ভুল রক্ত দেওয়া সেই বৃদ্ধার অবস্থার অবনতি, উন্নত চিকিৎসার সামর্থ্য নেই পরিবারের

যশোর প্রতিনিধি
আপডেট : ১০ জুন ২০২৪, ২০: ২৫
Thumbnail image

যশোর জেনারেল হাসপাতালে রোগীর শরীরে তিন ব্যাগ ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেওয়া ওই বৃদ্ধার শরীরে নতুন করে নানা রোগ দেখা দিয়েছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ৭৭ বছর বয়সী বৃদ্ধা সালেহা বেগম। বৃদ্ধার স্বজনেরা জানান, সালেহার স্বাস্থ্যের দিন দিন অবনতি হচ্ছে। পুরোনো রোগের সঙ্গে নতুন করে সমস্যা দেখা দিয়েছে বোনম্যারো, কিডনি ও হার্টের। এমন অবস্থায় উৎকণ্ঠায় শয্যাশায়ী ওই বৃদ্ধার স্বজনেরা। 

এদিকে এ ঘটনায় ৬ জুন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক গৌতম কুমার আচার্যকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে হাসপাতাল প্রশাসন। কমিটিকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

বর্তমানে ওই রোগী জেনারেল হাসপাতালের মহিলা পেয়িং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তিনি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের খড়িঞ্চা হেলাঞ্চি গ্রামের মৃত শামসুর রহমানের স্ত্রী। 

ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনেরা জানান, বার্ধক্যজনিত রোগে গত ২০ মে যশোর মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসকের পরামর্শে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সালেহা বেগমকে। সালেহার শরীরে রক্তশূন্যতার কারণে রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। রক্ত দেওয়ার জন্য হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে গিয়ে সালেহার রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেন স্বজনেরা। সেখানে সালেহার রক্তের গ্রুপ আসে বি পজিটিভ। 

এরপর ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সালেহার স্বজনদের ‘বি’ পজিটিভ রক্তদাতাকে খুঁজে আনতে বলেন। বি পজিটিভ গ্রুপের রক্তদাতাকে এনে সালেহার শরীরে রক্ত দেওয়া হয়। ২০, ২২ ও ২৪ মে তিন দিন তিন ব্যাগ বি পজিটিভ রক্ত দেওয়া হয়। যদিও ওই বৃদ্ধার রক্তের গ্রুপ ‘এ’ পজিটিভ। 

তিন ব্যাগ রক্ত দেওয়ার দুই দিন পর সালেহার পরিবার তাঁকে গ্রামে নিয়ে যান। গ্রামে গিয়ে সালেহার শরীর জ্বালাপোড়া, বমিসহ খিঁচুনি শুরু হয়। এসব উপসর্গের কারণে স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২ জুন (সোমবার) বিকেলে অবস্থার অবনতি হলে আবারও যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক সালেহাকে আবারও রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দেন। 

চিকিৎসকের পরামর্শে ৩ জুন (মঙ্গলবার) সকালে বি পজিটিভ রক্তদাতাকে নিয়ে সালেহাকে রক্ত দিতে গেলে সেই ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারাই বলেন, সালেহার রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ না। তাঁর রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। এরপর রোগীকে ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে রোগীর স্বজনেরা হট্টগোল শুরু করেন। পরবর্তীকালে হাসপাতালের কর্মকর্তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। 

আজ সোমবার দুপুরে সরেজমিন যশোর জেনারেল হাসপাতালের মহিলা পেয়িং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ভুক্তভোগী রোগী হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী। কোনো কথা বলতে পারছেন না। মানুষের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন। স্বজনের ভাষ্য, মৃত্যু পথযাত্রী সালেহা বেগমকে দেখতে আসছে স্বজনেরা। অনেকেই বেডে বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছেন। হাসপাতালের নার্সের সঙ্গে নিয়মিত দেখাশোনা করছেন তাঁর তিন মেয়ে।

বৃদ্ধার মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মায়ের দিন দিন স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। কিছু খেতে পারছে না। শরীর একদম রুগ্‌ণ হয়ে গেছে। হাসপাতালে যখন মাকে নিয়ে আসি, তখন আমাদের হাত ধরে হেঁটে হাসপাতালের চারতলায় উঠেছিল। এখন মাকে তিন–চারজন কোলে তুলে টয়লেটে নিয়ে যাওয়াসহ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করতে হচ্ছে।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকের পরামর্শে মাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম সুস্থ করতে, অথচ আমার মা এখন মৃত্যু পথযাত্রী। চিকিৎসকের পরামর্শে মায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা করেছি। সেখানে মায়ের বোনম্যারোর সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভুল রক্ত দেওয়া আগে মায়ের কিডনির ক্রিয়েটিনিন লেভেল ছিল ১ দশমিক ৫০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার। এখন সেটি বেড়ে ২ দশমিক ২২ হয়েছে। প্রস্রাবের নালিতে সংক্রমণসহ দেখা দিয়েছে হার্টের সমস্যা। এখানকার চিকিৎসকেরা মাকে বিভিন্ন চিকিৎসা দিচ্ছে—এটা সত্য। তবে তাঁরা বলছেন মাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকাতে নিয়ে যেতে। তবে পরিবারের অসামর্থ্যের কারণে সেখানে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ 

ভুক্তভোগী ওই রোগীর আরেক মেয়ে শিরিনা আক্তার বলেন, ‘হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের ভুলের কারণে আমার মা এখন জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তিনি এখন খুব অসুস্থ। তাঁর শরীরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সুস্থ করার জন্য আমার মাকে হাসপাতালে এনেছি, এখন তাঁর অবস্থা খারাপ। এ ঘটনার বিচার চাই।’ 

এদিকে এ ঘটনায় ৬ জুন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগরে চিকিৎসক গৌতম কুমার আচার্যকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি করেছে হাসপাতাল প্রশাসন। 

এ বিষয়ে গৌতম কুমার আচার্য বলেন, ‘রোগী শঙ্কামুক্ত নয়। রোগীর নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমরা তদন্তের কাজ শুরু করেছি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।’ 

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন আর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে রোগীর যাবতীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন। ঘটনা ঘটার পরে ভুক্তভোগী রোগীদের স্বজনদের অভিযোগে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদেরকে এক সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে রক্তের কিছু উপাদানও কম রয়েছে। যার কারণে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করতে বেগ পেতে হয়েছে ট্রান্সফিউশন মেডিসিন কর্মীদের। যার ফলে এমন সমস্যা হতে পারে। তারপরও তদন্ত করা হচ্ছে। কারও কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত