Ajker Patrika

শশী থারুরের নিবন্ধ /ভারতে মুসলমানেরা এক অনন্ত বিচারের মুখোমুখি

ভারতে পুরোনো মসজিদ ভেঙে সে স্থানে পুরোনো হিন্দু মন্দির পুনর্নির্মাণের প্রকল্প চলছে। কিন্তু এটি অতীতের অন্যায়ের কোনো প্রতিকার নয়, বরং নতুন অন্যায়ের জন্মদাতা। সুপ্রিম কোর্ট এতে হস্তক্ষেপ না করলে ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নতুন ঢেউ বয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা দেশটির জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ শশী থারুরের। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ছত্রচ্ছায়ায় এ ধরনের কার্যক্রমের ব্যবচ্ছেদ করে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮: ১০
মথুরার শাহি ঈদগাহ মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত
মথুরার শাহি ঈদগাহ মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মথুরায় শাহি ঈদগাহ মসজিদের নিচে প্রাচীন হিন্দু মন্দির ছিল, এমন দাবিতে সেখানে অনুসন্ধান চালানোর অনুমতি চেয়ে ১৫টি মামলা হয়। স্থানীয় আদালত সবগুলো মামলাকে একত্র করে কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেয়। পরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করা হলেও সর্বোচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের নির্দেশ বহাল রাখে।

আদালত এ সময় জোর দিয়ে বলে, এতে মামলার উভয় পক্ষই উপকৃত হবে। কারণ, এর ফলে একাধিক বিচারিক কার্যক্রমের জরুরত পড়বে না এবং দ্বিধাবিভক্ত রায়ের সম্ভাবনাও কমবে। মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, যখন সারা দেশেই ধর্মীয় বিরোধের সংখ্যা বাড়ছে, তখন আদালত এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে বিচারিক কার্যক্রমের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়টিকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছে।

ভারতের স্বাধীনতার পর প্রথম চার দশকে এই বিষয়টি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ১৯৮০–এর দশক থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যাকে কেন্দ্র করে ‘রাম জন্মভূমি’ পুনরুদ্ধারের আন্দোলন গতিশীল হলে ধর্মীয় সংঘাতের বিষয়টি উসকে উঠে। হিন্দুরা মনে করে, অযোধ্যা রামায়ণে বর্ণিত দেবতা রামের জন্মভূমি। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডবে ষোড়শ শতকে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়।

এরপর, ২০১৯ সালে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর হিন্দু পক্ষকে ‘পবিত্র স্থানটিতে’ মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয় আদালত। গত বছর সেখানে নির্মিত মন্দিরটি উদ্বোধনও হয়। বিপরীতে মুসলমানদের অন্যত্র পাঁচ একর জমি বরাদ্দ করা হয় নতুন মসজিদ নির্মাণের জন্য। অর্থাৎ, এই মামলায় যে পক্ষ অপরাধমূলকভাবে মসজিদ ধ্বংস করেছিল, রায় তাদের পক্ষেই গেছে। রায়ে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানানোর কথা বলা হয়, এমনকি তা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে হলেও! অথচ এই রায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলিমরা নীরবই থেকেছে, থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে।

অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমানের কাছে এসব বিতর্ক নির্দিষ্ট কোনো মসজিদকে কেন্দ্র করে নয়, বরং ভারতীয় সমাজে তাদের অবস্থান সম্পর্কিত। তারা মনে করে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ভারতের বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। তবে মুসলমানরা আশা করেছিলেন যে, রাম জন্মভূমি পুনরুদ্ধার হলে তাদের শান্তি নিশ্চিত হবে, বিরোধের অবসান ঘটবে। রামমন্দির ইস্যুটি উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিষাক্ত করে তুলেছে এবং এর মধ্য দিয়ে মুঘলরা যেসব বিখ্যাত ‘হিন্দু মন্দির ধ্বংস’ করেছে বলে দাবি করা হয়, সেগুলো পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টারও ইতি ঘটবে—এমনটাই আশা ছিল।

কিন্তু ভাগ্য মুসলমানদের সহায় হয়নি। হিন্দু ধর্মান্ধরা রাম জন্মভূমি নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তকে ভারতের জাতীয় ধারণার একটি ‘হিন্দুত্ববাদী পুনর্ব্যাখ্যার বিজয়’ হিসেবে দেখেছে। এই রায় তাদের মসজিদ ধ্বংসের ক্ষুধা মেটানোর পরিবর্তে বরং আরও উসকে দিয়েছে। ১৯৯১ সালে প্রণীত ‘প্লেসেস অব ওয়ারশিপ’ (বিশেষ আইন) আইনের উদ্দেশ্য ছিল অযোধ্যার মতো আরও বিরোধের উত্থান ঠেকানো। এই আইন স্বাধীনতা–উত্তর ভারতে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখের অবস্থান অনুযায়ী সব উপাসনালয়ের ধর্মীয় চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা বিধান করে। এই আইন কোনো উপাসনালয়ের যেকোনো ধরনের পরিবর্তন (রূপান্তর) নিষিদ্ধ করে এবং সংশ্লিষ্ট কোনো আইনি কার্যক্রম পরিচালনার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

আইনের স্পষ্ট বিধি থাকার পরও এর বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বারবার। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের আদালতের একটি আদেশকে বিবেচনা করা যায়। এই আদেশে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদের নির্মাণকাল ও অন্যান্য বিষয় জানার জন্য ভিডিও ধারণের (জরিপ) অনুমতি দেওয়া হয়। এর পরপরই একই ধরনের মামলার ঢেউ বয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী পক্ষের যুক্তি ছিল, মন্দির ও মসজিদের ধর্মীয় চরিত্র সম্পর্কিত মামলা শুনতে আদালতকে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে আইনটি ন্যায়বিচারের অধিকার সীমিত করেছে। এটি আইনের সাংবিধানিক ভিত্তি এবং ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।

উইলিয়াম এফ বাকলি লিখেছিলেন, ‘রক্ষণশীলেরা ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তাকে থামাতে চায়।’ কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদীরা ইতিহাসকে ‘পেছনে ফেরাতে চায়’। তারা এটি অতীতের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থেকে করে না, বরং বর্তমানকে নতুনভাবে রূপান্তরিত করতে ইতিহাসকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার ইচ্ছা থেকে করে। যেমন, সুপ্রিম কোর্টে যদি প্রমাণিত হয় যে, একটি মন্দির ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, তাহলে সেই মন্দির পুনর্নির্মাণের দাবি উঠবে এবং প্রতিটি পুনর্নির্মিত মন্দির ভারতের নতুন হিন্দুত্ববাদী সংস্করণ নির্মাণে একেকটি ইট হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

ভারতীয় সমাজে এরই মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থানের আদর্শ কার্যকরভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে এবং মুসলমানদের জাতীয় পরিসরে ‘প্রান্তিক’ হিসেবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অযোধ্যায় যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে রামমন্দির নির্মাণ উদ্‌যাপন করা হচ্ছিল তখন তা মূলত ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বিশাল পদক্ষেপ ছিল। এই উদ্‌যাপনে হিন্দু ধর্মের প্রতীকী গুরুত্ব তুলে ধরা হয় এবং এটি স্পষ্টতই হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এক বড় পদক্ষেপ। এই প্রেক্ষাপটে, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এখন আমাদের সামনে আরও দৃশ্যমান।

ভারতে অতীতেও ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু আজকের দিনে ঐতিহাসিক বিরোধের পুনরুত্থান এক বিপজ্জনক সংকেত। মথুরার মামলাগুলো একত্র করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সর্বোচ্চ আদালত নিম্ন আদালতগুলোকে এই ইস্যুতে নতুন মামলা গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে এবং মুলতবি থাকা মামলাগুলোর বিষয়ে আদেশ দিতে নিষেধ করেছে।

তবে সুপ্রিম কোর্টকে আরও এগিয়ে যেতে হবে এ ক্ষেত্রে। পুরোনো মসজিদগুলোর বদলে পুরোনো মন্দিরের নতুন সংস্করণ নির্মাণ পুরোনো অন্যায়ের ন্যায্যতা দেবে না, এটি কেবলই নতুন অন্যায়ের জন্ম দেবে। এর ফলে বুঁজে আসা ক্ষতগুলো রক্তাক্ত ও দগদগে হবে এবং হয়। বিচার বিভাগ দ্রুত এই বিরোধগুলোকে কঠোরভাবে দমন না করলে মুসলিমরা প্রতিরোধ শুরু করতে পারে। এর ফলে, সাম্প্রদায়িক হিংসার নতুন প্রবল স্রোত কেবলই ইতিহাসে নতুন করে আমাদের জিম্মি করে ফেলবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও কিছু ভুল ইতিহাসের পাঠ দেবে। যেগুলো তাদের নতুন করে শোধরাতে হবে।

হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাসকে তাদের লক্ষ্য হাসিলের গোলাবারুদ হিসেবে ব্যবহার করতে পেরে খুশি। কিন্তু তাদের এভাবে অতীতকে মুছে ফেলার নিরন্তর চেষ্টা ভারতের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে দিচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত