ছেলেরে মাইরালছে, দেখার মতো কেউ রইল না: গুলিতে নিহত মাসুমের মায়ের আহাজারি

রাজেশ গৌড়, দুর্গাপুর (নেত্রকোনা)
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৪, ১৬: ২০

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন রাজমিস্ত্রি মাসুম বিল্লাহ। তাঁর উপার্জনের টাকাই চলত সংসার। মা-বাবা, বোন ও স্ত্রী নিয়েই ছিল ছোট্ট সংসার। আয় অল্প হলেও এতেই খুশি ছিল পরিবারের সবাই। সব মিলিয়ে ছোট্ট সংসারটি চলছিল অনেকটাই হাসি–খুশিতেই। কিন্তু দুটি গুলিতে এ পরিবারের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।

গত ৫ আগস্ট (সোমবার) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ নেয় মাসুম বিল্লাহ (২৪)। পথে গাজীপুরের মাওনা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হলে এরপরই সেখানকার লোকজন তাঁকে ভালুকা হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বজনরা গিয়ে মরদেহ নিয়ে ওইদিন রাতেই গ্রামের বাড়ি ফিরে। পরদিন ৬ আগস্ট (মঙ্গলবার) সকাল ১০টার দিকে জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় তাঁকে।

নিহত মাসুম বিল্লাহর বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার ২ নম্বর দুর্গাপুর ইউনিয়নের নলুয়াপাড়া গ্রামে। সেখানে বাবা-মা, দুই বোন ও স্ত্রী নিয়েই বাস ছিল তাঁর। তবে মাসুম বিল্লাহ জীবিকার তাগিদে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন মাওনা নয়নপুরে। বাবা সাইদুর রহমান কৃষক। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাসুম বিল্লাহ দ্বিতীয়। এদিকে মাসুমের এমন মৃত্যুতে পরিবার, স্বজনসহ পুরো এলাকায় চলছে শোকের মাতম।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিন মাসুমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের মৃত্যুতে কেঁদেই চলছেন মা। তাঁর পাশে বসা মাসুমের স্ত্রী স্বামীকে হারিয়ে শোকে যেন পাথর। বারবার কান্না আহাজারি করছেন বোনরা। বাবা বারবার ছেলের কবরস্থানে ঘুরপাক খাচ্ছেন। এই সময় উপস্থিত স্বজনদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দরিদ্র পরিবার হওয়ায় মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও পড়াশোনা করা হয়নি মাসুম বিল্লাহর। বাবা অন্যের জমিতে ধান চাষ করতেন। তাই সংসারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই কাজে লেগে যান মাসুম। তাঁর উপার্জনের টাকায় সংসার চালানোসহ তিন বোনকে বিয়ে দিয়ে ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার। দুবছর আগে নিজেও বিয়ে করেছেন। পরিবার নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু গুলিতে সবকিছুই শেষ। তাঁকে হারিয়ে পরিবারেরও সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এর আগে গত সপ্তাহের রোববার বাড়িতে এসেছিলেন মাসুম। তবে এদিন এসে দিনেই ফিরে যান কর্মক্ষেত্রে। 

গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে মাওনা ব্রিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এরপরই খবর পেয়ে স্বজনরা গিয়ে মরদেহ নিয়ে ওই দিন রাতেই গ্রামের বাড়ি ফিরে। পরদিন সকালে জানাজা শেষে দাফন করা হয় তাঁকে।

ছেলে হারানোর দুঃখে কথাই বলতে পারছিলেন না বাবা সাইদুর রহমান। বুকভরা কষ্ট নিয়ে শুধু বললেন,‘আমার অবলম্বন আর কিছুই রইল না।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাসুম বিল্লাহর মা মুর্শিদা আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলেরে গুলিতে মাইরালছে। আমি কেমনে বাঁচবাম, আমাদের মাথার ওপর থেকে যেন বটগাছটাই সরে গেল। এখন আর আমাদের দেখার মতো কেউ রইল না।’

নিহত মাসুম বিল্লাহ খালা সাবিনা আক্তার জানান, মাসুম ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার অকালে চলে যাওয়ায় যেন পুরো পরিবারে কষ্ট নেমে এসেছে। পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ আর নাই। পাঁচটা বোনের একমাত্র আদরের ভাই ছিল। 

তিনি আরও জানান, ঘটনার দিন বেলা তিনটার দিকে মাসুম বিল্লাহর ফোন থেকে কল আসে এক ব্যক্তির। তিনি জানায় মাসুমের শরীরে গুলি লেগেছে। সে ভালুকা সরকারি হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি সেখানে যাওয়ার জন্য বলা হয়। এরপরই নিজস্ব লোকজন সেখান থেকে লাশ নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে। তার এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে সংসার চালানোর একমাত্র ব্যক্তি হারিয়ে দিশেহারা পরিবার।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত