ফখরুল ইসলাম
দেয়ালেরও কান আছে বলে একটি কথা বেশ প্রচলিত। এই কথার মধ্যেই রয়েছে একটা শঙ্কার আবহ। ব্যক্তিগত বা গোপন আলাপ গোপন রাখতে পারা–না পারা নিয়ে সংশয়। এই কথা যেমন একটি আলাপচারিতার দৃশ্যকে সামনে আনে, ঠিক তেমনি সামনে আনে আড়িপাতার একটি দৃশ্যও। বাংলা সিনেমায় এমন দৃশ্য বহুবার দেখানো হয়েছে। যেখানে মোটাদাগে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে কানের মালিককে। কিন্তু একটু বৃহৎ পরিসরে দাঁড়িয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় কথিত ‘কানটি’ কার? তবে নিশ্চিত উত্তর আসবে—রাষ্ট্রের। আর এই কর্তৃপক্ষীয় কান নিয়েই এখন হুলস্থূল।
আড়িপাতায় ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের তৈরি ‘পেগাসাস’ নামের একটি স্পাইওয়্যার ব্যবহারের তথ্য নিয়ে সারা দুনিয়া এখন তোলপাড় হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রশাসন এই পেগাসাস ব্যবহার করে কান পেতেছে তার সমালোচক থেকে শুরু করে শত্রু–বন্ধু অনেকের ব্যক্তি জীবনে। ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি এ ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, এমনকি কোনো দেশের ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্যদের ওপরও আড়িপাতা হয়েছে। ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা ফাঁস হয়েছে, যাদের স্মার্টফোনে আড়িপাতা হয়েছে বা এমন নিশানায় ছিল।
কথা হলো কেউ কেন ও কখন আড়ি পাতে? কেন–এর উত্তরটি বরাবরই বেশ জাঁকালো শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রশাসন দিয়ে আসছে। কখন—প্রশ্নটির উত্তর নানা সময়ে বিশ্লেষকেরা দিয়েছেন, আরও একবার না হয় দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। প্রথমে প্রথম প্রশ্নের কাছে যাওয়া যাক। কেন—প্রশ্নের উত্তরে বরাবরই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছে। নজরদারি বা আড়িপাতা—নাম যেটাই হোক, এই দুই বিষয়কেই বরাবর সামনে এনেছে আধুনিক রাস্ট্রকাঠামো। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধারণার একটা আকার থাকলেও হালে যে ‘নিরাপত্তা’–এর অজুহাত তুলে ধরা হচ্ছে, তা বলা যায় নিরাকার। নজরদারি চালানোর প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে এই তিনটি বিষয়ই কম–বেশি তুলে ধরে কর্তৃপক্ষীয় কান।
নজরদারি নিয়ে এই সময়ে ব্যাপক হইচই হলেও এর অস্তিত্ব কিন্তু বহু আগে থেকেই আছে। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আধুনিককালের প্রায় সব রাষ্ট্রই নজরদারির পথ অবলম্বন করে। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে তাঁর দপ্তরের অন্দরমহল, এমনকি দপ্তরের আসবাবপত্রও নজরদারি নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে কর্তৃপক্ষের কাছে এ এক মহৌষধ। এই অস্ত্র হাতে থাকলে আর ‘তেড়ে মেরে ডান্ডা, করে দেব ঠান্ডা’ নীতির প্রয়োজন পড়ে না। রাষ্ট্রের সুন্দর চেহারায়ও তখন আর কালি লাগে না।
একদিকে মানবাধিকার, অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান আইন। এর সঙ্গে করপোরেট চাপ, রাজনীতির অঙ্কসহ প্রগতির স্লোগান। এ রকম হাজারো নৈমিত্তিক ‘সমস্যা’ দূরে সরিয়ে জর্জ অরওয়েলের দেওয়া ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’ ধারণা অনুসারে প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিজীবনে অবাধে রাষ্ট্রের নজরদারি চলে। নজরদারির দীর্ঘ ইতিহাসে রাষ্ট্র সবসময়ই প্রধান খেলোয়াড় ছিল বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও।
আগে কর্তৃপক্ষীয় কান হিসেবে চৌকস ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হতো। তারা রাষ্ট্রের ভেতরে–বাইরে কর্তৃপক্ষীয় কান হিসেবে কাজ করত। আদিকালে ঠিক কখন থেকে গুপ্তচর ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তা দিন তারিখ ধরে বলা মুশকিল। তবে এটি যে পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো পেশা, এতে সন্দেহ নেই কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর। সভ্যতার শুরুতে মানুষ যখন দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু করে, তখন থেকেই গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের শুরু। বিবদমান দলের সর্দারেরা একে অন্যের গোপন খবর সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করত। প্রাচীন ভারত থেকে শুরু করে গ্রিস, চীন, পারস্য, রোম, মিসর, সিরিয়াসহ আরব শাসন ব্যবস্থায় গুপ্তচরবৃত্তি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। প্রাকযুদ্ধ, যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ শেষে একে অন্যের গোপন তথ্য সংগ্রহে হরহামেশাই গুপ্তচর পাঠানোর প্রচলন ছিল।
রাষ্ট্রের পত্তনের পর এই গুপ্তচরবৃত্তির পরিসর আরও বাড়ে। কিন্তু এই গুপ্তচরবৃত্তি ছিল মুখ্যত বহিঃশত্রুর কাছ থেকে কোনো হুমকি রয়েছে কি না, তা জানার লক্ষ্যে। এই লক্ষ্যই বদলে গেল যখন শত্রুর পরিচয় বদলে গেল। অর্থাৎ, রাষ্ট্র যখন নিজ সীমার ভেতরেই পেল সম্ভাব্য শত্রুর খোঁজ, তখন নিজ নাগরিকের ওপর নজর রাখার, তার আলাপে কান পাতার প্রয়োজন হলো। আধুনিক এই কালে ‘রাজা’ বলে মনে করা রাষ্ট্রনায়কেরা প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থাকে এ কাজে নিয়োগ করল। গোয়েন্দা বাহিনীর মোড়কে বেশ ভালোভাবেই এ কাজ চলে আসছে অনেক দিন। গোয়েন্দা বাহিনী থাকার পক্ষে অনেক যুক্তিও হাজির রয়েছে। বিশেষত অভ্যন্তরীণ নানা অপরাধ সামাল দিতে এই বাহিনী কাজে লাগানো হয়। সে ক্ষেত্রে চিহ্নিত সন্দেহভাজন বিভিন্ন গোষ্ঠী বা ব্যক্তির ওপর নজর রাখার কাজ প্রথাসিদ্ধ।
কিন্তু বর্তমানে এই গোয়েন্দা ও গুপ্তচরবৃত্তির পরিসরটি অনেক বড় হয়েছে। এখন আর বিশেষভাবে সন্দেহভাজনের তালিকায় ওঠার প্রয়োজন পড়ছে না। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর নজরদারি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। প্রতিটি দেশে গোয়েন্দাদের নিয়ে নজরদারি সংস্থা আছে। তারা তথাকথিত ‘নিরাপত্তার’ নামে সর্বোচ্চ মহলের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। হ্যাঁ, স্বার্থটি রাষ্ট্রের বলা হলেও তা আসলে সর্বোচ্চ মহলেরই। এখনকার এই প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে প্রযুক্তিকে।
ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি যে নজরদারি সফটওয়্যারের কথা বলা হচ্ছে, তা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রসর। এর আগের স্পাইওয়্যার ঘরানার সফটওয়্যারগুলো কার্যকর হওয়ার জন্য ব্যবহারকারীর দিক থেকে অন্তত একটি ক্লিকের প্রয়োজন হতো। এখন আর তাও প্রয়োজন হচ্ছে না। অর্থাৎ, লক্ষ্যবস্তুটি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকলেও নজরদারি এড়াতে পারবে না। লক্ষ্যবস্তুর ব্যবহৃত ডিভাইসের যেকোনো নিরাপত্তা ত্রুটির ফাঁক গলে এই নজরদারি চালু হয়ে যাবে। ব্যক্তির ব্যক্তিগত বলে কিছুই আর থাকবে না। যখন যাকে খুশি, তার অন্দরেই উঁকি মারতে পারবে। প্রয়োজন শুধু গ্রাহকের দিক থেকে একটি সবুজ সংকেত।
এবার আসা যাক—কখন একটি রাষ্ট্রের এমন বিস্তৃত পরিসরের নজরদারির প্রয়োজন পড়ে, এই প্রশ্নের দিকে। আগেই একটা আঁচ অবশ্য দেওয়া হয়েছে যে, কোনো দেশের প্রশাসন যখন নিজ দেশের লোকেদের মধ্যেই শত্রুর সন্ধান পায়, তখন এই নজরদারির প্রয়োজনীয়তা পড়ে। অর্থাৎ, নিজ নাগরিকদের ওপর আস্থার সংকট যত বড় হয়, নজরদারির পরিসর তত বাড়ে। আর আস্থার সংকট তখনই বাড়ে, যখন ক্ষমতায় নিজের থাকাটাকে আর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায় না।
এখন পর্যন্ত যেসব দেশের কথা জানা গেছে, কাকতালীয় হলেও সত্য, সবগুলো দেশেই হয় রাজতন্ত্র, নয় তো কট্টরপন্থী সরকার রয়েছে। তালিকায় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, মেক্সিকো, ভারতের মতো দেশের নাম থাকাটা তাই খুব একটা অবাক করার মতো নয়। যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সব জায়গায় খবরদারি করতে না পারলে যাদের পেটের ভাত হজম হয় না, তাদের ক্ষমতা জনগণের ওপর নজরদারির মাধ্যমেই টিকে থাকে। এ ধরনের রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষীয় কান বেশ শক্তিশালী। কতটা তা ‘পেগাসাস’ কাণ্ডেই স্পষ্ট।
পেগাসাসের মাধ্যমে যাদের ওপর নজর রাখা হয়েছিল বা নজর রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, তাদের ৫০ হাজার নম্বর ফাঁস হয়েছে। এই ৫০ হাজার নম্বর কাদের? কেউ সাংবাদিক, কেউ অ্যাকটিভিস্ট, কেউ আইনজীবী, কেউ আবার একেবারে সরকারেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অর্থাৎ কোনো পেশাই আর বাদ যাচ্ছে না। একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাতেই শুধু এটা হতে পারে।
গোটা বিশ্বে গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু বলে একটা কথা বেশ আগে থেকেই চাউর হয়েছে। গণতন্ত্রের এই দুর্দিনের প্রসঙ্গটি বারবার সামনে এসেছে একের পর এক কর্তৃত্ববাদী শাসকের উত্থানের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন দেশ থেকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা রুদ্ধ করার বিষয়ে নানা খবর এসেছে; তাও অনেক বছর হলো। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বা অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের মাধ্যমে গোটা বিশ্ব জেনেছে, কী করে এবং কতটা নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্র এই নজরদারির কাজটি করছে। তারপর অ্যাসাঞ্জ ও স্নোডেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বাহিনীগুলোকে তৎপর হতে আমরা দেখলাম। সময় গড়াল। কিন্তু কিছু বদলাল না। বরং আরও বড় ভার হয়ে তা ফিরে এল। পেগাসাস কাণ্ড জানিয়ে দিল, রাষ্ট্র আদতেই কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করে না। বাক্স্বাধীনতা বা নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতি ইত্যাদি তার মুখের বুলি শুধু।
আরও পড়ুন
দেয়ালেরও কান আছে বলে একটি কথা বেশ প্রচলিত। এই কথার মধ্যেই রয়েছে একটা শঙ্কার আবহ। ব্যক্তিগত বা গোপন আলাপ গোপন রাখতে পারা–না পারা নিয়ে সংশয়। এই কথা যেমন একটি আলাপচারিতার দৃশ্যকে সামনে আনে, ঠিক তেমনি সামনে আনে আড়িপাতার একটি দৃশ্যও। বাংলা সিনেমায় এমন দৃশ্য বহুবার দেখানো হয়েছে। যেখানে মোটাদাগে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে কানের মালিককে। কিন্তু একটু বৃহৎ পরিসরে দাঁড়িয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় কথিত ‘কানটি’ কার? তবে নিশ্চিত উত্তর আসবে—রাষ্ট্রের। আর এই কর্তৃপক্ষীয় কান নিয়েই এখন হুলস্থূল।
আড়িপাতায় ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের তৈরি ‘পেগাসাস’ নামের একটি স্পাইওয়্যার ব্যবহারের তথ্য নিয়ে সারা দুনিয়া এখন তোলপাড় হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রশাসন এই পেগাসাস ব্যবহার করে কান পেতেছে তার সমালোচক থেকে শুরু করে শত্রু–বন্ধু অনেকের ব্যক্তি জীবনে। ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি এ ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, এমনকি কোনো দেশের ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্যদের ওপরও আড়িপাতা হয়েছে। ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা ফাঁস হয়েছে, যাদের স্মার্টফোনে আড়িপাতা হয়েছে বা এমন নিশানায় ছিল।
কথা হলো কেউ কেন ও কখন আড়ি পাতে? কেন–এর উত্তরটি বরাবরই বেশ জাঁকালো শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রশাসন দিয়ে আসছে। কখন—প্রশ্নটির উত্তর নানা সময়ে বিশ্লেষকেরা দিয়েছেন, আরও একবার না হয় দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। প্রথমে প্রথম প্রশ্নের কাছে যাওয়া যাক। কেন—প্রশ্নের উত্তরে বরাবরই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছে। নজরদারি বা আড়িপাতা—নাম যেটাই হোক, এই দুই বিষয়কেই বরাবর সামনে এনেছে আধুনিক রাস্ট্রকাঠামো। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধারণার একটা আকার থাকলেও হালে যে ‘নিরাপত্তা’–এর অজুহাত তুলে ধরা হচ্ছে, তা বলা যায় নিরাকার। নজরদারি চালানোর প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে এই তিনটি বিষয়ই কম–বেশি তুলে ধরে কর্তৃপক্ষীয় কান।
নজরদারি নিয়ে এই সময়ে ব্যাপক হইচই হলেও এর অস্তিত্ব কিন্তু বহু আগে থেকেই আছে। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আধুনিককালের প্রায় সব রাষ্ট্রই নজরদারির পথ অবলম্বন করে। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে তাঁর দপ্তরের অন্দরমহল, এমনকি দপ্তরের আসবাবপত্রও নজরদারি নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে কর্তৃপক্ষের কাছে এ এক মহৌষধ। এই অস্ত্র হাতে থাকলে আর ‘তেড়ে মেরে ডান্ডা, করে দেব ঠান্ডা’ নীতির প্রয়োজন পড়ে না। রাষ্ট্রের সুন্দর চেহারায়ও তখন আর কালি লাগে না।
একদিকে মানবাধিকার, অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান আইন। এর সঙ্গে করপোরেট চাপ, রাজনীতির অঙ্কসহ প্রগতির স্লোগান। এ রকম হাজারো নৈমিত্তিক ‘সমস্যা’ দূরে সরিয়ে জর্জ অরওয়েলের দেওয়া ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’ ধারণা অনুসারে প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিজীবনে অবাধে রাষ্ট্রের নজরদারি চলে। নজরদারির দীর্ঘ ইতিহাসে রাষ্ট্র সবসময়ই প্রধান খেলোয়াড় ছিল বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও।
আগে কর্তৃপক্ষীয় কান হিসেবে চৌকস ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হতো। তারা রাষ্ট্রের ভেতরে–বাইরে কর্তৃপক্ষীয় কান হিসেবে কাজ করত। আদিকালে ঠিক কখন থেকে গুপ্তচর ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তা দিন তারিখ ধরে বলা মুশকিল। তবে এটি যে পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো পেশা, এতে সন্দেহ নেই কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর। সভ্যতার শুরুতে মানুষ যখন দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু করে, তখন থেকেই গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের শুরু। বিবদমান দলের সর্দারেরা একে অন্যের গোপন খবর সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করত। প্রাচীন ভারত থেকে শুরু করে গ্রিস, চীন, পারস্য, রোম, মিসর, সিরিয়াসহ আরব শাসন ব্যবস্থায় গুপ্তচরবৃত্তি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। প্রাকযুদ্ধ, যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ শেষে একে অন্যের গোপন তথ্য সংগ্রহে হরহামেশাই গুপ্তচর পাঠানোর প্রচলন ছিল।
রাষ্ট্রের পত্তনের পর এই গুপ্তচরবৃত্তির পরিসর আরও বাড়ে। কিন্তু এই গুপ্তচরবৃত্তি ছিল মুখ্যত বহিঃশত্রুর কাছ থেকে কোনো হুমকি রয়েছে কি না, তা জানার লক্ষ্যে। এই লক্ষ্যই বদলে গেল যখন শত্রুর পরিচয় বদলে গেল। অর্থাৎ, রাষ্ট্র যখন নিজ সীমার ভেতরেই পেল সম্ভাব্য শত্রুর খোঁজ, তখন নিজ নাগরিকের ওপর নজর রাখার, তার আলাপে কান পাতার প্রয়োজন হলো। আধুনিক এই কালে ‘রাজা’ বলে মনে করা রাষ্ট্রনায়কেরা প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থাকে এ কাজে নিয়োগ করল। গোয়েন্দা বাহিনীর মোড়কে বেশ ভালোভাবেই এ কাজ চলে আসছে অনেক দিন। গোয়েন্দা বাহিনী থাকার পক্ষে অনেক যুক্তিও হাজির রয়েছে। বিশেষত অভ্যন্তরীণ নানা অপরাধ সামাল দিতে এই বাহিনী কাজে লাগানো হয়। সে ক্ষেত্রে চিহ্নিত সন্দেহভাজন বিভিন্ন গোষ্ঠী বা ব্যক্তির ওপর নজর রাখার কাজ প্রথাসিদ্ধ।
কিন্তু বর্তমানে এই গোয়েন্দা ও গুপ্তচরবৃত্তির পরিসরটি অনেক বড় হয়েছে। এখন আর বিশেষভাবে সন্দেহভাজনের তালিকায় ওঠার প্রয়োজন পড়ছে না। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর নজরদারি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। প্রতিটি দেশে গোয়েন্দাদের নিয়ে নজরদারি সংস্থা আছে। তারা তথাকথিত ‘নিরাপত্তার’ নামে সর্বোচ্চ মহলের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। হ্যাঁ, স্বার্থটি রাষ্ট্রের বলা হলেও তা আসলে সর্বোচ্চ মহলেরই। এখনকার এই প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে প্রযুক্তিকে।
ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি যে নজরদারি সফটওয়্যারের কথা বলা হচ্ছে, তা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রসর। এর আগের স্পাইওয়্যার ঘরানার সফটওয়্যারগুলো কার্যকর হওয়ার জন্য ব্যবহারকারীর দিক থেকে অন্তত একটি ক্লিকের প্রয়োজন হতো। এখন আর তাও প্রয়োজন হচ্ছে না। অর্থাৎ, লক্ষ্যবস্তুটি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকলেও নজরদারি এড়াতে পারবে না। লক্ষ্যবস্তুর ব্যবহৃত ডিভাইসের যেকোনো নিরাপত্তা ত্রুটির ফাঁক গলে এই নজরদারি চালু হয়ে যাবে। ব্যক্তির ব্যক্তিগত বলে কিছুই আর থাকবে না। যখন যাকে খুশি, তার অন্দরেই উঁকি মারতে পারবে। প্রয়োজন শুধু গ্রাহকের দিক থেকে একটি সবুজ সংকেত।
এবার আসা যাক—কখন একটি রাষ্ট্রের এমন বিস্তৃত পরিসরের নজরদারির প্রয়োজন পড়ে, এই প্রশ্নের দিকে। আগেই একটা আঁচ অবশ্য দেওয়া হয়েছে যে, কোনো দেশের প্রশাসন যখন নিজ দেশের লোকেদের মধ্যেই শত্রুর সন্ধান পায়, তখন এই নজরদারির প্রয়োজনীয়তা পড়ে। অর্থাৎ, নিজ নাগরিকদের ওপর আস্থার সংকট যত বড় হয়, নজরদারির পরিসর তত বাড়ে। আর আস্থার সংকট তখনই বাড়ে, যখন ক্ষমতায় নিজের থাকাটাকে আর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায় না।
এখন পর্যন্ত যেসব দেশের কথা জানা গেছে, কাকতালীয় হলেও সত্য, সবগুলো দেশেই হয় রাজতন্ত্র, নয় তো কট্টরপন্থী সরকার রয়েছে। তালিকায় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, মেক্সিকো, ভারতের মতো দেশের নাম থাকাটা তাই খুব একটা অবাক করার মতো নয়। যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সব জায়গায় খবরদারি করতে না পারলে যাদের পেটের ভাত হজম হয় না, তাদের ক্ষমতা জনগণের ওপর নজরদারির মাধ্যমেই টিকে থাকে। এ ধরনের রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষীয় কান বেশ শক্তিশালী। কতটা তা ‘পেগাসাস’ কাণ্ডেই স্পষ্ট।
পেগাসাসের মাধ্যমে যাদের ওপর নজর রাখা হয়েছিল বা নজর রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, তাদের ৫০ হাজার নম্বর ফাঁস হয়েছে। এই ৫০ হাজার নম্বর কাদের? কেউ সাংবাদিক, কেউ অ্যাকটিভিস্ট, কেউ আইনজীবী, কেউ আবার একেবারে সরকারেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অর্থাৎ কোনো পেশাই আর বাদ যাচ্ছে না। একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাতেই শুধু এটা হতে পারে।
গোটা বিশ্বে গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু বলে একটা কথা বেশ আগে থেকেই চাউর হয়েছে। গণতন্ত্রের এই দুর্দিনের প্রসঙ্গটি বারবার সামনে এসেছে একের পর এক কর্তৃত্ববাদী শাসকের উত্থানের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন দেশ থেকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা রুদ্ধ করার বিষয়ে নানা খবর এসেছে; তাও অনেক বছর হলো। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বা অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের মাধ্যমে গোটা বিশ্ব জেনেছে, কী করে এবং কতটা নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্র এই নজরদারির কাজটি করছে। তারপর অ্যাসাঞ্জ ও স্নোডেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বাহিনীগুলোকে তৎপর হতে আমরা দেখলাম। সময় গড়াল। কিন্তু কিছু বদলাল না। বরং আরও বড় ভার হয়ে তা ফিরে এল। পেগাসাস কাণ্ড জানিয়ে দিল, রাষ্ট্র আদতেই কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করে না। বাক্স্বাধীনতা বা নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতি ইত্যাদি তার মুখের বুলি শুধু।
আরও পড়ুন
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
২ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৬ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৮ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৯ দিন আগে