‘মোগো চাউল লাগবে না, ভারতীয়গো মাছ ধরা ঠ্যাকান’

বরগুনা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১৬: ৫৫

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাদুরতলা এলাকার জেলে সেলিম মাঝি। নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর বেকার বসে আছেন। প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতে ৬৫ দিন ও মৌসুমের শেষের দিকে আরও ২২ দিন মোট ৭৭ দিন তাঁকে এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।

সেলিম বলেন, ‘এবার তেমন সুবিধা হয় নাই সাগরে, তয় নদীতে কিছু ইলিশ পাইছে। এহন অবরোধ যাওনের পর সাগরে নাইম্মা যদি মাছ পাই তয় খাইয়া পইড়্যা থাকতে পারমু।’ সেলিমের ক্ষোভ অবরোধের সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ ধরে। তাদের প্রতিরোধের দাবি তাঁর। সেলিম বলেন, ‘অবরোধের সময় মোগো মাছ সব ভারতীয়রা মাছ ধইর‍্যা লইয়া যায়। মোগো মাছ মোরা ধরতে পারি না। সরকাররে কই, মোগো চাউল লাগবে না, ভারতীয়গো মাছ ধরা ঠ্যাকান।’

প্রতি বছর ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময়ে সেলিমের মতো উপকূলের হাজার হাজার জেলের বেকার সময় কাটে। এ সময় সরকারি খাদ্য সহায়তার আওতায় থাকেন শুধু নিবন্ধিত জেলেরা। বাকিদের দিন যায় অনাহারে অর্ধাহারে।

উপকূলীয় এলাকায় সাধারণত দুই শ্রেণির জেলে আছেন। এক শ্রেণি গভীর সমুদ্রগামী, যারা মৌসুমের সময় গভীর সমুদ্রে ইলিশ শিকারের আশায় বছরের বাকিটা সময় বেকার থাকেন। আর এক শ্রেণি প্রান্তিক জেলে, যারা স্থানীয় নদ-নদীতে ছোট নৌকায় দল বেঁধে মাছ ধরেন। তাঁরা পেশাদার জেলে নন, কৃষি বা দিনমজুরের কাজ করেন। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় প্রান্তিক জেলেরা অন্য কাজ করলেও গভীর সমুদ্রগামী জেলেরা বেকার বসে থাকেন।

বরগুনার পাথরঘাটার বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) ঘাটে নোঙর করে রাখা হয়েছে ট্রলার। গভীর সমুদ্রগামী জেলে সিদ্দিকুর রহমান আকন বলেন, ‘মোরা যহন সরকারের কতা মাইন্না মাছ ধরা বন্ধ রাহি তহন ওরা (ভারতীয় জেলেরা) আমাগো সাগর চইষ্যা বেড়ায়। বড়বড় ট্রলিতে মাছ ধইর‍্যা লইয়া যায়। এইয়া না ঠেহাইতে পারলে কোনো কাম অইবেনা। সরকার দুগ্গা চাউল দেয় হেইয়াও সোমায় মতো পাই না। মোরা না খাইয়া থাকতেও রাজি আছি তোমো (তবুও) ওগো মাছ ধরা যেন সরকার ঠ্যাকাইয়া রাহে।’

একই কথা বলেন বরগুনা জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দুলাল মাঝি। তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় আমরা শ্রমিক ইউনিয়ন জেলেদের নিষেধাজ্ঞা শতভাগ মানার পরামর্শ দেই। কিন্তু ভারতীয় জেলেরা সাগরে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যায়। এটা প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা নিষেধাজ্ঞার সুফল থেকে বঞ্চিত হব।’

এ ব্যাপারে সংগঠনের পক্ষ থেকে কখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা গোটা মৌসুমের একটা বিরাট সময় নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকি। এ সময় ইন্ডিয়ানরা অবাধে আমাদের মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আমরা কথা বলেছি। জেলেরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে। গত দুই বছরে বেশ কিছু ভারতীয় জেলে আমাদের সমুদ্রসীমায় আটকও হয়েছে। কিন্তু তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না।’

নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে ট্রলার মেরামতে বরগুনার সদর উপজেলা পোটকাখালী এলাকায় ডকইয়ার্ডে তোলা হয়েছে।চলতি বছর সর্বশেষ গত আগস্টে ৩১ জন ভারতীয় জেলে আটক হয়। এর আগে জুন মাসে বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরার দায়ে আটক ১৩৫ ভারতীয় জেলেকে কারাগারে পাঠানো হয়। এটি নিয়মিত ঘটনা। যেখানে মা ইলিশ রক্ষায় মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা গত ৬ অক্টোবর দিবাগত রাত ১২টা থেকে দেশের সব নদী ও সাগরে টানা ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এবারও জেলেরা ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কোস্টগার্ড সদর দপ্তরের (ঢাকা) মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি সেলফোনে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা এর আগেও বেশ কিছু ভারতীয় জেলেদের আটক করেছি। এবার নিষেধাজ্ঞার সময় আমাদের সমন্বিত টহল থাকবে। কেউ যাতে মাছ শিকারের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। ভারতীয় জেলেদের আমাদের সমুদ্রসীমায় মাছ শিকারের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।’

বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, ‘২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে জেলেদের মাছ না ধরায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। এই ২২ দিন মাছ রা বন্ধে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর, কোস্টগার্ড, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং স্থানীয় মৎস্য বিভাগের উদ্যোগে ব্যাপকভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানো হবে। এ ছাড়া ভারতীয় জেলেদের ইলিশ শিকার বন্ধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের বৈঠক হয়েছে। আশা করি, এবার কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পার পাবে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত