টানেলে যুক্ত কর্ণফুলীর দুই পাড়

সবুর শুভ, চট্টগ্রাম
Thumbnail image

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে। ১১ বছর আগে চট্টগ্রামে এসে এই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল বা সুড়ঙ্গপথ বাস্তবায়ন কাজে হাত দিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে তিনি চীনের সাংহাই সিটির আদলে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ গড়ার স্বপ্ন দেখান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম হবে সাংহাই। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম পাতাল সুড়ঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ নির্মাণকাজ অবশেষে চূড়ান্ত।

চার লেনের টানেলে আছে দুটি টিউব। প্রতিটি টিউব ৩৫ ফুট চওড়া, ১৬ ফুট উঁচু। দুই টিউবের মধ্যবর্তী ব্যবধান ১১ মিটার। সুড়ঙ্গটির মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। তবে এর সঙ্গে উভয় পারের ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক যুক্ত হয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে আছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে।

টানেলটির নির্মাণকাজ করছে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রতি টিউবে দুই লেন করে রাস্তা। দুই প্রান্তের আনোয়ারা অংশে (পতেঙ্গা অংশে নেই) বিশাল টোল প্লাজা। এক সারিতে একই সঙ্গে ১৪টি যানবাহনের টোল আদায় করা হবে। এই কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য আছে সিসি ক্যামেরা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে টোল পরিশোধের পর সামনে থাকা বড় ডিসপ্লে বোর্ডে তা দেখানো হবে।

যানবাহন টানেলে ঢোকা ও বেরোনোর সময় এই টোল আদায় করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরপর টানেলে ঢুকে পড়বে গাড়ি। উভয় প্রান্তে যাত্রীদের স্বাগত জানানোর জন্য থাকছে ডিজিটাল স্ক্রিন। ভেতরে বিভিন্ন নির্দেশনা চোখে পড়বে। টানেলে তিনটি রং ব্যবহার করা হয়েছে। দুই পাশের দেয়াল রুপালি ও লাল রঙে সাজানো। ওপরের অংশে কালো রং। দুই প্রান্তের সড়ক, গোলচত্বরও সাজানো। পতেঙ্গা অংশে বিশাল সমুদ্রসৈকত। সাগরের নীল জলরাশি আর সারি সারি জাহাজ অন্য রকম মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেবে সুড়ঙ্গপথের যাত্রীদের।

উদ্বোধন আজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার এই টানেলের উদ্বোধন করবেন। তিনি পতেঙ্গায় কর্ণফুলীর পশ্চিম তীরে একটি এবং টানেল পার হয়ে বেলা ১১টায় আনোয়ারায় নদীর দক্ষিণ তীরে আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলার মধ্যে কর্ণফুলীর তলদেশে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত টানেলটি সোমবার সকাল ৬টা থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করবেন। প্রধানমন্ত্রী একটি বিশেষ স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী দিনের খাম এবং প্রথম পানির নিচের সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধন উপলক্ষে একটি বিশেষ সিলমোহরও প্রকাশ করবেন।
পরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) মাঠে এক জনসভায় ভাষণ দেবেন। 
বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার, মহেশখালী ও মিরসরাই অঞ্চল পর্যন্ত অর্থনৈতিক হাব (কেন্দ্র) গড়ে তোলার মূল অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে এই টানেল। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও যোগাযোগের অপরিহার্য করিডর। এই টানেলের চোখ দিয়েই পুরো বিশ্ব দেখবে চট্টগ্রামকে, বাংলাদেশকে। দুই প্রান্তের অর্থনীতি ও যোগাযোগব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসা টানেল হয়ে উঠবে সমৃদ্ধি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মোক্ষম হাতিয়ার। এই টানেল বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করবে।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, এই টানেল দেশের পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। পদ্মা সেতুর মতো এ টানেলও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। তবে চট্টগ্রাম অঞ্চল ঘিরে মেগা প্রকল্পগুলোর সুফল পেতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের কোনো বিকল্প নেই।
চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল এই টানেল।

মেয়র থাকাকালেও তিনি এই দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। গত বছরের ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীই প্রথম কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কথা বলেছিলেন। এটা তাঁর দাবি ছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরী বেঁচে থাকলে অনেক বেশি খুশি হতেন। অন্যদিকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাকে উপশহর হিসেবে গড়ে তোলার বাসনা ছিল আওয়ামী লীগের আরেক নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর। টানেলের সুবাদে সেই আনোয়ারা আজ আলোকময়। 

৩ মিনিটে পারাপার  
এই টানেলের পতেঙ্গা অংশ থেকে আনোয়ার অংশে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩ মিনিট। গাড়িতে এই ৩ মিনিটে ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে গাড়ির গতিসীমা রাখতে হবে নির্ধারিত ৬০ কিলোমিটারে। টানেলে প্রথম দিকে গাড়ি চলাচল করার গতিসীমা নির্ধারিত রাখা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। তবে ৮০ কিলোমিটার গতিবেগে গাড়ি চলাচল করতে পারবে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষার তথ্যমতে, টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সাল নাগাদ গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬ এবং ২০৬৭ সালে ধরা হয়েছে প্রতিদিন ১ লাখ ৬২ হাজার।

ভূমিকম্প সহনীয় 
রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প-সহনীয় করে নির্মাণ করা হয়েছে এই টানেল। সেতু নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৌশলীরা জানান, মাটির ২০ ফুট নিচে ভূমিকম্পের আঁচও তেমন লাগে না। টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের কাজ করবে সিসিসিসি। এটা করতে ৯৮৪ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে সরকারের সঙ্গে।  প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, নদীর তলদেশ থেকে ২০ ফুট নিচে ভূমিকম্পের কোনো আঁচ লাগবে না। নির্মাণকাজে পাঁচ বছরও লাগেনি ২০১৫ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরকালে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ঋণচুক্তি সই হয়।

চুক্তি অনুযায়ী চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে ঋণ দিয়েছে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। বাকি অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

কাজের শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ হাজার ৩৩ টাকায় ঠেকে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামের লোক এবং টানেলও চট্টগ্রামে। সব মিলিয়ে এত বড় উন্নয়নের সারথি হতে পেরে আমি গর্বিত।’

 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

দেওয়ানি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে একগুচ্ছ সুপারিশ কমিশনের

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত