সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
উত্তরের পথে আমাদের অভিযান
‘জলদি ওঠো। দেরি করা যাবে না। কেউ যেন বলতে না পারে আমাদের জন্য দেরি হয়েছে।’ অ্যালার্ম বাজতেই ভুবন ওর চিরচেনা সংলাপ দিচ্ছিল! ‘চিরচেনা’ বললাম এ কারণে, সে কারও সঙ্গে কোথাও যাওয়ার আগে ঠিক এই কথাগুলোই বলে। ওর কথা হচ্ছে, প্রয়োজন হলে সময়ের আগে প্রস্তুত থাকতে হবে বা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু দেরি হওয়া যাবে না। মাঝে মাঝে তাই ওকে ‘আর্মি পারসন’ বলি! যাই হোক, সেখানকার সময় ৬টায় উঠে গেলাম। আধা ঘণ্টার মধ্যে দুজনে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরিয়েছি। হঠাৎ বারান্দার একপাশ দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখি কী সুন্দর দৃশ্য! রাতে পাহাড়ের গায়ে যে তারা দেখেছিলাম জ্বলজ্বল করছে, সেগুলো দিনের আলোয় স্পষ্ট ঘরবাড়ি। ছবিতে দেখলে হয়তো মনে হবে বস্তি। সামনে থেকে না দেখলে এর সৌন্দর্য অনুভব করা যাবে না। ঝটপট সেই দৃশ্যের ছবি তুলে নিল ভুবন।
হোটেল থেকে বের হলাম নাশতা খাব বলে। রাতে তো নিয়নের আলোয় খুব একটা বুঝিনি, সকালে বের হয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মল রোডটা যে কত পরিষ্কার, স্বচ্ছ! রাস্তার ওপরেই যেন নির্দ্বিধায় গড়াগড়ি করা যাবে। রাস্তার একপাশ ‘ওয়ান ওয়ে’, অন্য পাশ দিয়ে কোনো যানবাহন প্রবেশ করানো যায় না। এপাশ দিয়ে সবাই আরাম করে হাঁটাহাঁটি করে। আর একধারে কিছু দূর পর পর বেঞ্চি আছে। হাঁটতে হাঁটতে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। ওই পথ ধরে হেঁটে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। খেলাম সবজি আর লুচি। সবজি বলতে গাঢ় ঝোলের মধ্যে আলু! আলুর দম বলা চলে। কিন্তু তারা এটাকে সবজিই নাম দিয়েছে। ভুবন অবশ্য লুচি না খেয়ে রুটি খেয়েছিল। মিষ্টির চেহারাগুলো দেখে এত লোভ লাগছিল! কিন্তু যেই খেতে গিয়েছি, আর ভালো লাগল না। নাশতা পর্ব শেষ করে আবার ছুটলাম হোটেলের দিকে। হাঁটার মাঝে থেমে থেমে কিছু ছবিও তুলে নিলাম। মোড়ে একটা বিশাল লাল পান্ডার ভাস্কর্য আছে। সেটার সঙ্গে ছবি তুলতে ভুললাম না। সময় পেলে সত্যিকারের লাল পান্ডা দেখতে যেতাম গ্যাংটকের চিড়িয়াখানায়, কিন্তু সময় হয়নি।
আমরা ঠিক ৭টার সময় হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবাই প্রস্তুত। কিন্তু গাড়ি আসেনি। ৮টার পর গাড়ি পেয়ে রওনা হলাম বজরা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের উদ্দেশে। মোটামুটি পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। সেখানে হলো মহাবিলম্ব! কতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে, পায়চারি করে সময় পার করেছি, আল্লাহ জানেন। কথা ছিল আগের দিন রাতেই অমরদা সব গাড়ি ঠিক করে রাখবেন, কিন্তু পারেননি।
প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমরা গাড়ি পেলাম। একটা বড় জিপ পেয়ে আমরা নয়জন চড়ে বসলাম সেটাতে। আমাদের দুজনকে সবাই জিজ্ঞেস করছিল কোথায় বসতে চাই। আমি বললাম, ‘আপনাদের সুবিধামতো আমাদের একটু জায়গা দিলেই হবে।’ আকাশ ভাই দুষ্টুমি করে বললেন, ‘তাহলে ছাদে বসে যান। আমরা আরাম করে যাই।’ আমি বললাম, ‘কোনো সমস্যা নাই। সেটা তো ভীষণ মজার ব্যাপার হবে!’ সবাই হো হো করে হেসে দিয়ে দুজনকে চালকের সঙ্গে সামনের সিটে বসতে দিলেন। সামনে দুইটা সিটই বলা চলে। চালকেরটা ছাড়া। আরামসে আমি আর ভুবন এঁটে যাই। সবাই গাড়িতে উঠে অপেক্ষা করছি। বাকিদের বসা হলে একসঙ্গে রওনা দেব। বড় দলটা আরও দুইটা জিপে ভাগ হয়ে উঠল। তবে ঝামেলা লেগেছিল ওই দলের দুজন ‘জেঠুমশাই’কে নিয়ে। তাঁরা দুজনে একই জায়গায় বসতে চান। অর্থাৎ, একই সিটে। এ নিয়ে তুমুল লঙ্কাকাণ্ড! গাল ফুলিয়ে, চোখ রাঙিয়ে যাঁর যাঁর পরিচয় দিচ্ছিলেন। মাঝখান দিয়ে বেচারা অমরদা হলেন তুলাধুনা। আমরা জিপের ভেতরে বসে থেকে দর্শকের মতো ওই নাটক-সিনেমা দেখছিলাম। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘আরে ওনারা এত বড় মানুষ হয়ে বাচ্চাদের মতো করছেন, অথচ আমাদের মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এজাজের গাড়ির ছাদে বা পেছনে ঝুলে যেতেও আপত্তি নাই।’ সত্যিই যদি এমন পরিস্থিতি হতো, তাহলেও আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। গাড়ির ছাদে বা পেছনে ঝুলে ঝুলেই যেতাম। যাই হোক, সিনেমাটা আধা ঘণ্টার মতো চলল। অবশেষে অমরদা গালি হজম করে হাসিমুখে সবাইকে নিয়ে রওনা দিলেন। প্রায় ১২টা বেজে গিয়েছিল তখন।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছি, বুঝতে পারছিলাম। আর সে কী যে পাগল করা অপরূপ সৌন্দর্য! এই পথে যেতে যেতে ‘মাশাআল্লাহ’, ‘সুবহানআল্লাহ’, ‘ওয়াও’, ‘অ্যামেজিং’ শব্দগুলো আপনা-আপনি মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়। সবাই মিলে এক এক করে গান ধরলাম। আকাশ ভাইয়ের গলা ভালো। তিনি অনেক গান গাইলেন। পুরোটা পথ এই গানের আসর সঙ্গী ছিল। ভুবনের গান শুনে তো সবাই মুগ্ধ। আকাশ ভাই আমাকে বলছিলেন, ‘বাহ, আপনার স্বামীর গানের গলা তো বেশ!’ মুচকি হেসে বললাম, ‘এমনি এমনি কি আর প্রেমে পড়েছি!’ এ কথা শুনে সবাই হেসে দিলেন। এরপর এল আমাদের প্রেমকাহিনির গল্পের অনুরোধ। গানের ফাঁকে ফাঁকে সেটাও হয়ে গেল। আমার গানের গলা ভালো না। ছেড়ে গাইতে পারি না। অনেকটা নাকি সুরে গাই। তবু সবার জোর অনুরোধে গাইতে হলো। একটার বেশি গাইলাম না। কারণ আমি ওই একটা গানই একটু ছেড়ে দিয়ে গাইতে পারি, ‘তোমার ঘরে বাস করে কারা...’।
আমাদের সামনে বসার খুব ভালো একটা সুফল পাওয়া গেছে। যতটা স্পষ্ট আমরা দুজন দেখতে পাচ্ছিলাম বাইরের দৃশ্য, পেছনের লোকজন হয়তো সেটার অর্ধেক দেখেছে। তবু যা দেখেছে, তাতে চোখ ছানাবড়া না হয়ে পারেই না। পথে থেমে থেমে পাহাড়ি ঝরনা দেখাচ্ছিলেন আমাদের চালক। তাঁর নাম রবিন। নামটা শুনে তাঁকে রবিন হুড ডাকতে ইচ্ছা হলো। রবিন হুড থেকে মনে পড়ল সালমান খানের ‘চুলবুল পান্ডে ওরফে রবিন হুড পান্ডে’ চরিত্রের কথা। আমি তাই তাঁকে ‘পান্ডেজি’ বলে ডাকা শুরু করলাম। পান্ডেজি নরম মানুষ। আস্তে-ধীরে কথা বলেন। নেপালি। মানে, সিকিমের বাসিন্দা আরকি। তিনি সবগুলো ঝরনার নাম ও বর্ণনা দিলেন। সব ঝরনার নামের সাইনবোর্ড নেই আবার। সেখানে নাম লেখা থাকে সাধারণত। আবার কোনো কোনো ঝরনার নাম নেই। সেগুলো ছোটখাটো। অনেক ঝরনার নাম পান্ডেজি নিজেও জানেন না। কারণ সেগুলো নতুন। সেভেন সিস্টার্স, নাগা, ভিম নালাসহ আরও ছোট-বড় কিছু ঝরনা দেখলাম। ভিম নালা ঝরনাটার আরেকটা নাম আছে। ‘অমিতাভ বচ্চন ফলস’। এমন নাম কেন, জিজ্ঞেস করতেই পান্ডেজি বললেন, ‘উ বহুত লম্বা হ্যায়। উ অ্যাক্টর হ্যায় না, অমিতাভ বচ্চন, উসকি তারাহ।’ লম্বায় এটা ২৭৫ ফুট। এর আরেক নাম ভিমা ফলস। স্থানীয় ভাষায় ভিমা বা ভিম নালা মানে ‘রেড স্নেক’ বা লাল সাপ। তাই এর আরেক নাম ‘রেড স্নেক’। বিগত কয়েক বছর ধরে পর্যটকেরা এই ঝরনাকে আবার ‘লাচুং নর্থ সিকিম ফলস’ নামেও ডাকছে। ঝরনার পাশাপাশি মেঘের কথা না বললেই নয়। পাহাড়ের চূড়ায় তুলার মতো লেগে থাকা মেঘ দেখা যায় দূর থেকে। আর পাহাড়ের নিচে স্বচ্ছ সবুজ তিস্তার পানি বয়ে চলে। ওপরের দিকে উঠতে উঠতে মেঘের ভেতর দিয়ে গিয়েছি আমরা। গাড়ি থেকে নেমেও ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আসলে মেঘ নিজেই তো আমাদের জাপটে ধরে।
দুপুর থেকে পেটে উৎপাত শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পথে টং দোকানের চা-বিস্কুট ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। শেষে বিকালের দিকে এক মুসলিম হোটেল পেলাম। পাহাড়ি রাস্তার একপাশে বেড়ার হোটেল। নিচের দিকে নেমে গেলে গ্রাম। সেখানে বেশির ভাগ মুসলমানরাই বাস করে। অনেকটা লুকিয়ে তারা গোমাংস রান্না করে খাওয়ায়। অমরদা আগে থেকে বলে রেখেছিলেন। তাই আমরা গরুর মাংস দিয়ে গরম ভাত-ডাল খেতে পারলাম। মনে হচ্ছিল অমৃত। রান্নাটাও বেশ। জম্পেশ খাওয়া দিয়ে আবার রওনা দিলাম। লাচুংয়ে পৌঁছাতে হবে। ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আলবৎ মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছিল। এরপর বাকিটা ইতিহাস। তবে পরদিন থেকে।
সন্ধ্যা নেমে এলে গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া গতি ছিল না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, যাচ্ছি আবার মেঘের ভেতর দিয়ে। পথ একেবারে পিচ্ছিল। ভয় পাচ্ছিলাম না একটুও। কেননা, পান্ডেজি যেভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে ভরসা না করে পারা যায় না। তিনি মুখে তো অভয় দিচ্ছিলেনই, কাজ দিয়েও প্রমাণ করেছেন। সিকিমের এই পাহাড়ি পথ এমনভাবে তৈরি করা যে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা খুব কম। জায়গায় জায়গায় সতর্কবার্তা লেখা আছে। আর চালকদের এতটাই মুখস্থ রাস্তা যে তারা চোখ বুজে পাড়ি দিতে পারেন।
লাচুংয়ে ঢোকার আগেও অনুমতি লাগল। সেখানে এক বিজ্ঞপ্তিতে লেখা দেখলাম উত্তরের কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে আর কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে না। অবশ্যই লাচুংয়ে টিক চিহ্ন দেওয়া ছিল। সেটা দেখে মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম। যাক বাবা, আটকে দিল না তাহলে। অনুমতি নিয়ে চলতে শুরু করলাম আবার। সাড়ে ৭টার পরপর পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। আর্মি চেকপোস্টের কাছাকাছি ‘লাচুং রিজেন্সি’তে গিয়ে উঠলাম। এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আগে থেকে করে রেখেছিলেন অমরদা। এই হোটেলে লোক মাত্র দুজন। যিনি ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন, তিনি নিজেই রান্না করেন। তাঁর সঙ্গে একজন আছেন, যিনি অতিথিদের ফরমাশ খাটেন। তাঁকে সাহায্যও করেন। আমরা যার যার রুম বেছে নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিলাম। ভাগ্যিস এখানে খাওয়া না পাওয়া যাওয়ার ভয় ছিল না।
ধীরে-সুস্থেই খাবারঘরে গেলাম। বুফে সিস্টেম করে রেখেছিলেন আমাদের রাঁধুনি। ভাত, ডাল, সবজি, রুটি, মটর পনির, সালাদ। এখানে আমিষজাতীয় কোনো রান্না হয় না। বেশ ভালোই লাগল খেতে। ভাত ছাড়া সব খেলাম অল্প করে। বড় দলটাকে আমার ভালো লাগছিল না। তারা সবকিছুতে একটা লোকদেখানো ভাব করছিল। সে যাক গে, খেয়েদেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকে গল্প করছিলাম। এর মধ্যে হেঁশেল থেকে খবর এল, কেউ গরুর দুধ খেতে চায় কি না। তবে কিনে খেতে হবে। ভুবন খুব আগ্রহ নিয়ে দুধ আনতে গেল রান্নাঘরে। ফিরে এল একটা দুঃখ ভাব নিয়ে। ব্যাপার কী? এক গ্লাস দুধের দাম ৫০ রুপি! যদিও সে কিনে এনেছে এবং খুব কষ্ট করে গিলেছে। মনে হচ্ছিল টাকা গিলছে! সবার এক কথা, আমাদের দেশে ৭০ টাকায় লিটার আর এখানে মাত্র এক গ্লাস ৫০ রুপি! একটু বেশি হয়ে যায় না? এক গ্লাসের দাম পড়ছে তাহলে পঁয়ষট্টি টাকার মতো। গল্প-গুজব শেষ করে রুমে গেলাম ঘুমাতে। এমন সময় বাইরে হন্তদন্ত শুনলাম। পরদিন কে কোথায় যাবে সেটা নিয়ে বিস্তর ক্যাচাল লেগে গেল অমরদার সঙ্গে। কে আর লাগাবে। সেই বড় দলের পণ্ডিতেরা। অমরদার ভাষ্যমতে, জিরো পয়েন্টে গিয়ে কোনো লাভ নেই।
সময় নষ্ট না করে শুধু ইয়ামথাং ভ্যালি ঘুরে এলেই হবে। জিরো পয়েন্টে যেতে আর্মিরা ঝামেলা করতে পারে। তখন আবহাওয়াও সুবিধার ছিল না। আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা সব জেনে-বুঝে, অন্তর্জাল ঘেঁটে অমরদার কথায় রাজি ছিলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা বড় দলের লোকজন। কেউ যেতে চান, কেউ চান না। যাঁরা যেতে চান, তাঁদের কথা হলো, ‘টাকা দিচ্ছি আপনাকে, নেবেন না কেন? যাবই!’ অথচ অমরদা আগেই বলে রেখেছিলেন যে যদি অনুমতি না পাই, আবহাওয়া দখলে না থাকে কিংবা পরিস্থিতি ভিন্ন হয়, তবে আমাদের পরিকল্পনার পরিবর্তন হতে পারে। সে কথাটা আমাদের দলকে না বললেও আমরা জানতাম। সিকিম ঘুরতে গেলে এই কথাগুলো মাথায় রাখতে হয়। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো যাঁরা জিরো পয়েন্টে যেতে চান, তাঁরা আলাদা যাবেন সকাল ৭টায়। আর বাকিরা নাশতা সেরে ৮টায় রওনা হবেন ইয়ামথাং ভ্যালির জন্য। জিরো পয়েন্ট ঘুরে বাকিরা সরাসরি ইয়ামথাং ভ্যালিতে চলে যাবেন। জিরো পয়েন্টে না যাওয়ার কারণ ছিল, সেখানে যা আছে তার চেয়ে কয়েক গুণ সুন্দর দৃশ্য ইয়ামথাং ভ্যালিতে আছে। শরীরের ওপর দিয়ে ধকল যাবে কি না, সে কথাও মাথা থেকে ফেলে দিলাম না। ওহ্, আরেকটা ব্যাপার, অমরদার কিন্তু জিরো পয়েন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিল সাঙ্গুতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু অনুমতি পাননি। সেখানে আমরা সবাই যেতে চেয়েছিলাম। অনুমতি পাননি বিধায় কয়েকজন জেঁকে ধরেছিলেন জিরো পয়েন্টে নিয়ে যেতে। আমাদের সাঙ্গুতে নিতে না পারায় কিন্তু তিনি পরে তাঁর সম্মানীটাও কম রেখেছিলেন।
বিতর্কের সিদ্ধান্ত জানার পর ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু কী মুশকিল! ঘুম যে আসে না! এক ফোঁটাও না। না আমার, না ভুবনের। রাত যত বাড়ে, ঠান্ডা তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে বাড়ে। ঘুম কী করে আসে এমন অবস্থায়! রুমে হিটার আনালাম। সেখানে আবার রুম হিটারের জন্য আলাদা খরচ করতে হয়। কিন্তু সারা রাতেও হিটার ঘরটাকে গরম করতে পারল না। এদিকে বাইরে হচ্ছে তুষারপাত। তাপমাত্রা সম্ভবত মাইনাস ৯ ছিল। একাত-ওকাত করে করে রাত পার করলাম। সব মিলিয়ে বড়জোর ঘণ্টা দেড়েক ঘুমিয়েছি; ভোরের দিকে যখন ঘরটা গরম হলো।
আরও পড়ুন:
উত্তরের পথে আমাদের অভিযান
‘জলদি ওঠো। দেরি করা যাবে না। কেউ যেন বলতে না পারে আমাদের জন্য দেরি হয়েছে।’ অ্যালার্ম বাজতেই ভুবন ওর চিরচেনা সংলাপ দিচ্ছিল! ‘চিরচেনা’ বললাম এ কারণে, সে কারও সঙ্গে কোথাও যাওয়ার আগে ঠিক এই কথাগুলোই বলে। ওর কথা হচ্ছে, প্রয়োজন হলে সময়ের আগে প্রস্তুত থাকতে হবে বা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু দেরি হওয়া যাবে না। মাঝে মাঝে তাই ওকে ‘আর্মি পারসন’ বলি! যাই হোক, সেখানকার সময় ৬টায় উঠে গেলাম। আধা ঘণ্টার মধ্যে দুজনে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরিয়েছি। হঠাৎ বারান্দার একপাশ দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখি কী সুন্দর দৃশ্য! রাতে পাহাড়ের গায়ে যে তারা দেখেছিলাম জ্বলজ্বল করছে, সেগুলো দিনের আলোয় স্পষ্ট ঘরবাড়ি। ছবিতে দেখলে হয়তো মনে হবে বস্তি। সামনে থেকে না দেখলে এর সৌন্দর্য অনুভব করা যাবে না। ঝটপট সেই দৃশ্যের ছবি তুলে নিল ভুবন।
হোটেল থেকে বের হলাম নাশতা খাব বলে। রাতে তো নিয়নের আলোয় খুব একটা বুঝিনি, সকালে বের হয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মল রোডটা যে কত পরিষ্কার, স্বচ্ছ! রাস্তার ওপরেই যেন নির্দ্বিধায় গড়াগড়ি করা যাবে। রাস্তার একপাশ ‘ওয়ান ওয়ে’, অন্য পাশ দিয়ে কোনো যানবাহন প্রবেশ করানো যায় না। এপাশ দিয়ে সবাই আরাম করে হাঁটাহাঁটি করে। আর একধারে কিছু দূর পর পর বেঞ্চি আছে। হাঁটতে হাঁটতে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। ওই পথ ধরে হেঁটে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। খেলাম সবজি আর লুচি। সবজি বলতে গাঢ় ঝোলের মধ্যে আলু! আলুর দম বলা চলে। কিন্তু তারা এটাকে সবজিই নাম দিয়েছে। ভুবন অবশ্য লুচি না খেয়ে রুটি খেয়েছিল। মিষ্টির চেহারাগুলো দেখে এত লোভ লাগছিল! কিন্তু যেই খেতে গিয়েছি, আর ভালো লাগল না। নাশতা পর্ব শেষ করে আবার ছুটলাম হোটেলের দিকে। হাঁটার মাঝে থেমে থেমে কিছু ছবিও তুলে নিলাম। মোড়ে একটা বিশাল লাল পান্ডার ভাস্কর্য আছে। সেটার সঙ্গে ছবি তুলতে ভুললাম না। সময় পেলে সত্যিকারের লাল পান্ডা দেখতে যেতাম গ্যাংটকের চিড়িয়াখানায়, কিন্তু সময় হয়নি।
আমরা ঠিক ৭টার সময় হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবাই প্রস্তুত। কিন্তু গাড়ি আসেনি। ৮টার পর গাড়ি পেয়ে রওনা হলাম বজরা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের উদ্দেশে। মোটামুটি পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। সেখানে হলো মহাবিলম্ব! কতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে, পায়চারি করে সময় পার করেছি, আল্লাহ জানেন। কথা ছিল আগের দিন রাতেই অমরদা সব গাড়ি ঠিক করে রাখবেন, কিন্তু পারেননি।
প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমরা গাড়ি পেলাম। একটা বড় জিপ পেয়ে আমরা নয়জন চড়ে বসলাম সেটাতে। আমাদের দুজনকে সবাই জিজ্ঞেস করছিল কোথায় বসতে চাই। আমি বললাম, ‘আপনাদের সুবিধামতো আমাদের একটু জায়গা দিলেই হবে।’ আকাশ ভাই দুষ্টুমি করে বললেন, ‘তাহলে ছাদে বসে যান। আমরা আরাম করে যাই।’ আমি বললাম, ‘কোনো সমস্যা নাই। সেটা তো ভীষণ মজার ব্যাপার হবে!’ সবাই হো হো করে হেসে দিয়ে দুজনকে চালকের সঙ্গে সামনের সিটে বসতে দিলেন। সামনে দুইটা সিটই বলা চলে। চালকেরটা ছাড়া। আরামসে আমি আর ভুবন এঁটে যাই। সবাই গাড়িতে উঠে অপেক্ষা করছি। বাকিদের বসা হলে একসঙ্গে রওনা দেব। বড় দলটা আরও দুইটা জিপে ভাগ হয়ে উঠল। তবে ঝামেলা লেগেছিল ওই দলের দুজন ‘জেঠুমশাই’কে নিয়ে। তাঁরা দুজনে একই জায়গায় বসতে চান। অর্থাৎ, একই সিটে। এ নিয়ে তুমুল লঙ্কাকাণ্ড! গাল ফুলিয়ে, চোখ রাঙিয়ে যাঁর যাঁর পরিচয় দিচ্ছিলেন। মাঝখান দিয়ে বেচারা অমরদা হলেন তুলাধুনা। আমরা জিপের ভেতরে বসে থেকে দর্শকের মতো ওই নাটক-সিনেমা দেখছিলাম। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘আরে ওনারা এত বড় মানুষ হয়ে বাচ্চাদের মতো করছেন, অথচ আমাদের মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এজাজের গাড়ির ছাদে বা পেছনে ঝুলে যেতেও আপত্তি নাই।’ সত্যিই যদি এমন পরিস্থিতি হতো, তাহলেও আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। গাড়ির ছাদে বা পেছনে ঝুলে ঝুলেই যেতাম। যাই হোক, সিনেমাটা আধা ঘণ্টার মতো চলল। অবশেষে অমরদা গালি হজম করে হাসিমুখে সবাইকে নিয়ে রওনা দিলেন। প্রায় ১২টা বেজে গিয়েছিল তখন।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছি, বুঝতে পারছিলাম। আর সে কী যে পাগল করা অপরূপ সৌন্দর্য! এই পথে যেতে যেতে ‘মাশাআল্লাহ’, ‘সুবহানআল্লাহ’, ‘ওয়াও’, ‘অ্যামেজিং’ শব্দগুলো আপনা-আপনি মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়। সবাই মিলে এক এক করে গান ধরলাম। আকাশ ভাইয়ের গলা ভালো। তিনি অনেক গান গাইলেন। পুরোটা পথ এই গানের আসর সঙ্গী ছিল। ভুবনের গান শুনে তো সবাই মুগ্ধ। আকাশ ভাই আমাকে বলছিলেন, ‘বাহ, আপনার স্বামীর গানের গলা তো বেশ!’ মুচকি হেসে বললাম, ‘এমনি এমনি কি আর প্রেমে পড়েছি!’ এ কথা শুনে সবাই হেসে দিলেন। এরপর এল আমাদের প্রেমকাহিনির গল্পের অনুরোধ। গানের ফাঁকে ফাঁকে সেটাও হয়ে গেল। আমার গানের গলা ভালো না। ছেড়ে গাইতে পারি না। অনেকটা নাকি সুরে গাই। তবু সবার জোর অনুরোধে গাইতে হলো। একটার বেশি গাইলাম না। কারণ আমি ওই একটা গানই একটু ছেড়ে দিয়ে গাইতে পারি, ‘তোমার ঘরে বাস করে কারা...’।
আমাদের সামনে বসার খুব ভালো একটা সুফল পাওয়া গেছে। যতটা স্পষ্ট আমরা দুজন দেখতে পাচ্ছিলাম বাইরের দৃশ্য, পেছনের লোকজন হয়তো সেটার অর্ধেক দেখেছে। তবু যা দেখেছে, তাতে চোখ ছানাবড়া না হয়ে পারেই না। পথে থেমে থেমে পাহাড়ি ঝরনা দেখাচ্ছিলেন আমাদের চালক। তাঁর নাম রবিন। নামটা শুনে তাঁকে রবিন হুড ডাকতে ইচ্ছা হলো। রবিন হুড থেকে মনে পড়ল সালমান খানের ‘চুলবুল পান্ডে ওরফে রবিন হুড পান্ডে’ চরিত্রের কথা। আমি তাই তাঁকে ‘পান্ডেজি’ বলে ডাকা শুরু করলাম। পান্ডেজি নরম মানুষ। আস্তে-ধীরে কথা বলেন। নেপালি। মানে, সিকিমের বাসিন্দা আরকি। তিনি সবগুলো ঝরনার নাম ও বর্ণনা দিলেন। সব ঝরনার নামের সাইনবোর্ড নেই আবার। সেখানে নাম লেখা থাকে সাধারণত। আবার কোনো কোনো ঝরনার নাম নেই। সেগুলো ছোটখাটো। অনেক ঝরনার নাম পান্ডেজি নিজেও জানেন না। কারণ সেগুলো নতুন। সেভেন সিস্টার্স, নাগা, ভিম নালাসহ আরও ছোট-বড় কিছু ঝরনা দেখলাম। ভিম নালা ঝরনাটার আরেকটা নাম আছে। ‘অমিতাভ বচ্চন ফলস’। এমন নাম কেন, জিজ্ঞেস করতেই পান্ডেজি বললেন, ‘উ বহুত লম্বা হ্যায়। উ অ্যাক্টর হ্যায় না, অমিতাভ বচ্চন, উসকি তারাহ।’ লম্বায় এটা ২৭৫ ফুট। এর আরেক নাম ভিমা ফলস। স্থানীয় ভাষায় ভিমা বা ভিম নালা মানে ‘রেড স্নেক’ বা লাল সাপ। তাই এর আরেক নাম ‘রেড স্নেক’। বিগত কয়েক বছর ধরে পর্যটকেরা এই ঝরনাকে আবার ‘লাচুং নর্থ সিকিম ফলস’ নামেও ডাকছে। ঝরনার পাশাপাশি মেঘের কথা না বললেই নয়। পাহাড়ের চূড়ায় তুলার মতো লেগে থাকা মেঘ দেখা যায় দূর থেকে। আর পাহাড়ের নিচে স্বচ্ছ সবুজ তিস্তার পানি বয়ে চলে। ওপরের দিকে উঠতে উঠতে মেঘের ভেতর দিয়ে গিয়েছি আমরা। গাড়ি থেকে নেমেও ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আসলে মেঘ নিজেই তো আমাদের জাপটে ধরে।
দুপুর থেকে পেটে উৎপাত শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পথে টং দোকানের চা-বিস্কুট ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। শেষে বিকালের দিকে এক মুসলিম হোটেল পেলাম। পাহাড়ি রাস্তার একপাশে বেড়ার হোটেল। নিচের দিকে নেমে গেলে গ্রাম। সেখানে বেশির ভাগ মুসলমানরাই বাস করে। অনেকটা লুকিয়ে তারা গোমাংস রান্না করে খাওয়ায়। অমরদা আগে থেকে বলে রেখেছিলেন। তাই আমরা গরুর মাংস দিয়ে গরম ভাত-ডাল খেতে পারলাম। মনে হচ্ছিল অমৃত। রান্নাটাও বেশ। জম্পেশ খাওয়া দিয়ে আবার রওনা দিলাম। লাচুংয়ে পৌঁছাতে হবে। ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আলবৎ মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছিল। এরপর বাকিটা ইতিহাস। তবে পরদিন থেকে।
সন্ধ্যা নেমে এলে গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া গতি ছিল না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, যাচ্ছি আবার মেঘের ভেতর দিয়ে। পথ একেবারে পিচ্ছিল। ভয় পাচ্ছিলাম না একটুও। কেননা, পান্ডেজি যেভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে ভরসা না করে পারা যায় না। তিনি মুখে তো অভয় দিচ্ছিলেনই, কাজ দিয়েও প্রমাণ করেছেন। সিকিমের এই পাহাড়ি পথ এমনভাবে তৈরি করা যে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা খুব কম। জায়গায় জায়গায় সতর্কবার্তা লেখা আছে। আর চালকদের এতটাই মুখস্থ রাস্তা যে তারা চোখ বুজে পাড়ি দিতে পারেন।
লাচুংয়ে ঢোকার আগেও অনুমতি লাগল। সেখানে এক বিজ্ঞপ্তিতে লেখা দেখলাম উত্তরের কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে আর কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে না। অবশ্যই লাচুংয়ে টিক চিহ্ন দেওয়া ছিল। সেটা দেখে মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম। যাক বাবা, আটকে দিল না তাহলে। অনুমতি নিয়ে চলতে শুরু করলাম আবার। সাড়ে ৭টার পরপর পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। আর্মি চেকপোস্টের কাছাকাছি ‘লাচুং রিজেন্সি’তে গিয়ে উঠলাম। এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আগে থেকে করে রেখেছিলেন অমরদা। এই হোটেলে লোক মাত্র দুজন। যিনি ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন, তিনি নিজেই রান্না করেন। তাঁর সঙ্গে একজন আছেন, যিনি অতিথিদের ফরমাশ খাটেন। তাঁকে সাহায্যও করেন। আমরা যার যার রুম বেছে নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিলাম। ভাগ্যিস এখানে খাওয়া না পাওয়া যাওয়ার ভয় ছিল না।
ধীরে-সুস্থেই খাবারঘরে গেলাম। বুফে সিস্টেম করে রেখেছিলেন আমাদের রাঁধুনি। ভাত, ডাল, সবজি, রুটি, মটর পনির, সালাদ। এখানে আমিষজাতীয় কোনো রান্না হয় না। বেশ ভালোই লাগল খেতে। ভাত ছাড়া সব খেলাম অল্প করে। বড় দলটাকে আমার ভালো লাগছিল না। তারা সবকিছুতে একটা লোকদেখানো ভাব করছিল। সে যাক গে, খেয়েদেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকে গল্প করছিলাম। এর মধ্যে হেঁশেল থেকে খবর এল, কেউ গরুর দুধ খেতে চায় কি না। তবে কিনে খেতে হবে। ভুবন খুব আগ্রহ নিয়ে দুধ আনতে গেল রান্নাঘরে। ফিরে এল একটা দুঃখ ভাব নিয়ে। ব্যাপার কী? এক গ্লাস দুধের দাম ৫০ রুপি! যদিও সে কিনে এনেছে এবং খুব কষ্ট করে গিলেছে। মনে হচ্ছিল টাকা গিলছে! সবার এক কথা, আমাদের দেশে ৭০ টাকায় লিটার আর এখানে মাত্র এক গ্লাস ৫০ রুপি! একটু বেশি হয়ে যায় না? এক গ্লাসের দাম পড়ছে তাহলে পঁয়ষট্টি টাকার মতো। গল্প-গুজব শেষ করে রুমে গেলাম ঘুমাতে। এমন সময় বাইরে হন্তদন্ত শুনলাম। পরদিন কে কোথায় যাবে সেটা নিয়ে বিস্তর ক্যাচাল লেগে গেল অমরদার সঙ্গে। কে আর লাগাবে। সেই বড় দলের পণ্ডিতেরা। অমরদার ভাষ্যমতে, জিরো পয়েন্টে গিয়ে কোনো লাভ নেই।
সময় নষ্ট না করে শুধু ইয়ামথাং ভ্যালি ঘুরে এলেই হবে। জিরো পয়েন্টে যেতে আর্মিরা ঝামেলা করতে পারে। তখন আবহাওয়াও সুবিধার ছিল না। আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা সব জেনে-বুঝে, অন্তর্জাল ঘেঁটে অমরদার কথায় রাজি ছিলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা বড় দলের লোকজন। কেউ যেতে চান, কেউ চান না। যাঁরা যেতে চান, তাঁদের কথা হলো, ‘টাকা দিচ্ছি আপনাকে, নেবেন না কেন? যাবই!’ অথচ অমরদা আগেই বলে রেখেছিলেন যে যদি অনুমতি না পাই, আবহাওয়া দখলে না থাকে কিংবা পরিস্থিতি ভিন্ন হয়, তবে আমাদের পরিকল্পনার পরিবর্তন হতে পারে। সে কথাটা আমাদের দলকে না বললেও আমরা জানতাম। সিকিম ঘুরতে গেলে এই কথাগুলো মাথায় রাখতে হয়। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো যাঁরা জিরো পয়েন্টে যেতে চান, তাঁরা আলাদা যাবেন সকাল ৭টায়। আর বাকিরা নাশতা সেরে ৮টায় রওনা হবেন ইয়ামথাং ভ্যালির জন্য। জিরো পয়েন্ট ঘুরে বাকিরা সরাসরি ইয়ামথাং ভ্যালিতে চলে যাবেন। জিরো পয়েন্টে না যাওয়ার কারণ ছিল, সেখানে যা আছে তার চেয়ে কয়েক গুণ সুন্দর দৃশ্য ইয়ামথাং ভ্যালিতে আছে। শরীরের ওপর দিয়ে ধকল যাবে কি না, সে কথাও মাথা থেকে ফেলে দিলাম না। ওহ্, আরেকটা ব্যাপার, অমরদার কিন্তু জিরো পয়েন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিল সাঙ্গুতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু অনুমতি পাননি। সেখানে আমরা সবাই যেতে চেয়েছিলাম। অনুমতি পাননি বিধায় কয়েকজন জেঁকে ধরেছিলেন জিরো পয়েন্টে নিয়ে যেতে। আমাদের সাঙ্গুতে নিতে না পারায় কিন্তু তিনি পরে তাঁর সম্মানীটাও কম রেখেছিলেন।
বিতর্কের সিদ্ধান্ত জানার পর ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু কী মুশকিল! ঘুম যে আসে না! এক ফোঁটাও না। না আমার, না ভুবনের। রাত যত বাড়ে, ঠান্ডা তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে বাড়ে। ঘুম কী করে আসে এমন অবস্থায়! রুমে হিটার আনালাম। সেখানে আবার রুম হিটারের জন্য আলাদা খরচ করতে হয়। কিন্তু সারা রাতেও হিটার ঘরটাকে গরম করতে পারল না। এদিকে বাইরে হচ্ছে তুষারপাত। তাপমাত্রা সম্ভবত মাইনাস ৯ ছিল। একাত-ওকাত করে করে রাত পার করলাম। সব মিলিয়ে বড়জোর ঘণ্টা দেড়েক ঘুমিয়েছি; ভোরের দিকে যখন ঘরটা গরম হলো।
আরও পড়ুন:
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে