ফজলুল কবির
শুনতে যেমনই লাগুক, যুক্তরাষ্ট্রের নিজ ঘরেই চলছে এক অঘোষিত যুদ্ধ। বিশ্বের নানা প্রান্তে হওয়া যুদ্ধ, সহিংসতা বা অন্য কোনো অস্থিরতা নিয়ে দেশটির সরব এবং কখনো কখনো অতিসরব ভূমিকা থাকলেও নিজ দেশে চলা এই অঘোষিত যুদ্ধ নিয়ে তার কোনো হেলদোল নেই। সবারই এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা যে, যুক্তরাষ্ট্রে চলা এই অঘোষিত যুদ্ধ বলতে আদতে বন্দুক হামলার কথা বলা হচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার লোক নির্বিচারে বন্দুক হামলায় মারা গেলেও এর একমাত্র ওষুধ ‘আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন’ এখনো অধরাই রয়ে গেছে। এবারও এমন একটি কঠোর আইনের প্রস্তাব উঠলেও তা রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের বিরোধের মুখে ভেস্তে গেছে।
না, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন করার বিষয়টি একেবারেই আলোচনার বাইরে যায়নি। তবে এটি হওয়ার সম্ভাবনা যে অনেক কম, তা একবাক্যে সবাই মানবেন। আইনপ্রণেতারা আরও কিছুদিন এ নিয়ে তর্ক করবেন। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে এ নিয়ে পাশা খেলা চলবে, দেশটির ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) এ নিয়ে লবিং করবে, সাধারণ মানুষ নানা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের দাবিনামা তুলে ধরবে, আর নানামুখী এই খেলার মাঝখানে ঝরে যেতে থাকবে একের পর এক প্রাণ।
সর্বশেষ আইওয়ায় গির্জায় হওয়া হামলায় দুই নারী যখন নিহত হচ্ছেন, তার কিছুক্ষণ আগেই সামরিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের পক্ষ নিয়ে ভাষণ দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার আগের দিন হলো হাসপাতালে। কে কাকে মারল? যে সার্জনের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেন, তাঁকেই হত্যা করলেন বন্দুকধারী। তার আগে হলো স্কুলে হামলা। তার আগে? তার আগে? না, হিসাব করাটা ভীষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বন্দুক হামলা হচ্ছে। শপিংমল, স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা, শেষকৃত্যানুষ্ঠান—কোনো কিছুই আর বন্দুকের আওতার বাইরে নয়। মানুষ মরছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এর মধ্যে নিউইয়র্কের বাফেলো সুপার মার্কেট, টেক্সাসের স্কুল ও টুলসার হাসপাতালে হামলা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে নিহতের সংখ্যা বিচারে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনই কেউ না কেউ বন্দুকের কারণে মরছে। হয় নিজে মরছে, নয়তো অন্যকে মারছে, আবার কেউ অন্যকে মেরে নিজেও মরছে। এ যেন থামার নয়। প্রতিটি বড় হামলা অবধারিতভাবেই মার্কিন জনপরিসরে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োজনীয়তার আলোচনাটি উসকে দেয়। তারপর এ নিয়ে হাজারটা কথা ঘুরে বেড়ায়। নেতারা প্রতিশ্রুতি দেন, নেতারা প্রস্তাব দেন, বিরোধিতাও করেন, আর এসবের মধ্য দিয়ে আইনের বিষয়টি আবারও ধামাচাপা পড়ে।
হ্যাঁ, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিষয়টি নিয়ে নির্লিপ্ত নন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে।’ কিন্তু যথেষ্ট তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। এ নিয়ে আরেক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও সোচ্চার হতে দেখেছিল মানুষ। কিন্তু কিছুই করা যায়নি।
এই না করার মধ্যেই মানুষ মারা পড়ছে অচেনা-অজানা ঘাতকের হাতে। কত মৃত্যু হচ্ছে আসলে? চলতি বছরের হিসাবের দিকেই একটু তাকানো যাক। মার্কিন ওয়েবসাইট গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ (জিভিএ) জানাচ্ছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত বন্দুকের গুলিতে দেশটিতে মারা পড়েছে ১৮ হাজার ৩১৯ জন। এর মধ্যে হত্যার উদ্দেশ্যে বা অনিচ্ছায় ছোড়া গুলিতে মারা পড়েছে ৮ হাজার ১৫৫ জন। আর আত্মহত্যার ঘটনা আছে ১০ হাজার ১৬৪টি। এই নিহতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাটি চমকে দেওয়ার মতো। বন্দুক হামলায় ১১ বছরের কম বয়সী ১৫২টি শিশু নিহত হয়েছে। আর ১২ থেকে ১৭ বছরের কিশোর আছে ৫৪১ জন। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যাও অনেক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বন্দুক হামলায় আহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৩২৫। এখানে বলে রাখা ভালো, জিভিএর পরিসংখ্যানে শুধু গুলিতে তদনগদ নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যাই উঠে এসেছে। গুলিতে হওয়া ক্ষতের কারণে পরে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মনে রাখা দরকার, চলতি বছরের মাত্র পাঁচ মাস পার হয়েছে। বাকি আছে আরও সাত মাস। পাঁচ মাসেই ১৮ হাজারের বেশি মৃত্যু দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। পরের সাত মাসে কী হয় কে জানে! সাম্প্রতিক প্রবণতা ভীষণ শঙ্কা ছড়াচ্ছে। কারণ গেল কয়েক দিনের মধ্যে একের পর এক বন্দুক হামলা, এগুলোর স্থান ভীষণ শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এমনকি এবার ২০২০ সালের রেকর্ডও ছাড়িয়ে যেতে পারে। মার্কিন সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্যমতে, ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় নিহত বা গুলিতে হওয়া ক্ষতের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৪৫ হাজার ২২২ জন মারা গেছে। এগুলোর মধ্যে যেমন বন্দুক সহিংসতা আছে, তেমনি আছে হত্যা ও আত্মহত্যাও।
সিডিসি জানায়, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুধু বন্দুকের কারণে হওয়া মৃত্যুর মধ্যে আত্মহত্যাই বেশি। মোট মৃত্যুর ৫৪ শতাংশ বা ২৪ হাজার ২৯২টি হচ্ছে আত্মহত্যা। আর ৪৩ শতাংশ হয়েছে সরাসরি হত্যা। সংখ্যার হিসাবে খুন হয়েছে ১৯ হাজার ৩৮৪টি। এর বাইরে অনিচ্ছায় ছোড়া গুলিতে বা দুর্ঘটনাবশত মৃত্যু হয়েছে ৫৩৫ জনের। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৬১১ জন। মোট মৃত্যুর হিসাবে ২০২০ সালে বন্দুকের কারণে মৃত্যু আগের বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। আর পাঁচ বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
অনেকে হয়তো বলবেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা অনুপাতে বন্দুকের কারণে মৃত্যু হিসাব করলে এতটা চমকাতে হবে না। তাহলে আবার একটু সিডিসির কাছে যাওয়া যাক। তারা জানাচ্ছে, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বন্দুকের কারণে নিহতের হার ১৩ দশমিক ৬। চলতি শতকে এটাই সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৭৪ সালে এই হার ছিল ১৬ দশমিক ৩, যা এ-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ শুরুর পর সর্বোচ্চ।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম ১৪৫ দিনে ২১৪টি বন্দুক হামলা হয়েছে, যেখানে চারজন বা তার বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে একটির বেশি বন্দুক হামলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই হিসাবে কিন্তু সাম্প্রতিকতম হামলাটি অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, সেখানে চারজন নয়, হামলাকারীসহ তিনজন নিহত হয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন মার্কিন আইনপ্রণেতারা পাশা খেলছেন বসে। এক পক্ষ কঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাব করছে, তো অন্য পক্ষ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দোহাইয়ে তা আটকে দিচ্ছে। এবার এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে ‘প্রোটেকটিং আওয়ার কিডস অ্যাক্ট’। নিশ্চিতভাবেই ডেমোক্রেটিক দল টেক্সাসের স্কুলে হওয়া হামলায় ১৯ শিশুর মৃত্যুর বিষয়টিকে সামনে এনে এ আইন প্রণয়নের জন্য চাপ প্রয়োগের নীতি নিয়েছে। আর এনআরএর আশীর্বাদপুষ্ট রিপাবলিকান দল কী করছে?
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ‘শিশু সুরক্ষা আইন’-এর প্রস্তাব নিয়ে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে আলোচনা হয়। এ সময় ফ্লোরিডা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়া রিপাবলিকান প্রতিনিধি গ্রেগ স্টিউব একে একে নিজের ব্যক্তিগত চারটি বন্দুক টেবিলের ওপর রাখেন এবং বলেন, ‘নিজেকে, নিজের পরিবার এবং ঘরকে সুরক্ষার জন্য আমি প্রতিদিন এই বন্দুক বহন করি।’ তাঁর এ কথার মাঝখানে জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান জেরল্ড ন্যাডলার বলেন, ‘এগুলোর কোনোটাই যেন লোডেড না হয়।’ কিন্তু এর জবাবে স্টিউব বলেন, ‘নিজের ঘরে, নিজের বন্দুক নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি।’
স্টিউবের এই বক্তব্যই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে রিপাবলিকান দলের অবস্থানকে প্রকাশ করে। তারা নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে সামনে এনে বরাবরই অস্ত্র আইনের বিরোধিতা করছে। কঠোর অস্ত্র আইনের বদলে তারা বলছে, স্কুলের নিরাপত্তা বাড়ানো হোক। অর্থাৎ নিরাপত্তা সরঞ্জামের অজুহাতে এনআরএর মতো অংশীজনদের লাভের গুড় আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়া আরকি। এটি তাদের অনেক পুরোনো অবস্থান। এ অবস্থায় ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ‘শিশু সুরক্ষা আইন’ হয়তো পাস করে নিতে পারবে। আগামী সপ্তাহেই হয়তো এর ওপর ভোট হবে প্রতিনিধি পরিষদে। কিন্তু আইন হিসেবে পাস করাতে হলে সিনেট পার হতে হবে প্রস্তাবটিকে। সেখানে উভয় পক্ষ সমানে-সমান। কিন্তু আইন হিসেবে পাস হতে হলে সিনেটের ১০০ ভোটের মধ্যে ৬০ টিকে অন্তত পক্ষে পেতে হবে।
ফলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সিনেটের দেয়ালটি এবারও টপকাতে পারবে না আইনটি। আরেকটি বড় হামলার আগ পর্যন্ত এবিষয়ক আলোচনা হয়তো শীতনিদ্রায় চলে যাবে। এর মাঝে একটি-দুটি করে হামলা প্রতিদিন হতে থাকবে আর মানুষ মরতে থাকবে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই হামলাগুলোয় যে মারছে এবং যে মরছে, তাদের মধ্যে এমনকি নেই কোনো শত্রুতার বিষয়ও। যেমনটি হয়ে থাকে যুদ্ধের ময়দানে। সেখানে পরস্পরের মুখোমুখি বন্দুক তাক করে থাকা সৈনিকদের কারও সঙ্গেই কারও নেই ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান এই বাস্তবতাকে অঘোষিত যুদ্ধই বলা যায় প্রকরণের দিক থেকে। নিজেদের লোকেরাই মারা পড়ছে, মারা পড়ছে নিজেদের শিশুরাই। অথচ দেশটির আইনপ্রণেতারা অক্রিয় বসে আছেন। যদিও দূরদেশ ইউক্রেনে হওয়া যুদ্ধ এবং এর কারণে হওয়া মৃত্যু ও ক্ষয় নিয়ে তারা খুব সোচ্চার। তারা সেই যুদ্ধ থামাতে সম্ভাব্য সবকিছু করতে রাজি। এ নিয়ে বহুপক্ষীয় তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। অন্য অনেক দেশকে সঙ্গে নিয়ে এই তৎপরতা চালাতে হচ্ছে। অথচ নিজ দেশের এই ক্ষয় থামানো নিয়ে তারাই কেমন বিস্ময়করভাবে নির্বিকার।
আরও পড়ুন:
শুনতে যেমনই লাগুক, যুক্তরাষ্ট্রের নিজ ঘরেই চলছে এক অঘোষিত যুদ্ধ। বিশ্বের নানা প্রান্তে হওয়া যুদ্ধ, সহিংসতা বা অন্য কোনো অস্থিরতা নিয়ে দেশটির সরব এবং কখনো কখনো অতিসরব ভূমিকা থাকলেও নিজ দেশে চলা এই অঘোষিত যুদ্ধ নিয়ে তার কোনো হেলদোল নেই। সবারই এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা যে, যুক্তরাষ্ট্রে চলা এই অঘোষিত যুদ্ধ বলতে আদতে বন্দুক হামলার কথা বলা হচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার লোক নির্বিচারে বন্দুক হামলায় মারা গেলেও এর একমাত্র ওষুধ ‘আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন’ এখনো অধরাই রয়ে গেছে। এবারও এমন একটি কঠোর আইনের প্রস্তাব উঠলেও তা রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের বিরোধের মুখে ভেস্তে গেছে।
না, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন করার বিষয়টি একেবারেই আলোচনার বাইরে যায়নি। তবে এটি হওয়ার সম্ভাবনা যে অনেক কম, তা একবাক্যে সবাই মানবেন। আইনপ্রণেতারা আরও কিছুদিন এ নিয়ে তর্ক করবেন। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে এ নিয়ে পাশা খেলা চলবে, দেশটির ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) এ নিয়ে লবিং করবে, সাধারণ মানুষ নানা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের দাবিনামা তুলে ধরবে, আর নানামুখী এই খেলার মাঝখানে ঝরে যেতে থাকবে একের পর এক প্রাণ।
সর্বশেষ আইওয়ায় গির্জায় হওয়া হামলায় দুই নারী যখন নিহত হচ্ছেন, তার কিছুক্ষণ আগেই সামরিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের পক্ষ নিয়ে ভাষণ দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার আগের দিন হলো হাসপাতালে। কে কাকে মারল? যে সার্জনের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেন, তাঁকেই হত্যা করলেন বন্দুকধারী। তার আগে হলো স্কুলে হামলা। তার আগে? তার আগে? না, হিসাব করাটা ভীষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বন্দুক হামলা হচ্ছে। শপিংমল, স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা, শেষকৃত্যানুষ্ঠান—কোনো কিছুই আর বন্দুকের আওতার বাইরে নয়। মানুষ মরছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এর মধ্যে নিউইয়র্কের বাফেলো সুপার মার্কেট, টেক্সাসের স্কুল ও টুলসার হাসপাতালে হামলা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে নিহতের সংখ্যা বিচারে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনই কেউ না কেউ বন্দুকের কারণে মরছে। হয় নিজে মরছে, নয়তো অন্যকে মারছে, আবার কেউ অন্যকে মেরে নিজেও মরছে। এ যেন থামার নয়। প্রতিটি বড় হামলা অবধারিতভাবেই মার্কিন জনপরিসরে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োজনীয়তার আলোচনাটি উসকে দেয়। তারপর এ নিয়ে হাজারটা কথা ঘুরে বেড়ায়। নেতারা প্রতিশ্রুতি দেন, নেতারা প্রস্তাব দেন, বিরোধিতাও করেন, আর এসবের মধ্য দিয়ে আইনের বিষয়টি আবারও ধামাচাপা পড়ে।
হ্যাঁ, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিষয়টি নিয়ে নির্লিপ্ত নন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে।’ কিন্তু যথেষ্ট তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। এ নিয়ে আরেক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও সোচ্চার হতে দেখেছিল মানুষ। কিন্তু কিছুই করা যায়নি।
এই না করার মধ্যেই মানুষ মারা পড়ছে অচেনা-অজানা ঘাতকের হাতে। কত মৃত্যু হচ্ছে আসলে? চলতি বছরের হিসাবের দিকেই একটু তাকানো যাক। মার্কিন ওয়েবসাইট গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ (জিভিএ) জানাচ্ছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত বন্দুকের গুলিতে দেশটিতে মারা পড়েছে ১৮ হাজার ৩১৯ জন। এর মধ্যে হত্যার উদ্দেশ্যে বা অনিচ্ছায় ছোড়া গুলিতে মারা পড়েছে ৮ হাজার ১৫৫ জন। আর আত্মহত্যার ঘটনা আছে ১০ হাজার ১৬৪টি। এই নিহতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাটি চমকে দেওয়ার মতো। বন্দুক হামলায় ১১ বছরের কম বয়সী ১৫২টি শিশু নিহত হয়েছে। আর ১২ থেকে ১৭ বছরের কিশোর আছে ৫৪১ জন। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যাও অনেক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বন্দুক হামলায় আহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৩২৫। এখানে বলে রাখা ভালো, জিভিএর পরিসংখ্যানে শুধু গুলিতে তদনগদ নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যাই উঠে এসেছে। গুলিতে হওয়া ক্ষতের কারণে পরে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মনে রাখা দরকার, চলতি বছরের মাত্র পাঁচ মাস পার হয়েছে। বাকি আছে আরও সাত মাস। পাঁচ মাসেই ১৮ হাজারের বেশি মৃত্যু দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। পরের সাত মাসে কী হয় কে জানে! সাম্প্রতিক প্রবণতা ভীষণ শঙ্কা ছড়াচ্ছে। কারণ গেল কয়েক দিনের মধ্যে একের পর এক বন্দুক হামলা, এগুলোর স্থান ভীষণ শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এমনকি এবার ২০২০ সালের রেকর্ডও ছাড়িয়ে যেতে পারে। মার্কিন সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্যমতে, ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় নিহত বা গুলিতে হওয়া ক্ষতের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৪৫ হাজার ২২২ জন মারা গেছে। এগুলোর মধ্যে যেমন বন্দুক সহিংসতা আছে, তেমনি আছে হত্যা ও আত্মহত্যাও।
সিডিসি জানায়, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুধু বন্দুকের কারণে হওয়া মৃত্যুর মধ্যে আত্মহত্যাই বেশি। মোট মৃত্যুর ৫৪ শতাংশ বা ২৪ হাজার ২৯২টি হচ্ছে আত্মহত্যা। আর ৪৩ শতাংশ হয়েছে সরাসরি হত্যা। সংখ্যার হিসাবে খুন হয়েছে ১৯ হাজার ৩৮৪টি। এর বাইরে অনিচ্ছায় ছোড়া গুলিতে বা দুর্ঘটনাবশত মৃত্যু হয়েছে ৫৩৫ জনের। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৬১১ জন। মোট মৃত্যুর হিসাবে ২০২০ সালে বন্দুকের কারণে মৃত্যু আগের বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। আর পাঁচ বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
অনেকে হয়তো বলবেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা অনুপাতে বন্দুকের কারণে মৃত্যু হিসাব করলে এতটা চমকাতে হবে না। তাহলে আবার একটু সিডিসির কাছে যাওয়া যাক। তারা জানাচ্ছে, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বন্দুকের কারণে নিহতের হার ১৩ দশমিক ৬। চলতি শতকে এটাই সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৭৪ সালে এই হার ছিল ১৬ দশমিক ৩, যা এ-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ শুরুর পর সর্বোচ্চ।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম ১৪৫ দিনে ২১৪টি বন্দুক হামলা হয়েছে, যেখানে চারজন বা তার বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে একটির বেশি বন্দুক হামলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই হিসাবে কিন্তু সাম্প্রতিকতম হামলাটি অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, সেখানে চারজন নয়, হামলাকারীসহ তিনজন নিহত হয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন মার্কিন আইনপ্রণেতারা পাশা খেলছেন বসে। এক পক্ষ কঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাব করছে, তো অন্য পক্ষ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দোহাইয়ে তা আটকে দিচ্ছে। এবার এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে ‘প্রোটেকটিং আওয়ার কিডস অ্যাক্ট’। নিশ্চিতভাবেই ডেমোক্রেটিক দল টেক্সাসের স্কুলে হওয়া হামলায় ১৯ শিশুর মৃত্যুর বিষয়টিকে সামনে এনে এ আইন প্রণয়নের জন্য চাপ প্রয়োগের নীতি নিয়েছে। আর এনআরএর আশীর্বাদপুষ্ট রিপাবলিকান দল কী করছে?
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ‘শিশু সুরক্ষা আইন’-এর প্রস্তাব নিয়ে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে আলোচনা হয়। এ সময় ফ্লোরিডা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়া রিপাবলিকান প্রতিনিধি গ্রেগ স্টিউব একে একে নিজের ব্যক্তিগত চারটি বন্দুক টেবিলের ওপর রাখেন এবং বলেন, ‘নিজেকে, নিজের পরিবার এবং ঘরকে সুরক্ষার জন্য আমি প্রতিদিন এই বন্দুক বহন করি।’ তাঁর এ কথার মাঝখানে জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান জেরল্ড ন্যাডলার বলেন, ‘এগুলোর কোনোটাই যেন লোডেড না হয়।’ কিন্তু এর জবাবে স্টিউব বলেন, ‘নিজের ঘরে, নিজের বন্দুক নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি।’
স্টিউবের এই বক্তব্যই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে রিপাবলিকান দলের অবস্থানকে প্রকাশ করে। তারা নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে সামনে এনে বরাবরই অস্ত্র আইনের বিরোধিতা করছে। কঠোর অস্ত্র আইনের বদলে তারা বলছে, স্কুলের নিরাপত্তা বাড়ানো হোক। অর্থাৎ নিরাপত্তা সরঞ্জামের অজুহাতে এনআরএর মতো অংশীজনদের লাভের গুড় আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়া আরকি। এটি তাদের অনেক পুরোনো অবস্থান। এ অবস্থায় ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ‘শিশু সুরক্ষা আইন’ হয়তো পাস করে নিতে পারবে। আগামী সপ্তাহেই হয়তো এর ওপর ভোট হবে প্রতিনিধি পরিষদে। কিন্তু আইন হিসেবে পাস করাতে হলে সিনেট পার হতে হবে প্রস্তাবটিকে। সেখানে উভয় পক্ষ সমানে-সমান। কিন্তু আইন হিসেবে পাস হতে হলে সিনেটের ১০০ ভোটের মধ্যে ৬০ টিকে অন্তত পক্ষে পেতে হবে।
ফলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সিনেটের দেয়ালটি এবারও টপকাতে পারবে না আইনটি। আরেকটি বড় হামলার আগ পর্যন্ত এবিষয়ক আলোচনা হয়তো শীতনিদ্রায় চলে যাবে। এর মাঝে একটি-দুটি করে হামলা প্রতিদিন হতে থাকবে আর মানুষ মরতে থাকবে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই হামলাগুলোয় যে মারছে এবং যে মরছে, তাদের মধ্যে এমনকি নেই কোনো শত্রুতার বিষয়ও। যেমনটি হয়ে থাকে যুদ্ধের ময়দানে। সেখানে পরস্পরের মুখোমুখি বন্দুক তাক করে থাকা সৈনিকদের কারও সঙ্গেই কারও নেই ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান এই বাস্তবতাকে অঘোষিত যুদ্ধই বলা যায় প্রকরণের দিক থেকে। নিজেদের লোকেরাই মারা পড়ছে, মারা পড়ছে নিজেদের শিশুরাই। অথচ দেশটির আইনপ্রণেতারা অক্রিয় বসে আছেন। যদিও দূরদেশ ইউক্রেনে হওয়া যুদ্ধ এবং এর কারণে হওয়া মৃত্যু ও ক্ষয় নিয়ে তারা খুব সোচ্চার। তারা সেই যুদ্ধ থামাতে সম্ভাব্য সবকিছু করতে রাজি। এ নিয়ে বহুপক্ষীয় তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। অন্য অনেক দেশকে সঙ্গে নিয়ে এই তৎপরতা চালাতে হচ্ছে। অথচ নিজ দেশের এই ক্ষয় থামানো নিয়ে তারাই কেমন বিস্ময়করভাবে নির্বিকার।
আরও পড়ুন:
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১০ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে