শীর্ষ হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যা করে বিস্তৃত যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ইসরায়েল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ২৩: ৪৭

গত বছরের অক্টোবরে হামাসের হামলার পর থেকেই ইসরায়েল সঙ্গে সীমান্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। একের পর এক রকেট ও মিসাইল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে হিজবুল্লাহ। জবাবে ইসরায়েলও হামলা করছে আকাশপথে। তবে সম্প্রতি ইসরায়েল হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারদের লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। এতে এই সীমান্ত সংঘাত নতুন মাত্রা নিতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্বের ঘাঘু কূটনৈতিকেরা।  

কূটনীতিকদের ভাষ্যমতে, দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর সিনিয়র কমান্ডারদের হত্যা করে ইসরায়েল ভুল করছে। এতে গত তিন মাস ধরে চলমান দুই দেশের সীমান্ত সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। 

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলা কূটনীতিকেরা বলেছেন, অক্টোবরে হামাসের নজিরবিহীন হামলার পরে হিজবুল্লাহর দুই কমান্ডারকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এতে দেশটি লেবাননের সঙ্গে ভঙ্গুর বোঝাপড়ার সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। 

সর্বশেষ আজ রোববার উত্তর ইসরায়েলের কেফার যুভাল গ্রামে আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে লেবানন। এতে ওই গ্রামের ৭৬ বছর বয়সী এক নারী এবং তাঁর ৪০ বছর বয়সী ছেলে নিহত হয়েছেন। কেফার যুভাল থেকে প্রায় ১০ মাইল (১৬ কিমি) উত্তর-পূর্বে এলাকায় চার ভারী অস্ত্রধারী লেবানিজকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হত্যার কয়েক ঘণ্টা পরেই এই হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। 

অক্টোবরে ইসরায়েল সরকার দেশটির উত্তর সীমান্তের ৪০ টিরও বেশি শহর থেকে নাগরিকদের সরিয়ে নেয়। এসব শহরের একটি কেফার যুভাল। ইসরায়েলি মিডিয়া জানিয়েছে, কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে পরিবারটি এলাকায় থেকে গিয়েছিল। 

যদিও ইসরায়েল দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে প্রধান প্রধান ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদেরও লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। তবে ২০০৬ সালে লেবাননের সঙ্গে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর থেকে দেশটি শীর্ষ হিজবুল্লাহ নেতাদের গোয়েন্দা হামলা বা লক্ষ্যবস্তু করা এড়িয়েছে। 

হিজবুল্লাহর এলিট রাদওয়ান ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার উইসাম আল-তাভিলকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশটি আগের নীতি পরিবর্তন করেছে বলে মনে হচ্ছে। গত সোমবার দক্ষিণ লেবাননের খিরবেত সেলমে নিজ গাড়িতে ড্রোন হামলায় ৫৮ বছর বয়সী তাভিল নিহত হন। এর কয়েক দিন আগে বৈরুতের শহরতলিতে ইসরায়েলি হামলায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর দ্বিতীয় ব্যক্তি সালেহ আল-আরৌরি নিহত হন। 

এরপর হিজবুল্লাহর বিমানবাহিনীর কমান্ডার আলি হুসেন বুরজি তাভিলের জানাজার ময়দানে গাড়িতে এক হামলায় নিহত হন। ঘটনার পরপরই ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে হত্যার দায় স্বীকার করে বলেছেন, ‘এটি আমাদের যুদ্ধের অংশ। আমরা হিজবুল্লাহর লোকদের ওপর হামলা চালিয়েছি।’ 

যদিও উভয় পক্ষই মাঝে মাঝে বা দিনে একাধিকবার লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তজুড়ে গুলি চালাচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষকেরা এমন লক্ষ্যবস্তু করে হত্যাকাণ্ডকে সংঘাতের একটি নতুন স্তর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। একজন সিনিয়র কূটনীতিক বলেছেন, ‘আমরা এর আগে এমন কিছু দেখিনি। এটি অবশ্যই [সংঘাতের] একটি নতুন স্তর। আমাদের দেখতে হবে এটি আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, এটি কোনো ছকের অংশ কি না।’ 

হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল আগুনে ঘি ঢালছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কূটনৈতিকেরা। 

যদিও দুই পক্ষের মধ্যেই নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য, এরপরও তাবিলের হত্যা হিজবুল্লাহর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কেননা যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু কমান্ডারেরা অন্যদের চেয়ে সংগঠনের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কম সহজেই তাঁদের শূন্যতা পূরণ করা যায় না। চার বছর আগে বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় রেভল্যুশনারি গার্ডস কমান্ডার কাসেম সুলেইমানি হত্যাকাণ্ডের পর ইরান বিষয়টি অনুধাবন করেছে। 

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ বৈরুতের সমসাময়িক মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের একজন সহকারী অধ্যাপক এবং গণমাধ্যম ভাষ্যকার মাকরম রাবাহ বলেছেন, ‘তাভিল একজন অভিজ্ঞ লোক ছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। তাবিল ছিল সোলাইমানির মতো। তাঁর জায়গা সহজে পূরণ করা যায় না। তিনি মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে উঠে আসা কমান্ডার ছিলেন।’ 

রাবাহার দৃষ্টিতে তাভিল এবং হিজবুল্লাহর ড্রোন বাহিনীর কমান্ডার বুর্জি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের বার্তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তুমি একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারো। কিন্তু আমরা জানি কে এসব হামলা চালাচ্ছে এবং চাইলেই তাঁদের পেছনে লাগতে ও ঘায়েল করতে পারি।’ 

রাবাহ তাবিলের ভাইয়ের বাড়ির বাইরে এবং তাবিলের জানাজার ময়দানে বুর্জির ওপর চালানো হামলাকে কথিত ‘নিয়মের’ (লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা) আরেকটি উল্লেখযোগ্য লঙ্ঘন হিসাবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘লেবাননের সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা জেনেও জানাজার ময়দানে এই হামলা আরেকটি সীমারেখার লঙ্ঘন। কিন্তু এই হত্যার মধ্যে দিয়ে ইসরায়েলের বার্তা ছিল যে, তাঁরা সবার অবস্থান জানে। অন্য হিজবুল্লাহ নেতারা এখনো জীবিত কারণ আমরা (ইসরায়েল) তাঁদের হত্যা করতে চাই না। কিন্তু আমরা চাইলেই তোমাকে মেরে ফেলতে পারি।’ 

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে দিয়ে লেবাননে ইসরায়েলি এবং সন্দেহভাজন ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপক প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে। 

হামাস নেতা আরৌরির আগে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল সিরিয়ায় বড়দিনে দামেস্কের একটি খামারে সিনিয়র ইরানি কমান্ডার সাইয়্যেদ রাজি মুসাভি হত্যাকাণ্ড। সোলেইমানির পর থেকে হত্যা করা ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পসের সবচেয়ে সিনিয়র কমান্ডার। 

যাদের বিশ্লেষণ হিজবুল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি, তারাও মনে করছেন, লক্ষ্যবস্তু করে হত্যাকাণ্ড কয়েক মাস ধরে চলা সংঘাতের কথিত ‘নিয়ম’ লঙ্ঘিত হয়েছে। হিজবুল্লাহর আল-মানার টেলিভিশনে ভাষ্যকার ডা. আলি হামি বলেছেন, ‘আমরা এখনো কিছু নিয়মের সঙ্গে যুদ্ধে আছি। লক্ষ্যবস্তু করে হত্যাকাণ্ড সীমা অতিক্রম করেছে। আমরা যুদ্ধের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি...এটি বন্ধ করার পদক্ষেপের চেয়ে [আরও বেশি] প্রসারিত হচ্ছে।’ 

গার্ডিয়ান থেকে নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত