ফজলুল কবির
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শেষে কিছু বিষয়ে বিশ্বনেতারা ঐকমত্যে পৌঁছালেও তা নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই কারও মধ্যে। পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মীরা তো বটেই অনেক দেশের রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে—আশা অনুযায়ী অর্জন হয়নি। সম্মেলন শেষে বরাবরের মতোই একটি চুক্তি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট বা সংক্ষেপে গ্লাসগো চুক্তি। কিন্তু এই চুক্তি নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও তার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গোটা বিশ্ব, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম অনেক আগে থেকেই সোচ্চার। এই সংকটের মূল নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বারবার করে বলা হয়েছে—কয়লা, জীবাশ্ম জ্বালানি ইত্যাদির ব্যবহার এবং আরও নানা মানবসৃষ্ট কারণ এই জলবায়ু পরিবর্তনের নেপথ্যে। এ জন্য কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের কথা বহু আগে থেকে বলা হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বিশ্বনেতারাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই গোল বাঁধছে কে কতটা কার্বন নিঃসরণ কমাবে, সেই হিসাব নিয়ে। একজন যদি বলে এ দায়ী, অন্যজন বলছে—‘আমি! কক্ষনো না। দায়ী তো আসলে সে।’ আবার কেউ হয়তো নিজের দায়টা স্বীকার করছে, কিন্তু সঙ্গে অন্য কাউকে জুড়ে দিয়ে বলছেন—‘সে করলে, আমারও করতে আপত্তি নেই।’ কিন্তু এই প্রতিটি দাবি ও প্রস্তাবের সঙ্গে জুড়িগাড়ি বাঁধাটাই বিপত্তি তৈরি করছে।
আর এই অজুহাত-বিপত্তির ফাঁদে পড়ে কাতরাচ্ছে পৃথিবী। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এখন নাকাল বললেও কম বলা হবে। দাবদাহ, খরা, বন্যা, দাবানল, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে ক্রমাগত। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন উদ্বাস্তু হচ্ছে। শুধু ২০২০ সালেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাড়ে ৫ কোটি লোক শরণার্থী হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে। কিন্তু এদিকে যেন কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আলোচনায় বসছেন বিশ্বনেতারা, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে কী, তা একেবারেই অস্পষ্ট। অথচ পৃথিবীর জ্বর ক্রমাগত বাড়ছে। গত দশকটি ছিল বিশ্বের এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা উষ্ণতম দশক। এসব তথ্য নিয়মিত বিরতিতেই সামনে আসছে। একটা নড়েচড়ে বসা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার ফল কিন্তু ঘরে উঠছে না।
বিশ্বনেতারা ‘জলবায়ু শরণার্থী’ শব্দবন্ধটির সঙ্গে এখন পরিচিত। কিন্তু এ নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আবার জলবায়ু শরণার্থীর যেমন আছে, তেমনি অন্য শরণার্থীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টিও আছে। যেকোনো দেশে আশ্রিত শরণার্থী যেহেতু স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে তুলনামূলক কম নাগরিক সুবিধার আওতায় থাকে, সেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিতে তারাই বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচিসআরের প্রতিবেদনেও তেমনটিই বলা হয়েছে। এই সংকট কিন্তু সময়ের সঙ্গে ক্রমাগত বাড়ছে।
সব মিলিয়ে এবারের সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই। এতে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। এবারের সম্মেলনে সবচেয়ে বড় যে অগ্রগতি হয়েছে, তা হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্মত হওয়া। এ লক্ষ্য অর্জনে এ দুই দেশ আগামী দশক একযোগে কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া বনাঞ্চল ধ্বংস বন্ধ এবং নতুন করে বনায়নের বিষয়ে সম্মত হয়েছেন শতাধিক দেশের নেতা। এই দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্রাজিল, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর ‘ফুসফুস’খ্যাত আমাজন।
এবারের সম্মেলনে কয়লা থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতিপত্রে সই করেছে ৪০টির বেশি দেশ। এর মধ্যে পোল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও চিলির মতো দেশগুলো থাকা যদি আশা জাগায়, তবে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের না থাকাটা হতাশাজনক নিশ্চয়।
সম্মেলনে ২০০টি দেশের প্রতি ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এই নিঃসরণ হ্রাসের বিষয়টি ২০১৫ সালে হওয়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতেই ছিল। তাহলে কপ ২৬ নতুন কী দিল? একটা পার্থক্য হলো—প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় দেশগুলো। এখানে এবারের সম্মেলনে এই লক্ষ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য আরও ব্যাপকভাবে নিঃসরণ হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে আগামী বছরের মধ্যেই ২০৩০ সালের মধ্যে উষ্ণায়ন কমাতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে দেশগুলোকে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে দেওয়া ধনী দেশগুলোর অর্থায়নের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
কয়লাভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত তা অর্জনের খাতা থেকে ছুটে গেছে। খসড়া চুক্তিতে কয়লা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হলেও চীন ও ভারতের চাপে পরে তা পরিবর্তন করা হয়। নতুন করে লেখা হয়—কয়লার ব্যবহার কমানো হবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে এ খাতে ভর্তুকি না দেওয়ার প্রস্তাবে কোনো বদল হয়নি। কিন্তু জলবায়ু চুক্তিতে সই করা কোনো দেশই এটি মেনে চলতে আইনত বাধ্য নয়। এর মধ্যে যখন শুরুতেই মূল এজেন্ডা থেকে সরে আসা হয়, তখন তা মেনে চলা বা না চলার বিষয়টি নিয়ে আর বলবার কিছু থাকে না।
টেকসই জ্বালানি বিষয়েও এক ধরনের সমঝোতা এসেছে। তবে এসব ছাপিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকেই অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এ দুটিই কার্বন নিঃসরণকারী সবচেয়ে বড় দুই দেশ। পরিসংখ্যান বিষয়ক ওয়েবসাইট স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশই করেছে চীন। ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ নিয়ে পরের অবস্থানেই আছে যুক্তরাষ্ট্র। ৭ ও সাড়ে ৪ শতাংশ নিয়ে এর পরের দুই অবস্থান যথাক্রমে ভারত ও রাশিয়ার। এর মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে একযোগে দুই শীর্ষ দেশের কাজ করার খবর নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এর সঙ্গে ভারত ও রাশিয়াকে পাশে না পাওয়াটা কিছুটা হতাশার।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সামনে এসেছে, তা হলো বনাঞ্চল ধ্বংস না করার ব্যাপারে শতাধিক দেশের সম্মত হওয়া। এই দেশগুলোতেই রয়েছে বিশ্বের মোট বনাঞ্চলের ৮৫ শতাংশ। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে, এমন সমঝোতা এবং প্রতিশ্রুতি এর আগেও মিলেছিল। খোদ বাংলাদেশের প্রশাসন থেকেই প্রতি বছর পরিবেশ দিবসে বা জলবায়ু সম্মেলনের আগে-পরে পরিবেশ প্রেম উগরে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে বনাঞ্চল ধ্বংস ও পরিবেশবাদী আন্দোলন ও দিবস পালন একসঙ্গেই চলে। সুন্দরবনের আশপাশে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সেই সঙ্গে নানা শিল্প কারখানা এখন আর শঙ্কা নয়, বাস্তব।
এবারের সম্মেলনে বায়ুমণ্ডলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেনের নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হিসেবে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কমানোকে চিহ্নিত করেছেন অনেক আগেই। ফলে এবারের সম্মেলনে এই গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের এক জোট হওয়াকে অনেক বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। এ সম্পর্কিত ঘোষণায় বিশ্বের মোট মিথেন গ্যাস নিঃসরণের ৩০ শতাংশ ২০৩০ সালের মধ্যে কমিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছে শতাধিক দেশ। এটি নিঃসন্দেহে আশাব্যাঞ্জক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই শতাধিক দেশের মধ্যে নেই চীন, ভারত ও রাশিয়া, যারা এই গ্রিনহাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় তিন নিঃসরণকারী দেশ।
এ ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিলের আকার ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৩০ কোটি ডলার করার কথা বলা হয়েছে। তবে এতে খুশি হতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। তারা বলছে, চাহিদার চেয়ে এটি অনেক কম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই তহবিল দিয়ে আদতে কী করা হচ্ছে। খোদ বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, একদিকে জলবায়ু তহবিল নিয়ে তোড়জোড় চলে, অন্যদিকে পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কাজও চলে। ফলে কেন এই তহবিলের প্রসঙ্গটি আসছে, তা আর না বললেও চলে। কারণ, প্রকল্পই একমাত্র প্রকল্প ব্যয়সহ যাবতীয় অর্থ লেনদেনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। আর তাই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল এবং অতি অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সংকট নিরসন, প্রতিরোধের বদলে তহবিলের পেছনে ছুটেই বেশি সময় ব্যয় করে। এই বিনিয়োগ করা সময় যে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষের পকেট ভরতে ভালো কাজে লাগে, তার উল্লেখ অবান্তর।
এবারের সম্মেলনে ক্লিন বা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে অর্থায়নে সম্মত হয়েছে ৪৫০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৩০ লাখ কোটি ডলার। এটি আশার সঙ্গে শঙ্কাও জাগাচ্ছে। কারণ, এর মাধ্যমে পৃথিবীর ভাগ্যটি অন্য অর্থে বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কিনা সাধারণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।
সব মিলিয়ে পুরোনো কাসুন্দিই ঘুরে ফিরে এল। কপ ২৬ নিয়ে যে হইচই হয়েছিল, তার তুলনায় অর্জন সামান্যই। এবং এই অর্জনগুলোও আবার অনেকগুলো যদি-কিন্তুতে আটকে আছে। হয়তো কিছু তহবিল ছাড় পাওয়া যাবে ধনী দেশগুলো থেকে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এ নিয়ে একটা প্রচার করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন বা নদীগুলো বা মাটি ও হাওয়া যে ভালো থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। আরও ভালো কর বললে—প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার মাঝখানে সেই একই অনিশ্চয়তাতেই থেকে যাচ্ছে পৃথিবী।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শেষে কিছু বিষয়ে বিশ্বনেতারা ঐকমত্যে পৌঁছালেও তা নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই কারও মধ্যে। পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মীরা তো বটেই অনেক দেশের রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে—আশা অনুযায়ী অর্জন হয়নি। সম্মেলন শেষে বরাবরের মতোই একটি চুক্তি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট বা সংক্ষেপে গ্লাসগো চুক্তি। কিন্তু এই চুক্তি নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও তার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গোটা বিশ্ব, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম অনেক আগে থেকেই সোচ্চার। এই সংকটের মূল নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বারবার করে বলা হয়েছে—কয়লা, জীবাশ্ম জ্বালানি ইত্যাদির ব্যবহার এবং আরও নানা মানবসৃষ্ট কারণ এই জলবায়ু পরিবর্তনের নেপথ্যে। এ জন্য কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের কথা বহু আগে থেকে বলা হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বিশ্বনেতারাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই গোল বাঁধছে কে কতটা কার্বন নিঃসরণ কমাবে, সেই হিসাব নিয়ে। একজন যদি বলে এ দায়ী, অন্যজন বলছে—‘আমি! কক্ষনো না। দায়ী তো আসলে সে।’ আবার কেউ হয়তো নিজের দায়টা স্বীকার করছে, কিন্তু সঙ্গে অন্য কাউকে জুড়ে দিয়ে বলছেন—‘সে করলে, আমারও করতে আপত্তি নেই।’ কিন্তু এই প্রতিটি দাবি ও প্রস্তাবের সঙ্গে জুড়িগাড়ি বাঁধাটাই বিপত্তি তৈরি করছে।
আর এই অজুহাত-বিপত্তির ফাঁদে পড়ে কাতরাচ্ছে পৃথিবী। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এখন নাকাল বললেও কম বলা হবে। দাবদাহ, খরা, বন্যা, দাবানল, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে ক্রমাগত। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন উদ্বাস্তু হচ্ছে। শুধু ২০২০ সালেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাড়ে ৫ কোটি লোক শরণার্থী হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে। কিন্তু এদিকে যেন কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আলোচনায় বসছেন বিশ্বনেতারা, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে কী, তা একেবারেই অস্পষ্ট। অথচ পৃথিবীর জ্বর ক্রমাগত বাড়ছে। গত দশকটি ছিল বিশ্বের এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা উষ্ণতম দশক। এসব তথ্য নিয়মিত বিরতিতেই সামনে আসছে। একটা নড়েচড়ে বসা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার ফল কিন্তু ঘরে উঠছে না।
বিশ্বনেতারা ‘জলবায়ু শরণার্থী’ শব্দবন্ধটির সঙ্গে এখন পরিচিত। কিন্তু এ নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আবার জলবায়ু শরণার্থীর যেমন আছে, তেমনি অন্য শরণার্থীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টিও আছে। যেকোনো দেশে আশ্রিত শরণার্থী যেহেতু স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে তুলনামূলক কম নাগরিক সুবিধার আওতায় থাকে, সেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিতে তারাই বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচিসআরের প্রতিবেদনেও তেমনটিই বলা হয়েছে। এই সংকট কিন্তু সময়ের সঙ্গে ক্রমাগত বাড়ছে।
সব মিলিয়ে এবারের সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই। এতে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। এবারের সম্মেলনে সবচেয়ে বড় যে অগ্রগতি হয়েছে, তা হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্মত হওয়া। এ লক্ষ্য অর্জনে এ দুই দেশ আগামী দশক একযোগে কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া বনাঞ্চল ধ্বংস বন্ধ এবং নতুন করে বনায়নের বিষয়ে সম্মত হয়েছেন শতাধিক দেশের নেতা। এই দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্রাজিল, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর ‘ফুসফুস’খ্যাত আমাজন।
এবারের সম্মেলনে কয়লা থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতিপত্রে সই করেছে ৪০টির বেশি দেশ। এর মধ্যে পোল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও চিলির মতো দেশগুলো থাকা যদি আশা জাগায়, তবে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের না থাকাটা হতাশাজনক নিশ্চয়।
সম্মেলনে ২০০টি দেশের প্রতি ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এই নিঃসরণ হ্রাসের বিষয়টি ২০১৫ সালে হওয়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতেই ছিল। তাহলে কপ ২৬ নতুন কী দিল? একটা পার্থক্য হলো—প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় দেশগুলো। এখানে এবারের সম্মেলনে এই লক্ষ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য আরও ব্যাপকভাবে নিঃসরণ হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে আগামী বছরের মধ্যেই ২০৩০ সালের মধ্যে উষ্ণায়ন কমাতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে দেশগুলোকে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে দেওয়া ধনী দেশগুলোর অর্থায়নের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
কয়লাভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত তা অর্জনের খাতা থেকে ছুটে গেছে। খসড়া চুক্তিতে কয়লা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হলেও চীন ও ভারতের চাপে পরে তা পরিবর্তন করা হয়। নতুন করে লেখা হয়—কয়লার ব্যবহার কমানো হবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে এ খাতে ভর্তুকি না দেওয়ার প্রস্তাবে কোনো বদল হয়নি। কিন্তু জলবায়ু চুক্তিতে সই করা কোনো দেশই এটি মেনে চলতে আইনত বাধ্য নয়। এর মধ্যে যখন শুরুতেই মূল এজেন্ডা থেকে সরে আসা হয়, তখন তা মেনে চলা বা না চলার বিষয়টি নিয়ে আর বলবার কিছু থাকে না।
টেকসই জ্বালানি বিষয়েও এক ধরনের সমঝোতা এসেছে। তবে এসব ছাপিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকেই অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এ দুটিই কার্বন নিঃসরণকারী সবচেয়ে বড় দুই দেশ। পরিসংখ্যান বিষয়ক ওয়েবসাইট স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশই করেছে চীন। ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ নিয়ে পরের অবস্থানেই আছে যুক্তরাষ্ট্র। ৭ ও সাড়ে ৪ শতাংশ নিয়ে এর পরের দুই অবস্থান যথাক্রমে ভারত ও রাশিয়ার। এর মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে একযোগে দুই শীর্ষ দেশের কাজ করার খবর নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এর সঙ্গে ভারত ও রাশিয়াকে পাশে না পাওয়াটা কিছুটা হতাশার।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সামনে এসেছে, তা হলো বনাঞ্চল ধ্বংস না করার ব্যাপারে শতাধিক দেশের সম্মত হওয়া। এই দেশগুলোতেই রয়েছে বিশ্বের মোট বনাঞ্চলের ৮৫ শতাংশ। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে, এমন সমঝোতা এবং প্রতিশ্রুতি এর আগেও মিলেছিল। খোদ বাংলাদেশের প্রশাসন থেকেই প্রতি বছর পরিবেশ দিবসে বা জলবায়ু সম্মেলনের আগে-পরে পরিবেশ প্রেম উগরে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে বনাঞ্চল ধ্বংস ও পরিবেশবাদী আন্দোলন ও দিবস পালন একসঙ্গেই চলে। সুন্দরবনের আশপাশে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সেই সঙ্গে নানা শিল্প কারখানা এখন আর শঙ্কা নয়, বাস্তব।
এবারের সম্মেলনে বায়ুমণ্ডলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেনের নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হিসেবে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কমানোকে চিহ্নিত করেছেন অনেক আগেই। ফলে এবারের সম্মেলনে এই গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের এক জোট হওয়াকে অনেক বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। এ সম্পর্কিত ঘোষণায় বিশ্বের মোট মিথেন গ্যাস নিঃসরণের ৩০ শতাংশ ২০৩০ সালের মধ্যে কমিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছে শতাধিক দেশ। এটি নিঃসন্দেহে আশাব্যাঞ্জক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই শতাধিক দেশের মধ্যে নেই চীন, ভারত ও রাশিয়া, যারা এই গ্রিনহাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় তিন নিঃসরণকারী দেশ।
এ ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিলের আকার ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৩০ কোটি ডলার করার কথা বলা হয়েছে। তবে এতে খুশি হতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। তারা বলছে, চাহিদার চেয়ে এটি অনেক কম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই তহবিল দিয়ে আদতে কী করা হচ্ছে। খোদ বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, একদিকে জলবায়ু তহবিল নিয়ে তোড়জোড় চলে, অন্যদিকে পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কাজও চলে। ফলে কেন এই তহবিলের প্রসঙ্গটি আসছে, তা আর না বললেও চলে। কারণ, প্রকল্পই একমাত্র প্রকল্প ব্যয়সহ যাবতীয় অর্থ লেনদেনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। আর তাই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল এবং অতি অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সংকট নিরসন, প্রতিরোধের বদলে তহবিলের পেছনে ছুটেই বেশি সময় ব্যয় করে। এই বিনিয়োগ করা সময় যে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষের পকেট ভরতে ভালো কাজে লাগে, তার উল্লেখ অবান্তর।
এবারের সম্মেলনে ক্লিন বা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে অর্থায়নে সম্মত হয়েছে ৪৫০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৩০ লাখ কোটি ডলার। এটি আশার সঙ্গে শঙ্কাও জাগাচ্ছে। কারণ, এর মাধ্যমে পৃথিবীর ভাগ্যটি অন্য অর্থে বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কিনা সাধারণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।
সব মিলিয়ে পুরোনো কাসুন্দিই ঘুরে ফিরে এল। কপ ২৬ নিয়ে যে হইচই হয়েছিল, তার তুলনায় অর্জন সামান্যই। এবং এই অর্জনগুলোও আবার অনেকগুলো যদি-কিন্তুতে আটকে আছে। হয়তো কিছু তহবিল ছাড় পাওয়া যাবে ধনী দেশগুলো থেকে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এ নিয়ে একটা প্রচার করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন বা নদীগুলো বা মাটি ও হাওয়া যে ভালো থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। আরও ভালো কর বললে—প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার মাঝখানে সেই একই অনিশ্চয়তাতেই থেকে যাচ্ছে পৃথিবী।
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
৫ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৮ দিন আগে