অনলাইন ডেস্ক
গত মাসের শুরুর দিকে ভারতের সঙ্গে সরাসরি রুপিতে লেনদেন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে রুপিতে কেনা পণ্যের প্রথম চালান দেশে এসেছে। অবশ্য রুপিতে আমদানি করা হয়েছে ৩০টি ট্রাক লরি।
দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই উদ্যোগকে ‘মাইলফলক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এই উদ্যোগ কেবল দুই দেশের বাণিজ্যকেই বাড়াবে না, একই সঙ্গে দুই দেশকে ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্য মোকাবিলার সুযোগও দেবে। তবে এখন প্রশ্ন হলো, এই উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশ আসলে কতটা লাভবান হবে?
চীনের পরপরই ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। তবে এই লেনদেনের মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে এবং আমদানি করে ১৪ বিলিয়ন ডলারের। নতুন এই উদ্যোগ বা চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ কেবল এই দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রুপিতে করতে পারবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যে পরিমাণ রপ্তানি সেই পরিমাণই রুপিতে লেনদেন হবে। যেখানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার।
দুই দেশের বাণিজ্যে এই বিশাল ফারাকের বিষয়টি সামনে রেখে বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ এবং বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা এই উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশের লাভবান হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, এই উদ্যোগ ভারতীয় মুদ্রার আন্তর্জাতিকীকরণে সহায়তা করবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশকে তেমন কোনো সুবিধা দেবে না। সম্প্রতি তাঁরা কাতারভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম আল-জাজিরাকে এমনটিই জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মত, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ কমাতে তেমন কোনো সহায়তা করবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে বাংলাদেশের চার মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব। অথচ চলতি বছরের শুরুতেই এই পরিমাণ ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ আমদানি নীতি কঠোর করেছে। কিন্তু দেশের রিজার্ভের ৭৫ শতাংশই গ্রিনব্যাক তথা ডলারে হওয়ায়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান বিগত এক বছরে ২৫ শতাংশ কমে গেছে। এ কারণে কঠোর আমদানি নীতি এনেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশ ডলারের ওপর চাপ কমাতে অন্যান্য বিদেশি মুদ্রা, যেমন—চীনা ইউয়ানে লেনদেন করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সরকার। অবশ্য এতে সুফল মিলেছে। ইউয়ানের রিজার্ভ ২০১৭ সালের ১ শতাংশের তুলনায় বেড়ে ১ দশমিক ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক আল-জাজিরাকে বলেছেন, রুপিতে লেনদেনের উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো।
কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন অন্য কথা। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘হিসাবটা খুবই সরল। বাংলাদেশকে (ভারতের সঙ্গে) ঘাটতি থাকা ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি লেনদেন করতে হবে ডলারেই। যদি না ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টাকায় লেনদেনে রাজি হন। তাই আমি দেখছি না যে রুপিতে লেনদেন করা হলে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।’
তবে জাহিদ হোসেনের মতে, এত কোনো ক্ষতিও নেই। যদিও এতে ভারতের ফায়দা স্পষ্ট। এ বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন হলো, ভারত তার মুদ্রার আন্তর্জাতিকীকরণ চায় এবং এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন পদক্ষেপও নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সম্ভবত সহায়তা করার চেষ্টা করছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রুপিতে লেনদেন তাঁরা অনেকটাই উপকৃত হবেন। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম গার্মেন্টস কারখানা এমবি নিট ফ্যাশনের মালিক মোহাম্মদ হাতেম জানান, রুপিতে লেনদেন হলে তাঁর অন্তত ৬ শতাংশ আমদানি খরচ বেঁচে যাবে। তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের টাকাকে ডলারে রূপান্তরিত করতে হতো। এটি করতে গিয়ে প্রতি ১০০ ডলারে আমাদের ৬ ডলার খরচ হতো রূপান্তর ফি দিতে গিয়ে। কিন্তু আমরা এখন রুপিতে সরাসরি লেনদেন করতে পারব।’
বাংলাদেশে ব্যবসা করা অন্যতম বৃহৎ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রুপিতে লেনদেন শুরু হওয়ায় তাঁদের খরচও কমবে। কারণ, তাঁদের পণ্য উৎপাদনের জন্য ৪০ শতাংশ কাঁচামালই আসে ভারত থেকে।
তবে রুপিতে লেনদেন হলে কীভাবে তা সাশ্রয়ী হবে সে বিষয়টি অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি বলছেন, ‘আগে ভারতের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহার করা হতো এবং এখন ব্যবহার করা হবে রুপি। ফলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে আগেও একটি মুদ্রাকে (টাকাকে ডলারে) রূপান্তরিত করতে হতো এবং এখনো একটি মুদ্রাকে (টাকাকে রুপিতে) রূপান্তর করতে হবে। তো আসলে তো কেবল মুদ্রার বদল হচ্ছে, তাই এটি স্পষ্ট নয় যে কীভাবে রূপান্তরের ক্ষেত্রে অর্থ সাশ্রয় হবে।’
বাংলাদেশি অর্থনীতি বিশ্লেষক জিয়া হাসান একটি বিষয় সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে রুপিতে লেনদেন রিজার্ভ রক্ষায় কোনো অবদান রাখবে না। আমদানিতে ডলারের বদলে রুপি ব্যবহার করায় যে পরিমাণ ডলার বেঁচে যাবে রুপিতে রপ্তানি করার ফলে তা একই থাকবে।
এই বিশ্লেষকের মতে, রুপিতে লেনদেনের জন্য যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ রুপি জমা থাকবে। কিন্তু এতে ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, ভারতের মতো একটি রপ্তানিমুখী দেশ সব সময়ই চাইবে রুপির অবমূল্যায়ন করতে। জিয়া হাসান বলেন, ‘সাধারণত একটি দেশের মুদ্রা অবমূল্যায়িত হলে দেশটির রপ্তানিকারকেরা সুবিধা পান এবং বাজার আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই যদি রুপির মূল্য কখনো কমে (সাধারণত ডলারের চেয়ে ভারতীয় রুপির মান অনেক বেশি অস্থিতিশীল) তখন বাংলাদেশকে এই অবমূল্যায়নের জন্য ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’
ওই বিশ্লেষক আরও একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশে রপ্তানি করার সময় রুপিতে লেনদেন করতে না-ও চাইতে পারেন। রুপির বিপরীতে তাঁদের ডলার কামানোর ঝোঁক থাকতে পারে।
তিন বছর ধরে ভারতে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। কিন্তু গত বছর তা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিষয়টির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে রুপিতে লেনদেন চালুর দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘এই উদ্যোগ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় ক্রেতারা দেখবেন যে তাঁরা নিজের মুদ্রায় পণ্য কিনতে পারছেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁরা বাংলাদেশি পণ্যকে নিজেদের পণ্য বলেই বিবেচনা করবেন।’ গভর্নর বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধির নতুন পথ খুলে দেবে।’
তবে বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এই উদ্যোগ দুই দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচন করবে—এমন সম্ভাবনা নেই।’ তাঁর মতে, ভারত এখনো অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি (বাইরে থেকে কম দামে আমদানি করা কোনো পণ্যের দাম দেশীয় পণ্যের সঙ্গে সমান করার জন্য যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়) আরোপ করছে। যার ফলে বাংলাদেশ ভারতে নিজস্ব পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতীয় পণ্যের বিপরীতে একটি টেকসই নেটওয়ার্ক তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলছেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি না, নতুন বাণিজ্য সৃষ্টি না হলে কীভাবে এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং রুপিতে লেনদেন থেকে বাংলাদেশ কীভাবে সুবিধা পাবে।’
তবে আবার আশার আলো দেখাচ্ছেন ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সাধারণ সম্পাদক এস এম আবুল কালাম আজাদ। সেটি অবশ্য সে অর্থে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় নয়। তাঁর মতে, এই চুক্তির ফলে লাখো বাংলাদেশি উপকৃত হবেন। বিশেষ করে যারা ভারতে বেড়াতে, চিকিৎসা নিতে এবং পড়াশোনা করতে যান তাঁরা এই চুক্তি থেকে উপকৃত হবেন।
গত বছরের জুলাই থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রুপিতে বৈশ্বিক বাণিজ্য লেনদেনে পথ প্রশস্ত করার জন্য রুপির আন্তর্জাতিকীকরণে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতির দেশসহ মোট ১৮টি দেশ এখন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে রাজি হয়েছে।
যা-ই হোক, বৈশ্বিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারে লেনদেন করাই ভালো। এমনটাই মত দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ডালাসের বিজনেস স্কুলের একজন অ্যাডজাংকট ফ্যাকাল্টি শাফকাত রাব্বি। তাঁর মতে, বৈশ্বিক লেনদেনের জন্য সব পক্ষের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী-প্রচলিত মুদ্রা ব্যবহার করা আসলেই সর্বোত্তম। কারণ, এটি লেনদেনের খরচ কমায় এবং এতে লেনদেন সহজ হয়।
শাফকাত রাব্বি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘বেশির ভাগ দেশই মার্কিন ডলারে বাণিজ্যিক লেনদেন করে এবং ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ, অন্য সবাইও তাই করে।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
গত মাসের শুরুর দিকে ভারতের সঙ্গে সরাসরি রুপিতে লেনদেন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে রুপিতে কেনা পণ্যের প্রথম চালান দেশে এসেছে। অবশ্য রুপিতে আমদানি করা হয়েছে ৩০টি ট্রাক লরি।
দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই উদ্যোগকে ‘মাইলফলক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এই উদ্যোগ কেবল দুই দেশের বাণিজ্যকেই বাড়াবে না, একই সঙ্গে দুই দেশকে ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্য মোকাবিলার সুযোগও দেবে। তবে এখন প্রশ্ন হলো, এই উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশ আসলে কতটা লাভবান হবে?
চীনের পরপরই ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। তবে এই লেনদেনের মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে এবং আমদানি করে ১৪ বিলিয়ন ডলারের। নতুন এই উদ্যোগ বা চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ কেবল এই দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রুপিতে করতে পারবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যে পরিমাণ রপ্তানি সেই পরিমাণই রুপিতে লেনদেন হবে। যেখানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার।
দুই দেশের বাণিজ্যে এই বিশাল ফারাকের বিষয়টি সামনে রেখে বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ এবং বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা এই উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশের লাভবান হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, এই উদ্যোগ ভারতীয় মুদ্রার আন্তর্জাতিকীকরণে সহায়তা করবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশকে তেমন কোনো সুবিধা দেবে না। সম্প্রতি তাঁরা কাতারভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম আল-জাজিরাকে এমনটিই জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মত, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ কমাতে তেমন কোনো সহায়তা করবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে বাংলাদেশের চার মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব। অথচ চলতি বছরের শুরুতেই এই পরিমাণ ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ আমদানি নীতি কঠোর করেছে। কিন্তু দেশের রিজার্ভের ৭৫ শতাংশই গ্রিনব্যাক তথা ডলারে হওয়ায়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান বিগত এক বছরে ২৫ শতাংশ কমে গেছে। এ কারণে কঠোর আমদানি নীতি এনেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশ ডলারের ওপর চাপ কমাতে অন্যান্য বিদেশি মুদ্রা, যেমন—চীনা ইউয়ানে লেনদেন করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সরকার। অবশ্য এতে সুফল মিলেছে। ইউয়ানের রিজার্ভ ২০১৭ সালের ১ শতাংশের তুলনায় বেড়ে ১ দশমিক ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক আল-জাজিরাকে বলেছেন, রুপিতে লেনদেনের উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো।
কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন অন্য কথা। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘হিসাবটা খুবই সরল। বাংলাদেশকে (ভারতের সঙ্গে) ঘাটতি থাকা ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি লেনদেন করতে হবে ডলারেই। যদি না ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টাকায় লেনদেনে রাজি হন। তাই আমি দেখছি না যে রুপিতে লেনদেন করা হলে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।’
তবে জাহিদ হোসেনের মতে, এত কোনো ক্ষতিও নেই। যদিও এতে ভারতের ফায়দা স্পষ্ট। এ বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন হলো, ভারত তার মুদ্রার আন্তর্জাতিকীকরণ চায় এবং এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন পদক্ষেপও নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সম্ভবত সহায়তা করার চেষ্টা করছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রুপিতে লেনদেন তাঁরা অনেকটাই উপকৃত হবেন। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম গার্মেন্টস কারখানা এমবি নিট ফ্যাশনের মালিক মোহাম্মদ হাতেম জানান, রুপিতে লেনদেন হলে তাঁর অন্তত ৬ শতাংশ আমদানি খরচ বেঁচে যাবে। তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের টাকাকে ডলারে রূপান্তরিত করতে হতো। এটি করতে গিয়ে প্রতি ১০০ ডলারে আমাদের ৬ ডলার খরচ হতো রূপান্তর ফি দিতে গিয়ে। কিন্তু আমরা এখন রুপিতে সরাসরি লেনদেন করতে পারব।’
বাংলাদেশে ব্যবসা করা অন্যতম বৃহৎ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রুপিতে লেনদেন শুরু হওয়ায় তাঁদের খরচও কমবে। কারণ, তাঁদের পণ্য উৎপাদনের জন্য ৪০ শতাংশ কাঁচামালই আসে ভারত থেকে।
তবে রুপিতে লেনদেন হলে কীভাবে তা সাশ্রয়ী হবে সে বিষয়টি অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি বলছেন, ‘আগে ভারতের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহার করা হতো এবং এখন ব্যবহার করা হবে রুপি। ফলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে আগেও একটি মুদ্রাকে (টাকাকে ডলারে) রূপান্তরিত করতে হতো এবং এখনো একটি মুদ্রাকে (টাকাকে রুপিতে) রূপান্তর করতে হবে। তো আসলে তো কেবল মুদ্রার বদল হচ্ছে, তাই এটি স্পষ্ট নয় যে কীভাবে রূপান্তরের ক্ষেত্রে অর্থ সাশ্রয় হবে।’
বাংলাদেশি অর্থনীতি বিশ্লেষক জিয়া হাসান একটি বিষয় সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে রুপিতে লেনদেন রিজার্ভ রক্ষায় কোনো অবদান রাখবে না। আমদানিতে ডলারের বদলে রুপি ব্যবহার করায় যে পরিমাণ ডলার বেঁচে যাবে রুপিতে রপ্তানি করার ফলে তা একই থাকবে।
এই বিশ্লেষকের মতে, রুপিতে লেনদেনের জন্য যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ রুপি জমা থাকবে। কিন্তু এতে ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, ভারতের মতো একটি রপ্তানিমুখী দেশ সব সময়ই চাইবে রুপির অবমূল্যায়ন করতে। জিয়া হাসান বলেন, ‘সাধারণত একটি দেশের মুদ্রা অবমূল্যায়িত হলে দেশটির রপ্তানিকারকেরা সুবিধা পান এবং বাজার আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই যদি রুপির মূল্য কখনো কমে (সাধারণত ডলারের চেয়ে ভারতীয় রুপির মান অনেক বেশি অস্থিতিশীল) তখন বাংলাদেশকে এই অবমূল্যায়নের জন্য ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’
ওই বিশ্লেষক আরও একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশে রপ্তানি করার সময় রুপিতে লেনদেন করতে না-ও চাইতে পারেন। রুপির বিপরীতে তাঁদের ডলার কামানোর ঝোঁক থাকতে পারে।
তিন বছর ধরে ভারতে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। কিন্তু গত বছর তা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিষয়টির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে রুপিতে লেনদেন চালুর দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘এই উদ্যোগ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় ক্রেতারা দেখবেন যে তাঁরা নিজের মুদ্রায় পণ্য কিনতে পারছেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁরা বাংলাদেশি পণ্যকে নিজেদের পণ্য বলেই বিবেচনা করবেন।’ গভর্নর বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধির নতুন পথ খুলে দেবে।’
তবে বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এই উদ্যোগ দুই দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচন করবে—এমন সম্ভাবনা নেই।’ তাঁর মতে, ভারত এখনো অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি (বাইরে থেকে কম দামে আমদানি করা কোনো পণ্যের দাম দেশীয় পণ্যের সঙ্গে সমান করার জন্য যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়) আরোপ করছে। যার ফলে বাংলাদেশ ভারতে নিজস্ব পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতীয় পণ্যের বিপরীতে একটি টেকসই নেটওয়ার্ক তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলছেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি না, নতুন বাণিজ্য সৃষ্টি না হলে কীভাবে এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং রুপিতে লেনদেন থেকে বাংলাদেশ কীভাবে সুবিধা পাবে।’
তবে আবার আশার আলো দেখাচ্ছেন ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সাধারণ সম্পাদক এস এম আবুল কালাম আজাদ। সেটি অবশ্য সে অর্থে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় নয়। তাঁর মতে, এই চুক্তির ফলে লাখো বাংলাদেশি উপকৃত হবেন। বিশেষ করে যারা ভারতে বেড়াতে, চিকিৎসা নিতে এবং পড়াশোনা করতে যান তাঁরা এই চুক্তি থেকে উপকৃত হবেন।
গত বছরের জুলাই থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রুপিতে বৈশ্বিক বাণিজ্য লেনদেনে পথ প্রশস্ত করার জন্য রুপির আন্তর্জাতিকীকরণে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতির দেশসহ মোট ১৮টি দেশ এখন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে রাজি হয়েছে।
যা-ই হোক, বৈশ্বিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারে লেনদেন করাই ভালো। এমনটাই মত দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ডালাসের বিজনেস স্কুলের একজন অ্যাডজাংকট ফ্যাকাল্টি শাফকাত রাব্বি। তাঁর মতে, বৈশ্বিক লেনদেনের জন্য সব পক্ষের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী-প্রচলিত মুদ্রা ব্যবহার করা আসলেই সর্বোত্তম। কারণ, এটি লেনদেনের খরচ কমায় এবং এতে লেনদেন সহজ হয়।
শাফকাত রাব্বি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘বেশির ভাগ দেশই মার্কিন ডলারে বাণিজ্যিক লেনদেন করে এবং ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ, অন্য সবাইও তাই করে।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১ ঘণ্টা আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
৭ ঘণ্টা আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
১ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ দিন আগে