অনলাইন ডেস্ক
ভারতের বিগত এক দশকের ক্রয়ক্ষমতা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশের পর অনেকেই আহ্লাদিত হয়েছেন, উদ্বেলিত হয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে, সরকারি এই ডেটাগুলো ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে নির্বাচনের সামনে সুবিধা দিতেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দারিদ্র্য ভারতের গভীরে প্রোথিত এবং খুব শিগগির তা দূর হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) আমার প্রথম বস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রয়াত মিচেল মুসা বলেছিলেন, কোনো একটি পরিসংখ্যানকে অবশ্যই ‘স্মেল টেস্টে’ উতরে যেতে হবে। সাধারণত, যখন কোনো একজন ব্যক্তি তাঁর সাধারণ জ্ঞান–অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে কোনো পরিসংখ্যান সত্য বা অসত্য কিনা তা নির্ধারণ করতে পারেন তখন সেটিকে স্মেল টেস্ট বলা হয়। সম্প্রতি যখন ভারত সরকার, বিগত এক দশকের ভোক্তা ব্যয়ের ডেটা প্রকাশ করেছে তখন আমার প্রথমেই সেই ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বের কথাটি মনে পড়েছে। আর তাঁর পরামর্শ অনুসরণ করতে ভারত সরকারের হাজির করা তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছি, তা থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, ভারতের অফিশিয়াল জিডিপির ডেটা ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জি–২০ সম্মেলনের ঠিক আগে, ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ নির্লজ্জভাবে এমন একটি ফুলানো–ফাঁপানো পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। গত দশকের আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১১ সালে। সে সময় ভারতীয়দের উচ্চ অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতার হার উঠে এসেছিল। যার ফলে চাকরি হারাতে হয়েছিল সে সময়কার জরিপ পরিচালকের।
২০১২ সালে পরিচালিত ভোক্তা ব্যয় জরিপ অনুসারে, ভারতে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা লোকের হার ছিল ২২ শতাংশ। এরপর ২০১৮ সালে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। যে জরিপের তথ্য সরকার চেপে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ফাঁস হওয়া তথ্য দেখায় যে, দারিদ্র্যের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। তারপরও ভারত সরকারের আংশিক ভোক্তা ব্যয়ের ডেটা কিছু অর্থনীতিবিদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। যেমন, ভারতে নিযুক্ত আইএমএফের সাবেক প্রধান সুরজিৎ ভল্লা এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ করণ ভাসিন তড়িঘড়ি এই ডেটা প্রকাশের পর উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলেছেন, ভারতের চরম দারিদ্র্য ‘দূর হয়েছে।’
তবে পরিসংখ্যানের এমন উপস্থাপন বিশ্বের এলিট দেশগুলোর মধ্যে ভারতের ব্যাপারে হাইপ বাড়ালেও দারিদ্র্য দেশটির গভীরে প্রোথিতই থেকে যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গরিবদের আয় কমে যাওয়ায় আয়বৈষম্য আরও বাড়তেই থাকবে।
দারিদ্র্যের পরিমাপ করা কঠিন। বিশেষ করে কোন সীমা পর্যন্ত মানুষকে দরিদ্র বলে বিবেচনা করা হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন। ১৯৯০—এর দশকে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যের সীমা নির্ধারণ করেছিল দৈনিক অন্তত ১ ডলার আয়। পরে ২০১১ সালে তা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৯০ ডলার নির্ধারণ করা হয়। যারা দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় করতে পারেন না তাদের চরম দরিদ্র বলে বিবেচনা করা হয়।
ভারতের একজন ব্যক্তির জন্য দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় খুবই নিচু স্তরের ভোক্তা ব্যয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থনীতিবিদ শাওহুয়া চেন এবং মারটিন রাভালিয়নের মতে, এই আয় দিয়ে ন্যূনতম খাবার চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। বাকি মৌলিক চাহিদাগুলোর খুব সামান্যই এ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। ২০১২ সালে ১ দশমিক ৯০ ডলার সমান ছিল ৩০ রুপি। যা দিয়ে দিনে দুই বেলার খাবার জোটানোই কষ্টসাধ্য ছিল বলে মনে করেন দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ এস. সুব্রাহ্মনিয়ম।
মনে হচ্ছে, সর্বশেষ ভোগ-ব্যয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সুরজি ভল্লা এবং করণ ভাসিন এবারও ১ দশমিক ৯০ ডলারকে রুপিতে পরিবর্তিত করে হিসাব করেছেন। যেখানে আইএমএফের হিসাব বলছে, ১ ডলারের মূল্য হলো ২২ দশমিক ৯ রুপি। এর ফলে তাঁরা মনে করছেন, যারা দিনে ৪৫ রুপি ব্যয় করতে পারে না তারাই দরিদ্র।
তাদের এই হিসাব পদ্ধতির উদ্দেশ্য মূলত যেকোনো মূল্যে দেশ থেকে দারিদ্র্য ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। সরকারি হিসাব অনুসারে, ভারতের গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ। সেই হিসাবে ২০১২ সালের ৩০ রুপি দামের পণ্যের দাম এখন কমপক্ষে ৫৮ রুপি হবে। অধিকন্তু, নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলো অযৌক্তিক মূল্যস্ফীতি বৈষম্যের মুখোমুখি হয়—তারা যে ধরনের পণ্য কেনে, তাদের পছন্দের সীমিত স্বাধীনতা (যা তাদের স্থানীয় একচেটিয়াদের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়) এবং প্রচুর পরিমাণে কেনার অক্ষমতার কারণে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেশি।
অধিকন্তু, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি বৈষম্যের শিকার হন নানা কারণে, তাদের জন্য মূল্যস্ফীতির কশাঘাতটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশিই। কারণ তারা নিয়মিত ভিত্তিতে যেসব পণ্য কেনেন তাতে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় বেশি মূল্যস্ফীতি বহন করতে হয়। কারণ, তাদের সামনে অন্য কোনো সুযোগ না থাকায় একচেটিয়া বাজারের ওপর বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হয়। একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ পণ্য কিনতে না পারায়ও তাদের ক্রয়ক্ষমতা আসলে অন্যদের তুলনায় কমই হয়।
দুঃখের বিষয়, ভারত সরকার কখনোই সেই অর্থে গৃহস্থালির আয়ের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট খাত ধরে ধরে মূল্যস্ফীতির তথ্য দেয় না। ভারতের অর্ধেকেরও বেশি পরিবারের জন্য যদি বার্ষিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশও হয় তবে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য তাদের প্রতিদিন প্রায় ৮০ রুপি লাগবে। সে ক্ষেত্রে, ভারতের দারিদ্র্যের হার প্রায় ২২ শতাংশের মতো হবে। যা ২০১২ সালের সমানই।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, অতিরঞ্জিতভাবে সূচক ওপরে তুলে দেওয়ার অর্থ হলো—কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। ২০১৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর চক্রবর্তী রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে একটি কমিটি বলেছিল যে, গ্রামীণ অঞ্চলে প্রকৃত দারিদ্র্যসীমা হলো—দৈনিক ৩৩ রুপি আয়। অর্থাৎ, যারা এই অর্থ আয় করতে পারে না তাঁরা চরম দরিদ্র। এই সীমারেখা বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া সীমারেখার কাছাকাছি। সেই কমিটির হিসাব অনুসারে, ২০১৪ সালে শহুরে এলাকায় একজনের দৈনন্দিন ব্যয় প্রয়োজন ছিল অন্তত ৪৭ রুপি। তবে এস. সুব্রাহ্মনিয়াম বলছেন, শহুরে দারিদ্র্যের বিষয়টিকে ভয়াবহভাবে খাটো করে দেখা হয়েছে। তাঁর অনুমান, শহরে একজন মানুষের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা পূরণে অন্তত ৮৮ রুপি প্রয়োজন।
বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ব্যবহার করে রঙ্গরাজন ও সুব্রহ্মনিয়ামের অনুমানের মধ্যে তুলনা করে একটি উপসংহারে আসা যায়। এই দুই বিশেষজ্ঞের হিসাবের মাঝামাঝি রাখলে শহরে দারিদ্র্যের হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে। এর অর্থ হলো, সামগ্রিকভাবে ভারতীয়দের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এটি সম্ভবত শিক্ষা, পরিবহন এবং আবাসন খরচ, সেই সঙ্গে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চিকিৎসা ব্যয় তীব্রভাবে বৃদ্ধির কারণে হতে পেরেছে। এর কারণে, অনেক অভিভাবককে বাধ্য হয়েই তাদের সন্তানের জন্য খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে শিক্ষার সুযোগ ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য ২০১৬ সালের ডিমনিটাইজেশনও অনেকটাই দায়ী। সে সময় ভারত সরকার মহাত্মা গান্ধীর ছবি সংবলিত ৫০০ ও ১০০০ রুপির মূল্যমানের সব নোট বাজার থেকে তুলে নেয়। যার ফলে, ভারতের ৮৭ শতাংশ মুদ্রাই বাতিল হয়ে যায়। এ ছাড়া, ২০১৭ সালের পণ্য ও সেবা কর আইন প্রয়োগও অন্যতম কারণ। এই দুটি বিষয় দরিদ্র শ্রেণির ওপর ভয়াবহ আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছিল।
কোভিড-১৯ মহামারিও একটি কঠিন ধাক্কা দিয়েছে ভারতীয় অর্থনীতিতে। এর কারণে কোটি কোটি মানুষ আবারও তুলনামূলক কম উৎপাদনশীল কৃষি খাতে ফিরে গেছে। ২০১৮ সালের তুলনায় বর্তমান সময়ে ভারতে অন্তত ৭ কোটি বেশি মানুষ কৃষি খাতে কাজ করছেন। এর মূল কারণ হলো, ভারতে কৃষি খাত ছাড়া অন্যান্য আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাতে তাদের জন্য কোনো কাজ নেই। যাও বা আছে সেগুলোর বেশির ভাগই আর্থিক ও শারীরিকভাবে অনিশ্চিত খাত যেমন—নির্মাণ, হকার, বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী এবং অন্যান্য গার্হস্থ্য কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
যেখানে কোটি কোটি ভারতীয় এই ধরনে উল্লেখযোগ্য কঠোর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে নির্বাচনের আগে এ ধরনে ভোগ-ব্যয় বৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সন্দেহের উদ্রেক করে বৈকি। এই প্রেক্ষাপটে সুরজিৎ ভল্লা ও করণ ভাসিনের দারিদ্র্যের অবসানের ঘোষণাও সংশয়পূর্ণ। অধিকন্তু, তাঁরা যে দাবি করেছেন যে, ভোগ বৈষম্য তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে তাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ ধনী ভারতীয়রা যে ৪০০ ডলার মূল্যের জুতা পড়েন, যে ল্যাম্বরগিনি গাড়ি চালান বা বিলাসবহুল পার্টিতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন তা তাঁরা সরকারি জরিপকারীদের কাছে উল্লেখ করেন না।
ভারতে ধনী-গরিবের ব্যবধানও বেশ ভীতিপূর্ণ। ধনকুবের মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের আগেই ১২ কোটি ডলার ব্যয়ের অনুষ্ঠান-উদ্যাপনের কথাই বিবেচনা করুন। যেখানে অনন্ত আম্বানি ১০ লাখ ডলারের ঘড়ি পরেছিল, একজন সুপারস্টার তাঁর বিয়েতে পারফর্ম করার জন্য ৬০ লাখ ডলার পারিশ্রমিক পেয়েছিল এবং ভারতীয় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটিদের সেই বিয়েতে যোগ দেওয়া এবং সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য স্থানীয় একটি বিমানবন্দর সাধারণের সেবার জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল।
এদিকে, দরিদ্রদের মধ্যে ভোক্তা ব্যয়ের ব্যাপক অভাব এবং মূল্যস্ফীতির প্রকৃত ডেটার অভাব ভারতীয় দারিদ্র্যের সঠিক চিত্র পাওয়াকে অসম্ভব করে তোলে। এর চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের তরফ থেকে কৌশলগতভাবে প্রকাশিত ডেটা এবং সেগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিশ্লেষণ উভয়ই আসলে সন্দেহের দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
ভারতের বিগত এক দশকের ক্রয়ক্ষমতা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশের পর অনেকেই আহ্লাদিত হয়েছেন, উদ্বেলিত হয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে, সরকারি এই ডেটাগুলো ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে নির্বাচনের সামনে সুবিধা দিতেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দারিদ্র্য ভারতের গভীরে প্রোথিত এবং খুব শিগগির তা দূর হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) আমার প্রথম বস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রয়াত মিচেল মুসা বলেছিলেন, কোনো একটি পরিসংখ্যানকে অবশ্যই ‘স্মেল টেস্টে’ উতরে যেতে হবে। সাধারণত, যখন কোনো একজন ব্যক্তি তাঁর সাধারণ জ্ঞান–অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে কোনো পরিসংখ্যান সত্য বা অসত্য কিনা তা নির্ধারণ করতে পারেন তখন সেটিকে স্মেল টেস্ট বলা হয়। সম্প্রতি যখন ভারত সরকার, বিগত এক দশকের ভোক্তা ব্যয়ের ডেটা প্রকাশ করেছে তখন আমার প্রথমেই সেই ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বের কথাটি মনে পড়েছে। আর তাঁর পরামর্শ অনুসরণ করতে ভারত সরকারের হাজির করা তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছি, তা থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, ভারতের অফিশিয়াল জিডিপির ডেটা ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জি–২০ সম্মেলনের ঠিক আগে, ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ নির্লজ্জভাবে এমন একটি ফুলানো–ফাঁপানো পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। গত দশকের আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১১ সালে। সে সময় ভারতীয়দের উচ্চ অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতার হার উঠে এসেছিল। যার ফলে চাকরি হারাতে হয়েছিল সে সময়কার জরিপ পরিচালকের।
২০১২ সালে পরিচালিত ভোক্তা ব্যয় জরিপ অনুসারে, ভারতে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা লোকের হার ছিল ২২ শতাংশ। এরপর ২০১৮ সালে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। যে জরিপের তথ্য সরকার চেপে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ফাঁস হওয়া তথ্য দেখায় যে, দারিদ্র্যের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। তারপরও ভারত সরকারের আংশিক ভোক্তা ব্যয়ের ডেটা কিছু অর্থনীতিবিদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। যেমন, ভারতে নিযুক্ত আইএমএফের সাবেক প্রধান সুরজিৎ ভল্লা এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ করণ ভাসিন তড়িঘড়ি এই ডেটা প্রকাশের পর উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলেছেন, ভারতের চরম দারিদ্র্য ‘দূর হয়েছে।’
তবে পরিসংখ্যানের এমন উপস্থাপন বিশ্বের এলিট দেশগুলোর মধ্যে ভারতের ব্যাপারে হাইপ বাড়ালেও দারিদ্র্য দেশটির গভীরে প্রোথিতই থেকে যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গরিবদের আয় কমে যাওয়ায় আয়বৈষম্য আরও বাড়তেই থাকবে।
দারিদ্র্যের পরিমাপ করা কঠিন। বিশেষ করে কোন সীমা পর্যন্ত মানুষকে দরিদ্র বলে বিবেচনা করা হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন। ১৯৯০—এর দশকে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যের সীমা নির্ধারণ করেছিল দৈনিক অন্তত ১ ডলার আয়। পরে ২০১১ সালে তা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৯০ ডলার নির্ধারণ করা হয়। যারা দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় করতে পারেন না তাদের চরম দরিদ্র বলে বিবেচনা করা হয়।
ভারতের একজন ব্যক্তির জন্য দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় খুবই নিচু স্তরের ভোক্তা ব্যয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থনীতিবিদ শাওহুয়া চেন এবং মারটিন রাভালিয়নের মতে, এই আয় দিয়ে ন্যূনতম খাবার চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। বাকি মৌলিক চাহিদাগুলোর খুব সামান্যই এ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। ২০১২ সালে ১ দশমিক ৯০ ডলার সমান ছিল ৩০ রুপি। যা দিয়ে দিনে দুই বেলার খাবার জোটানোই কষ্টসাধ্য ছিল বলে মনে করেন দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ এস. সুব্রাহ্মনিয়ম।
মনে হচ্ছে, সর্বশেষ ভোগ-ব্যয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সুরজি ভল্লা এবং করণ ভাসিন এবারও ১ দশমিক ৯০ ডলারকে রুপিতে পরিবর্তিত করে হিসাব করেছেন। যেখানে আইএমএফের হিসাব বলছে, ১ ডলারের মূল্য হলো ২২ দশমিক ৯ রুপি। এর ফলে তাঁরা মনে করছেন, যারা দিনে ৪৫ রুপি ব্যয় করতে পারে না তারাই দরিদ্র।
তাদের এই হিসাব পদ্ধতির উদ্দেশ্য মূলত যেকোনো মূল্যে দেশ থেকে দারিদ্র্য ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। সরকারি হিসাব অনুসারে, ভারতের গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ। সেই হিসাবে ২০১২ সালের ৩০ রুপি দামের পণ্যের দাম এখন কমপক্ষে ৫৮ রুপি হবে। অধিকন্তু, নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলো অযৌক্তিক মূল্যস্ফীতি বৈষম্যের মুখোমুখি হয়—তারা যে ধরনের পণ্য কেনে, তাদের পছন্দের সীমিত স্বাধীনতা (যা তাদের স্থানীয় একচেটিয়াদের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়) এবং প্রচুর পরিমাণে কেনার অক্ষমতার কারণে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেশি।
অধিকন্তু, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি বৈষম্যের শিকার হন নানা কারণে, তাদের জন্য মূল্যস্ফীতির কশাঘাতটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশিই। কারণ তারা নিয়মিত ভিত্তিতে যেসব পণ্য কেনেন তাতে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় বেশি মূল্যস্ফীতি বহন করতে হয়। কারণ, তাদের সামনে অন্য কোনো সুযোগ না থাকায় একচেটিয়া বাজারের ওপর বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হয়। একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ পণ্য কিনতে না পারায়ও তাদের ক্রয়ক্ষমতা আসলে অন্যদের তুলনায় কমই হয়।
দুঃখের বিষয়, ভারত সরকার কখনোই সেই অর্থে গৃহস্থালির আয়ের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট খাত ধরে ধরে মূল্যস্ফীতির তথ্য দেয় না। ভারতের অর্ধেকেরও বেশি পরিবারের জন্য যদি বার্ষিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশও হয় তবে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য তাদের প্রতিদিন প্রায় ৮০ রুপি লাগবে। সে ক্ষেত্রে, ভারতের দারিদ্র্যের হার প্রায় ২২ শতাংশের মতো হবে। যা ২০১২ সালের সমানই।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, অতিরঞ্জিতভাবে সূচক ওপরে তুলে দেওয়ার অর্থ হলো—কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। ২০১৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর চক্রবর্তী রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে একটি কমিটি বলেছিল যে, গ্রামীণ অঞ্চলে প্রকৃত দারিদ্র্যসীমা হলো—দৈনিক ৩৩ রুপি আয়। অর্থাৎ, যারা এই অর্থ আয় করতে পারে না তাঁরা চরম দরিদ্র। এই সীমারেখা বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া সীমারেখার কাছাকাছি। সেই কমিটির হিসাব অনুসারে, ২০১৪ সালে শহুরে এলাকায় একজনের দৈনন্দিন ব্যয় প্রয়োজন ছিল অন্তত ৪৭ রুপি। তবে এস. সুব্রাহ্মনিয়াম বলছেন, শহুরে দারিদ্র্যের বিষয়টিকে ভয়াবহভাবে খাটো করে দেখা হয়েছে। তাঁর অনুমান, শহরে একজন মানুষের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা পূরণে অন্তত ৮৮ রুপি প্রয়োজন।
বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ব্যবহার করে রঙ্গরাজন ও সুব্রহ্মনিয়ামের অনুমানের মধ্যে তুলনা করে একটি উপসংহারে আসা যায়। এই দুই বিশেষজ্ঞের হিসাবের মাঝামাঝি রাখলে শহরে দারিদ্র্যের হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে। এর অর্থ হলো, সামগ্রিকভাবে ভারতীয়দের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এটি সম্ভবত শিক্ষা, পরিবহন এবং আবাসন খরচ, সেই সঙ্গে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চিকিৎসা ব্যয় তীব্রভাবে বৃদ্ধির কারণে হতে পেরেছে। এর কারণে, অনেক অভিভাবককে বাধ্য হয়েই তাদের সন্তানের জন্য খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে শিক্ষার সুযোগ ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য ২০১৬ সালের ডিমনিটাইজেশনও অনেকটাই দায়ী। সে সময় ভারত সরকার মহাত্মা গান্ধীর ছবি সংবলিত ৫০০ ও ১০০০ রুপির মূল্যমানের সব নোট বাজার থেকে তুলে নেয়। যার ফলে, ভারতের ৮৭ শতাংশ মুদ্রাই বাতিল হয়ে যায়। এ ছাড়া, ২০১৭ সালের পণ্য ও সেবা কর আইন প্রয়োগও অন্যতম কারণ। এই দুটি বিষয় দরিদ্র শ্রেণির ওপর ভয়াবহ আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছিল।
কোভিড-১৯ মহামারিও একটি কঠিন ধাক্কা দিয়েছে ভারতীয় অর্থনীতিতে। এর কারণে কোটি কোটি মানুষ আবারও তুলনামূলক কম উৎপাদনশীল কৃষি খাতে ফিরে গেছে। ২০১৮ সালের তুলনায় বর্তমান সময়ে ভারতে অন্তত ৭ কোটি বেশি মানুষ কৃষি খাতে কাজ করছেন। এর মূল কারণ হলো, ভারতে কৃষি খাত ছাড়া অন্যান্য আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাতে তাদের জন্য কোনো কাজ নেই। যাও বা আছে সেগুলোর বেশির ভাগই আর্থিক ও শারীরিকভাবে অনিশ্চিত খাত যেমন—নির্মাণ, হকার, বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী এবং অন্যান্য গার্হস্থ্য কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
যেখানে কোটি কোটি ভারতীয় এই ধরনে উল্লেখযোগ্য কঠোর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে নির্বাচনের আগে এ ধরনে ভোগ-ব্যয় বৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সন্দেহের উদ্রেক করে বৈকি। এই প্রেক্ষাপটে সুরজিৎ ভল্লা ও করণ ভাসিনের দারিদ্র্যের অবসানের ঘোষণাও সংশয়পূর্ণ। অধিকন্তু, তাঁরা যে দাবি করেছেন যে, ভোগ বৈষম্য তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে তাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ ধনী ভারতীয়রা যে ৪০০ ডলার মূল্যের জুতা পড়েন, যে ল্যাম্বরগিনি গাড়ি চালান বা বিলাসবহুল পার্টিতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন তা তাঁরা সরকারি জরিপকারীদের কাছে উল্লেখ করেন না।
ভারতে ধনী-গরিবের ব্যবধানও বেশ ভীতিপূর্ণ। ধনকুবের মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের আগেই ১২ কোটি ডলার ব্যয়ের অনুষ্ঠান-উদ্যাপনের কথাই বিবেচনা করুন। যেখানে অনন্ত আম্বানি ১০ লাখ ডলারের ঘড়ি পরেছিল, একজন সুপারস্টার তাঁর বিয়েতে পারফর্ম করার জন্য ৬০ লাখ ডলার পারিশ্রমিক পেয়েছিল এবং ভারতীয় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটিদের সেই বিয়েতে যোগ দেওয়া এবং সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য স্থানীয় একটি বিমানবন্দর সাধারণের সেবার জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল।
এদিকে, দরিদ্রদের মধ্যে ভোক্তা ব্যয়ের ব্যাপক অভাব এবং মূল্যস্ফীতির প্রকৃত ডেটার অভাব ভারতীয় দারিদ্র্যের সঠিক চিত্র পাওয়াকে অসম্ভব করে তোলে। এর চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের তরফ থেকে কৌশলগতভাবে প্রকাশিত ডেটা এবং সেগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিশ্লেষণ উভয়ই আসলে সন্দেহের দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
১০ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১৮ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে