মোস্তাকিম ফারুকী, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ঈদের ছুটি। পরিচিতদের অনেকেই ছুটছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। নিজের মনেও দিল পাখির উড়াল। কিন্তু উপায় কী। ঢাকা থেকে খুব কাছের দূরত্বও যে দুর্লঙ্ঘ হয়ে গেছে শুধু টিকিটের কারণে। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মিরাশানী গ্রামে। সেখানে যেতে আইঢাই মন নিয়ে বাস ও ট্রেনের টিকিট কত না খুঁজেছি। পাওয়া হলো কই।
কোথাও কোনো টিকিট নেই। তাই ১৯ ঘণ্টা রিকশা ভ্রমণ করে ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাই। ঘটনা শুরু থেকে বলা যাক।
গত ২৮ এপ্রিল (বুধবার) দুপুর ২টায় ওয়ারির বাসা থেকে বের হয়েছি কাঁটাবনের দিকে একটা ইফতারের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে। বাড়িতে পরিবারের সবাই একত্রিত হবে, শবে কদরকে কেন্দ্র করে বাড়িতে একটা উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হবে। সে আয়োজনে আমাকে অবশ্যই থাকতে হবে বলে তাড়া দিচ্ছিল বাড়ি থেকে। কমলাপুরে কয়েকবার সন্ধান করেছি, ট্রেনের কোনো টিকিট নেই। ২৭ রমজান বাড়িতে যেতে পারব না বলে হাল ছেড়ে দিয়েছি, ঢাকার কাজেই মনোযোগ দিয়েছি। কাঁটাবনে ইফতার শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পরিচিতদের সঙ্গে বেশ ভালো সময় কাটাচ্ছিলাম। রাত ১২টার দিকে ভর্তা বাড়িতে ইমরান ভাইয়ের সৌজন্যে একটা খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়।
খাওয়াদাওয়া শেষে সৈকত ভাইয়ের উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে আবারও আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলে। হঠাৎ মোবারক ভাই বলেন, ‘রাত অনেক হয়েছে বাসার দিকে চলে যা।’ সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ওয়ারির উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠলাম। কথায় কথায় জানা গেল, রিকশাওয়ালা ভদ্রলোকের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। টিএসসি থেকে উদ্দেশ্য ছিল ওয়ারি যাব। তখন তিনি গলা ছেড়ে মনের সুখে গান গাইছিলেন, ‘অ ছখিনা, গেচছ কি না ভুইল্ল্যা আমারে। আমি অহন রিসকা চালাই ঢাহা শহরে।’ গান শুনে আমি রসিকতা করে উত্তর দিলাম, ‘আপনার ছখিনে আপনারে ভুলে নাই।’ বেচারা আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন, থামিয়ে দিলেন গান। স্তব্ধ হয়ে পড়লেন কিছু সময়ের জন্য। তারপর করুণ কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘মামা ৪ মাস যাবৎ বাড়িতে যাই না, বাড়ির কাউরে দেখি না।’
প্রস্তাব করলাম, ‘চলেন আজই বাড়িতে, যেহেতু নিজের গাড়ি। বউ-বাচ্চার সঙ্গে ঈদ করবেন।’ রিকশা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবেন—এমন কথা শুনে প্রথমে তিনি বিচলিত হয়েছিলেন। বললাম, ‘আরে মিয়া চলেন, গাড়ি চালাইয়াই তো যাবেন। এটা কোনো ব্যাপার হইল! টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করবেন না, সারা দিনে আপনার যা ইনকাম হয় পুষিয়ে দিব।’ যেই কথা, সেই কাজ! বেচারা রাজি।
আধ ঘণ্টার ব্যবধানে আমি আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাসা থেকে সংগ্রহ করি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। যাত্রাবাড়ীতে রিকশাচালকের বাসা। পথিমধ্যে তিনিও তাঁর বাসা থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে আসেন। যাত্রাপথে ব্যাটারি চালিত এই রিকশার চার্জ শেষ হয়ে যাবে—এটা নিশ্চিত। তবে চার্জ শেষ হলে প্যাডেল দিয়ে চলবে এমন ব্যবস্থাও আছে। রিকশায় চার্জ দেওয়ার জন্য তিনটি যাত্রাবিরতি হতে পারে বলে সিদ্ধান্ত হলো। প্রথমটি নরসিংদী, দ্বিতীয়টি ভৈরব এবং তৃতীয়টি বিশ্বরোড। এই তিনটি জায়গার রিকশা গ্যারেজে চার্জ দিয়ে আবার ছুটে চলা হবে গন্তব্যে—এমনই সিদ্ধান্ত। গাড়ি চার্জে লাগিয়ে সে এলাকায় পরিচিত কাউকে পেলে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো যাবে।
মদনপুর দিয়ে রিকশা ঢুকল। সে রাস্তায় শুধু ট্রাক আর ট্রাক! গাজীপুরের সব ফ্যাক্টরির মালামাল সে রাস্তা দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দরে যায়। রাস্তায় জ্যামের কারণে সারিবদ্ধ হয়ে ট্রাকের পর ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। তবে পাশ দিয়ে রিকশা চলার মতো যথেষ্ট ফাঁকা ছিল। তাই অল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম গাউছিয়া। রাত ৩টা ১০ মিনিটে মায়ের দোয়া নামের একটা হোটেলে সাহরি খেতে ঢুকলাম।
হোটেল মালিক মো. রাকিব খুব আন্তরিকতার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করলেন এবং আমাদের দীর্ঘ যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। খাবার শেষে রিকশাচালক শুক্কর মিয়া চা পান করলেন। চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার কিঞ্চিৎ আশঙ্কা ছিল। তাই প্যাডেলে চেপে রিকশা চালালেন কিছুক্ষণ। হাইওয়েতে বড় বড় গাড়ি দেখে দড়িপাড়ার রোড দিয়ে গ্রামের ভেতরে চলে গেলাম আমরা রিকশা নিয়ে। সেখানে একটি মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে আবার যাত্রা শুরু।
চলতে চলতে সকাল ৯টায় মাধবদী পৌঁছালাম আমরা। সকালবেলা রাস্তা খুব নীরব। বৈশাখী সূর্যের প্রখরতা তেমন নেই। ভাটিয়ালি গান চলছিল রিকশাওয়ালার ফোনে। তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল। ইটাখোলা, চান্দিনা অতিক্রম করেছি বেলা ১২টায়। সেই মুহূর্তটা ভ্রমণের মধ্যে সবচেয়ে ক্লান্তিকর ছিল। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল; কিন্তু রিকশায় ঘুমানোর কোনো সুযোগ নেই। নরসিংদী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে একটা অটো গ্যারেজে ৩০ মিনিট ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হলো প্রথমবারের মতো।
আশপাশে ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু কোথাও বসব, সে সুযোগ হচ্ছিল না। যেহেতু রোজা আছি, তাই অহেতুক অপরিচিত হোটেলে বসে থাকাটাও অস্বস্তিকর ছিল। হাঁটতে হাঁটতে আবার রিকশার কাছে যাই। দুপুর ২টায় রায়পুরা জামে মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই আমরা। তারপর গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে রামনগর দিয়ে ভৈরব চলে আসি। ভৈরব বাজারে প্রবেশের সময় আমার সার্জেন্ট পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হয়। ভৈরব চৌরাস্তায় আবার অটো গ্যারেজে রিকশা রেখে চালককে নিয়ে আশপাশে হাঁটছিলাম।
খাবার খাওয়া ছাড়া কোনো হোটেলে বসাটা অস্বস্তিকর ছিল। তাই রিকশার ড্রাইভারকে কিছু খাওয়ার প্রস্তাব করলাম। কিন্তু তিনি রোজা ভাঙতে নারাজ। আমরা তখন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থিত ভৈরব ব্রিজের পাশে দাঁড়ালাম। খেয়াল করলাম, সেখানে রিকশা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
স্থানীয় এক ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলাম এবং তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা করতে এলেন। খানিকক্ষণ আগে একজন পুলিশের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করলাম। ততক্ষণে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে রাস্তায় গাড়ির চাপ কম। সেই বড় ভাই আর পুলিশ সদস্যটির সহযোগিতায় ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব হলো। এর মধ্যে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল।
একটা পানির বোতল আর কিছু শুকনো খাবার দিয়ে ইফতার সেরে ফেললাম আমরা। ভালো কোথাও বসে ইফতার করার প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না ড্রাইভার সাহেব। কারণ, এ সময় রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল এবং খুব দ্রুতই আমরা বিশ্বরোড চলে এলাম। সেখানে আমরা একটা ছোট খাবারের দোকানে বসে কিছু খেয়ে নিলাম। দোকানে মোবাইল চার্জে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাই রিফাতের ফোন এল। তাকে কোথায় আছি জানালাম। সে দ্রুতই দুই প্যাকেট বিরিয়ানি আর দোকানের কেনা জুস নিয়ে হাজির হলো। আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। এবার রিকশায় সঙ্গী হলো রিফাত।
ভরা পেটে আমাদের যাত্রা আবার শুরু হলো। শুক্কর মিয়ার গানের সুরও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। শুক্কর মিয়া লোক ভালো, রসিক মানুষ। উচ্চ শব্দযুক্ত মোবাইল আছে তাঁর। মাঝেমধ্যেই গান, গজল বাজাচ্ছেন। আবার নিজেও গলা ছেড়ে গাইছেন। আমি রিকশাওয়ালাকে সম্বোধন করছিলাম ড্রাইভার সাহেব বলে। যতবারই এভাবে ডাকি, ততবারই ফিক করে একটা হাসি দেন তিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা হাসেন কেন?’ তিনি চাপা আনন্দে হেসে উত্তর দিলেন, ‘আমি আবার সাহেব নাকি!’
সারা দিনব্যাপী তাঁর কর্মকাণ্ড খেয়াল করলাম। আসলে প্রতিটি মানুষই তার পরিবারের কাছে একজন হিরো। প্রত্যেকেই যার যার আত্মসম্মানে বলিষ্ঠ। প্রতিদিন রিকশা নিয়ে বের হলে তিনি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। এর মধ্যে কিছু রাস্তায় ব্যয় হয়, কিছু গ্যারেজে। সবকিছু বাদ দিয়েও এক থেকে দেড় হাজার টাকা তাঁর থেকে যায়। বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম অনেকক্ষণ। অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করা আমার পরিচিত খুব কম মানুষের বেতনই ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার ওপরে। অথচ যাদের আমরা দরিদ্র রিকশাওয়ালা হিসেবে চিনি, তাঁরা প্রতিদিন যা উপার্জন করেন, তার পরিমাণ এক মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজারের বেশি। অথচ দুই শ্রেণির মানুষের জীবনযাপনে কত পার্থক্য! আমার কাছে বিষয়টা স্পষ্ট, কীভাবে শুধু পড়াশোনা মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে।
রাত ৯টা। গ্রামে প্রবেশ করলাম। দীর্ঘ প্রায় ১৯ ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে দূর থেকে নিজের বাড়ি যখন দেখতে পাচ্ছিলাম, তখনকার অনুভূতি বলে প্রকাশ করার মতো নয়। সারা দিন কত কত বাড়ি ছেড়ে আসলাম, শত শত দোকানের সামনে দিয়ে গেলাম, রাস্তায় জীবনের সবচেয়ে ক্লান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাতে। কিন্তু কোথাও বসে যে একদণ্ড বিশ্রাম নেব, সেই আন্তরিক অনুভূতি ভেতরে তৈরি হয়নি। মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, কখন বাড়ি পৌঁছাব। সকল জল্পনা-কল্পনা শেষে যখন বাড়ির লাইট দেখা যাচ্ছিল দূর থেকে, তখন মন আনন্দে নেচে উঠছিল।
রিকশা কাছে আসতেই দেখি আম্মাসহ আশপাশের সবাই দাঁড়িয়ে বাড়ির সামনে। ১৯ ঘণ্টার দীর্ঘ রিকশাযাত্রা শেষ করে বাসায় উপস্থিত হলাম। কীভাবে ছিলি এতক্ষণ রিকশায়, ঠিকঠাক আছিস তো? সবার মনে কত প্রশ্ন। আর আমার ভাবনায় তখন একটাই কথা, বাড়ি পৌঁছে গেছি।
রিকশা ড্রাইভার শুক্কর মিয়াকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো খাওয়াদাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনিও চলে যেতে অস্থির। বুঝতে পারলাম, আমার মতো তাঁর মধ্যেও অস্থিরতা কাজ করছে, কখন বাড়ি যাবেন। বাড়িতে শুক্কর মিয়ার পরিবার অপেক্ষায় আছে।
লেখক: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সম্মান চতুর্থ বর্ষের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ঈদের ছুটি। পরিচিতদের অনেকেই ছুটছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। নিজের মনেও দিল পাখির উড়াল। কিন্তু উপায় কী। ঢাকা থেকে খুব কাছের দূরত্বও যে দুর্লঙ্ঘ হয়ে গেছে শুধু টিকিটের কারণে। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মিরাশানী গ্রামে। সেখানে যেতে আইঢাই মন নিয়ে বাস ও ট্রেনের টিকিট কত না খুঁজেছি। পাওয়া হলো কই।
কোথাও কোনো টিকিট নেই। তাই ১৯ ঘণ্টা রিকশা ভ্রমণ করে ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাই। ঘটনা শুরু থেকে বলা যাক।
গত ২৮ এপ্রিল (বুধবার) দুপুর ২টায় ওয়ারির বাসা থেকে বের হয়েছি কাঁটাবনের দিকে একটা ইফতারের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে। বাড়িতে পরিবারের সবাই একত্রিত হবে, শবে কদরকে কেন্দ্র করে বাড়িতে একটা উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হবে। সে আয়োজনে আমাকে অবশ্যই থাকতে হবে বলে তাড়া দিচ্ছিল বাড়ি থেকে। কমলাপুরে কয়েকবার সন্ধান করেছি, ট্রেনের কোনো টিকিট নেই। ২৭ রমজান বাড়িতে যেতে পারব না বলে হাল ছেড়ে দিয়েছি, ঢাকার কাজেই মনোযোগ দিয়েছি। কাঁটাবনে ইফতার শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পরিচিতদের সঙ্গে বেশ ভালো সময় কাটাচ্ছিলাম। রাত ১২টার দিকে ভর্তা বাড়িতে ইমরান ভাইয়ের সৌজন্যে একটা খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়।
খাওয়াদাওয়া শেষে সৈকত ভাইয়ের উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে আবারও আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলে। হঠাৎ মোবারক ভাই বলেন, ‘রাত অনেক হয়েছে বাসার দিকে চলে যা।’ সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ওয়ারির উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠলাম। কথায় কথায় জানা গেল, রিকশাওয়ালা ভদ্রলোকের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। টিএসসি থেকে উদ্দেশ্য ছিল ওয়ারি যাব। তখন তিনি গলা ছেড়ে মনের সুখে গান গাইছিলেন, ‘অ ছখিনা, গেচছ কি না ভুইল্ল্যা আমারে। আমি অহন রিসকা চালাই ঢাহা শহরে।’ গান শুনে আমি রসিকতা করে উত্তর দিলাম, ‘আপনার ছখিনে আপনারে ভুলে নাই।’ বেচারা আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন, থামিয়ে দিলেন গান। স্তব্ধ হয়ে পড়লেন কিছু সময়ের জন্য। তারপর করুণ কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘মামা ৪ মাস যাবৎ বাড়িতে যাই না, বাড়ির কাউরে দেখি না।’
প্রস্তাব করলাম, ‘চলেন আজই বাড়িতে, যেহেতু নিজের গাড়ি। বউ-বাচ্চার সঙ্গে ঈদ করবেন।’ রিকশা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবেন—এমন কথা শুনে প্রথমে তিনি বিচলিত হয়েছিলেন। বললাম, ‘আরে মিয়া চলেন, গাড়ি চালাইয়াই তো যাবেন। এটা কোনো ব্যাপার হইল! টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করবেন না, সারা দিনে আপনার যা ইনকাম হয় পুষিয়ে দিব।’ যেই কথা, সেই কাজ! বেচারা রাজি।
আধ ঘণ্টার ব্যবধানে আমি আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাসা থেকে সংগ্রহ করি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। যাত্রাবাড়ীতে রিকশাচালকের বাসা। পথিমধ্যে তিনিও তাঁর বাসা থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে আসেন। যাত্রাপথে ব্যাটারি চালিত এই রিকশার চার্জ শেষ হয়ে যাবে—এটা নিশ্চিত। তবে চার্জ শেষ হলে প্যাডেল দিয়ে চলবে এমন ব্যবস্থাও আছে। রিকশায় চার্জ দেওয়ার জন্য তিনটি যাত্রাবিরতি হতে পারে বলে সিদ্ধান্ত হলো। প্রথমটি নরসিংদী, দ্বিতীয়টি ভৈরব এবং তৃতীয়টি বিশ্বরোড। এই তিনটি জায়গার রিকশা গ্যারেজে চার্জ দিয়ে আবার ছুটে চলা হবে গন্তব্যে—এমনই সিদ্ধান্ত। গাড়ি চার্জে লাগিয়ে সে এলাকায় পরিচিত কাউকে পেলে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো যাবে।
মদনপুর দিয়ে রিকশা ঢুকল। সে রাস্তায় শুধু ট্রাক আর ট্রাক! গাজীপুরের সব ফ্যাক্টরির মালামাল সে রাস্তা দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দরে যায়। রাস্তায় জ্যামের কারণে সারিবদ্ধ হয়ে ট্রাকের পর ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। তবে পাশ দিয়ে রিকশা চলার মতো যথেষ্ট ফাঁকা ছিল। তাই অল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম গাউছিয়া। রাত ৩টা ১০ মিনিটে মায়ের দোয়া নামের একটা হোটেলে সাহরি খেতে ঢুকলাম।
হোটেল মালিক মো. রাকিব খুব আন্তরিকতার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করলেন এবং আমাদের দীর্ঘ যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। খাবার শেষে রিকশাচালক শুক্কর মিয়া চা পান করলেন। চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার কিঞ্চিৎ আশঙ্কা ছিল। তাই প্যাডেলে চেপে রিকশা চালালেন কিছুক্ষণ। হাইওয়েতে বড় বড় গাড়ি দেখে দড়িপাড়ার রোড দিয়ে গ্রামের ভেতরে চলে গেলাম আমরা রিকশা নিয়ে। সেখানে একটি মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে আবার যাত্রা শুরু।
চলতে চলতে সকাল ৯টায় মাধবদী পৌঁছালাম আমরা। সকালবেলা রাস্তা খুব নীরব। বৈশাখী সূর্যের প্রখরতা তেমন নেই। ভাটিয়ালি গান চলছিল রিকশাওয়ালার ফোনে। তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল। ইটাখোলা, চান্দিনা অতিক্রম করেছি বেলা ১২টায়। সেই মুহূর্তটা ভ্রমণের মধ্যে সবচেয়ে ক্লান্তিকর ছিল। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল; কিন্তু রিকশায় ঘুমানোর কোনো সুযোগ নেই। নরসিংদী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে একটা অটো গ্যারেজে ৩০ মিনিট ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হলো প্রথমবারের মতো।
আশপাশে ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু কোথাও বসব, সে সুযোগ হচ্ছিল না। যেহেতু রোজা আছি, তাই অহেতুক অপরিচিত হোটেলে বসে থাকাটাও অস্বস্তিকর ছিল। হাঁটতে হাঁটতে আবার রিকশার কাছে যাই। দুপুর ২টায় রায়পুরা জামে মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই আমরা। তারপর গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে রামনগর দিয়ে ভৈরব চলে আসি। ভৈরব বাজারে প্রবেশের সময় আমার সার্জেন্ট পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হয়। ভৈরব চৌরাস্তায় আবার অটো গ্যারেজে রিকশা রেখে চালককে নিয়ে আশপাশে হাঁটছিলাম।
খাবার খাওয়া ছাড়া কোনো হোটেলে বসাটা অস্বস্তিকর ছিল। তাই রিকশার ড্রাইভারকে কিছু খাওয়ার প্রস্তাব করলাম। কিন্তু তিনি রোজা ভাঙতে নারাজ। আমরা তখন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থিত ভৈরব ব্রিজের পাশে দাঁড়ালাম। খেয়াল করলাম, সেখানে রিকশা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
স্থানীয় এক ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলাম এবং তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা করতে এলেন। খানিকক্ষণ আগে একজন পুলিশের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করলাম। ততক্ষণে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে রাস্তায় গাড়ির চাপ কম। সেই বড় ভাই আর পুলিশ সদস্যটির সহযোগিতায় ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব হলো। এর মধ্যে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল।
একটা পানির বোতল আর কিছু শুকনো খাবার দিয়ে ইফতার সেরে ফেললাম আমরা। ভালো কোথাও বসে ইফতার করার প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না ড্রাইভার সাহেব। কারণ, এ সময় রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল এবং খুব দ্রুতই আমরা বিশ্বরোড চলে এলাম। সেখানে আমরা একটা ছোট খাবারের দোকানে বসে কিছু খেয়ে নিলাম। দোকানে মোবাইল চার্জে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাই রিফাতের ফোন এল। তাকে কোথায় আছি জানালাম। সে দ্রুতই দুই প্যাকেট বিরিয়ানি আর দোকানের কেনা জুস নিয়ে হাজির হলো। আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। এবার রিকশায় সঙ্গী হলো রিফাত।
ভরা পেটে আমাদের যাত্রা আবার শুরু হলো। শুক্কর মিয়ার গানের সুরও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। শুক্কর মিয়া লোক ভালো, রসিক মানুষ। উচ্চ শব্দযুক্ত মোবাইল আছে তাঁর। মাঝেমধ্যেই গান, গজল বাজাচ্ছেন। আবার নিজেও গলা ছেড়ে গাইছেন। আমি রিকশাওয়ালাকে সম্বোধন করছিলাম ড্রাইভার সাহেব বলে। যতবারই এভাবে ডাকি, ততবারই ফিক করে একটা হাসি দেন তিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা হাসেন কেন?’ তিনি চাপা আনন্দে হেসে উত্তর দিলেন, ‘আমি আবার সাহেব নাকি!’
সারা দিনব্যাপী তাঁর কর্মকাণ্ড খেয়াল করলাম। আসলে প্রতিটি মানুষই তার পরিবারের কাছে একজন হিরো। প্রত্যেকেই যার যার আত্মসম্মানে বলিষ্ঠ। প্রতিদিন রিকশা নিয়ে বের হলে তিনি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। এর মধ্যে কিছু রাস্তায় ব্যয় হয়, কিছু গ্যারেজে। সবকিছু বাদ দিয়েও এক থেকে দেড় হাজার টাকা তাঁর থেকে যায়। বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম অনেকক্ষণ। অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করা আমার পরিচিত খুব কম মানুষের বেতনই ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার ওপরে। অথচ যাদের আমরা দরিদ্র রিকশাওয়ালা হিসেবে চিনি, তাঁরা প্রতিদিন যা উপার্জন করেন, তার পরিমাণ এক মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজারের বেশি। অথচ দুই শ্রেণির মানুষের জীবনযাপনে কত পার্থক্য! আমার কাছে বিষয়টা স্পষ্ট, কীভাবে শুধু পড়াশোনা মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে।
রাত ৯টা। গ্রামে প্রবেশ করলাম। দীর্ঘ প্রায় ১৯ ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে দূর থেকে নিজের বাড়ি যখন দেখতে পাচ্ছিলাম, তখনকার অনুভূতি বলে প্রকাশ করার মতো নয়। সারা দিন কত কত বাড়ি ছেড়ে আসলাম, শত শত দোকানের সামনে দিয়ে গেলাম, রাস্তায় জীবনের সবচেয়ে ক্লান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাতে। কিন্তু কোথাও বসে যে একদণ্ড বিশ্রাম নেব, সেই আন্তরিক অনুভূতি ভেতরে তৈরি হয়নি। মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, কখন বাড়ি পৌঁছাব। সকল জল্পনা-কল্পনা শেষে যখন বাড়ির লাইট দেখা যাচ্ছিল দূর থেকে, তখন মন আনন্দে নেচে উঠছিল।
রিকশা কাছে আসতেই দেখি আম্মাসহ আশপাশের সবাই দাঁড়িয়ে বাড়ির সামনে। ১৯ ঘণ্টার দীর্ঘ রিকশাযাত্রা শেষ করে বাসায় উপস্থিত হলাম। কীভাবে ছিলি এতক্ষণ রিকশায়, ঠিকঠাক আছিস তো? সবার মনে কত প্রশ্ন। আর আমার ভাবনায় তখন একটাই কথা, বাড়ি পৌঁছে গেছি।
রিকশা ড্রাইভার শুক্কর মিয়াকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো খাওয়াদাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনিও চলে যেতে অস্থির। বুঝতে পারলাম, আমার মতো তাঁর মধ্যেও অস্থিরতা কাজ করছে, কখন বাড়ি যাবেন। বাড়িতে শুক্কর মিয়ার পরিবার অপেক্ষায় আছে।
লেখক: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সম্মান চতুর্থ বর্ষের ছাত্র
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে কোনো মানসনদই নেয়নি রাজশাহীর পদ্মা বেকারি। তারপরও পদ্মা বেকারির বিস্কুট, পাউরুটি ও কেকের প্যাকেটে অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
২৩ মিনিট আগেরাজধানীর খিলগাঁওয়ে মাদকাসক্ত ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে বোন খুন হয়েছেন। নিহতের নাম রুমি আক্তার (৩৫)। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন তাদের আরেক ভাই মো. বাবুল (৫৫)। ঘটনার পর ঘাতক আব্দুস সালামকে (৪০) আটক করেছে পুলিশ।
২৬ মিনিট আগে২৯ বছর পর গাজীপুরে শ্রমিক নেতা বিল্লাল হোসেন বিলু (৩৫) হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফালানকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। আজ বুধবার তাকে কালীগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
২৮ মিনিট আগেঘটনার ছয় বছর পর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দায়ের করা এক যুবদল নেতার মামলায় সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মামলার ১ মাস পর তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ আজ বুধবার সকালে মৌলভীবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিছবাহর রহমানের আদালতে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদ
৩৮ মিনিট আগে