Ajker Patrika

হাজার গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের টালবাহানা

সবুজ শর্মা শাকিল, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)
আপডেট : ৩০ মে ২০২৪, ২০: ৫৪
Thumbnail image

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভায়েরখীল এলাকার সত্তরোর্ধ্ব ছকিনা বেগম ২০১১ সালে তাঁর একমাত্র মেয়ে মনোয়ারা বেগমের নামে মাসিক ২০০ টাকা করে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সে ১২ বছরের জন্য একটি ডিপিএস করেন। ২০২১ সালে মেয়াদ পূর্তির পর প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের সহকারী ম্যানেজার খদিজা বেগমের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দেওয়ার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তাঁর সঞ্চিত টাকা ফেরত পাননি তিনি। 

শুধু সকিনা বেগম নন, মেয়াদ পূর্তির তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো টাকা পাননি সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ভায়েরখীল ও আলী চৌধুরীপাড়া এলাকার ফিরোজা, নাসিমা, মনোয়ারা বেগম, পারভীন আক্তারসহ অনেক গ্রাহক। টাকা পেতে জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে হন্য হয়ে ঘুরছেন। 

প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের সীতাকুণ্ড শাখা অফিসের ইনচার্জ মো. নুর উদ্দিন বলেন, ‘সীতাকুণ্ড শাখায় বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা রাখা প্রায় এক হাজার গ্রাহকের মেয়াদ পূর্তি হয়েছে। এসব গ্রাহক এক কোটি টাকা পাবেন।’ 

ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, মেয়াদ পূর্তির পর তাঁদের কাছ থেকে ডিপিএসের বইসহ টাকা জমানো বিভিন্ন প্রকল্পের বই ও প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র মাঠকর্মী নিরুয়া আক্তার ও সংস্থাটির বি এম মনোয়ারা বেগমের মাধ্যমে জমা নেন সহকারী ম্যানেজার খদিজা বেগম। জমা নেওয়ার সময় মাসখানেকের মধ্যেই সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করে তাঁদের হাতে চেক তুলে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু মাস পেরিয়ে তিন বছর অতিবাহিত হলেও এখনো তাঁদের হাতে চেক তুলে দিতে পারেননি তাঁরা। যখনই তাঁদের কাছে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে যান, তখন তাঁরা কথা বলতে অনীহা প্রকাশের পাশাপাশি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে গ্রাহকেরা তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী সীতাকুণ্ড পৌর সদরের অফিসে ছুটে গেলে নানা ধরনের জটিলতার কথা বলে তাঁদের তাড়িয়ে দেন। 

তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়াদ উত্তীর্ণের পর এসব গ্রাহকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা নেওয়ার পাশাপাশি তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন। তাঁরা বিধি মেনেই গ্রাহকদের মেয়াদোত্তর সুবিধার চেক প্রদানের চেষ্টা করছেন। কিন্তু অর্থসংকটের কারণেই চেক ছাড় না দেওয়ায় তাঁরা সঠিক সময়ে গ্রাহকের হাতে চেক তুলে দিতে পারেননি। 

গতকাল বুধবার রাতে উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ভায়েরখীল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেয়াদ উত্তীর্ণের তিন বছর পরও চেক না পাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে অর্ধশতাধিক গ্রাহক প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের সহকারী ম্যানেজার খদিজা বেগমের বাড়ি ঘেরাও করেন। এ সময় উত্তেজিত গ্রাহকেরা তাঁদের টাকা ফেরত দিতে খাদিজার ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। একপর্যায়ে সেখানে ছুটে আসেন বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জহির। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির সমাধান ও ভুক্তভোগীদের পাশে থেকে তাঁদের সহযোগিতার আশ্বাস দিলে তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। 

ভুক্তভোগী গ্রাহক নাসিমা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, খদিজার মাধ্যমে তিনি প্রতি মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ১২ বছরের জন্য ডিপিএস করেন। কিন্তু তাঁকে প্রতি মাসে ২ হাজার ৩০০ টাকা জমা করার রসিদ প্রদান করেন। রসিদে না থাকা টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তা মেয়াদ পূর্তি শেষে বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে খাদিজা জানান। তিনি ২০২১ সালে মেয়াদ শেষে অফিসে কাগজপত্র জমা দেন। এর পর থেকে খাদিজার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি অফিসের শতাধিকবার গিয়েও তাঁর প্রাপ্য টাকার চেক মিলেনি। কবে নাগাদ দেওয়া হবে, সে বিষয়টি বলতে নারাজ অফিসে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।

ভুক্তভোগী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমি ১২ বছরের জন্য এককালীন ৫০ হাজার টাকা জমা রেখেছি। সেই সঙ্গে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে ডিপিএসও। দুটোর মেয়াদ তিন বছর আগেই পূর্ণ হয়েছে। মেয়াদ পূর্তির পর খাদিজার মাধ্যমে অফিসে কাগজ জমা দিয়েছি। কিন্তু দীর্ঘ তিন বছর অতিবাহিত হলেও এখনো টাকার কোনো সুরাহা মেলেনি।’

তিনি আরও বলেন, টাকার বিষয়ে জানতে খাদিজার কাছে ছুটে গেলে তিনি সীতাকুণ্ড অফিসে যেতে বলেন। আর সীতাকুণ্ড অফিসে গেলে সেখানে থাকা কর্মকর্তারা হেড অফিসে যোগাযোগের কথা বলে অনেকটাই তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করেই তাড়িয়ে দেন। 

প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের বি এম মনোয়ারা বেগম ও মাঠকর্মী নিরু বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ইনস্যুরেন্স সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা নেই। গ্রাহক সংগ্রহ ও টাকা উত্তোলনের কাজ করতে খাদিজা চাকরি দিয়েছিল। তাঁরা খাদিজার পরামর্শে নতুন গ্রাহককে বুঝিয়ে ইনস্যুরেন্স করানোর পাশাপাশি প্রতি মাসের টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে তুলে খাদিজার হাতে এনে জমা দিতেন। 

বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জহির আজকের পত্রিকাকে বলেন, মেয়াদ পূর্তির পর টাকা না পাওয়া শতাধিক বিক্ষুব্ধ গ্রাহক ইনস্যুরেন্স কর্মকর্তা খাদিজাকে অবরুদ্ধ করেন। তিনি বিক্ষুব্ধ গ্রাহকদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। 

এরপর তিনি ভুক্তভোগী বেশ কিছু গ্রাহককে নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সংস্থাটির সীতাকুণ্ড শাখা অফিসে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সেখানে দায়িত্বরত কোনো কর্মকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেষে অফিস ইনচার্জ নুর উদ্দিনের সঙ্গে কথা বললে তিনি গ্রাহকের টাকা কবে নাগাদ ফেরত পাবে সে বিষয়ে অবগত নন বলে জানান। 

শতাধিক গ্রাহকের টাকা না পাওয়ার বিষয়টি সত্যি জানিয়ে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের সহকারী ম্যানেজার খাদিজা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, কর্মীদের গাফিলতির কারণে মেয়াদ পূর্তির পরও সঠিক সময়ে কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি। তবে সময়ক্ষেপণ করে জমা দিলেও প্রতিষ্ঠানের অর্থসংকটের কারণে গ্রাহকের সঞ্চিত টাকার চেক দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জুলাই মাসে এসব গ্রাহকদের চেক দেওয়া হবে বলে হেড অফিস থেকে তাঁকে জানানো হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে জুলাই মাসে চেক মিলবে কি না সে বিষয়েও সন্দিহান।

এ বিষয়ে জানতে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের সীতাকুণ্ড শাখা অফিসের ইনচার্জ মো. নুর উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, সীতাকুণ্ড শাখায় ডিপিএস, মেয়াদি বিমাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা রাখা প্রায় এক হাজার গ্রাহকের মেয়াদ পূর্তি হয়েছে। এসব গ্রাহকেরা এক কোটি টাকা পাবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের অর্থসংকটের কারণে তাঁরা এই মুহূর্তে টাকা ছাড় দিতে পারছেন না। জুলাই মাসে সারা দেশে সংস্থাটির যতগুলো অফিস রয়েছে, সে অফিসগুলোর জন্য দুই কোটি টাকা ছাড় দেবে। সেই হিসাবে তাঁরা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পাবেন। সে টাকা দিয়ে তাঁদের কিছুই হবে না।

তবে কবে নাগাদ গ্রাহকেরা টাকা পেতে পারেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, সে অবস্থা থেকে কবে উত্তোরণ ঘটবে তার কোনো ঠিক নেই। সেই হিসাবে কবে নাগাদ তাঁরা গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করতে পারবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে সময়ক্ষেপণ হলেও পর্যায়ক্রমে গ্রাহকেরা তাঁদের টাকা ফেরত পাবেন বলে তিনি আশাবাদী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত