ফরিদপুরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নামে গ্রাহকের কোটি টাকা নিয়ে উধাও যুবক

ফরিদপুর প্রতিনিধি
Thumbnail image
অভিযুক্ত যুবক আকরাম শেখ। ছবি: সংগৃহীত

ফরিদপুরে প্রতারণার মাধ্যমে হতদরিদ্র ও অসহায় পরিবারের প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আরব আমিরাতে (দুবাই) পাড়ি জমিয়েছেন আকরাম শেখ (৩০) নামে এক যুবক। তিনি জেলা সদরের গেরদা ইউনিয়নের ইকরি গ্রামের ইছাহাক শেখের ছেলে। এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে এই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। তবে, দীর্ঘ দেড় বছর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও চেয়ারম্যানের ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

ইউনিয়নের গোকাইল গ্রামের মৃত শেখ ফরিদের স্ত্রী রেখা বেগম (৩০) একজন ভুক্তভোগী। তিনি জানান, স্বামী বছর দু–এক আগে রং মিস্ত্রীর কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লাখ টাকা পান। আরও কিছু জমানো টাকাসহ প্রায় আড়াই লাখ টাকা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শাখায় রাখেন। কিন্তু এজেন্ট ব্যাংকিং টাকা জমা নেওয়ার নিয়মের বাইরে তাঁকে দুটি ক্যাশ চেক দেওয়া হয়। সেই চেকে নিউ বিগ বাজার নামে আকরাম শেখের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে।

রেখা বেগম বলেন, ‘আমরা অশিক্ষিত মানুষ, এত কিছু বুঝতে পারি নাই। আকরাম আমাদের বলে তার ওইখানে টাকা রাখলে মাসে লাখ প্রতি ১ হাজার করে টাকা দেবে। এ জন্য সেখানে আমার সব টাকা রাখি। কিন্তু এভাবে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাবে বুঝি নাই। এখন ছোট ছোট দুইড্যা ছাওয়াল নিয়ে বাঁচব ক্যামনে!’

রেখার মতো ইকরি গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৯০ জন দরিদ্র নারী–পুরুষের কাছ থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যান আকরাম। প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ লাখ, ২ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। এসব টাকা ব্যক্তিগতভাবে জমা করেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা।

ভুক্তভোগীরা জানান, এ ঘটনার পর টাকা চাইলে বা অভিযোগ দিতে চাইলে স্থানীয় চেয়ারম্যান শাহ মো. এমার হক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু হারিচ মিয়া ভুক্তভোগীদের হুমকি–ধামকি দিতেন। ভয়ে তাঁরা কোথাও অভিযোগ দেননি। এখন দুইজন ভুক্তভোগী থানায় জানিয়েছেন।

তবে ৫ আগস্টের পর চেয়ারম্যান ও ওই আওয়ামী লীগ নেতা দুজনেই পলাতক।

ফরিদপুর ডাচ–বাংলা ব্যাংক শাখা সূত্রে জানা যায়, আকরাম শেখ ২০২০ সালের অক্টোবরে গেরদা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে আউটলেটটির (এজেন্ট ব্যাংকিং) কার্যক্রম শুরু করেন। প্রায় তিন বছর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেলে ২০২৩ সালের আগস্টে আউটলেটটি বন্ধ করে দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এই সময়ের মধ্যে সেখানে ১ হাজার ৪১৫টি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। তবে, তাঁর মাধ্যমে গ্রাহকের কত টাকা লেনদেন হয়েছে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য দেওয়া দুষ্কর বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

গতকাল রোববার ভুক্তভোগীরা আকরাম শেখের বাড়ির সামনে জড়ো হন। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল রোববার ভুক্তভোগীরা আকরাম শেখের বাড়ির সামনে জড়ো হন। ছবি: আজকের পত্রিকা

আকরাশ শেখ এক বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। গতকাল রোববার দুপুরে ইকরি গ্রামে আকরাম শেখের বাড়ির সামনে ভিড় করে প্রায় ৭০ জন ভুক্তভোগী। প্রত্যেকেই আকরামের দেওয়া চেক নিয়ে হাজির হয়েছেন। প্রতিটি চেক নিউ বিগবাজার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। আকরামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা নৌকা ও টয় ট্রেন (মেলায় বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত) বিক্রি করা হবে, এমন খবরে ছুটে এসেছেন সবাই।

খাদিজা বেগম নীলি নামে এক বিধবা বলেন, নিজের গয়না বিক্রি করে এবং জমানো টাকাসহ ৪ লাখ টাকা ওই ব্যাংকে রেখেছিলেন। তাঁর হার্টের সমস্যা আছে। ওষুধ কেনার জন্য প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা পাবেন সেই আশায় টাকাগুলো রাখেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি! চাল–ডাল কেনার টাকাও নাই। অনেক কষ্ট করে টাকা জমায়ছিলাম।’

ওই ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সৈয়দ মাকসুদ আলী বিদু ভুক্তভোগীদের তালিকা করছিলেন। তিনিই পরে আকরাম শেখের মালামাল বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা ভুক্তভোগীদের মাঝে ভাগ করে দেন।

সৈয়দ মাকসুদ আলী বিদু বলেন, ‘আকরাম শেখ প্রথম দিকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যাংকটি পরিচালনা করে। সবাই মনে করে আকরামের ওইখানে টাকা রাখলে নিরাপদে থাকবে। এভাবেই সে অসহায় মানুষের টাকা সংগ্রহ করে। একদিন জানতে পারি সে উধাও হয়ে গেছে। এরপর মানুষ অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও টাকা পায়নি।’

ওই সময় পাশেই নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখা যায় আকরাম হোসেনের বাবা বৃদ্ধ ইছাহাক শেখকে। ছেলে এভাবে মানুষের টাকা মেরে দেওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ২৫ বছর প্রবাসে ছিলাম, এখন দেশে এসেও দিনভর অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। আমার ছেলে সব শেষ করে দিয়েছে! আমি ওর টাকা দিব কীভাবে!’

এ বিষয়ে ডাচ–বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে একজন নারী অভিযোগ করার পর আমরা তদন্ত করে তাৎক্ষণিকভাবে আটউলেটটি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এ ছাড়া অন্য কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি। আর টাকাগুলো ব্যক্তিগতভাবে লেনদেন করেছে, সেটির দায়ভার আমাদের না। তবে যেহেতু ডাচ–বাংলা ব্যাংকের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করেছে সে বিষয়ে আমরা শিগগিরই মামলা করব।’

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার জানামতে বিষয়টি নিয়ে কেউ থানায় অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত