আষাঢ়ের বৃষ্টিতে নাকাল ঢাকাবাসী

মাহমুদ সোহেল
আপডেট : ২২ জুন ২০২১, ২০: ২৬
Thumbnail image

ঢাকা: বৃদ্ধ বাবাকে ডাক্তার দেখাতে কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে এসেছিলেন দিলরুবা হাসান। ফিরবেন যাত্রাবাড়ি। একে তো বৃষ্টি তার ওপর রাস্তায় জমা পানি। সিএনজির জন্য প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে আর পারছিলেন না। অসুস্থ বাবাকে সামলাবেন নাকি পানি থেকে নিজেকে।

বিরক্তি আর ক্ষোভ নিয়ে দিলরুবা বলেন, ‘রাস্তায় পানি, ফুটপাতেও পানি। বাসায় যাবো, এক ঘণ্টা ধরে ভিজে একটা সিএনজি পাচ্ছি না। দু-একটা পেয়েছি ভাড়া চায় চার গুন। আমাদের কষ্ট কেউ বুঝতে চায় না।

আজ মঙ্গলবার দিলরুবার মতো যারা কাজে বেরিয়েছেন, তাঁদের হয় পানিতে কাপড় নোংরা হয়েছে, নইলে যানজট আর বৃষ্টির ভোগান্তিতে পড়েছেন।

বৃষ্টি হলে ঢাকার রাজপথ হয়ে যায় নদী। এমন ভোগান্তি থেকে মুক্তির পথ কি? এমন প্রশ্ন ছিল বেশির ভাগ মানুষের মুখে। সামান্য পানিতেই তলিয়ে যায় মহানগরের সড়ক। পানি উঠে যায় ফুটপাতেও।

সোমবারের পর মঙ্গলবারও সেই একই চিত্র ছিল পুরো রাজধানীজুড়ে। নিচু এলাকা হিসেবে পরিচিত খিলগাঁও, সবুজবাগ, যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ যেমন ডুবেছে পানিতে তেমনি শান্তিনগর, মতিঝিল, পল্টনের বেশির ভাগ এলাকা ছিল পানির নিচে। মিরপুর, আগারগাঁও, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়ার অনেক জায়গায় জমেছে পানি। সব মিলে ঢাকাবাসীর কাছে আষাঢ় রূপ নিয়েছে ভোগান্তির আরেক নামে। নগরবিদেরা বলছেন অর্ধশত খাল মেরে ফেলার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে নগর বাসিকে।

অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে গেছে রাজপথ। ছবিটি রাজধানীর সার্কুলার রোড থেকে তোলা।

অথচ আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় মাত্র ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এটিকে সামান্য বৃষ্টি উল্লেখ করে আবহাওয়া অফিস বলছে, বর্ষার মৌসুমে এমন বৃষ্টি হতেই থাকবে।

মঙ্গলবারের বৃষ্টিতেও অচল হয় ঢাকা। তবে ভারী বৃষ্টি হয়েছে কম। তাতেই মহাসড়ক হয়ে যায় নদী পথ। পল্টন, খিলগাঁও, ফকিরাপুল, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ইত্যাদি যানবাহন অর্ধেক পানিতে তলিয়ে যায়।

পল্টন বিএনপি অফিসের সামনে বেশ কিছু মোটর বাইক ও প্রাইভেট সিএনজিকে ঠেলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। চালকেরা জানান, ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। কাকরাইল নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত রাস্তায় শুধু পানি আর পানি।

বাড্ডার রসুলবাগ ও বাগানবাড়ি এলাকায় ভোগান্তি ছিল চোখে পড়ার মতো। এখানকার মুদি দোকানদার আবুল কাশেম জানান, বৃষ্টি হলেই ব্যবসায় ভাটা পড়ে। দোকানের সামনে হাঁটু পানি জমে। ক্রেতারা আর দোকানে আসতে পারে না। বেচা–কেনা বন্ধ হয়।

খিলগাঁও মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক সুলতানা পারভীন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই ভোগান্তি। এই শহরে থাকতে আর ভাল্লাগে না। ল্যাব এইড হাসপাতালে যাবো, হাতে-পায়ে ধরলাম সিএনজি যাবে না। তাদের ইচ্ছেমতো যাবে তারা। এত পথ রিকশায় যাওয়াও যাচ্ছে না। এ সব দেখারও কেউ নেই। এমন ঢাকা আমরা চাই না’।

নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ৩০ বছর ধরে ভুল পরিকল্পনায় চলছে ঢাকা। রাজউক যে পরিকল্পনা করছে তা আধুনিক শহরের পরিপন্থী।

জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে নগর বাসি। ছবিটি রাজধানীর রাজারবাগ থেকে তোলা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স–এর সাধারণ সম্পাদক, পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই শহরের অব্যবস্থাপনা একদিনে তৈরি হয়নি। তিন দশকের কুফল এগুলো। এ জন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে লাভ নেই। রাজউক একটা পরিকল্পনা করে ৫ থেকে ১০ বছরের চিন্তা করে। এটি বাস্তবায়ন হতে হতে শহরে নতুন সমস্যা দেখা দেয়। জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব। স্বল্প মেয়াদি কোনো পরিকল্পনা সুফল আনবে না ঢাকার জন্য।

তিনি জানান, একটি আধুনিক শহরের জন্য ৪০ থেকে ৫০ ভাগ অবকাঠামো বা ভবনমুক্ত এলাকা রাখতে হয়। যাতে পানি মাটির নিচে জমতে পারে। ঢাকায় তা নেই। পাকা রাস্তার কারণে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে যেতে পারছে না। ফলে জলজট তৈরি হচ্ছে। আর মাটির তলদেশে পানির অভাব থেকেই দিচ্ছে। ড্যাপের পরিকল্পনাও আধুনিক নয়। ১৯৯৫ সালে ও ২০১০ সালে ড্যাপ যে পরিকল্পনা করেছে তা যুগোপযোগী করার পরামর্শ দেন এই নগরবিদ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে জানান, সিটি করপোরেশন সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এই শহরের পরিকল্পনায় গলদ আছে। ১৯৫৯ সালের মাস্টারপ্ল্যানে এখনো চলছে ঢাকা। বর্তমান ঢাকার জনসংখ্যা, ধারণ ক্ষমতা, অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ এ সবকিছু মাথায় রেখে ২০-২৫ বছরের সময়োপযোগী প্ল্যান করা দরকার। খাল নেই, আধুনিক ড্রেন নেই। যতটুকু আছে তার ব্যবস্থাপনায় ভুল। ঢাকার জন্য আধুনিক বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা জরুরি হয়ে পড়েছে ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত