অনলাইন ডেস্ক
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর (আইএনএসটিসি) নতুন করে চালুর বিষয়টি কেবল স্বপ্নই ছিল। এই করিডর প্রায় ৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও রেলপথের সমন্বয়ে গঠিত। এই রুট রাশিয়া থেকে ইরান হয়ে ভারতে পৌঁছেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্যের পর এই স্বপ্ন এখন বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মস্কো-তেহরান-দিল্লি শিগগির এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠে নামবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের বাজারে প্রবেশাধিকার হারানো রাশিয়ার জন্য এই যৌথ উদ্যোগ নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
চলতি বছরের জুনে ইরান এই আইএনএসটিসি ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে বন্দর আব্বাস ও হরমুজ প্রণালি হয়ে ভারতে পণ্য পরিবহনের ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণার পর চলতি জুলাই মাসের শুরুতে রাশিয়া থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ৩৯টি কনটেইনার নিয়ে বেশ কয়েকটি ভারতের উদ্দেশে রওনা করে, যা ভারতের জওহরলাল নেহরু বন্দর বা নাভা শেভা বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক পরামর্শক বৈশালি বসু শর্মা আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘এটি কেবল শুরু।’ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ বহুমুখী ট্রান্সপোর্ট অপারেটর আরজেডডি লজিস্টিকস আইএনএসটিসি রুটে কনটেইনারবাহী ট্রেন উদ্বোধন করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই রুট প্রতিবছর ২৫ মিলিয়ন টন পণ্য পরিবহন করতে পারবে, যা সমগ্র ইউরেশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবছর যে পরিমাণ কনটেইনার চলাচল করে, তার প্রায় ৭৫ শতাংশ।
ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ডেজান শিরা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস ডেভনশায়ার-এলিস বলছেন, ‘এমনকি ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘাত শেষ হওয়ার পরও যেহেতু রাশিয়ার ওপর ইইউর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে, তাই এই পূর্বমুখী নতুন রুট যথাযথভাবে ব্যবহারের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে মস্কো।’
আইএনএসটিসি রুট ব্যবহারের যুক্তি খুবই সহজ। ঐতিহাসিকভাবে ভারত থেকে রাশিয়া পর্যন্ত ভূকেন্দ্রিক (সড়ক-রেল) পণ্য পরিবহনব্যবস্থা উন্নত না থাকায় ভারত থেকে পণ্যবাহী যেকোনো জাহাজ প্রথমে আরব সাগর, তারপর লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে পূর্ব ইউরোপ হয়ে সর্বশেষ বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছায় রাশিয়ার পিটার্সবার্গে। ফেডারেশন অব ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন এক হিসাবে দেখিয়েছে, আইএনএসটিসি ব্যবহারের ফলে রাশিয়া থেকে পণ্য পরিবহনে সময় কম লাগবে অন্তত ৪০ থেকে ৬০ দিন। এতে ব্যয়ও কমবে প্রায় ৩০ শতাংশ।
ভারতের জন্যও এই রুট কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই রুট ভারতকে চিরবৈরী দেশ পাকিস্তানের ভূখণ্ড এড়িয়ে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ দেবে। ২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেহরান সফরের সময় ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়নের জন্য ৮৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং দেড় শ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নয়াদিল্লি চায়, চাবাহার বন্দরকে আইএনএসটিসি রুটে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
অগ্রাধিকারের পরিবর্তন
বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সম্ভাবনা থাকার পরও আইএনএসটিসি একটা সময় পর্যন্ত ভারত বা রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপই রাশিয়ার প্রধান বাজার ছিল সব সময় এবং এখনো রাশিয়ার মনোযোগ সেখানেই। কোভিডের সময় ২০২০ সালে রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ হয়েছে ইউরোপের সঙ্গেই।
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক গুলশান সাচদেবা আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘রাশিয়ার বেশির ভাগ সাপ্লাই চেইনই তৈরি করা হয়েছে ইউরোপের জন্য। ভারতও গত দুই দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্ব, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের ওপর মনোযোগ দিয়েছে। এ ছাড়া ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো আইএনএসটিসিতে দেশটির বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে আরও জটিল করে তুলেছে।’
তবে বর্তমানে সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। গত জুন মাসে লিথুয়ানিয়া বাল্টিক সাগর তীরবর্তী রাশিয়ার ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে সব ধরনের পণ্য পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কালিনিনগ্রাদে মালামাল পরিবহনের অনুমতি দেওয়ায় লিথুয়ানিয়া সিদ্ধান্ত বদলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। চলতি জুলাইয়ের শুরুতে রুশ সংবাদমাধ্যম মস্কো টাইমস জানিয়েছিল, কাজাখস্তান দেশটিতে এমন একটি আইনের প্রস্তাব করেছে, যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেগুলো সে দেশ হয়ে রাশিয়ায় ঢুকতে পারবে না।
এই বিষয়ে ক্রিস ডেভনশায়ার-এলিস বলেছেন, ‘এসব ঘটনার ফলে রাশিয়ার জন্য নতুন সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে অন্যান্য সাপ্লাই চ্যানেলেও তাদের জোর দিতে হবে।’
এদিকে বছরের পর বছর ভারত ও রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্য প্রায় স্থবির। এ দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য ৮ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। ফলে এ বিষয়টিও আইএনএসটিসি প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের ভাবাবে বলে মন্তব্য করেছেন গুলশান সাচদেবা। তিনি বলেছেন, ‘এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় তা হলো—এই যদি হয় দুই দেশের মধ্যকার বিনিয়োগের পরিমাণ, তাহলে কি এই বিশাল প্রকল্পে বিনিয়োগ করা বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ হবে?’
তবে গত কয়েক মাসের ঘটনাবলি নাটকীয়ভাবে করিডরে বিনিয়োগের পক্ষে যুক্তিকে শক্তিশালী করেছে। এ বছরের এপ্রিল ও মে মাসে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি প্রায় ২৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২১ সালের তুলনায়। মাত্র দুই মাসে দুই দেশের বাণিজ্য ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ দুই মাসে ভারত রাশিয়া থেকে সার আমদানি বাড়িয়েছে প্রায় ৮০০ শতাংশ। গুলশান সাচদেবা বলেন, ‘দুই দেশের বাণিজ্যে এই ব্যাপক উল্লম্ফন আইএনএসটিসির পক্ষে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই প্রমাণ হিসাবে কাজ করবে। নেতৃবৃন্দ অবশেষে আইএনএসটিসির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।’
মার্কিন চাপ
তবে এর পরও এই নতুন উদ্যোগে বাধার সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়া থেকে ক্রমবর্ধমান হারে তেল আমদানি করায় নয়াদিল্লি এরই মধ্যে ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চক্ষুশূল হয়েছে। ফলে আইএনএসটিসি নিয়ে সামনে বাড়লে ভারত যে আরও দ্বিগুণ হারে পশ্চিমা চাপের মুখে পড়বে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক পরামর্শক বৈশালি বসু শর্মা বলেছেন, ক্রমাগত পশ্চিমা চাপের মুখে ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এর আগেও, ভারত পশ্চিমের কথামতো ইরান-ভেনেজুয়েলার কাছ থেকে তেল কেনা থেকে বিরত ছিল। অথচ, এখন যুক্তরাষ্ট্রই ভেনেজুয়েলার তেল ইউরোপে পৌঁছানোর বিষয়ে কাজ করছে। আল-জাজিরাকে বৈশালি আরও বলেন, ‘ভারত ও রাশিয়ার মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এবং আইএনএসটিসি নিয়ে এ দুই দেশের উদ্যোগ এটিই নিশ্চিত করে যে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো অবশেষে উন্নত দেশগুলোর সৃষ্ট অর্থনৈতিক কাঠামোর আধিপত্য ভেঙে বের হতে শুরু করেছে।’
থিংকট্যাংক অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান সিকিউরিটি পলিসির পরিচালক ভেলিনা চাখারোভা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ওয়াশিংটন ভারতকে কতটা চাপ দিতে পারবে তারও নিশ্চয়ই একটি সীমা রয়েছে। কারণ, রুশ ভালুক এবং চীনা ড্রাগনকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে চাইলে ওয়াশিংটনের খুব করে ভারতকে প্রয়োজন হবে।’
তবে এসবের বাইরে আরও বিভিন্ন প্রতিকূলতা রয়েছে। বৈশালি বসু শর্মা বলছেন, রাশিয়া ও ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আইএনএসটিসিতে এই দুই দেশের বিনিয়োগ কঠিন করে তুলবে। এ ছাড়া এই প্রকল্প; অর্থাৎ, আইএনএসটিসি এখনো বেশ কয়েকটি দেশের রেল-সড়ক-সামুদ্র পথের নেটওয়ার্কের জোড়াতালি দেওয়া কাঠামো, যা এখনো পূর্ণাঙ্গ কাঠামো পায়নি। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, এখনো এই প্রকল্পের কোনো একক কর্তৃপক্ষ নেই।
তবে এই প্রকল্প যে কেবল রাশিয়া-ইরান-ভারতেরই চাওয়া, তা নয়। আশপাশের বেশ কয়েকটি দেশও এই প্রকল্প থেকে উপকৃত হবে। এ প্রসঙ্গে ডেভনশায়ার-এলিস বলেছেন, ‘আইএনএসটিসি যে কেবল রাশিয়া-ইরান-ভারতের স্বার্থ দেখবে, তা নয়। এই প্রকল্প আরও কয়েকটি দেশকে যুক্ত করবে। এই করিডর জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান ও তুরস্ককে যুক্ত করবে। এ বিষয়ে এই দেশগুলো একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে এ বছর, যার নাম দেওয়া হয়েছে “মিডল করিডর”। ফলে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষাও হাজির হয়েছে।’
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর (আইএনএসটিসি) নতুন করে চালুর বিষয়টি কেবল স্বপ্নই ছিল। এই করিডর প্রায় ৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও রেলপথের সমন্বয়ে গঠিত। এই রুট রাশিয়া থেকে ইরান হয়ে ভারতে পৌঁছেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্যের পর এই স্বপ্ন এখন বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মস্কো-তেহরান-দিল্লি শিগগির এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠে নামবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের বাজারে প্রবেশাধিকার হারানো রাশিয়ার জন্য এই যৌথ উদ্যোগ নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
চলতি বছরের জুনে ইরান এই আইএনএসটিসি ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে বন্দর আব্বাস ও হরমুজ প্রণালি হয়ে ভারতে পণ্য পরিবহনের ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণার পর চলতি জুলাই মাসের শুরুতে রাশিয়া থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ৩৯টি কনটেইনার নিয়ে বেশ কয়েকটি ভারতের উদ্দেশে রওনা করে, যা ভারতের জওহরলাল নেহরু বন্দর বা নাভা শেভা বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক পরামর্শক বৈশালি বসু শর্মা আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘এটি কেবল শুরু।’ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ বহুমুখী ট্রান্সপোর্ট অপারেটর আরজেডডি লজিস্টিকস আইএনএসটিসি রুটে কনটেইনারবাহী ট্রেন উদ্বোধন করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই রুট প্রতিবছর ২৫ মিলিয়ন টন পণ্য পরিবহন করতে পারবে, যা সমগ্র ইউরেশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবছর যে পরিমাণ কনটেইনার চলাচল করে, তার প্রায় ৭৫ শতাংশ।
ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ডেজান শিরা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস ডেভনশায়ার-এলিস বলছেন, ‘এমনকি ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘাত শেষ হওয়ার পরও যেহেতু রাশিয়ার ওপর ইইউর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে, তাই এই পূর্বমুখী নতুন রুট যথাযথভাবে ব্যবহারের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে মস্কো।’
আইএনএসটিসি রুট ব্যবহারের যুক্তি খুবই সহজ। ঐতিহাসিকভাবে ভারত থেকে রাশিয়া পর্যন্ত ভূকেন্দ্রিক (সড়ক-রেল) পণ্য পরিবহনব্যবস্থা উন্নত না থাকায় ভারত থেকে পণ্যবাহী যেকোনো জাহাজ প্রথমে আরব সাগর, তারপর লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে পূর্ব ইউরোপ হয়ে সর্বশেষ বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছায় রাশিয়ার পিটার্সবার্গে। ফেডারেশন অব ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন এক হিসাবে দেখিয়েছে, আইএনএসটিসি ব্যবহারের ফলে রাশিয়া থেকে পণ্য পরিবহনে সময় কম লাগবে অন্তত ৪০ থেকে ৬০ দিন। এতে ব্যয়ও কমবে প্রায় ৩০ শতাংশ।
ভারতের জন্যও এই রুট কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই রুট ভারতকে চিরবৈরী দেশ পাকিস্তানের ভূখণ্ড এড়িয়ে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ দেবে। ২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেহরান সফরের সময় ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়নের জন্য ৮৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং দেড় শ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নয়াদিল্লি চায়, চাবাহার বন্দরকে আইএনএসটিসি রুটে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
অগ্রাধিকারের পরিবর্তন
বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সম্ভাবনা থাকার পরও আইএনএসটিসি একটা সময় পর্যন্ত ভারত বা রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপই রাশিয়ার প্রধান বাজার ছিল সব সময় এবং এখনো রাশিয়ার মনোযোগ সেখানেই। কোভিডের সময় ২০২০ সালে রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ হয়েছে ইউরোপের সঙ্গেই।
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক গুলশান সাচদেবা আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘রাশিয়ার বেশির ভাগ সাপ্লাই চেইনই তৈরি করা হয়েছে ইউরোপের জন্য। ভারতও গত দুই দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্ব, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের ওপর মনোযোগ দিয়েছে। এ ছাড়া ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো আইএনএসটিসিতে দেশটির বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে আরও জটিল করে তুলেছে।’
তবে বর্তমানে সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। গত জুন মাসে লিথুয়ানিয়া বাল্টিক সাগর তীরবর্তী রাশিয়ার ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে সব ধরনের পণ্য পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কালিনিনগ্রাদে মালামাল পরিবহনের অনুমতি দেওয়ায় লিথুয়ানিয়া সিদ্ধান্ত বদলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। চলতি জুলাইয়ের শুরুতে রুশ সংবাদমাধ্যম মস্কো টাইমস জানিয়েছিল, কাজাখস্তান দেশটিতে এমন একটি আইনের প্রস্তাব করেছে, যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেগুলো সে দেশ হয়ে রাশিয়ায় ঢুকতে পারবে না।
এই বিষয়ে ক্রিস ডেভনশায়ার-এলিস বলেছেন, ‘এসব ঘটনার ফলে রাশিয়ার জন্য নতুন সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে অন্যান্য সাপ্লাই চ্যানেলেও তাদের জোর দিতে হবে।’
এদিকে বছরের পর বছর ভারত ও রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্য প্রায় স্থবির। এ দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য ৮ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। ফলে এ বিষয়টিও আইএনএসটিসি প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের ভাবাবে বলে মন্তব্য করেছেন গুলশান সাচদেবা। তিনি বলেছেন, ‘এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় তা হলো—এই যদি হয় দুই দেশের মধ্যকার বিনিয়োগের পরিমাণ, তাহলে কি এই বিশাল প্রকল্পে বিনিয়োগ করা বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ হবে?’
তবে গত কয়েক মাসের ঘটনাবলি নাটকীয়ভাবে করিডরে বিনিয়োগের পক্ষে যুক্তিকে শক্তিশালী করেছে। এ বছরের এপ্রিল ও মে মাসে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি প্রায় ২৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২১ সালের তুলনায়। মাত্র দুই মাসে দুই দেশের বাণিজ্য ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ দুই মাসে ভারত রাশিয়া থেকে সার আমদানি বাড়িয়েছে প্রায় ৮০০ শতাংশ। গুলশান সাচদেবা বলেন, ‘দুই দেশের বাণিজ্যে এই ব্যাপক উল্লম্ফন আইএনএসটিসির পক্ষে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই প্রমাণ হিসাবে কাজ করবে। নেতৃবৃন্দ অবশেষে আইএনএসটিসির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।’
মার্কিন চাপ
তবে এর পরও এই নতুন উদ্যোগে বাধার সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়া থেকে ক্রমবর্ধমান হারে তেল আমদানি করায় নয়াদিল্লি এরই মধ্যে ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চক্ষুশূল হয়েছে। ফলে আইএনএসটিসি নিয়ে সামনে বাড়লে ভারত যে আরও দ্বিগুণ হারে পশ্চিমা চাপের মুখে পড়বে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক পরামর্শক বৈশালি বসু শর্মা বলেছেন, ক্রমাগত পশ্চিমা চাপের মুখে ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এর আগেও, ভারত পশ্চিমের কথামতো ইরান-ভেনেজুয়েলার কাছ থেকে তেল কেনা থেকে বিরত ছিল। অথচ, এখন যুক্তরাষ্ট্রই ভেনেজুয়েলার তেল ইউরোপে পৌঁছানোর বিষয়ে কাজ করছে। আল-জাজিরাকে বৈশালি আরও বলেন, ‘ভারত ও রাশিয়ার মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এবং আইএনএসটিসি নিয়ে এ দুই দেশের উদ্যোগ এটিই নিশ্চিত করে যে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো অবশেষে উন্নত দেশগুলোর সৃষ্ট অর্থনৈতিক কাঠামোর আধিপত্য ভেঙে বের হতে শুরু করেছে।’
থিংকট্যাংক অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান সিকিউরিটি পলিসির পরিচালক ভেলিনা চাখারোভা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ওয়াশিংটন ভারতকে কতটা চাপ দিতে পারবে তারও নিশ্চয়ই একটি সীমা রয়েছে। কারণ, রুশ ভালুক এবং চীনা ড্রাগনকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে চাইলে ওয়াশিংটনের খুব করে ভারতকে প্রয়োজন হবে।’
তবে এসবের বাইরে আরও বিভিন্ন প্রতিকূলতা রয়েছে। বৈশালি বসু শর্মা বলছেন, রাশিয়া ও ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আইএনএসটিসিতে এই দুই দেশের বিনিয়োগ কঠিন করে তুলবে। এ ছাড়া এই প্রকল্প; অর্থাৎ, আইএনএসটিসি এখনো বেশ কয়েকটি দেশের রেল-সড়ক-সামুদ্র পথের নেটওয়ার্কের জোড়াতালি দেওয়া কাঠামো, যা এখনো পূর্ণাঙ্গ কাঠামো পায়নি। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, এখনো এই প্রকল্পের কোনো একক কর্তৃপক্ষ নেই।
তবে এই প্রকল্প যে কেবল রাশিয়া-ইরান-ভারতেরই চাওয়া, তা নয়। আশপাশের বেশ কয়েকটি দেশও এই প্রকল্প থেকে উপকৃত হবে। এ প্রসঙ্গে ডেভনশায়ার-এলিস বলেছেন, ‘আইএনএসটিসি যে কেবল রাশিয়া-ইরান-ভারতের স্বার্থ দেখবে, তা নয়। এই প্রকল্প আরও কয়েকটি দেশকে যুক্ত করবে। এই করিডর জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান ও তুরস্ককে যুক্ত করবে। এ বিষয়ে এই দেশগুলো একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে এ বছর, যার নাম দেওয়া হয়েছে “মিডল করিডর”। ফলে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষাও হাজির হয়েছে।’
গত সেপ্টেম্বরে ভ্লাদিভস্টকের একটি অর্থনৈতিক ফোরামে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। এ বিষয়ে পরে তিনি একটি উপহাসমূলক হাসি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
৫ ঘণ্টা আগেআব্রাহাম অ্যাকর্ডস মূলত একটি চটকদার বিষয়। এতে বাস্তব, স্থায়ী আঞ্চলিক শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছুই এতে ছিল না। যেসব রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেছে তারা তা করেছে—কারণ, তারা ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনে প্রভাব বিস্তারের পথ হিসেবে দেখে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসরায়েলের ওপর মার
৯ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেখেয়ালি, সেটা আগা থেকেই সবার জানা। তবে দেশটির নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে এসেও তিনি অসংলগ্ন, অশ্লীল, স্বৈরতান্ত্রিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এ থেকে অন্তত একটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে একটি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ সরকারের নেতৃত্ব দেবেন।
৯ দিন আগেএবারের আইএমইএক্স মহড়ায়ও কিছু দেশ আছে যারা আগেরবারও অংশগ্রহণ করেছিল। এসব দেশের নাম আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই মহড়ার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—ইরান ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেকে এমন দেশগুলোর কক্ষপথে নিয়ে যাচ্ছে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত
৯ দিন আগে