‘ভাইয়ের অবস্থা ভালো না, জানি না কহন কী হয়!’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩, ১৭: ৪০
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৩, ১৭: ৪৯

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের দগ্ধ ও ক্ষতবিক্ষত আট জন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে দুজন লাইফ সাপোর্টে এবং একজন সাধারণ আইসিইউতে রয়েছেন। এ তিনজনই সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। 

আজ শুক্রবার দুপুরে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউয়ের সামনে সাদা বোর্ডে এসব তথ্য দেখা গেল। পাশেই সিঁড়িতে বসে কথা হয় লাইফ সাপোর্টে থাকা খলিলুর রহমান হাসানের ছোট ভাই রাতুল ইসলাম রায়হানের সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। লাইফ সাপোর্টে রাখছে। জানি না, কহন কী হয়!’ 

হাসান কুইন টাওয়ারের সামনের ফুটপাতে ব্যাগের ব্যবসা করতেন। এ ভবনেই বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার দিনও সেখানেই ছিলেন হাসান। বিস্ফোরণে উড়ে আসা তিনটি কাচের টুকরা তাঁর গলার তিন জায়গায় বিঁধে যায়। আগুনে ঝলসে যায় মুখ। এ অবস্থায় সেখান থেকে রিকশায় করে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঢামেক থেকে পাঠানো হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। তাঁর গলায় গুরুতর জখম আর মুখ ও শরীরের ১২ শতাংশ দগ্ধ। তিন দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে ৩৫ বছরের এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সুমনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। ঢাকায় সিদ্দিকবাজারের একটি মেসে ভাড়া থাকতেন। 

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অবস্থার অবনতি হলে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় আজম মৃধাকে। শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া আজম কাজ করতেন ভবনটির বাংলাদেশ স্যানিটারি নামে একটি দোকানে। তাঁর বাড়ি রাজধানীর মগবাজারের মধুবাগে। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছেন। কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন, ছোট্ট একটা কন্যা রয়েছে। 

নিম্ন আয়ের পরিবারে অর্থ সংস্থানের বড় অংশ বহন করতেন আজম। এখন আয়–ব্যয়ের হিসাবের ঊর্ধ্বে। আজমের প্রতিদিন কয়েক ব্যাগ প্লাটিলেট দরকার হচ্ছে। ওষুধপথ্যের খরচ জোগাতেই হিমশিম পরিবার। চার তলার আইসিইউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় আজমের চাচাতো ভাই শাকিল মৃধা ও অন্য স্বজনদের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, অবস্থা খুব খারাপ! শেষ চেষ্টা হিসেবে গতকাল লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। এখন বাকিটা আল্লাহর হাতে। আমরা দোয়া আর চেষ্টা ছাড়া তো কিছু করতে পারব না!

গতকাল সন্ধ্যায় বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা ইয়াসিন আলী নামে একজন মারা গেছেন। এর আগে এখানে চিকিৎসাধীন হাফেজ মোহাম্মদ মুসা নামে একজনের মৃত্যু হয়। মুসার শরীরের ৯৮ শতাংশ দগ্ধ ছিল। এসব খুব কাছে থেকে দেখে অন্যদের পরিবার ও স্বজনেরাও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার চেষ্টা করছেন। যে কোনো সময় সবচেয়ে খারাপ খবরটি শুনতে হতে পারে! 

সাধারণ আইসিইউতে ভর্তি আছেন নবাবগঞ্জ ডিএন কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ জাহান। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার জন্য ঘটনার দিন নবাবগঞ্জ থেকে দনিয়ার বোনের বাসায় ফিরছিলেন। বোনের বাসায় বিকেল ৫টায় গিয়ে ভাত খাওয়ার কথা ছিল তাঁর। এরপর সেখান থেকে যাত্রাবাড়ী তাজ মার্কেটে যাওয়ার কথা। সেখানে একটি দোকানে খণ্ডকালীন কাজ করতেন জাহান। 

চোখের সামনে হরিণের মতো ছুটতে থাকা ভাইকে আইসিইউতে কাতরাতে দেখে সহ্য করতে পারছেন না বোন জান্নাতুন নেসা জাকিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে এভাবে দেখতে হবে ভাবিনি কখনো। আমরা দোয়া করছি সে যেন সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসে। কিন্তু কী হবে আমরা জানি না। আল্লাহ যেন আমাদের দোয়া কবুল করেন, আপনারাও দোয়া করবেন।’ 

পাশেই সিঁড়িতে বসে নাগারে কেঁদে যাচ্ছেন জাহানের মা সেলিনা বেগম। বাবা আলমগীর হোসেন কোনো কাজে বাইরে গেছেন। 

লাইফ সাপোর্টে ও আইসিইউতে থাকা এই তিনজনের অবস্থা ‘খুবই খারাপ’ বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, ‘লাইফ সাপোর্টে আছেন দুইজন। একজন সাধারণ আইসিইউতে। তাঁদের অবস্থা সংকটাপন্ন।’ 

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুইজন চিকিৎসাধীন ছিলেন বার্ন ইনস্টিটিউটে আর বাকিরা ঘটনাস্থল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। 

আহতদের মধ্যে বর্তমানে ঢামেক হাসপাতাল ও বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ২২ জন। এর মধ্যে ১৪ জন ঢাকা মেডিকেলে, তাঁদের মধ্যে একজন আইসিইউতে। বাকিরা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। 

বিস্ফোরণের ঘটনায় মোট ১৭২ জনকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এর মধ্যে নিহত ২৩ জনও রয়েছেন। বার্ন ইনস্টিটিউট আর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীনেরা বাদে বাকিরা বাড়ি ফিরে গেছেন অথবা বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। 

আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত