শাহাদুজ্জামান
সম্প্রতি প্রায় দেড় শ বছর পর বিলাতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম ঠিকানাটি খুঁজে বের করা হলো এবং সেখানে বসানো হলো একটা ফলক। সুযোগ হলো সেই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। সে গল্পটাই শোনাই।
রবীন্দ্রনাথকে প্রথম বিলাতে পাঠানো হয়েছিল ১৮৭৮ সালে, ব্যারিস্টারি পড়তে। তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। তখনকার ভারতীয় অভিজাত পরিবারের অনেকেই বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তে আসতেন। সে সময়ে বিলাতের নানা শহরেই ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ছড়িয়ে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ উঠেছিলেন ব্রাইটন শহরে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সে বাড়ি ব্রাইটন শহরেরই প্রান্তে হোভ এলাকায়। বাড়ির নাম ছিল ‘মেডিনা ভিলা’। পাঠক হিসেবে এ তথ্য জানা ছিল আমার। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল এই কারণে, এ শহরেই আমার কর্মস্থল সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়। থাকি ব্রাইটনের গা-ঘেঁষা এক শহরে। নিত্যদিন বিলাতের যে শহরে আসা-যাওয়া করি, সে শহরের যে বাড়িটাতে রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন, তার সামনে দাঁড়াবার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু মেডিনা ভিলার খোঁজ কেউ দিতে পারে না। প্রথম বিলাতযাত্রার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তিনি যখন জানলেন ব্রাইটনের মেডিনা ভিলা নামে এক বাড়িতে থাকবেন, তখন তিনি বেশ উত্তেজিত ছিলেন এই ভেবে, এ নিশ্চয়ই গাছগাছালি, পাখপাখালি ঘেরা এক বিশাল বাড়ি হবে। কিন্তু এসে হতাশ হয়েছিলেন। কারণ, সে বাড়িটা ছিল সারি বাঁধা অসংখ্য বাড়ির একটি মাত্র। এর আশপাশে গাছপালা বিশেষ ছিল না। তবে তাঁর একটাই সান্ত্বনা ছিল, বাড়িটা সমুদ্রের ধারে। এ ধরনের গায়ে গায়ে লাগোয়া বাড়ির সারিকে বিলাতে বলে ‘ট্যারেস হাউস’।
গাছগাছালি ভরা একক ভিলাও বিস্তর আছে। তবে ভারতে ধনবান হলেও বিলাতে তেমন বিলাসবহুল বাড়িতে থাকার সংগতি বা ইচ্ছা হয়তো ছিল না ঠাকুর পরিবারের। আর ব্রাইটন তো সমুদ্রেরই শহর। পাথুরে সৈকতে ভ্রমণ করতে সে দেশের নানা অঞ্চল থেকে মানুষ সুযোগ পেলেই চলে আসে ব্রাইটনে। বোঝা যায়, বাড়ির পাশের সমুদ্র রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিল স্বস্তির। সেই সমুদ্রের পাড়ে আমি হাঁটি প্রায়ই, দেখি সমুদ্রের দিকে মুখ করা সারি সারি বাড়ি। কিন্তু এর মধ্যে কোনটা যে সেই বিশেষ বাড়ি, সেটা জানার তো উপায় নেই।
কিন্তু ভবের লীলা বলে কথা। কাকতালীয় ঘটনা ঘটে একদিন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মীর সুবাদে ঘটনাক্রমে একদিন পরিচয় ঘটে ব্রাইটনবাসী ব্রিটিশ বাউলবিষয়ক গবেষক জান ওপেনশের (Jeanne Openshow) সঙ্গে। তাঁর নামের উচ্চারণ ঠিক কী হবে, এ নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম। জিজ্ঞেস করাতে চমৎকার বাংলা বলতে পারা ওই ব্রিটিশ নারী ঠাট্টা করে বললেন, ‘জান আমার নাম। প্রাণের কথা মনে থাকলে জানের কথাও মনে থাকবে।’ জান বেশির ভাগ সময়ই গবেষণার কাজে শান্তিনিকেতনের কাছে বোলপুরে থাকেন। মাঝে মাঝে ব্রাইটনে আসেন তাঁর বাড়িতে। পরে দেখেছি বাউলদের ওপর Seeking Baul’s of Bengal নামে চমৎকার গবেষণামূলক বই আছে জানের। তাঁকে রবীন্দ্রনাথের বাড়ির প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘আমি ব্রাইটনবাসী, থাকি শান্তিনিকেতনে আর রবীন্দ্রনাথের ব্রাইটের বাড়ি নিয়ে আমার কৌতূহল থাকবে না, তা কি হয়?’ তারপর জান আমাকে জানালেন অভিযানের বিস্তারিত কাহিনি এবং আমাদের এই পরিচয় যে বেশ এক অদ্ভুত কাকতালীয় মুহূর্তে ঘটল, জানালেন সেটাও।
ঘটনা এই, আমার মতোই জান দীর্ঘদিন হোভের সেই মেডিনা ভিলা খুঁজে বেরিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিচারণায় মেডিনা ভিলা নাম লিখলেও তার কোনো সুনির্দিষ্ট ঠিকানা লেখেননি। জান এই শহরের পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটেও এই বাড়ির কোনো হদিস করতে পারেননি। হয়তো ভেঙেই ফেলা হয়েছে সেই বাড়ি। কিন্তু জান নাছোড়বান্দা। তাঁরই শহরে রবীন্দ্রনাথ দিন কাটিয়ে গেছেন অথচ রবীন্দ্রনাথের কোনো স্মৃতিচিহ্ন এই শহরে থাকবে না, সেটা তিনি মানতে পারছিলেন না। জান তখন বিকল্প পথ ধরলেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকে জানা গেছে, ব্যারিস্টারি পড়ার প্রস্তুতি হিসেবে তাঁকে প্রথম ভর্তি করানো হয়েছিল ব্রাইটন প্রিপারেটরি নামে একটা স্কুলে। তিনি সেই স্কুলের সন্ধানে নামলেন। সে স্কুল এখন নেই কিন্তু স্কুলটির ইতিহাস পাওয়া গেল। জানা গেল সেই স্কুলের নির্দিষ্ট ঠিকানাও। স্কুলটি ছিল ব্রাইটন শহরের একেবারে কেন্দ্রেই, ৭ নম্বর শিপ স্ট্রিটে। সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখতে পেলেন এখন সেটা একটা পুরোদস্তুর চার তারকা হোটেল, নাম ডু ভিন। হোটেল কর্তৃপক্ষ ইতিহাসের স্বার্থে সেই স্কুলের একটা ক্লাসরুম এবং কিছু অংশ গত শতাব্দীর মতোই অবশ্য অক্ষত রেখেছে। জান এই আবিষ্কারে যারপরনাই উত্তেজিত। হোটেল কর্তৃপক্ষকে এই তথ্য দেওয়াতে তাদের ভেতর বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।
কারণ, রবীন্দ্রনাথ বলে কারও নাম তারা কখনো শোনেনি। এরপর শুরু হলো জানের ভিন্নতর যাত্রা। তিনি ঠিক করলেন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি যখন পাওয়া গেল না, এই স্কুলটিতেই তিনি রবীন্দ্রনাথের একটা ফলক বসাবেন। ইউরোপের কোনো শহরে জগৎখ্যাত কোনো ব্যক্তির পদচারণা থাকলে সেখানে একটা ফলক লাগিয়ে তাঁকে স্মরণ করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু জান চাইলেই তো আর ব্যক্তিগতভাবে এমন একটা ফলক বসিয়ে দিতে পারেন না। শহরের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। সে নানা জটিল প্রক্রিয়া। জান ব্রাইটন শহরের মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর এই প্রস্তাব দিতে মেয়র সাহেব টেগোর নামটিকে খানিকটা স্মরণ করতে পারলেও তার গুরুত্ব ঠিক অনুধাবন করলেন না। বলা বাহুল্য, ভারত বিষয়ে উৎসাহী কিছু মানুষের বাইরে রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রতিক ইউরোপের কোনো পরিচিত নাম নন। কিন্তু জান মেয়রকে নানা রকম তথ্য সরবরাহ করতে থাকেন।
মেয়র নিজেও তখন খোঁজখবর করতে শুরু করেন। তিনি জানতে পারেন, ইউরোপের বাইরে তিনিই প্রথম নোবেল বিজয়ী। আরও জানতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব টালমাটাল ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রীতিমতো এক তারকা ব্যক্তিত্ব। একপর্যায়ে ব্রাইটনের মেয়র নিজেই উদ্যোগী হন রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর শহরে একটা ফলক বসানোর ব্যাপারে। তিনি এর মাধ্যমে তাঁর শহরের একটা পর্যটন গুরুত্বও অনুধাবন করেন। ইতিমধ্যে খোঁজখবর নিয়ে ৭ শিপ রোডের ‘ডু ভিন’ হোটেল কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তারা টের পায় এতে করে মুহূর্তে তাদের এই সাধারণ হোটেলটি পেয়ে যাবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মেয়র ঘোষণা দেন, বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনিই এই ফলক উন্মোচন করবেন। মেয়র জানকেই অনুরোধ করেন এই অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব নিতে এবং জানান, তাঁকে সব রকম প্রশাসনিক এবং আর্থিক সহায়তা দেবেন। জান ব্যাপক উৎসাহে নেমে পড়েন অনুষ্ঠান আয়োজনে। আমার সঙ্গে জানের পরিচয় সেই কাকতালীয় মুহূর্তে, যখন তিনি এই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ-ও জানলাম, সেই ফলক উন্মোচনের তারিখ পরের মাসেই।
পুরো বিষয়টার এই অদ্ভুত সমাপতনে আমি স্বভাবতই আনন্দিত, বিস্মিত। কিন্তু জানতাম না, আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। পরিচয়ের পরের সপ্তাহেই জানের কাছ থেকে মেইল পেলাম। জান আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে। আমার সহকর্মী মারফত এবং অন্যান্য সূত্র থেকে ইতিমধ্যে আমার লেখক পরিচয়ের খোঁজ পেয়ে গেছেন জান। তিনি জানালেন, অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেবেন লন্ডনের টেগোর সেন্টারের পরিচালক ড. কল্যাণ কুণ্ডু। অনুষ্ঠানের ফলক উন্মোচন করবেন ব্রাইটনের মেয়র, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ব্রিটেনে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই হাইকমিশনারকে। জান বললেন, ব্রাইটনবাসী বাংলাদেশি একজন লেখক হিসেবে আমার এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখা প্রাসঙ্গিক হবে। এ আমন্ত্রণকে আমি বিশেষ সম্মান হিসেবেই গ্রহণ করি এবং সাগ্রহে রাজি হই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি সেই দিনটির।
অবশেষে ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর হয় সেই ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের দিনের নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে হাজির হই ৭ শিপ স্ট্রিটে। একটা চাপা উত্তেজনায় হোটেলের করিডর দিয়ে ধীরে ঢুকে পড়ি অক্ষত রাখা শতাব্দীপ্রাচীন সেই স্কুলের ক্লাসরুমে। আজ থেকে প্রায় দেড় শ বছর আগে এই ক্লাসরুমেই বসে থাকা কিশোর রবীন্দ্রনাথের কথা ভাবি। এই স্কুলে কয়েক মাস পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পড়াশোনায় বিশেষ অগ্রগতি হচ্ছিল না দেখে তাঁকে পরে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলাত ভ্রমণে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার সবই সুখকর ছিল না। তবে এই ব্রাইটন প্রিপারেটরি স্কুল নিয়ে আনন্দের স্মৃতির কথাই লিখেছেন তিনি। লিখেছেন, এই স্কুলের ছেলেরা তাঁর সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করেনি বরং মাঝে মাঝে তাঁর কোটের পকেটে আপেল কিংবা কমলা গুঁজে দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে।
ব্রিটিশ কায়দায় অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে, পতাকা তুলে মেয়র উন্মোচন করলেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিফলক। তারপর ব্রাইটনের সেই রাজপথে হঠাৎ যেন জমল এক মিলনমেলা। সমবেত ব্রিটিশ, ভারতীয়, বাংলাদেশি অধিকাংশই একে অন্যকে চেনেন না কিন্তু এক জায়গায় তাঁদের আত্মার মিল। তাঁরা সবাই রবীন্দ্রপ্রেমী। তাঁরা আলাপ জুড়লেন। এক বয়স্ক ব্রিটিশ নারী উৎসাহে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, তিনি আমাকে একটা জিনিস দেখাতে চান। তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলেন। দেখলাম রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির অনুবাদের বহু পুরোনো একটা সংস্করণ। জানালেন, এটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ। এরপর তিনি বইটির প্রথম পৃষ্ঠা উল্টে আমাকে দেখালেন কালো কালিতে উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা স্বাক্ষর। মহিলা বললেন, এই বই পারিবারিক সম্পদ হিসেবে তাঁরা সংরক্ষণ করছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ফাউন্টেন কলমে লেখা রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফটি একটু ম্লান হয়েছে, আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। মিলনমেলা ভাঙলে ফিরতি পথে ব্রাইটনের সমুদ্রপাড়ে হাঁটি।
গায়ে এসে লাগে সমুদ্রের হাওয়া। বিদেশ-বিভূঁইয়ের এই অচেনা সৈকতে তাঁর গানই জেগে ওঠে মনে: ‘আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন যে তার গেল খুলে/তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্ অচেনার ধারে।।’
সম্প্রতি প্রায় দেড় শ বছর পর বিলাতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম ঠিকানাটি খুঁজে বের করা হলো এবং সেখানে বসানো হলো একটা ফলক। সুযোগ হলো সেই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। সে গল্পটাই শোনাই।
রবীন্দ্রনাথকে প্রথম বিলাতে পাঠানো হয়েছিল ১৮৭৮ সালে, ব্যারিস্টারি পড়তে। তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। তখনকার ভারতীয় অভিজাত পরিবারের অনেকেই বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তে আসতেন। সে সময়ে বিলাতের নানা শহরেই ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ছড়িয়ে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ উঠেছিলেন ব্রাইটন শহরে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সে বাড়ি ব্রাইটন শহরেরই প্রান্তে হোভ এলাকায়। বাড়ির নাম ছিল ‘মেডিনা ভিলা’। পাঠক হিসেবে এ তথ্য জানা ছিল আমার। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল এই কারণে, এ শহরেই আমার কর্মস্থল সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়। থাকি ব্রাইটনের গা-ঘেঁষা এক শহরে। নিত্যদিন বিলাতের যে শহরে আসা-যাওয়া করি, সে শহরের যে বাড়িটাতে রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন, তার সামনে দাঁড়াবার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু মেডিনা ভিলার খোঁজ কেউ দিতে পারে না। প্রথম বিলাতযাত্রার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তিনি যখন জানলেন ব্রাইটনের মেডিনা ভিলা নামে এক বাড়িতে থাকবেন, তখন তিনি বেশ উত্তেজিত ছিলেন এই ভেবে, এ নিশ্চয়ই গাছগাছালি, পাখপাখালি ঘেরা এক বিশাল বাড়ি হবে। কিন্তু এসে হতাশ হয়েছিলেন। কারণ, সে বাড়িটা ছিল সারি বাঁধা অসংখ্য বাড়ির একটি মাত্র। এর আশপাশে গাছপালা বিশেষ ছিল না। তবে তাঁর একটাই সান্ত্বনা ছিল, বাড়িটা সমুদ্রের ধারে। এ ধরনের গায়ে গায়ে লাগোয়া বাড়ির সারিকে বিলাতে বলে ‘ট্যারেস হাউস’।
গাছগাছালি ভরা একক ভিলাও বিস্তর আছে। তবে ভারতে ধনবান হলেও বিলাতে তেমন বিলাসবহুল বাড়িতে থাকার সংগতি বা ইচ্ছা হয়তো ছিল না ঠাকুর পরিবারের। আর ব্রাইটন তো সমুদ্রেরই শহর। পাথুরে সৈকতে ভ্রমণ করতে সে দেশের নানা অঞ্চল থেকে মানুষ সুযোগ পেলেই চলে আসে ব্রাইটনে। বোঝা যায়, বাড়ির পাশের সমুদ্র রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিল স্বস্তির। সেই সমুদ্রের পাড়ে আমি হাঁটি প্রায়ই, দেখি সমুদ্রের দিকে মুখ করা সারি সারি বাড়ি। কিন্তু এর মধ্যে কোনটা যে সেই বিশেষ বাড়ি, সেটা জানার তো উপায় নেই।
কিন্তু ভবের লীলা বলে কথা। কাকতালীয় ঘটনা ঘটে একদিন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মীর সুবাদে ঘটনাক্রমে একদিন পরিচয় ঘটে ব্রাইটনবাসী ব্রিটিশ বাউলবিষয়ক গবেষক জান ওপেনশের (Jeanne Openshow) সঙ্গে। তাঁর নামের উচ্চারণ ঠিক কী হবে, এ নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম। জিজ্ঞেস করাতে চমৎকার বাংলা বলতে পারা ওই ব্রিটিশ নারী ঠাট্টা করে বললেন, ‘জান আমার নাম। প্রাণের কথা মনে থাকলে জানের কথাও মনে থাকবে।’ জান বেশির ভাগ সময়ই গবেষণার কাজে শান্তিনিকেতনের কাছে বোলপুরে থাকেন। মাঝে মাঝে ব্রাইটনে আসেন তাঁর বাড়িতে। পরে দেখেছি বাউলদের ওপর Seeking Baul’s of Bengal নামে চমৎকার গবেষণামূলক বই আছে জানের। তাঁকে রবীন্দ্রনাথের বাড়ির প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘আমি ব্রাইটনবাসী, থাকি শান্তিনিকেতনে আর রবীন্দ্রনাথের ব্রাইটের বাড়ি নিয়ে আমার কৌতূহল থাকবে না, তা কি হয়?’ তারপর জান আমাকে জানালেন অভিযানের বিস্তারিত কাহিনি এবং আমাদের এই পরিচয় যে বেশ এক অদ্ভুত কাকতালীয় মুহূর্তে ঘটল, জানালেন সেটাও।
ঘটনা এই, আমার মতোই জান দীর্ঘদিন হোভের সেই মেডিনা ভিলা খুঁজে বেরিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিচারণায় মেডিনা ভিলা নাম লিখলেও তার কোনো সুনির্দিষ্ট ঠিকানা লেখেননি। জান এই শহরের পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটেও এই বাড়ির কোনো হদিস করতে পারেননি। হয়তো ভেঙেই ফেলা হয়েছে সেই বাড়ি। কিন্তু জান নাছোড়বান্দা। তাঁরই শহরে রবীন্দ্রনাথ দিন কাটিয়ে গেছেন অথচ রবীন্দ্রনাথের কোনো স্মৃতিচিহ্ন এই শহরে থাকবে না, সেটা তিনি মানতে পারছিলেন না। জান তখন বিকল্প পথ ধরলেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকে জানা গেছে, ব্যারিস্টারি পড়ার প্রস্তুতি হিসেবে তাঁকে প্রথম ভর্তি করানো হয়েছিল ব্রাইটন প্রিপারেটরি নামে একটা স্কুলে। তিনি সেই স্কুলের সন্ধানে নামলেন। সে স্কুল এখন নেই কিন্তু স্কুলটির ইতিহাস পাওয়া গেল। জানা গেল সেই স্কুলের নির্দিষ্ট ঠিকানাও। স্কুলটি ছিল ব্রাইটন শহরের একেবারে কেন্দ্রেই, ৭ নম্বর শিপ স্ট্রিটে। সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখতে পেলেন এখন সেটা একটা পুরোদস্তুর চার তারকা হোটেল, নাম ডু ভিন। হোটেল কর্তৃপক্ষ ইতিহাসের স্বার্থে সেই স্কুলের একটা ক্লাসরুম এবং কিছু অংশ গত শতাব্দীর মতোই অবশ্য অক্ষত রেখেছে। জান এই আবিষ্কারে যারপরনাই উত্তেজিত। হোটেল কর্তৃপক্ষকে এই তথ্য দেওয়াতে তাদের ভেতর বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।
কারণ, রবীন্দ্রনাথ বলে কারও নাম তারা কখনো শোনেনি। এরপর শুরু হলো জানের ভিন্নতর যাত্রা। তিনি ঠিক করলেন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি যখন পাওয়া গেল না, এই স্কুলটিতেই তিনি রবীন্দ্রনাথের একটা ফলক বসাবেন। ইউরোপের কোনো শহরে জগৎখ্যাত কোনো ব্যক্তির পদচারণা থাকলে সেখানে একটা ফলক লাগিয়ে তাঁকে স্মরণ করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু জান চাইলেই তো আর ব্যক্তিগতভাবে এমন একটা ফলক বসিয়ে দিতে পারেন না। শহরের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। সে নানা জটিল প্রক্রিয়া। জান ব্রাইটন শহরের মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর এই প্রস্তাব দিতে মেয়র সাহেব টেগোর নামটিকে খানিকটা স্মরণ করতে পারলেও তার গুরুত্ব ঠিক অনুধাবন করলেন না। বলা বাহুল্য, ভারত বিষয়ে উৎসাহী কিছু মানুষের বাইরে রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রতিক ইউরোপের কোনো পরিচিত নাম নন। কিন্তু জান মেয়রকে নানা রকম তথ্য সরবরাহ করতে থাকেন।
মেয়র নিজেও তখন খোঁজখবর করতে শুরু করেন। তিনি জানতে পারেন, ইউরোপের বাইরে তিনিই প্রথম নোবেল বিজয়ী। আরও জানতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব টালমাটাল ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রীতিমতো এক তারকা ব্যক্তিত্ব। একপর্যায়ে ব্রাইটনের মেয়র নিজেই উদ্যোগী হন রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর শহরে একটা ফলক বসানোর ব্যাপারে। তিনি এর মাধ্যমে তাঁর শহরের একটা পর্যটন গুরুত্বও অনুধাবন করেন। ইতিমধ্যে খোঁজখবর নিয়ে ৭ শিপ রোডের ‘ডু ভিন’ হোটেল কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তারা টের পায় এতে করে মুহূর্তে তাদের এই সাধারণ হোটেলটি পেয়ে যাবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মেয়র ঘোষণা দেন, বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনিই এই ফলক উন্মোচন করবেন। মেয়র জানকেই অনুরোধ করেন এই অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব নিতে এবং জানান, তাঁকে সব রকম প্রশাসনিক এবং আর্থিক সহায়তা দেবেন। জান ব্যাপক উৎসাহে নেমে পড়েন অনুষ্ঠান আয়োজনে। আমার সঙ্গে জানের পরিচয় সেই কাকতালীয় মুহূর্তে, যখন তিনি এই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ-ও জানলাম, সেই ফলক উন্মোচনের তারিখ পরের মাসেই।
পুরো বিষয়টার এই অদ্ভুত সমাপতনে আমি স্বভাবতই আনন্দিত, বিস্মিত। কিন্তু জানতাম না, আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। পরিচয়ের পরের সপ্তাহেই জানের কাছ থেকে মেইল পেলাম। জান আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে। আমার সহকর্মী মারফত এবং অন্যান্য সূত্র থেকে ইতিমধ্যে আমার লেখক পরিচয়ের খোঁজ পেয়ে গেছেন জান। তিনি জানালেন, অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেবেন লন্ডনের টেগোর সেন্টারের পরিচালক ড. কল্যাণ কুণ্ডু। অনুষ্ঠানের ফলক উন্মোচন করবেন ব্রাইটনের মেয়র, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ব্রিটেনে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই হাইকমিশনারকে। জান বললেন, ব্রাইটনবাসী বাংলাদেশি একজন লেখক হিসেবে আমার এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখা প্রাসঙ্গিক হবে। এ আমন্ত্রণকে আমি বিশেষ সম্মান হিসেবেই গ্রহণ করি এবং সাগ্রহে রাজি হই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি সেই দিনটির।
অবশেষে ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর হয় সেই ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের দিনের নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে হাজির হই ৭ শিপ স্ট্রিটে। একটা চাপা উত্তেজনায় হোটেলের করিডর দিয়ে ধীরে ঢুকে পড়ি অক্ষত রাখা শতাব্দীপ্রাচীন সেই স্কুলের ক্লাসরুমে। আজ থেকে প্রায় দেড় শ বছর আগে এই ক্লাসরুমেই বসে থাকা কিশোর রবীন্দ্রনাথের কথা ভাবি। এই স্কুলে কয়েক মাস পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পড়াশোনায় বিশেষ অগ্রগতি হচ্ছিল না দেখে তাঁকে পরে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলাত ভ্রমণে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার সবই সুখকর ছিল না। তবে এই ব্রাইটন প্রিপারেটরি স্কুল নিয়ে আনন্দের স্মৃতির কথাই লিখেছেন তিনি। লিখেছেন, এই স্কুলের ছেলেরা তাঁর সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করেনি বরং মাঝে মাঝে তাঁর কোটের পকেটে আপেল কিংবা কমলা গুঁজে দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে।
ব্রিটিশ কায়দায় অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে, পতাকা তুলে মেয়র উন্মোচন করলেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিফলক। তারপর ব্রাইটনের সেই রাজপথে হঠাৎ যেন জমল এক মিলনমেলা। সমবেত ব্রিটিশ, ভারতীয়, বাংলাদেশি অধিকাংশই একে অন্যকে চেনেন না কিন্তু এক জায়গায় তাঁদের আত্মার মিল। তাঁরা সবাই রবীন্দ্রপ্রেমী। তাঁরা আলাপ জুড়লেন। এক বয়স্ক ব্রিটিশ নারী উৎসাহে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, তিনি আমাকে একটা জিনিস দেখাতে চান। তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলেন। দেখলাম রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির অনুবাদের বহু পুরোনো একটা সংস্করণ। জানালেন, এটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ। এরপর তিনি বইটির প্রথম পৃষ্ঠা উল্টে আমাকে দেখালেন কালো কালিতে উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা স্বাক্ষর। মহিলা বললেন, এই বই পারিবারিক সম্পদ হিসেবে তাঁরা সংরক্ষণ করছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ফাউন্টেন কলমে লেখা রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফটি একটু ম্লান হয়েছে, আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। মিলনমেলা ভাঙলে ফিরতি পথে ব্রাইটনের সমুদ্রপাড়ে হাঁটি।
গায়ে এসে লাগে সমুদ্রের হাওয়া। বিদেশ-বিভূঁইয়ের এই অচেনা সৈকতে তাঁর গানই জেগে ওঠে মনে: ‘আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন যে তার গেল খুলে/তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্ অচেনার ধারে।।’
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
৩ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২১ দিন আগে