জর্জিয়া কি পরবর্তী ইউক্রেন হতে যাচ্ছে

মারুফ ইসলাম
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩, ১৫: ৫৫
আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৩, ১৭: ৪২

জর্জিয়ার সংসদে একটি খসড়া আইনের প্রথম অংশ পাস হওয়ার পরে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আইনটি পুরোপুরি পাস হলে দেশটিতে কাজ করা এনজিওগুলো ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত হবে।

এনজিওগুলো এ আইনের তীব্র নিন্দা করেছে। তারা বলেছে, আইনটি পাস হলে মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস পাবে।

বিলটির বিপক্ষে গত মঙ্গলবার রাতে জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসে সংসদ ভবনের বাইরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছে। সে সময় তারা কেবল জর্জিয়ার পতাকাই নয়, একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকাও উড়িয়েছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। 

জর্জিয়া ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা একটি দেশ। দেশটির প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া। জর্জিয়ার বেশির ভাগ নাগরিক ইউরোপপন্থী। নাগরিকদের ভাবাবেগ ও শক্তিশালী রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে জর্জিয়া।

সম্প্রতি হঠাৎ করে দেশটিতে বিক্ষোভ দেখা দেওয়ায় অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, জর্জিয়া কি তবে পরবর্তী ইউক্রেন হতে যাচ্ছে? 

কী আছে আইনে
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের সহযোগী পরিচালক জর্জি গোগিয়া জানিয়েছেন, জর্জিয়ার সংসদে দুটি বিল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। 

প্রথম বিলে বলা হয়েছে, জর্জিয়ায় কাজ করা এনজিওগুলো তাদের তহবিলের ২০ ভাগের বেশি ‘বিদেশি তহবিল’ পেলে তারা ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। যারা আইন ভঙ্গ করবে, তাদের ২৫ হাজার জর্জিয়ান লারি (৯ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার) জরিমানা গুনতে হবে। 

দ্বিতীয় বিলে বলা হয়েছে, জরিমানার পাশাপাশি পাঁচ বছরের কারাদণ্ডও দেওয়া হতে পারে। 

জর্জি গোগিয়া বলেছেন, বিলটি পাস হলে মানবাধিকার স্পষ্টতই হুমকির মুখে পড়বে। বিরোধী মত ও সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। 

বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছেগত মঙ্গলবার সংসদে ৭৬-১৩ ভোটে বিলটি পাস হয়। বিলের বিপক্ষে ভোট পড়েছিল ১৩টি। পাস হওয়া বিলটি পরে সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তবে বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার জন্য আরও কয়েকটি অংশ পাস হতে হবে। 

এদিকে জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট বিলটির বিপক্ষে ভেটো দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি এরই মধ্যে ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ভিডিওর মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। 

প্রেসিডেন্ট জৌরবিচভিলি বলেছেন, ‘যাঁরা বিলটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা সবাই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তাঁরা আমাদের সবাইকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পাঁয়তারা করছেন।’

তবে প্রেসিডেন্ট জৌরবিচভিলি ভেটো দিলেও খুব একটা লাভ হবে না বলে মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটি বলেছে, প্রেসিডেন্টের ভেটো কাটিয়ে ওঠার জন্য সংসদে ক্ষমতাসীন জর্জিয়ান ড্রিম পার্টির যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। জৌরবিচভিলি ক্ষমতাসীন জর্জিয়ান ড্রিম পার্টির সদস্য নন। 

আরও যেসব দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে
জর্জিয়ার প্রতিবেশী দেশ রাশিয়ায়ও এ ধরনের বিতর্কিত আইন রয়েছে। ২০১২ সালে রাশিয়া আইনটি পাস করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রুশ মডেলটিকেই অনুসরণ করছে জর্জিয়া। এতে বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে। 

জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট জৌরবিচভিলি বিলটির বিপক্ষে ভেটো দেবেন বলে জানিয়েছেনজর্জি গোগিয়া বলেছেন, ‘বিদেশি তহবিল গ্রহণকারী এনজিও ও গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেই জর্জিয়া বিশেষ এই আইন পাস করতে যাচ্ছে।’ 

রাশিয়ার প্রতিবেশী আরেকটি দেশ বেলারুশে ‘নাগরিকত্ব আইন’ নামে এ ধরনের একটি আইন রয়েছে। ২০০২ সালে বেলারুশ আইনটি পাস করেছিল। পরে গত বছরের ডিসেম্বরে ওই আইনের একটি সংশোধনী পাস হয়। এতে বেলারুশ সরকার খুব সহজেই বিরোধী দলের কর্মী ও সমালোচকদের চাপে রাখতে পারবে বলে মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। 

আইনটির পেছনে কারা রয়েছেন
ক্ষমতাসীন জর্জিয়ান ড্রিম পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়া কয়েকজন আইনপ্রণেতা বিলটি উত্থাপন করেছিলেন। তবে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জর্জিয়ান ড্রিম পার্টি বিলটিকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়েছে। ফলে বিলটির প্রথম পাট পাস হয়েছে। 

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর) নামের একটি থিংকট্যাংক বলছে, জর্জিয়ান ড্রিম পার্টি দেশটিকে রাশিয়ার প্রভাববলয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইসিএফআর বলেছে, জর্জিয়ান ড্রিম পার্টির জোট ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে জর্জিয়া ক্রমেই পশ্চিম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং রাশিয়ার প্রভাববলয়ের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। 

ইসিএফআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইইউ থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য জর্জিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জর্জিয়ান ড্রিম পার্টির নেতা বিডজিনা ইভানিশভিলির নানা পদক্ষেপই দায়ী। 

ইউক্রেনের সঙ্গে কেন তুলনা করা হচ্ছে
জর্জিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশই একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে দুটি দেশই পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে আটকা পড়ে। জর্জিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিকে ইউক্রেনের ২০১৪ ও ২০২২ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছে থিংকট্যাংক ইসিএফআর। 

রাশিয়া ২০০৮ সালে জর্জিয়া আক্রমণ করেছিল। সে প্রসঙ্গে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ২০১১ সালে বলেছিলেন, রাশিয়া যদি ২০০৮ সালে জর্জিয়া আক্রমণ না করত, তাহলে ন্যাটো রাশিয়া দখল করে নিত। 

. জর্জিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশই এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) অন্তর্ভুক্ত ছিলজর্জিয়ার দুটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ ওসেটিয়া ও আবখাজিয়াকে কেন্দ্র করে ২০০৮ সালে সংঘাতটি হয়েছিল। জর্জিয়া এ দুটি প্রদেশকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করলেও ওই দুটি প্রদেশের বাসিন্দারা রাশিয়ার অংশ হিসেবে থাকতেই আগ্রহী। 

ইসিএফআর জানিয়েছে, ওই সময় (২০০৮ সালে) জর্জিয়ায় রুশ আক্রমণ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এরপর একই ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া আক্রমণ করেছিল। 

এসব কারণে জর্জিয়া ও ইউক্রেনে রুশ আক্রমণকে সাম্রাজ্যবাদী অংশ বলে উল্লেখ করেছে ইসিএফআর। 

আইনটি পাস হলে জর্জিয়ায় কী হবে
আইনটি পাস হলে জর্জিয়ার নাগরিক সমাজ ও ইউরোপীয় এনজিওগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না বলে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। 

এ ছাড়া এই আইন পাস হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হতেও জর্জিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। গত মঙ্গলবার ইইউ এক বিবৃতিতে বলেছে, এ আইনের বিষয়গুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আইনটি পাস হলে আমাদের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি হতে পারে। 

গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইসও বলেছেন, ‘যারা এই খসড়া আইনের পক্ষে ভোট দেবে, তারা ইউরোপ ও পশ্চিমের সঙ্গে জর্জিয়ার সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’ 

সূত্র: সিএনএন, বিবিসি ও আল জাজিরা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত