রিকশা গ্যারেজগুলোই বন্ধু এখন

ফজলুল কবির
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২১, ১৫: ২১
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২১, ২০: ২৯

গভীর রাত। চারপাশ নিয়ম মেনেই অন্ধকার। ফাঁকা শহর এই অন্ধকারকে আরও নিঝুম করেছে। পুলিশের দু–একটা টহল গাড়ি ছাড়া রাস্তায় কিছু নেই। যখন গন্তব্যে পৌঁছাতে দুই পা ছাড়া আর কোনো সহায় নেই বলে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে প্রায়, তখনই পাশ দিয়ে একটা খালি রিকশা যেতে দেখা গেল। নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতেও রাজি হলেন চালক; তবে কোনোমতেই ভাড়া ঠিক করা গেল না। রিকশায় চড়ে ‘ভাড়া মিটিয়ে নেওয়া উচিত’ বলে একটা ভাষণের প্রস্তুতি নিতেই বললেন—‘এখন সবার খারাপ সময়। আপনার পকেটে টাকা আছে কি–না, আমি তো জানি না। যা থাকবে দেবেন।’

কথাটা শুনে চুপ হয়ে যেতে হলো। চিন–পরিচয় হলো দ্রুতই। কবির নামে নাম—আহসান হাবিব। প্যাডেল মারা দেখে বোঝা যায়; নিজেও স্বীকার করলেন রিকশা চালাচ্ছেন এই কয়েক দিন হলো। কারণ আর জানতে চাওয়া হলো না। এমন তো অনেকের সঙ্গেই গল্প হলো গত দেড় বছরে। করোনার এই দুঃসময়ে কাজ হারিয়ে আক্ষরিক অর্থেই চোখে অন্ধকার দেখা মানুষদেরই একজন হবেন এই আহসান হাবিব। সে আলাপে না গিয়ে অন্য গল্প এগোল বেশ। মনে মনে ভাবনা—ঢাকার রিকশা গ্যারেজগুলোর কাঁধ এই আকালেই চওড়া হলো, নাকি আগে থেকেই ছিল, যা ঠাওর করা হয়নি কখনো!

‘আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন বলেই নয়, বন্ধুত্ব বলতে আসলে এটিই বোঝায়। আর এই ভয়াবহ দুঃসময়ে করোনা ও লকডাউনের ফেরে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তখন তাঁরা বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছেন ঢাকার রিকশা গ্যারেজগুলোকেই।

করোনা মহামারিকালে দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত তো বটেই, প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোও ভীষণ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। লকডাউনের কারণে মহানগরের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাঁদের আয়ের উপায় হারিয়েছেন। কর্মহীন হয়েছেন বিস্তর মানুষ। এর সঙ্গে ছোট থেকে মাঝারি বিভিন্ন শিল্প বন্ধ হওয়ায় আরও বহু মানুষ যুক্ত হয়েছেন কর্মহীনের তালিকায়। এর একাংশ ঢাকা ছেড়েছেন—এটা সত্য। কিন্তু এও সত্য যে, বহু মানুষ এখনো সুদিনের আশায় ঢাকাতেই রয়ে গেছেন। সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকামুখী জনস্রোতও থামেনি। এই আসা–যাওয়া চলছে। কিন্তু এই এত মানুষকে আশ্রয় কে দেবে?

চাইলেই তো আর কঠোর বিধিনিষেধ ডিঙিয়ে অতি ক্ষুদ্র পুঁজি সম্বল করে কোনো একটি পণ্য ঝাঁপিতে নিয়ে ফেরি করতে কিংবা রাস্তার ধারে বসে যাওয়া যায় না। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা যায় না যেমনই হোক একটা কোনো ব্যবসা। এমনকি অন্যের দেওয়া এমন কোনো ব্যবসায় কর্মী হিসেবে যোগ দেওয়াও সম্ভব নয়। কারণ, সেই স্বল্প পুঁজির অন্য লোকটিও এখন সচল শহরের আশায় দিন গুনছেন। বাকি রইল চাকরির বাজার। সোনার হরিণ আখ্যা পাওয়া এই মহার্ঘ্য বস্তু এই করোনাকালে রীতিমতো অমাবস্যার চাঁদ হয়ে উঠেছে।

এই তাবৎ আশা–চোখে খাবি খাওয়া মানুষদের বেঁচে থাকার অক্সিজেনটুকু দিচ্ছে ঢাকার গ্যারেজগুলো। আরও ভালো করে বললে রিকশা গ্যারেজগুলো।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মহানগর ঢাকায় যত কঠোর বিধিনিষেধই হোক, রিকশা কিন্তু চলছে। কখনো বেশি, কখনো কম—এটুকুই তফাৎ। নাগরিকদেরও যাতায়াতের ক্ষেত্রে রিকশাই এখন পরম বন্ধু। তিন চাকার এই বাহন শুধু পরিবহনের ক্ষেত্রেই নয়, খোদ মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রেই এক বড় ভূমিকা রাখছে। কতটা তা, একটি মাঝারি বায়িং হাউস থেকে চাকরি খুইয়ে পথে বসা আহসান হাবিব কিংবা ঢাকা–কুমিল্লা দূরপাল্লার বাসের চালক রেজাউলের মতো মানুষেরাই জানেন।

করোনার কারণে বিভিন্ন পেশায় থাকা বহু মানুষ হঠাৎ কাজ হারিয়ে যখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন, তখন এই রিকশা গ্যারেজগুলোই তাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কোনো একটি পরিচয় সূত্র ধরে ঢাকার গলি–ঘুপচিতে থাকা গ্যারেজগুলোয় গেলেই তাঁরা পেয়েছেন কোনো না কোনো উপায়। কখনো আধাবেলা, কখনো সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটি দিন ভাগ করে রিকশা চালিয়ে তাঁরা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধার জ্বালা মিটিয়েছে, মেটাচ্ছেন। এমনকি ঘোর দুঃসময়ে রায়েরবাজারের এক গ্যারেজ মালিকের খোঁজও পাওয়া গেল, যিনি লকডাউনের সময় নির্ধারিত জমাও মওকুফ করেন। শর্ত ছিল—নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে যা থাকবে, তা গ্যারেজে দিলেই হবে। এমন গ্যারেজ মালিকের সংখ্যা হয়তো অত বেশি নয়। কিন্তু এই দুঃসময়ে কাজ হারানো নিম্ন আয়ের মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার রিকশা ও অটোরিকশা গ্যারেজগুলো যে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আজকের এই বিশ্ব বন্ধু দিবসের সবটুকু ভালোবাসা তাই ঢাকার অন্যতম আইকন এই তিন চাকার বাহন ও এর গ্যারেজ মালিকদের প্রাপ্য। তাঁদের জন্য ভালোবাসা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত