিমা দেশগুলো এক বছরেরও আগে মাদ্রিদ সম্মেলনে পূর্ব সীমানায় ব্রিগেড সাইজের ইউনিট মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
আসন্ন সংঘাত ও কঠিন সময়কে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ও নাগরিকদের তাদের প্রয়োজন ও চাহিদাকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। মার্কিনরা জলবায়ু নীতির মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পের মধ্যে আটকে থাকার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও পিছিয়ে পড়ছে। এদিকে চীন প্রতি সপ্তাহে দুটি করে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ইউরোপীয়দের তাদের পারমাণবিক শক্তির প্রতি অনীহার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। মার্কিন প্রগতিশীলদের স্বআরোপিত বিধিনিষেধগুলো নিয়ে আরেকবার ভাবা প্রয়োজন। বিশেষ করে যে বিধিনিষেধগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি উৎপাদন সীমিত হয়ে পড়ছে।
এখানে যে যে উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এর কোনোটাই সহজ নয়। তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদেশগুলো এক কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন ও ইসরায়েলে এখন যা হচ্ছে, কয়েক বছর আগেও তা কল্পনার বাইরে ছিল। সামনের দিন গুলোতে আরও অনেক অভাবনীয় পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে। আসন্ন বৈশ্বিক সংঘাতে নিজেদের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে না দেখতে চাইলে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোর নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার এখনই সময়।
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন সানজিদা কাওছার ঋতু
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মাত্র এক কদম দূরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঞ্চলে এরই মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এ দুটিতেই প্রত্যক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে চীন যদি তাইওয়ানে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় তবে তা শিগগিরই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে, যেখানে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র।
সংঘাত এড়ানোর সুযোগ খানিকটা পার হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান উন্নত করার সুযোগ এখনো পুরোপুরি হাতছাড়া হয়ে যায়নি বলে বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকারের সাবেক কর্মকর্তা এ ওয়েস মিচেল। সম্ভাব্য মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে নিজস্ব ভাবনা ও আশঙ্কার কথা তুলে ধরে একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। ভূরাজনীতি বিষয়ক সাময়িকী ফরেন পলিসিতে সেটি প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বেশ দীর্ঘসময় ধরেই বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশের অবস্থানে রয়েছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই জয়ী এ দেশ কাবু করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এবং আজও এ দেশের সামরিক শক্তির জুড়ি নেই।
দেড় বছর ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ লড়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই আঁটঘাট বেঁধে নামা দেখে অনেক বিশ্লেষকেরই মনে হয়েছিল, এবারও দেশটির জয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে। আর এরপরই যুক্তরাষ্ট্র ফের ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক অবস্থান মজবুত করার দিকে মন দেবে।
তবে দিন দিন এ কৌশল ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে রাশিয়া দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যেও শুরু হয়েছে সংঘাত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমান মনযোগ প্রয়োজন। এ সুযোগ কাজে লাগানোর প্রলোভনে পড়তে পারে চীন। দ্রুত গতিতে শক্তিশালী হচ্ছে দেশটির অস্ত্রাগার। যুক্তরাষ্ট্রের এ দুর্বল সময়ের ফায়দা নিয়ে আক্রমণ করতে পারে তাইওয়ানে। চীন ভালোভাবেই জানে, এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তিনটি ভূরাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
এই মুহূর্তে যদি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলেই থাকবে:
এর মধ্যে একটি হলো ভূগোল। সর্বশেষ দুটি মার্কিন জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল থেকে এটা অন্তত স্পষ্ট যে, বর্তমান মার্কিন সামরিক বাহিনী একই সঙ্গে দুটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম নয়। ইউক্রেন ও ইসরায়েলে সহযোগিতা অব্যাহত রেখে তাইওয়ানকে সহায়তা করতে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করা বেশ কঠিনই হতে যাচ্ছে।
এর মানে এ নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শক্তিশালী নয়। তবে, যাদের হয়ে লড়াই চালাতে হবে তাদের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের মতো পোক্ত নয়। চীন, রাশিয়া এবং ইরানকে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কেবল নিজেদের মাটিতে শক্তিশালী হতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্রকে কমপক্ষে তিনটি দূরবর্তী অঞ্চলে স্বল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে দুর্বল অস্ত্রসজ্জিত মিত্রের হয়ে লড়াই করতে হবে। বলতে গেলে এ তিনটি দেশই দীর্ঘ সংঘাত বজায় রাখার সংকল্প, সম্পদ ও বেপরোয়া নীতি নিয়ে বৃহৎ শিল্পশক্তি–সম্পন্ন দেশের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করতে অক্ষম। এ লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, সম্পদের একত্রীকরণ ও ত্যাগের ইচ্ছা।
যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও বহুমুখী যুদ্ধ লড়েছে। তবে আগের লড়াইগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকবারই প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন চিত্র ভিন্ন। চীনের নৌবহর এখনই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড় এবং তা বছর বছর বেড়েই চলেছে। প্রতি চার বছরে চীনের নৌবহরে যুক্ত হচ্ছে ১৩০টি জাহাজ, যা পুরো ফরাসি নৌবহরের সমান। এ তুলনায় আগামী এক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৭৫টি জাহাজ যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে।
এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিক সংকটও মোকাবিলা করতে হবে। আগের সংঘাতগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সহজেই প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে পারত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ ও জিডিপির অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ১১৩ শতাংশ। কোনো সংঘাতে জড়ানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় রাখতে হবে, এর ঋণ এরই মধ্যে জিডিপির ১০০ শতাংশ অতিক্রম করে ফেলেছে।
সম্ভাব্য মহাযুদ্ধের পরিধিও যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো হয় তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বেড়ে জিডিপির ২০০ শতাংশ বা তার বেশি হবে—এমনটি অনুমান করা খুব একটা অযৌক্তিক হবে না। কংগ্রেসনাল বাজেট কার্যালয় ও অন্যান্য সূত্রের মতে, এ পরিমাণ ঋণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বৈশ্বিক সংঘাত অন্যান্য বিপদও ডেকে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী—রাশিয়া ও ইরান— প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের পরিসীমা বাড়ার কারণে হরমুজ প্রণালি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার করে বাড়তে পারে। এতে মুদ্রাস্ফীতির ওপরও চাপ পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঋণদাতা দেশ চীন। দীর্ঘদিন ধরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ থাকলে যুক্তরাষ্ট্রেরই অর্থনৈতিক চাপ বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে ঘর–বাড়ি নির্মাণের সরঞ্জাম—সব ক্ষেত্রেই সংকট দেখা দেবে।
তবে মার্কিনরা সবচেয়ে গুরুতর যে ক্ষতির মুখোমুখি হবে তা হলো, বৈশ্বিক সংঘাতে বিপুলসংখ্যক মার্কিন সৈন্য নিহত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীগুলো পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হামলা করা তাদের জন্য অসাধ্য নয়। এ ছাড়া দেশটির পশ্চিম সীমান্তের দুর্বল অবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে, অন্য দেশগুলোর পক্ষে সহজেই যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালানো সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র শান্তি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিলেও যুদ্ধ বন্ধ করার মতো কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়নি। মার্কিনদের যেমন সংঘাতে না জড়ানোর প্রত্যাশা রাখতে হবে, তেমনি সংঘাতের মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতিও রাখতে হবে। যে কোনো আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে।
ইউক্রেন, ইসরায়েল ও তাইওয়ানের আত্মরক্ষা করার মতো অস্ত্র মজুত নিশ্চিত করাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। কারণ তারাই এ সংঘাতের সম্মুখ যোদ্ধা। এ দেশগুলো যদি আগ্রাসন এড়িয়ে চলার কৌশল অবলম্বন করতে পারে, তবে এ সহিংসতার পরিসর কমিয়ে আনার আশা করা যেতে পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিরক্ষা শিল্প সঠিক ব্যবস্থায় না আনা পর্যন্ত এটি সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিরক্ষা খাতে উৎপাদন বাড়িয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। অথচ শিল্পশক্তি–সম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের সংঘাতে বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদের প্রয়োজন।
পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যান্য বেসামরিক উৎপাদন খাতকেও সামরিক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। ভোক্তা অর্থনীতির চেয়ে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হতে হবে দেশটিকে। এর সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থাও সম্প্রসারিত করতে হবে। যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনে জটিলতা সৃষ্টি করে এমন পরিবেশগত নিয়ন্ত্রকগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে।
ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় বাড়াতে হবে তা নিশ্চিত। বাইডেন প্রশাসন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের পরিবর্তে জলবায়ু নীতি বা সামাজিক খাতে ব্য়য় করে চলেছে। এ মুহূর্তে এ কৌশল কোনো সুফল এনে দেবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেরও নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্য দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি। এরপরও এদের এক–তৃতীয়াংশ দেশও তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার শর্ত পূরণ করছে না। ন্যাটোর প্রধান পশ্চিমা দেশগুলো এক বছরেরও আগে মাদ্রিদ সম্মেলনে পূর্ব সীমানায় ব্রিগেড সাইজের ইউনিট মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
আসন্ন সংঘাত ও কঠিন সময়কে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ও নাগরিকদের তাদের প্রয়োজন ও চাহিদাকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। মার্কিনরা জলবায়ু নীতির মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পের মধ্যে আটকে থাকার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও পিছিয়ে পড়ছে। এদিকে চীন প্রতি সপ্তাহে দুটি করে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ইউরোপীয়দের তাদের পারমাণবিক শক্তির প্রতি অনীহার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। মার্কিন প্রগতিশীলদের স্বআরোপিত বিধিনিষেধগুলো নিয়ে আরেকবার ভাবা প্রয়োজন। বিশেষ করে যে বিধিনিষেধগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি উৎপাদন সীমিত হয়ে পড়ছে।
এখানে যে যে উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এর কোনোটাই সহজ নয়। তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদেশগুলো এক কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন ও ইসরায়েলে এখন যা হচ্ছে, কয়েক বছর আগেও তা কল্পনার বাইরে ছিল। সামনের দিন গুলোতে আরও অনেক অভাবনীয় পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে। আসন্ন বৈশ্বিক সংঘাতে নিজেদের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে না দেখতে চাইলে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোর নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার এখনই সময়।
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন সানজিদা কাওছার ঋতু
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
৬ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১৪ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে