পলিথিনমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নে ইফতেখারুল

 রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৮: ৩৫
আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৮: ১০
ভুট্টায় তৈরি বায়োটেক ব্যাগ কারখানা। ছবি: মিলন শেখ

প্রথম দেখায় পলিথিনের ব্যাগ ছাড়া কিছুই মনে হবে না। তাতে পানিও বহন করা যায় নিশ্চিন্তে, যেমন করা যায় পলিথিনে। কিন্তু পলিথিন না পচলেও এটি পচে যায় বলে পরিবেশের ক্ষতি করে না। এই ব্যাগ তৈরিতে পেট্রোলিয়াম নয়, ব্যবহার করা হয় ভুট্টার উপাদান। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চাপাল এলাকায় চার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ব্যাগ তৈরির কারখানা। উদ্যোক্তা ইফতেখারুল হক।

খোঁজ মিলল যেভাবে

ব্যবসায় প্রশাসনে পড়াশোনা শেষ করে পাটশিল্পে ক্যারিয়ার গড়েছিলেন ইফতেখারুল হক। দেখলেন, পলিথিনের কারণে দেশের পাটশিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। ইফতেখারুল ভাবেন, পাটের ব্যাগ দিয়ে আসলে পলিথিনকে ঠেকানো সম্ভব নয়। সেটিকে আটকাতে হলে পলিথিনের মতোই বিকল্প কিছু প্রয়োজন।

তারপর ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন ইন্টারনেটে। খুঁজতে খুঁজতেই পেয়ে যান জার্মান টেকনোলজির ভুট্টায় তৈরি বায়োটেক ব্যাগ। তথ্য পেলেন, বেশ কিছু দেশে সেগুলোর উৎপাদন ও ব্যবহার হচ্ছে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে ইফতেখারুল ভারতের আহমেদাবাদে যান এই ব্যাগ তৈরির একটি কারখানা পরিদর্শনে। দেখে সবকিছুই পছন্দ হয়। সেখানেই এই ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল এবং কারখানার বিভিন্ন যন্ত্র অর্ডার দিয়ে আসেন। দেশে এসে পড়ে থাকা গোদাগাড়ীর জমিতে স্থাপন করেন কারখানা, ক্রিস্টাল বায়োটেক।

ব্যাগের বৈশিষ্ট্য

দেখতে পলিথিন ব্যাগের মতো হলেও ভুট্টার তৈরি এ ব্যাগ ওজনে কিছুটা ভারী। এই ব্যাগে যেকোনো পণ্য পরিবহন করা যায়। এমনকি পানিসহ মাছও নেওয়া যায় বায়োটেক ব্যাগে। আর এতে খাবার রাখাও নিরাপদ।

ইফতেখারুল সম্প্রতি একটি পলিথিন এবং একটি বায়োটেক ব্যাগে ২০ দিন কাঁচা মরিচ রেখেছিলেন ফ্রিজে। দেখা গেছে, পলিথিনের ভেতর পানি জমে কাঁচা মরিচ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বায়োটেক ব্যাগের ভেতরটা ছিল শুকনো। তাতে কাঁচা মরিচের কোনো ক্ষতি হয়নি। বছরের পর বছর পলিথিন যখন মাটিতে পচে না, তখন বায়োটেক ব্যাগ ব্যাকটেরিয়ার ছোঁয়ায় ছয় মাসের মধ্যে প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়।

আসলেই কি ভুট্টার ব্যাগ

ক্রিস্টাল বায়োটেকের কর্ণধার ইফতেখারুল জানালেন, মসুর ডালের দানার মতো সাদা সাদা একটি কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করতে হয় এই ব্যাগ তৈরির জন্য। এই বায়োপ্লাস্টিকই ব্যাগ তৈরির একমাত্র উপাদান। এটিতে থাকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, পিএলএ, পিবিএটি এবং ভুট্টার দানার ভেতরের সাদা অংশ। তাই এটি ভুট্টার ব্যাগ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। ব্যাগ তৈরির ওই কাঁচামালে ওয়ানস্টার্চসহ থাকে আরও কিছু বায়ো ম্যাটেরিয়াল।

ইফতেখারুল তাঁর কারখানার জন্য আবেদন করে রাখলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাননি এখনো। বুয়েটে ব্যাগ পরীক্ষার আগে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আর বিএসটিআই মৌখিকভাবেই ব্যাগ তৈরির অনুমোদন দিয়েছে ইফতেখারুলকে।

ভুট্টায় তৈরি বায়োটেক ব্যাগ কারখানা। ছবি: মিলন শেখ
ভুট্টায় তৈরি বায়োটেক ব্যাগ কারখানা। ছবি: মিলন শেখ

বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে

দিনে দিনে পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগের কথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে কারখানায় অর্ডার আসছে। শুধু তা-ই নয়, ইতিমধ্যে দুবাইয়ে রপ্তানি হয়েছে এই ব্যাগ। আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে নমুনা পাঠানো হয়েছে। রপ্তানির বিষয়ে আলোচনা চলছে। বায়োটেক ব্যাগের দাম অবশ্য পলিথিনের চেয়ে কিছুটা বেশি।

১ কেজি পণ্য রাখা যায় এমন ব্যাগ কারখানা থেকে বিক্রি করা হয় প্রতিটি ২ টাকা। এ ছাড়া দেড় কেজির ব্যাগ ৩ টাকা এবং ৩ কেজির ব্যাগ ৫ টাকায় বিক্রি হয় কারখানা থেকে।

উদ্যোক্তারাও আসছেন কারখানায়

ইফতেখারুল দাবি করছেন, দেশে তিনিই প্রথম পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ তৈরি শুরু করেন। তারপর আরও দু-এক জায়গায় শুরু হয়েছে। তিনি চান, এই ব্যাগ তৈরির কারখানা ছড়িয়ে পড়ুক। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্যোক্তারা তাঁর কারখানা পরিদর্শনে আসছেন।

ইফতেখারুল। ছবি: আজকের পত্রিকা
ইফতেখারুল। ছবি: আজকের পত্রিকা

যে স্বপ্ন দেখেন ইফতেখারুল

ইফতেখারুল স্বপ্ন দেখেন, একদিন দেশে কোনো পলিথিন ব্যাগ থাকবে না। তিনি বলেন, ‘আমি তো অন্য ব্যবসাও করতে পারতাম। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে আমি এই প্রতিষ্ঠান গড়েছি।’

অন্তর্বর্তী সরকার পলিথিন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সাধুবাদ জানান ইফতেখারুল। তিনি সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের এক মেলায় অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে বেশ প্রশংসিত হয়েছে এই পরিবেশবান্ধব ব্যাগ। পরিবেশ উপদেষ্টা এই ব্যাগ সম্প্রসারণের আগ্রহ দেখিয়েছেন।

ইফতেখারুল মনে করেন, পলিথিনের সব কারখানা এই বায়োটেক ব্যাগ তৈরির কারখানায় রূপান্তর করা সম্ভব। অল্প কিছু অর্থ ব্যয় হলেও কোনো শ্রমিক বেকার হবেন না। এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে ইফতেখারুল এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টাল বায়োটেক।

কিছু বিতর্ক থাকলেও পলিথিনমুক্ত পৃথিবী এখন সবার স্বপ্ন। রাজশাহীর ইফতেখারুল হক সেই স্বপ্নের বীজ বুনেছেন। এখন দেখার বিষয়, সেই বীজ থেকে কত দ্রুত চারা জন্মায়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত