ফারজানা সিদ্দিকা
পাঠকমাত্রই জানেন শামসুর রাহমানের জীবনে প্রেম ও কবিতার অবস্থান সমান্তরাল। এ নিয়ে লুকোছাপা নেই তাঁর। প্রেমে পড়ার, প্রেমে জড়িত থাকার বা বিচ্ছেদে নিদারুণ বেদনার কথা যতটা অকপটে লিখেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায়, এমনকি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার থেকে বেশি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতায়।
কবি তাঁর অফিসের ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখতেন প্রেমিকাদের ছবি। লোকজন না থাকলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন! প্রেমিকাদের দীর্ঘ চিঠি লিখতেন তিনি। প্রেমিকারাও লিখতেন তাঁকে। চিঠিরই তো যুগ ছিল তখন। আর ছিল অ্যানালগ টেলিফোন। সম্ভাব্য সুযোগ পেলে টেলিফোনে কথা বলতেন। কিন্তু কবি পছন্দ করতেন চিঠি লিখতে এবং চিঠি পেতে।
কোথায় হারালো সেসব চিঠি? ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘মীজানুর রহমান ত্রৈমাসিক’-এর শামসুর রাহমান সংখ্যায় কোনো পারিবারিক পত্র প্রকাশিত হয়নি। সেগুলো মূলত শামসুর রাহমানকে লেখা বিশিষ্ট লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের চিঠি। অর্থাৎ এসব পত্র শামসুর রাহমান নিজেই যত্নসহকারে সংরক্ষণ করেছেন। কিন্তু তাঁর লেখা পত্র? ২০০৭-এ সময় প্রকাশন থেকে বদরুল আলম আমিনের সম্পাদনায় ‘শামসুর রাহমানের পত্র ও প্রেমপত্র’ গ্রন্থে মীজানুর রহমান ত্রৈমাসিকের শামসুর রাহমান সংখ্যায় প্রকাশিত পত্রগুলোর সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত পারিবারিক পত্র এবং নয়খানা প্রেমপত্র যুক্ত হয়েছে। সেখানে মাত্র নয়খানা প্রেমপত্র আছে, নাম-পরিচয়হীন! অর্থাৎ কোনো এক প্রেমিকাকে লেখা কবির নয়খানা পত্র, তাতে প্রেমিকার নাম নেই, ছদ্মনামে বা বিভিন্ন উপমা দিয়ে প্রেমিকাকে সম্বোধন করেছেন তিনি। সেসব চিঠি কাকে লিখেছিলেন কবি? উৎসুক পাঠক হিসেবে তার খোঁজে গিয়েছিলাম কবি তুষার করের বাড়িতে। শামসুর রাহমানের অনুরাগী পাঠক তিনি। বছরের পর বছর তিনি কবির সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হওয়া কবির লেখা সযত্নে রেখেছেন। এমনও হয়েছে, প্রকাশ হওয়া কোনো লেখার কপি কবির কাছে নেই, কিন্তু কবি জানেন, তুষার করের কাছে নিশ্চিত পাওয়া যাবে! বহু পুরোনো লেখা একসঙ্গে জড়ো করে কবির জন্য পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। ঢাকার বাইরে কত অনুষ্ঠানে গেছেন কবির সঙ্গে। কবির বাড়িতে থেকেছেন দিনের পর দিন! এসব গল্প করবার সময় তুষার করের মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়! শিশুর সারল্য মাখা কণ্ঠে একদিন বললেন, ‘জানেন, কত রাত কবির সঙ্গে ঘুমিয়েছি আমি! মাঝরাতে জেগে উঠে আমি কবির ঘুমন্ত মুখ দেখতাম!’ বইয়ে প্রকাশিত নয়খানা চিঠির প্রাপকের খোঁজ তুষার কর জানবেনই এমন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে তাঁর বাড়িতে যাওয়া বিফল হয়নি। সেই নয়টি চিঠির প্রাপকের পরিচয় জানেন তুষার কর। কবি ও চিঠির প্রাপকের গল্প করতে করতে ভেতরের ঘর থেকে নিয়ে এলেন আরও কিছু কাগজপত্র। বারবার বাসা বদলাতে গিয়ে এরই মধ্যে অনেক সংগ্রহ হারিয়ে গেছে তাঁর। সেসব নিয়ে আফসোস করতে করতে পুরোনো কাগজপত্রের ভেতর থেকে বের হলো একটা রঙিন ভাঁজপত্র! তারপর আরও কয়েকটা চিঠি!
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করে নিতে চাই এ জন্য যে, কবির ‘প্রেমিক সত্তা’ কেমন হয় তা যেন পাঠক উপলব্ধি করে নিতে পারেন।
১৯৯১-এ হুমায়ুন আজাদের মুখোমুখি হন শামসুর রাহমান। কবিতা নিয়ে বিস্তর কথার ভিড়ে আসে কবিতায় প্রেমের প্রসঙ্গ। সেই সাক্ষাৎকার থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো :
হুমায়ুন আজাদ: আপনার প্রেমের কবিতা কি শুধুই কল্পনার সৃষ্টি? না ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ?
শামসুর রাহমান : ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধই অধিকাংশ কবিতা।
হুমায়ুন আজাদ : আপনার এ প্রেমের কবিতাগুলোর মধ্যে কজন প্রেমিকাকে খুঁজে বের করা যাবে?
শামসুর রাহমান : বেশ কয়েকজনকে।
হুমায়ুন আজাদ : আপনার প্রেমের কবিতায় আপনি কোন ধরনের আবেগ প্রকাশ করেন? অর্থাৎ হৃদয়ের আবেগের ওপর আপনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, না শারীরিক আবেগের ওপর?
শামসুর রাহমান : দুটোতেই।
হুমায়ুন আজাদ : আশাকরি আপনার অনেক প্রেমিকা ছিল। এঁদের মধ্যে কে সবচে অনুপ্রেরণা দিতে পেরেছে আপনাকে? অন্তত আপনি নামটা উল্লেখ করতে পারেন।
প্রথমটি না দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়টি...।
শামসুর রাহমান : এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয়, আমি সবার কাছেই ঋণী।
শেষের প্রশ্নটিতে মনে হচ্ছে হুমায়ুন আজাদ কবির কথায় প্রায় নিশ্চিত হয়েছেন, একাধিক প্রেমিকা এসেছিল তাঁর জীবনে। কোনো একজন প্রেমিকার নাম জানতে চাইছেন।
কিন্তু ‘এটা বলা মুশকিল’ বলে এড়িয়ে গেলেন কবি। এই ‘মুশকিল’ ব্যাপারটিই হলো আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকট। এ সংকটের ফলেই কবিকে সতর্কে লুকোতে হয় প্রেমিকার নাম। আর প্রেমিকারা লুকিয়ে রাখেন প্রেমিক কবির প্রেমপত্র! কিংবা একজন মাত্র প্রেমিকা প্রেমিক কবির মৃত্যুর পর নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি পত্র ছাপতে দেন। অথচ সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে কোনো প্রেমিকার নাম প্রকাশ না করলেও কী অনায়াসে ‘ঋণী’ হয়ে থাকেন তিনি!
১৯৯৪ সালে তরুণী প্রেমিকার উদ্দেশে লেখা আটটি কবিতা নিয়ে বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হবে ‘গোধূলিতে হৃদয়ের ধ্বনি’ নামে একটি ভাঁজপত্রের কাব্যগ্রন্থ—সেই কাব্যগ্রন্থের খোঁজ জানবেন না কবির রচনাবলির সম্পাদকেরাও! তুষার কর সেই ভাঁজপত্রটিই মেলে ধরেছিলেন!
রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের এক আয়োজনে শিলাইদহে দেখা হয়েছিল তাঁদের। সেই তরুণী গান জানেন, আবৃত্তি করেন, অভিনয় জানেন। সেই প্রথম দেখা ও আলাপ।
তারপর ফিরে গেছেন যে যাঁর গন্তব্যে। একজন ঢাকায়, অন্যজন রাজশাহী। পরবর্তী সময়ে নিয়মিত পত্র বিনিময়ে খুব একটা সময় লাগেনি। মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথাও বলেছেন। এমনকি, একা একা কোনো একটা বাহানা করে বিমানে উঠে কবি চলে গেছেন রাজশাহী! লিখে ফেলেছেন রাজশাহীর বিমানবন্দর নিয়ে কবিতা! ভাঁজপত্রের একটি কবিতার নাম ‘বিমান বন্দর’। ‘বিমান বন্দরটার নেই কোনো বাহারি আদল,/ নেহাতই শাদামাটা; অনুজ্জ্বল/ দরজার কাছে জলকণাময়, [...] সেই বিমান বন্দর বন্দনীয়/ এবং চিরপ্রিয়/ হয়ে ওঠে আমার শুধু তুমি ছিলে ব’লে,/ আমাকে স্পর্শ করেছিলে ব’লে কথাচ্ছলে।’ ভাঁজপত্রের আরেকটি কবিতায় আছে রাজশাহীর ভূ-প্রকৃতির চিহ্ন। ‘বড় রুখা সুখা সেই শহর, অথচ সেখানে যাওয়ার সাধ আমার চূড়াস্পর্শী। কবিতার নাম ‘আলোকলতার মূল’। কবির সঙ্গেও ঢাকায় দেখা করতে এসেছিলেন প্রেমিকা। চারদিকে সতর্ক নজর!
ততদিনে কবি জাতীয় ব্যক্তিত্ব। পথেঘাটে দেখা করা মুশকিল। এমনকি নিজের বাড়িতে লেখার ঘরেও। বাড়ির লোকেরাও পাহারা দেয় তাঁকে! আরও বহু কবিতা অনুরাগীর বেশ ধরে প্রেমিকা আসেন কবির বাড়িতে, সামান্য সময়ের জন্য দেখা দিতে পারেন। সেটুকু সময়ের রেশ রয়ে যায় ভাঁজপত্রের কবিতায়, ‘যাচ্ছো, যাও।/ পথ রোধ করে দাঁড়াবার/ নেই অধিকার আমার।/ তোমার চ’লে-যাওয়া/ জানে দূর মফস্বলগামী বাস,/ প্রত্যুষের হাওয়া,/ লেজঝোলা পাখি,/ সবচেয়ে বেশি জানে/ এ কবির বিদীর্ণ হৃদয়।’ কবিতার নাম ‘যাচ্ছো, যাও’। এমনই সেই নজরদারি যে বাড়িতে বসে প্রেমিকার চিঠির উত্তর দিতে পারেন না কবি! কবির চিঠি বা খোঁজ না পেলে তুষার করকেই চিঠি লিখেন কবির প্রেমিকা। ২৯.০৩.১৯৯৪ তারিখযুক্ত জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের রাইটিং প্যাডে কবির ওপর সেই নজরদারির কথা প্রেমিকা লিখছেন, ‘ [...] অথচ কী আশ্চর্য জানেন?
কবি, আমার কবি, এখন এই ৬৬/বয়সে এসে কড়া শাসনের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন, দগ্ধ। বিখ্যাত এই কবির; একজন লেখকের লেখার স্বাধীনতা থাকবে না? ভাবতে পারেন?
লিখতে বসলে পাহারা দেওয়া হয়, কাকে লিখছেন [,] কারণ কি শুনবেন? শুনতে কারো মন্দ লাগবে না! আপনারও না। কারণ? ‘ভালোবাসা’ সমাজে হাতে গোনা ক’জন এর বেশি যেন কাউকে ভালো না বাসেন। তবে হ্যাঁ, পুরুষ হলে আলাদা কথা [,] কোনো মেয়েদের নয়। মেয়েদের ভালোবাসলে মহা অন্যায় হয়। পাপ হয়। মেয়েরা কি ভালোবাসার কোনো বস্তু হ’ল? তুষার’কে ভালোবাসতে দোষ নেই মানা নেই, তমা’কে বাসলেই যত বিপত্তি। [...]’ ২২.৮.৯৬ এ তুষার করকে শেষ চিঠি লেখেন কবির প্রেমিকা। তত দিনে তাঁর জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে! বাবর আকস্মিক মৃত্যু, প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়া, পুত্রসন্তান নিয়ে চাকরির সন্ধান, এমনকি ঢাকায় বিজ্ঞাপনের কাজের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর সব শেষে দ্বিতীয় বিয়ের খবর। এই চিঠিতে কবি সম্পর্কে একটি বাক্যও নেই!
১৯৯৪-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী এ প্রেম ঘিরে কেবল এই ভাঁজপত্রের আটটি কবিতাই নয়, কবির এই পর্বের প্রেমে আরও অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। পদ্মাপাড়ের এই প্রেমিকাকে নিয়ে লেখা কবির শেষ কবিতা কোনটি? ‘উত্তর’? ‘তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো, এই আকাশ আমার।’ প্রেমিকাকে ‘তমা’ নামেই সম্বোধন করতেন কবি। ‘উত্তর’ কবিতাটি ১৯৯৫-এ প্রকাশিত ‘এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থে রয়েছে। কিন্তু তত দিনে কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর নতুন প্রেমিকাকে!
পাঠকমাত্রই জানেন শামসুর রাহমানের জীবনে প্রেম ও কবিতার অবস্থান সমান্তরাল। এ নিয়ে লুকোছাপা নেই তাঁর। প্রেমে পড়ার, প্রেমে জড়িত থাকার বা বিচ্ছেদে নিদারুণ বেদনার কথা যতটা অকপটে লিখেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায়, এমনকি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার থেকে বেশি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতায়।
কবি তাঁর অফিসের ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখতেন প্রেমিকাদের ছবি। লোকজন না থাকলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন! প্রেমিকাদের দীর্ঘ চিঠি লিখতেন তিনি। প্রেমিকারাও লিখতেন তাঁকে। চিঠিরই তো যুগ ছিল তখন। আর ছিল অ্যানালগ টেলিফোন। সম্ভাব্য সুযোগ পেলে টেলিফোনে কথা বলতেন। কিন্তু কবি পছন্দ করতেন চিঠি লিখতে এবং চিঠি পেতে।
কোথায় হারালো সেসব চিঠি? ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘মীজানুর রহমান ত্রৈমাসিক’-এর শামসুর রাহমান সংখ্যায় কোনো পারিবারিক পত্র প্রকাশিত হয়নি। সেগুলো মূলত শামসুর রাহমানকে লেখা বিশিষ্ট লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের চিঠি। অর্থাৎ এসব পত্র শামসুর রাহমান নিজেই যত্নসহকারে সংরক্ষণ করেছেন। কিন্তু তাঁর লেখা পত্র? ২০০৭-এ সময় প্রকাশন থেকে বদরুল আলম আমিনের সম্পাদনায় ‘শামসুর রাহমানের পত্র ও প্রেমপত্র’ গ্রন্থে মীজানুর রহমান ত্রৈমাসিকের শামসুর রাহমান সংখ্যায় প্রকাশিত পত্রগুলোর সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত পারিবারিক পত্র এবং নয়খানা প্রেমপত্র যুক্ত হয়েছে। সেখানে মাত্র নয়খানা প্রেমপত্র আছে, নাম-পরিচয়হীন! অর্থাৎ কোনো এক প্রেমিকাকে লেখা কবির নয়খানা পত্র, তাতে প্রেমিকার নাম নেই, ছদ্মনামে বা বিভিন্ন উপমা দিয়ে প্রেমিকাকে সম্বোধন করেছেন তিনি। সেসব চিঠি কাকে লিখেছিলেন কবি? উৎসুক পাঠক হিসেবে তার খোঁজে গিয়েছিলাম কবি তুষার করের বাড়িতে। শামসুর রাহমানের অনুরাগী পাঠক তিনি। বছরের পর বছর তিনি কবির সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হওয়া কবির লেখা সযত্নে রেখেছেন। এমনও হয়েছে, প্রকাশ হওয়া কোনো লেখার কপি কবির কাছে নেই, কিন্তু কবি জানেন, তুষার করের কাছে নিশ্চিত পাওয়া যাবে! বহু পুরোনো লেখা একসঙ্গে জড়ো করে কবির জন্য পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। ঢাকার বাইরে কত অনুষ্ঠানে গেছেন কবির সঙ্গে। কবির বাড়িতে থেকেছেন দিনের পর দিন! এসব গল্প করবার সময় তুষার করের মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়! শিশুর সারল্য মাখা কণ্ঠে একদিন বললেন, ‘জানেন, কত রাত কবির সঙ্গে ঘুমিয়েছি আমি! মাঝরাতে জেগে উঠে আমি কবির ঘুমন্ত মুখ দেখতাম!’ বইয়ে প্রকাশিত নয়খানা চিঠির প্রাপকের খোঁজ তুষার কর জানবেনই এমন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে তাঁর বাড়িতে যাওয়া বিফল হয়নি। সেই নয়টি চিঠির প্রাপকের পরিচয় জানেন তুষার কর। কবি ও চিঠির প্রাপকের গল্প করতে করতে ভেতরের ঘর থেকে নিয়ে এলেন আরও কিছু কাগজপত্র। বারবার বাসা বদলাতে গিয়ে এরই মধ্যে অনেক সংগ্রহ হারিয়ে গেছে তাঁর। সেসব নিয়ে আফসোস করতে করতে পুরোনো কাগজপত্রের ভেতর থেকে বের হলো একটা রঙিন ভাঁজপত্র! তারপর আরও কয়েকটা চিঠি!
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করে নিতে চাই এ জন্য যে, কবির ‘প্রেমিক সত্তা’ কেমন হয় তা যেন পাঠক উপলব্ধি করে নিতে পারেন।
১৯৯১-এ হুমায়ুন আজাদের মুখোমুখি হন শামসুর রাহমান। কবিতা নিয়ে বিস্তর কথার ভিড়ে আসে কবিতায় প্রেমের প্রসঙ্গ। সেই সাক্ষাৎকার থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো :
হুমায়ুন আজাদ: আপনার প্রেমের কবিতা কি শুধুই কল্পনার সৃষ্টি? না ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ?
শামসুর রাহমান : ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধই অধিকাংশ কবিতা।
হুমায়ুন আজাদ : আপনার এ প্রেমের কবিতাগুলোর মধ্যে কজন প্রেমিকাকে খুঁজে বের করা যাবে?
শামসুর রাহমান : বেশ কয়েকজনকে।
হুমায়ুন আজাদ : আপনার প্রেমের কবিতায় আপনি কোন ধরনের আবেগ প্রকাশ করেন? অর্থাৎ হৃদয়ের আবেগের ওপর আপনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, না শারীরিক আবেগের ওপর?
শামসুর রাহমান : দুটোতেই।
হুমায়ুন আজাদ : আশাকরি আপনার অনেক প্রেমিকা ছিল। এঁদের মধ্যে কে সবচে অনুপ্রেরণা দিতে পেরেছে আপনাকে? অন্তত আপনি নামটা উল্লেখ করতে পারেন।
প্রথমটি না দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়টি...।
শামসুর রাহমান : এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয়, আমি সবার কাছেই ঋণী।
শেষের প্রশ্নটিতে মনে হচ্ছে হুমায়ুন আজাদ কবির কথায় প্রায় নিশ্চিত হয়েছেন, একাধিক প্রেমিকা এসেছিল তাঁর জীবনে। কোনো একজন প্রেমিকার নাম জানতে চাইছেন।
কিন্তু ‘এটা বলা মুশকিল’ বলে এড়িয়ে গেলেন কবি। এই ‘মুশকিল’ ব্যাপারটিই হলো আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকট। এ সংকটের ফলেই কবিকে সতর্কে লুকোতে হয় প্রেমিকার নাম। আর প্রেমিকারা লুকিয়ে রাখেন প্রেমিক কবির প্রেমপত্র! কিংবা একজন মাত্র প্রেমিকা প্রেমিক কবির মৃত্যুর পর নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি পত্র ছাপতে দেন। অথচ সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে কোনো প্রেমিকার নাম প্রকাশ না করলেও কী অনায়াসে ‘ঋণী’ হয়ে থাকেন তিনি!
১৯৯৪ সালে তরুণী প্রেমিকার উদ্দেশে লেখা আটটি কবিতা নিয়ে বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হবে ‘গোধূলিতে হৃদয়ের ধ্বনি’ নামে একটি ভাঁজপত্রের কাব্যগ্রন্থ—সেই কাব্যগ্রন্থের খোঁজ জানবেন না কবির রচনাবলির সম্পাদকেরাও! তুষার কর সেই ভাঁজপত্রটিই মেলে ধরেছিলেন!
রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের এক আয়োজনে শিলাইদহে দেখা হয়েছিল তাঁদের। সেই তরুণী গান জানেন, আবৃত্তি করেন, অভিনয় জানেন। সেই প্রথম দেখা ও আলাপ।
তারপর ফিরে গেছেন যে যাঁর গন্তব্যে। একজন ঢাকায়, অন্যজন রাজশাহী। পরবর্তী সময়ে নিয়মিত পত্র বিনিময়ে খুব একটা সময় লাগেনি। মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথাও বলেছেন। এমনকি, একা একা কোনো একটা বাহানা করে বিমানে উঠে কবি চলে গেছেন রাজশাহী! লিখে ফেলেছেন রাজশাহীর বিমানবন্দর নিয়ে কবিতা! ভাঁজপত্রের একটি কবিতার নাম ‘বিমান বন্দর’। ‘বিমান বন্দরটার নেই কোনো বাহারি আদল,/ নেহাতই শাদামাটা; অনুজ্জ্বল/ দরজার কাছে জলকণাময়, [...] সেই বিমান বন্দর বন্দনীয়/ এবং চিরপ্রিয়/ হয়ে ওঠে আমার শুধু তুমি ছিলে ব’লে,/ আমাকে স্পর্শ করেছিলে ব’লে কথাচ্ছলে।’ ভাঁজপত্রের আরেকটি কবিতায় আছে রাজশাহীর ভূ-প্রকৃতির চিহ্ন। ‘বড় রুখা সুখা সেই শহর, অথচ সেখানে যাওয়ার সাধ আমার চূড়াস্পর্শী। কবিতার নাম ‘আলোকলতার মূল’। কবির সঙ্গেও ঢাকায় দেখা করতে এসেছিলেন প্রেমিকা। চারদিকে সতর্ক নজর!
ততদিনে কবি জাতীয় ব্যক্তিত্ব। পথেঘাটে দেখা করা মুশকিল। এমনকি নিজের বাড়িতে লেখার ঘরেও। বাড়ির লোকেরাও পাহারা দেয় তাঁকে! আরও বহু কবিতা অনুরাগীর বেশ ধরে প্রেমিকা আসেন কবির বাড়িতে, সামান্য সময়ের জন্য দেখা দিতে পারেন। সেটুকু সময়ের রেশ রয়ে যায় ভাঁজপত্রের কবিতায়, ‘যাচ্ছো, যাও।/ পথ রোধ করে দাঁড়াবার/ নেই অধিকার আমার।/ তোমার চ’লে-যাওয়া/ জানে দূর মফস্বলগামী বাস,/ প্রত্যুষের হাওয়া,/ লেজঝোলা পাখি,/ সবচেয়ে বেশি জানে/ এ কবির বিদীর্ণ হৃদয়।’ কবিতার নাম ‘যাচ্ছো, যাও’। এমনই সেই নজরদারি যে বাড়িতে বসে প্রেমিকার চিঠির উত্তর দিতে পারেন না কবি! কবির চিঠি বা খোঁজ না পেলে তুষার করকেই চিঠি লিখেন কবির প্রেমিকা। ২৯.০৩.১৯৯৪ তারিখযুক্ত জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের রাইটিং প্যাডে কবির ওপর সেই নজরদারির কথা প্রেমিকা লিখছেন, ‘ [...] অথচ কী আশ্চর্য জানেন?
কবি, আমার কবি, এখন এই ৬৬/বয়সে এসে কড়া শাসনের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন, দগ্ধ। বিখ্যাত এই কবির; একজন লেখকের লেখার স্বাধীনতা থাকবে না? ভাবতে পারেন?
লিখতে বসলে পাহারা দেওয়া হয়, কাকে লিখছেন [,] কারণ কি শুনবেন? শুনতে কারো মন্দ লাগবে না! আপনারও না। কারণ? ‘ভালোবাসা’ সমাজে হাতে গোনা ক’জন এর বেশি যেন কাউকে ভালো না বাসেন। তবে হ্যাঁ, পুরুষ হলে আলাদা কথা [,] কোনো মেয়েদের নয়। মেয়েদের ভালোবাসলে মহা অন্যায় হয়। পাপ হয়। মেয়েরা কি ভালোবাসার কোনো বস্তু হ’ল? তুষার’কে ভালোবাসতে দোষ নেই মানা নেই, তমা’কে বাসলেই যত বিপত্তি। [...]’ ২২.৮.৯৬ এ তুষার করকে শেষ চিঠি লেখেন কবির প্রেমিকা। তত দিনে তাঁর জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে! বাবর আকস্মিক মৃত্যু, প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়া, পুত্রসন্তান নিয়ে চাকরির সন্ধান, এমনকি ঢাকায় বিজ্ঞাপনের কাজের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর সব শেষে দ্বিতীয় বিয়ের খবর। এই চিঠিতে কবি সম্পর্কে একটি বাক্যও নেই!
১৯৯৪-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী এ প্রেম ঘিরে কেবল এই ভাঁজপত্রের আটটি কবিতাই নয়, কবির এই পর্বের প্রেমে আরও অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। পদ্মাপাড়ের এই প্রেমিকাকে নিয়ে লেখা কবির শেষ কবিতা কোনটি? ‘উত্তর’? ‘তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো, এই আকাশ আমার।’ প্রেমিকাকে ‘তমা’ নামেই সম্বোধন করতেন কবি। ‘উত্তর’ কবিতাটি ১৯৯৫-এ প্রকাশিত ‘এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থে রয়েছে। কিন্তু তত দিনে কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর নতুন প্রেমিকাকে!
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে