Ajker Patrika

দ্য কনভারসেশনের নিবন্ধ

অ্যালগরিদমিক বায়াসনেস: বাংলাদেশের সহিংসতাকেন্দ্রিক অনুসন্ধানে ভারতের প্রতি গুগলের পক্ষপাত

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৫৪
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিশ্বজুড়ে অনলাইনে সার্চের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি সেকেন্ডে গুগলে ৬৩ লাখ বার অনুসন্ধান চালানো হয়। সংখ্যাধিক্যের কারণে, গুগল সার্চের ফলাফলের প্রভাবও ব্যাপক। গুগলের দাবি, তাদের অনুসন্ধান ফলাফল নিরপেক্ষ নিয়ম ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। কিন্তু গবেষণা দেখিয়েছে, এই অ্যালগরিদম প্রায়ই পক্ষপাতদুষ্ট ফলাফল হাজির করে।

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা এবং ভারতে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় এই অ্যালগরিদমিক পক্ষপাতের বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। ভারতের পক্ষে একটি মিসইনফরমেশন (বিভ্রান্তিকর) ও ডিসইনফরমেশন (মিথ্যা) ক্যাম্পেইন বা প্রচারণা এই পক্ষপাতকে কাজে লাগিয়ে তাদের এজেন্ডা সামনে এনেছে এবং আনছে। বিশ্লেষকেরা এই প্রচারণার মূল বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইসলামবিদ্বেষকে এবং তাঁরা এটিকে ভীতিকর বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এ ধরনের ক্যাম্পেইন বাংলাদেশের বেশ কিছু দাঙ্গা ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে চালানো হয়েছে। এ থেকে আরও একবার প্রমাণ হচ্ছে যে, গুগল সার্চ ইঞ্জিন জনমতের গঠনে কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে এবং কীভাবে এটির অপব্যবহার সম্ভব। একই সঙ্গে, এই বিষয়টি ব্যবহারকারীদের জন্য সতর্কবার্তা দেয়। এ কারণে গুগল সার্চের ফলাফল চোখ বন্ধ করে গ্রহণ না করে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা জরুরি।

অ্যালগরিদমিক বায়াসনেস বা পক্ষপাত কী?

গুগল সার্চ ইঞ্জিন যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, সেটিকে বিপুল পরিমাণ তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গুগল সার্চের যে ফলাফল আসে সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা হয় স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার বটের মাধ্যমে। এই বট ইন্টারনেটের কোটি কোটি ওয়েবপেজ স্ক্যান করে সেগুলোর বিষয়বস্তু ও গুণমান বিশ্লেষণ করে। পরে এই প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত তথ্য গুগলের ডেটাবেইসে সংরক্ষিত হয় এবং সেখান থেকেই সার্চ ইঞ্জিন নির্দিষ্ট অনুসন্ধানের প্রাসঙ্গিক ফলাফল তুলে ধরে ব্যবহারকারীর জন্য।

আশঙ্কার বিষয় হলো, এই তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় গুগলের অ্যালগরিদম ইন্টারনেটের সব ওয়েবসাইট গণ্য করে না। পুরো প্রক্রিয়াটি নির্দিষ্ট কিছু পূর্বনির্ধারিত নিয়মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। গুগলের অ্যালগরিদম ‘উচ্চ মান’ ও ‘নিম্ন মানের’ কনটেন্টের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। আর এই পূর্ব নির্ধারিত সংজ্ঞার কারণেই অনুসন্ধানের পর প্রদর্শিত ডেটায় পক্ষপাতের সৃষ্টি হয়।

উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বে মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ ইংরেজিভাষী। কিন্তু অনলাইনে যত লিখিত কনটেন্ট আছে তার ৫৫ শতাংশই ইংরেজিতে। ফলে, যেসব দেশ ইংরেজিভাষী নয় প্রায়শই সেসব দেশের প্রকৃত বাস্তবতা গুগল সার্চের ফলাফলে সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে প্রতিফলিত হয় না। বিশেষ করে, গ্লোবাল সাউথের (পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ) দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি আরও প্রকট।

গুগল অ্যালগরিদমের এই পক্ষপাত কেবল ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং বাস্তব জগতেও এটি বৈষম্যপূর্ণ ভুল ধারণা তৈরি করে। এই পক্ষপাতের কারণে কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে একটি সুসংহত ও পরিপূর্ণ বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কী ঘটছে?

বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর ভারত ‘সেক্যুলার’ হলেও বর্তমানে দেশটির ক্ষমতায় আছে কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে। গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। ভারত হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছিল।

হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার ইস্যুকে ব্যবহার করে এই সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। গত নভেম্বরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে জাতীয় পতাকা অবমাননার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। এরপর চিন্ময়ের সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে এক মুসলিম আইনজীবী নিহত হন। এ ছাড়া, হিন্দুত্ববাদী একদল জনতা ভারতে (ত্রিপুরার আগরতলায়) অবস্থিত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলা চালায়।

বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সহিংসতার কয়েকটি নিশ্চিত ঘটনা ঘটেছে। তবে, বাংলাদেশ সরকারের দাবি, এসব ঘটনা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সাম্প্রদায়িক হামলা নয়। চলতি মাসের শুরুতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাজধানী ঢাকায় হাসিনার পারিবারিক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়ে।

এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত থেকে পরিচালিত একটি ডিসইনফরমেশন বা মিথ্যা তথ্য ক্যাম্পেইন বা প্রচারণা বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সহিংসতার ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে। এই প্রচারণাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে গুগলের অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত।

যেভাবে পক্ষপাতিত্ব করছে গুগল

টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষণ অনুসারে, গত বছরের ২৫ নভেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গুগলে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার সংক্রান্ত অনুসন্ধানে ‘নিয়মিত পক্ষপাত’ লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে এই ইস্যুতে সার্চ বা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুগল ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোকে—যার মধ্যে হিন্দু চরমপন্থী গণমাধ্যমও আছে—প্রাধান্য দিয়েছে। এ কারণে সার্চের ফলাফলে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে।

ফলস্বরূপ, বাংলাদেশি নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমের বাস্তব ও নিরপেক্ষ প্রতিবেদনগুলো চাপা পড়ে গেছে, এমনকি এই বিষয়ে সার্চ বাংলাদেশ থেকে চালানো হলেও গুগল ভারতীয় গণমাধ্যমকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এই পক্ষপাত বিদেশের স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে করা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস সংক্রান্ত ৯০ শতাংশ শীর্ষ ফলাফল ভারতীয় গণমাধ্যমের। বাংলাদেশি গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন ১৩ ও ১৪ তম পৃষ্ঠায় পাওয়া গেছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক পরিমাণে ইংরেজি ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করে এবং উন্নত সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) কৌশল ব্যবহার করে। যেমন কার্যকর কীওয়ার্ড এবং উত্তেজক শিরোনাম। এ কারণেই তারা গুগলের অনুসন্ধান ফলাফলে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের তুলনায় অগ্রাধিকার পায়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুয়া ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারকারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টের ৭২ শতাংশই ভারত থেকে পরিচালিত।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ অ্যালগরিদমিক পক্ষপাতের একটি বৈশ্বিক সমস্যা তুলে ধরেছে। এই পক্ষপাত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কীভাবে সার্চ ইঞ্জিনগুলোর মাধ্যমে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে জনমত প্রভাবিত করা হয়। এই সমস্যা নীতিনির্ধারক, প্রযুক্তি কোম্পানি এবং সরকারের যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরে। বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথে এর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। কারণ, এখানে মতামত দমনের সংখ্যা ও আশঙ্কা অনেক বেশি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলার আহ্বান ত্রিপুরার রাজপরিবার প্রধানের

পরিবারের সামনে পুলিশ কর্মকর্তা লাঞ্ছিত, স্বেচ্ছাসেবক দলের ৩ নেতা-কর্মী আটক

গ্রেপ্তার আসামিকে ছিনিয়ে নিতে পুলিশের ওপর হামলা, বিএনপির ১৭ নেতা-কর্মী আটক

তখন অন্য একটা সংগঠন করতাম, এখন বলতে লজ্জা হয়: জামায়াতের আমির

বাংলাদেশে-ভারত সম্পর্কের অবনতিতে দায়ী মোদি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা: কংগ্রেস

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত