Ajker Patrika

সৌদি প্রস্তাব ফিরিয়ে আলোচনায় বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট, দেশপ্রেম নাকি জনতুষ্টি

অনলাইন ডেস্ক
বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ত্রাওরে। ছবি: সংগৃহীত
বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ত্রাওরে। ছবি: সংগৃহীত

ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে এখন আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর অন্তর্বর্তীকালীন নেতা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল হেনরি দামিবাকে উৎখাত করে তিনি ক্ষমতা দখল করেন। ৩৭ বছর বয়সী এই ক্যাপ্টেন সে বছর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোচ মার্ক কাবোরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে পল দামিবাকে সমর্থন করেছিলেন।

মসজিদ নির্মাণে সৌদি আরবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বেশ আলোচনায় ত্রাওরে। এমনকি বাংলাদেশেও তিনি এখন পরিচিত হয়ে উঠেছেন। অনেকে তাঁর এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।

ত্রাওরে ক্ষমতা নেওয়ার পর, আঞ্চলিক জোট ইকোওয়াস থেকে পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসো–সহ তিনটি দেশকে বের করে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পরে বুরকিনা ফাসো, নাইজার এবং মালি মিলে অ্যালায়েন্স অব সাহেল স্টেটস নামে একটি বিকল্প জোট গঠন করে।

ত্রাওরে ১৯৮৮ সালে বন্দোকুয়ে শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ববো দিওলাসোতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় শেষ করার পর রাজধানীতে চলে যান, সেখানে তিনি ওয়াগাদুগু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন। স্নাতক শেষ করে ত্রাওরে ২০১০ সালে ২২ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি বুরকিনা ফাসোর সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার স্কুল জর্জ নামোয়ানো মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১২ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ২০১৪ সালে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হওয়ার পর জাতিসংঘের মাল্টি ডাইমেনশনাল ইন্টিগ্রেটেড স্ট্যাবিলাইজেশন মিশন ইন মালিতে (মিনুসমা) শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করেন।

মিনুসমায় কাজ করার পর ত্রাওরে সন্ত্রাসবাদ দমনে একটি বিশেষ ইউনিটের অংশ হিসেবে উত্তর বুরকিনা ফাসোর মিশনে অংশ নেন। ২০২০ সালে ৩২ বছর বয়সে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কাবোরের বিরুদ্ধে কর্নেল দামিবা অভ্যুত্থান ঘটান। এরপর তিনি ত্রাওরেকে বুরকিনা ফাসোর উত্তর–মধ্য অঞ্চলের একটি আর্টিলারি রেজিমেন্টের প্রধান নিযুক্ত করেন।

দামিবা সেনাবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন—এটি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ত্রাওরে ও জুনিয়র অফিসারদের একটি দল অভ্যুত্থান পরিকল্পনা করে। এক অতর্কিত হামলায় ১১ জন সেনা এবং কয়েক ডজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর সৃষ্ট জনরোষ এবং সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে তাঁরা ক্ষমতা দখল করেন।

কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণ ক্যাপ্টেন এবং তাঁর দল অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে জনগণের ব্যাপক সমর্থন পান। কেউ কেউ ত্রাওরেকে বুরকিনা ফাসোর বামপন্থী বিপ্লবী সামরিক নেতা ক্যাপ্টেন থমাস সাঙ্কারার সঙ্গে তুলনা করেন। এটা সত্য যে, দুই ক্যাপ্টেন ৩৪ বছর বয়সে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তবে তুলনা শুধু ওই পদ আর বয়সের মধ্যে চলে।

১৯৮০–এর দশকে এবং স্নায়ুযুদ্ধের শেষের দিকে সাঙ্কারা ক্ষমতায় আসেন। ওই সময় আদর্শগত বিভাজন বুরকিনা ফাসোর সশস্ত্র বাহিনীকে বিভক্ত করে ফেলেছিল। সাঙ্কারাকে সমর্থনকারী অফিসাররা ১৯৮৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটান। মার্কসবাদী বিপ্লবী সাঙ্কারা রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা করেছিলেন। এর মধ্যে গণমুখী রাজনীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশ দূষণ মোকাবিলা এবং বৈষম্য নিরসনের নীতি ছিল সাঙ্কারার অন্যতম এজেন্ডা।

সেদিক থেকে ত্রাওরের অবস্থান বেশ অনিশ্চিত। অধিকাংশ সামরিক অফিসার তাঁর বা দামিবার নেতৃত্বে কোনো অভ্যুত্থানে অংশ নেননি, যা বুরকিনা ফাসোর সশস্ত্র বাহিনীর বিভক্ত অবস্থাকে তুলে ধরে। ত্রাওরে সরকার তাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগ করেছে।

নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে ত্রাওরে অবশ্য শুদ্ধি ও পুনর্গঠন অভিযান শুরু করেছেন। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা বাজেটের ওপর কর ধার্য করা, খনি খাত এবং অন্যান্য সরকারি রাজস্বের উৎস থেকে আয় বাড়ানো অন্তর্ভুক্ত। তিনি নাগরিকদের স্বদেশ রক্ষায় সহিংস উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এটি মূলত সামরিক সরকার সমর্থিত একটি বেসামরিক মিলিশিয়া বাহিনী। যদিও ‘স্বেচ্ছাসেবকদের’ জোরপূর্বক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

ত্রাওরেকে যেভাবে প্রায়শই চিত্রিত করা হয়, তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে ততটা জনপ্রিয় কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সমালোচকদের কঠোরভাবে দমন, একাধিক কথিত অভ্যুত্থানের চেষ্টা, সেই সঙ্গে চলমান সহিংসতা এবং মানবিক সংকট থেকে এটি অনুমেয়। তিনি বাক–স্বাধীনতা খর্ব করেছেন। বিরোধী মত দমনে অত্যন্ত কঠোর। সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের নেতা, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং এমনকি বিচারকদেরও লক্ষ্যবস্তু করেছে তাঁর সরকার।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থানে রাশিয়ার তথ্য কারসাজি এবং হস্তক্ষেপের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এই প্রচারণাগুলোর কেন্দ্রে ছিল রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী গোষ্ঠী ভাগনার। এ ছাড়া, বিভিন্ন ভুয়া সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিভাজনমূলক প্রচারণা চালানো হয় এবং স্থানীয় ক্ষোভের জন্য ফ্রান্স এবং অন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করা হয়।

অভ্যুত্থানের পরপরই নিজের সমর্থন বাড়ানোর লক্ষ্যে ত্রাওরে দেশটিতে বিদ্যমান ফ্রান্স–বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগান। তিনি দেশের অনেক দুর্দশার জন্য ফ্রান্সকে দায়ী করেন এবং দামিবাকে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে তুলে ধরেন। কয়েক মাসের মধ্যে, ত্রাওরে বুরকিনা ফাসো থেকে ফ্রান্সের সেনা উপস্থিতি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারের দাবি জানান।

ফ্রান্স সেনা প্রত্যাহারের পর রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদের ত্রাওরেকে সুরক্ষা দিতে দেখা গেছে এবং মালি সীমান্তের কাছে এই ভাগনার বাহিনী সরকারের হয়ে অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া, প্রায় ১০০–৩০০ জন রুশ সেনা বুরকিনা ফাসোতে যায় বলে জানা যায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ত্রাওরে এবং তাঁর সেনা সরকারের মনোযোগ নিরাপত্তার দিকে নিবদ্ধ।

কিন্তু ত্রাওরের কর্মকাণ্ড দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারেনি। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে জঙ্গিবাদী ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৩ হাজার ৫৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে; অভ্যুত্থানের আগের দুই বছরের তুলনায় যা প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। জঙ্গি সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা ২০২২ সালের চেয়ে (৩ হাজার ৬২১ জন) বেড়ে ২০২৪ সালে ৬ হাজার ৩৮৯ জনে বা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

ত্রাওরের ক্ষমতা দখলের পর থেকে জান্তা বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার দাবি করেছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক গণহত্যার কয়েক সপ্তাহ পরেই ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা হয়। বারসালোঘো শহরের বাইরে শত শত বেসামরিক নাগরিককে উগ্রবাদীরা হত্যা করে। জঙ্গিবাদী ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর হামলায় বেসামরিক প্রাণহানি ২০২২ সালে যেখানে ৭২১ জন ছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৫১ জনে। তবে এর চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সামরিকবাহিনী বা তাদের অর্থায়নে পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে বেসামরিক মৃত্যুর ঘটনা। ত্রাওরের আমলে সহিংসতা এতটাই বেড়ে গেছে যে, কিছু অনুমান অনুসারে, দেশটিতে বর্তমানে ৩০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত।

বুরকিনা ফাসো স্বাধীন হওয়ার পর ৬৫ বছর পেরিয়ে গেছে, এর মধ্যে দেশটি ৪৫ বছরই সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিল বা আছে। এই অবস্থায় দেশটিতে বিদ্যমান সহিংসতা এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সামরিক বাহিনী প্রধান রাজনৈতিক অভিনেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

যাই হোক, অতি সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, সৌদি আরব ত্রাওরেকে বুরকিনা ফাসোতে ২০০টি মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ত্রাওরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সৌদি আরবকে দেশটির শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।

ত্রাওরে জানিয়েছেন, এরই মধ্যে বুরকিনা ফাসোতে যথেষ্ট মসজিদ আছে। কিছু মসজিদে তো এমনকি নামাজও পড়া হয় না, বিরান পড়ে রয়েছে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত জাতীয় অগ্রগতির জন্য তাঁর ব্যাপক পরিকল্পনাকেই প্রতিফলিত করে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ত্রাওরে স্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জনগুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নত করার ওপর মনোনিবেশ করেছেন।

তাঁর সরকার সরকারি প্রকল্পগুলো পরিচালনার পদ্ধতি উন্নত করতে সংস্কার করছে। যেমন, গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় এখন পরিকল্পনা থেকে নির্মাণ পর্যন্ত পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, পাশাপাশি সব নিরাপত্তা, পরিবেশগত এবং প্রযুক্তিগত মান পূরণ নিশ্চিত করে।

অবকাঠামোর বাইরে ত্রাওরে নিরাপত্তা সংকটের কারণে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য আবাসন সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০২৪ সালের ১২ জুলাই তিনি ১ হাজার সামাজিক আবাসন ইউনিট নির্মাণের একটি প্রকল্প ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণা মূলত ২০৩০ সালের মধ্যে বুরকিনা ফাসোর সব নাগরিকের বাসস্থান নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অংশ।

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য প্রচেষ্টায়, ত্রাওরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে আর্থিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। পরিবর্তে, তিনি দেশের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করতে চান। তাঁর সরকার কৃষি, স্থানীয় শিল্প এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর ফোকাস করে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাচ্ছে।

সৌদি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, ত্রাওরে স্পষ্ট করে দিয়েছেন—তাঁর অগ্রাধিকার হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তিনি বিশ্বাস করেন, এগুলোই বুরকিনা ফাসোর জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় মূল ক্ষেত্র। এই অবস্থায় ত্রাওরেকে একজন সাহসী সংস্কারক, ত্রাতা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে। যদিও রাজনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে ত্রাওরের পদক্ষেপ হয়তো বুরকিনা ফাসোকে আগামী কয়েক দশক ভোগাবে।

তথ্যসূত্র: এক্সটিআর আফ্রিকা ও দ্য কনভারসেশন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত