নিউমোনিয়া আক্রান্ত সাত মাসের শিশুর ডেঙ্গু চিকিৎসার অভিযোগ

নুরুল আমিন হাসান, উত্তরা (ঢাকা) 
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১: ২৮

ঠান্ডা কাশির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সাত মাস বয়সী শিশু মো. ইব্রাহিমকে। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে জানিয়েছেন, ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসাও করিয়েছেন তিন দিন। 

কিন্তু শিশুটির কোনো জ্বর না থাকায় খটকা লাগে মায়ের। এদিকে চিকিৎসার পরও উন্নতি না হয়ে দিন দিন অবনতি হচ্ছিল। পরে অন্য হাসপাতালে গোপনে পরীক্ষা করিয়ে জানা গেল শিশুটির ডেঙ্গু হয়নি। তার নিউমোনিয়া হয়েছে। 

এমন অভিযোগ উঠেছে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে অবস্থিত ‘আইচি হাসপাতাল লিমিটেড’ এর বিরুদ্ধে। আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।

খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ভুক্তভোগী ওই শিশুটি দক্ষিণখানের আশকোনার ডিলার বাড়ি এলাকার হারুনুর রশিদের ছেলে। 

শিশুটির বাবা হারুনুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঠান্ডা কাশির কারণে শিশুকে গত সোমবার (২৮ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৫টায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে ডা. মোয়াজ্জেম স্যারের আন্ডারে ভর্তি করাইছিলাম। পরে বুধবার (৩০ আগস্ট) মধ্যরাত পর্যন্ত হাসপাতালের বি-৬০৮ (সি) বেডে রেখে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করান ডাক্তারেরা।

হারুনুর রশিদ আরও বলেন, ‘আইচি হাসপাতালে ভর্তির সময় তারা শিশুর পরীক্ষা করে জানিয়েছে প্লাটিলেট ছিল ৫ লাখ ৭৩ হাজার ছিল। একদিন পরে প্লাটিলেট প্রায় এক লাখ কমে গেছে। চিকিৎসক ডেঙ্গু পরীক্ষা করে জানিয়েছে, শিশুর ডেঙ্গু হয়েছে। অথচ উত্তরার ওমেন অ্যান্ড চিলড্রেন হাসপাতালে পরীক্ষা করে দেখা যায়, শিশুর ডেঙ্গু নেই। পরীক্ষা করানোর পর প্লাটিলেট কাউন্ট এসেছে ৬ লাখ ৪২ হাজার।’ 

ভুল চিকিৎসার অভিযোগ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বুধবার (৩০ আগস্ট) রাতে বাগ্‌বিতণ্ডার পর জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোনকল করেন হারুনুর রশিদ। পুলিশ আসার পর শিশুকে আইচি হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের পুরো বিল পরিশোধ করার কথা বলে। পুরো বিল পরিশোধ করতে পারিনি বলে শিশুর নানা কাজল মিয়াকে হাসপাতালে জিম্মি করে রাখা হয়।’

বুধবার (৩০ আগস্ট) রাত দেড়টার দিকে হাসপাতালের পঞ্চম তালায় গিয়ে দেখা যায়, শিশুটির নানা কাজল মিয়া চেয়ারে বসে আছেন। তাঁকে পাহারা দিচ্ছেন সিকিউরিটি গার্ড দিলীপ। তখন মো. কাজল মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিশুরে ভুল চিকিৎসা করাইছে। শিশুর হইছে ঠান্ডা। কিন্তু বলছে ডেঙ্গু। ডেইলি তিনবার রক্ত নিতে নিতে শিশুর অবস্থা খুব খারাপ করে ফেলছে।’ 

কাজল মিয়া বলেন, ‘আজকে কৌশলে এখান থেকে শিশুকে বাইর করে নিয়ে অন্য হাসপাতালে পরীক্ষা করানো হইছে। পরে দেখা যায় ডেঙ্গু বলতে কোনো কিছু নাই। তখন খবর দিলে পুলিশ আসে। শিশুকে হাসপাতাল অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেই। কিন্তু বকেয়া বিলের জন্য আমাকে আটক রাখা হইছে।’ 

ওই সময় হাসপাতালের পঞ্চম তলার রিসেপশনে থাকা স্টাফ নার্স শাহরিয়ার বলেন, ‘বিলের জন্য ওনাকে বসিয়ে রাখা হইছে। আমি এত কথা বলতে পারব না। ব্যস্ত আছি।’ 

সিকিউরিটি গার্ড দিলীপ বলেন, ‘ওনাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে দেখে রাখার জন্য হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ড, ওয়ার্ড বয়, নার্সরা আছে।’ 

ভুল চিকিৎসার অভিযোগের বিষয়ে জানতে ওই সময় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে হাসপাতালের পাশের একটি চায়ের টং দোকানে পাওয়া যায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি ম্যানেজার মো. সুমনকে। তিনি বলেন, ‘ইব্রাহিম নামের শিশুটির ডেঙ্গু পরীক্ষার কাগজপত্রসহ আপনার যা যা তথ্য লাগবে, তা পরে এসে নিয়ে যাইয়েন। এখন কিছুই বলতে পারব না।’ 

৯৯৯–এ কল পেয়ে ওই সময় হাসপাতালে যাওয়া উত্তরা পূর্ব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোফাজ্জল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিশুটিকে ঠান্ডা জনিত সমস্যায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। পরে ডাক্তাররা বলছে, শিশুটির ডেঙ্গু হয়েছে। তাই তাকে হাসপাতালে ভর্তিও করানো হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসায় শিশুর উন্নতি হচ্ছিল না, বরং অবনতি হচ্ছিল। এদিকে শিশুটির জ্বরও ছিল না। একপর্যায়ে শিশুটির মায়ের সন্দেহ হয়। পরে অন্য একটি হাসপাতালে পরীক্ষা করানো হলে ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। এ নিয়ে রোগীর স্বজন ও হাসপাতালের লোকজনের মধ্যে ঝামেলা হয়। পরে খবর পেয়ে এসে শিশুটিকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।’

ভুল চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই মোফাজ্জল বলেন, ‘হয়তো আইচি হাসপাতালের মেশিনে সমস্যা ছিল। যার কারণে ভুল রিপোর্ট এসেছে।’

শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ভুক্তভোগী শিশুর বাবা হারুনুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পরের দিন বৃহস্পতিবার (৩০ আগস্ট) ভুল চিকিৎসা কারণে আমি উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। একজন অফিসার পাঠিয়ে দিয়ে কিছুটা কম বিলের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছে। সেটি পরিশোধ করার পর শ্বশুরকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসি। বিল পরিশোধ করার পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার কাগজপত্র দেয়নি। তারা জোর করে রেখে দিয়েছে।’

শিশুটির চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ও আইচি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের মন্তব্য জানার জন্য পরপর তিন দিন হাসপাতালে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ভিজিটিং কার্ডে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে হাসপাতালের রিসিপশনিস্ট রিতমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ওই চিকিৎসকের ফোন নম্বর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। 

হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. শরিফুল ইসলামকে আইচি হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠালে তিনি অভিযোগটি মিথ্যা বলে দাবি করেন। ডেঙ্গু পরীক্ষার রিপোর্ট চাইলে সেটি দিতেও রাজি হননি তিনি।

শিশুটি এখন মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হসপিটালের শিশু বিভাগে ভর্তি। সেখানে শিশুটির মা চম্পা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আগে আইচি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা করাইছে। যার কারণে দিন দিন বাচ্চাটা সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে হয়েছিল। পরে এখানে (মহিলা মেডিকেলে) আসার সুস্থ হওয়া শুরু করেছে। এখন আগের থেকে অনেক ভালো।’

এ বিষয়ে মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হসপিটালের উপপরিচালক ডা. আমিনা হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হয়তো ওই হাসপাতালে রোগীর এক্স–রে বা অন্য কিছু করায়নি। তাই নিউমোনিয়া ধরা পড়েনি। করলে হয়তো বা ধরা পড়ত। আমাদের এখানে আসার পর তো নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। আমাদের চিকিৎসায় রোগী আলহামদুলিল্লাহ ভালোও আছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত