ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্র কিশোরগঞ্জ, নিহত ৪

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৪, ০০: ১৩
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৪, ০০: ৩৬

কিশোরগঞ্জে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। রোববার ত্রিমুখী এই সংঘর্ষের সময় জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে এসব হামলা, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় একজন নারীসহ অন্তত চারজন মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে অঞ্জনা বেগম (৩৫) নামে এক নারীসহ দুইজন দগ্ধ হয়ে এবং একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে।

তাঁদের মধ্যে একজনের নাম মবিন (৩৫) এবং দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির নাম জুলকার মিয়া। তিনি উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের বাসিন্দা। এ ছাড়া রুবেল আব্দুল্লাহ (৩২) নামে এক যুবক হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

অন্যদিকে এসব ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তাদের মধ্যে পুলিশ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী, সাংবাদিক ও আন্দোলনকারীরা রয়েছেন। এদিকে নিহতদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের সময় দুইজন দগ্ধ হয়ে মারা গেছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এই দুই জনের একজন অঞ্জনা বেগম। তিনি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল গ্রামের আলম মিয়ার স্ত্রী।

অন্যদিকে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় শহরের শহীদী মসজিদ এলাকায় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে রুবেল আব্দুল্লাহ নামে এক যুবক মারা গেছেন বলে জানা গেছে। তিনি জেলার তাড়াইল উপজেলার তালজাঙ্গা ইউনিয়নের চরতালজাঙ্গা গ্রামের আজহারুল ইসলামের ছেলে। রুবেল আব্দুল্লাহর বোন সুমাইয়া বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। অন্যদিকে নিহত মবিন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কর্শাকড়িয়াইলের বাসিন্দা। তিনি যুবলীগ নেতা বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচিকে ঘিরে রোববার সকাল থেকে শহরের পুরানথানা মোড়ে জমায়েত হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে সেখানে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা জমায়েত হন। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগ অফিস এলাকায় জড়ো হতে থাকেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীরা। বেলা ১১টার দিকে সেখান থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী পুরানথানা অভিমুখে রওনা দেন। অন্যদিকে পুরানথানা এলাকা থেকে আন্দোলনকারীরা গৌরাঙ্গবাজার মোড় অভিমুখে রওনা হন।

গৌরাঙ্গবাজার মোড় এলাকায় উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে চলে এলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রতিরক্ষা ভেঙে গেলে রাজপথ দখলে নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় শহরের পুরানথানা এলাকা থেকে শুরু করে স্টেশন রোডের জেলা আওয়ামী লীগ অফিস পর্যন্ত সড়ক আন্দোলনকারীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। একপর্যায়ে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা ছাড়াও কার্যালয়ের সামনে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

এ সময় প্রধান সড়ক দখলে রেখে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। হাজার হাজার ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো শহর। একপর্যায়ে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় হামলাকারীরা বাসার গেইট ভেঙে ভেতরে ঢুকে বহুতল ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখা ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়রা এগিয়ে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তবে এর আগেই ভবনটিতে থাকা গাড়ি ও মোটর সাইকেলসহ ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন গুরুতর দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে একজন নারীসহ দুইজন ঘটনাস্থলেই মারা যান।

আন্দোলনকারীরা মডেল থানা, পুরানথানা মোড়ের ট্রাফিক বক্স এবং বটতলা এলাকার আরেকটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে ভাঙচুর চালায়।

বেলা ১টার দিকে আন্দোলনকারীদের দমনে অ্যাকশনে নামে পুলিশ। তারা আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এর জবাবে ইট-পাটকেল ছোড়েন আন্দোলনকারীরা। এ সময় পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এদিকে জেলা শহরের বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা নিতে যাওয়া আহতদের ভিড় দেখা গেছে। আহত আন্দোলনকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপপরিচালক) আকরাম উল্লাহ জানান, অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় মারা যাওয়া দুইজনের লাশ হাসপাতালে রয়েছে। তাদেরকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন পুরুষ (৫০) ও আরেকজন মহিলা (৩৫)। মহিলার নাম অঞ্জনা বেগম। এছাড়া পুরুষের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি। হাসপাতালটিতে ২৫ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ও ১৫ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া উন্নত চিকিৎসার জন্য দুইজনকে অন্যত্র রেফার্ড করা হয়েছে।

অন্যদিকে বিকাল ৫টায় কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. হেলাল উদ্দিন জানান, হাসপাতালে নিহত একজনের লাশ রয়েছে। তার নাম মবিন। এখানে মোট ৬৫ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তাদের মধ্যে ১৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত