ঘেরা দিয়ে পাহাড় কেটে নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন

সবুর শুভ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১০: ২১
আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১০: ২৬

রঙিন টিন দিয়ে বেশ উঁচু ও বড় বেষ্টনী। বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা, ওপরে বাঁশ দিয়ে ত্রিপল সাঁটানো। এর ভেতর চলছে পাহাড় কাটার যজ্ঞ। এভাবেই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীর আসকার দীঘির পাড় এলাকার রিমা কমিউনিটি সেন্টারের বিপরীতের একটি পাহাড়।

চার বছর ধরে এ পাহাড় কেটে এখানে তিনটি ভবন তৈরির কাজ চলছে। ভবনের জন্য পিলার ও রিটেইনিং দেয়াল নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে ৯২টি ফ্ল্যাটের এ বিশাল আবাসন গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) গত চার বছরে এই পাহাড় কাটা থামাতে পারেনি। 

পরিবেশ আন্দোলনকারীরা বলছেন, পরিবেশ অধিদপ্তর চার বছর আগে জরিমানা করে দায়িত্ব সেরেছে। এরপর আর কোনো ব্যবস্থার দিকে যায়নি সংস্থাটি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে একবার ওই আবাসনে অভিযান চালিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু কোনো ধরনের জরিমানা করা হয়নি। আর ওই প্রকল্প অনুমোদনের সময় দেওয়া সিডিএর শর্তগুলোর কোনোটি ভঙ্গ করলে প্রকল্প বাতিল করা হবে বলে সময় সময় হুংকার দিয়েই কর্তব্য সেরেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংস্থাটি। সংস্থাগুলোর এ ধরনের দায়িত্বহীনতার মধ্যে বেশ আরামে প্রকল্পের কাজ সারছেন নির্মাতারা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনের বেলা ওই আবাসনের বেষ্টনীর ভেতরে প্রবেশের দরজা বন্ধ থাকে। ভেতরে নিরাপত্তাপ্রহরীরা থাকেন। সন্ধ্যার পর খুলে যায় ওই গেট। রাত ১১টার পর ভেতরে ঢোকে একের পর এক ট্রাক। এরপর পাহাড় কাটা মাটিগুলো পরিবহনের কাজ চলে সারা রাত। এভাবে চলছে পাহাড় কাটা। রাস্তাসংলগ্ন বেষ্টনীর ঠিক ভেতরের অংশের টিলা খনন করার ফলে সেখানে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। 

বেষ্টনী গেটের পাশে সাঁটানো হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিট আদেশও চোখে পড়ল। ভবন নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে রিট আদেশ আনেন রিটকারীরা। কিন্তু রিটে এখানে পাহাড়ের অস্তিত্বের কথা গোপন করা হয়েছে। ওই রিটে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, প্রধান প্রকৌশলীসহ ৮ জনকে বিবাদী করা হলেও বাদ রাখা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরকে। অথচ এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ এবং পাহাড়খেকোদের আইনগতভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ক্ষমতা ও দায় পরিবেশ অধিদপ্তরই সবচেয়ে বেশি সংরক্ষণ করে। 

এ বিষয়ে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের খবর পেয়ে আমরা সরেজমিনে সেখানে যাই গত ৩০ জুলাই। সেখানে উম্মুক্তভাবে পাহাড় কাটতে দেখি। এরপর বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে জানানো হয়, কিন্তু ভবন নির্মাণ বন্ধ হয়নি।’ 

নগরীর আসকার দীঘির পাড়ের ওই পাহাড়ের ঢালের সর্বোচ্চ চূড়া ১২৭ ফুট উঁচু। সেই পাহাড় সরকারের রেকর্ডে বাড়ি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। এই জমি কয়েকবার হাতবদল হয়ে ব্যবসায়ী সজল চৌধুরী, খোকন ধর, হিমেল দাশ, সুভাষ নাথ, রনজিত কুমার দে, রূপক সেনগুপ্তসহ ৯২ জনের হাতে এসেছে। ১০ কোটি টাকায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কেনা এ জায়গা জামালখান এস এস খালেদ রোডে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের পাহাড় বলে পরিচিত। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল ইমারত নির্মাণ কমিটির কাছ থেকে তিনটি বেজমেন্ট ও ১৪ তলা (পাহাড়ে বেজমেন্ট হয় না, বাস্তবে তিনটি পার্কিং ফ্লোর ও ১৪ তলা আবাসিক মোট ১৭ তলা) ভবনের অনুমোদন নেওয়া হয়। 

এ বিষয়ে সিডিএর ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং অনুমোদনের সময় নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্যসচিব, বিশেষ প্রকল্পের চেয়ারম্যান ও ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘পাহাড় কেটে আবাসন গড়ে তোলার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আমরা এ ভবনগুলো নির্মাণে অনেক শর্ত দিয়েছি। অনেক শর্ত প্রতিপালন না করার বিষয়েও আমরা জেনেছি। এ ব্যাপারে আমরা অ্যাকশনে যাব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নিলে পাহাড় কাটা বন্ধের কাজটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’

সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আগে আমরা চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে কাজ করতে পারিনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কাউকে পাহাড় ধ্বংস করতে দেওয়া হবে না।’

পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাসের মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। 

আবাসনের মালিকদের একজন ব্যবসায়ী সজল চৌধুরীকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এরপর ফোন করা হয় অ্যাডভোকেট নিখিল কুমারকে। তিনি বলেন, ‘কোনো পাহাড় কাটা হচ্ছে না। ভবন ও পার্কিং নির্মাণের জন্য লেভেলিং ও মাটি ড্রেসিং করা হচ্ছে। পাহাড় অক্ষুণ্ন রেখেই তিনটি ভবন গড়ে তোলার জন্য সিডিএর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। জমির রেকর্ডে এখানে পাহাড় নেই।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত