মানুষের বাড়িতে কাজ কইরা খিলায়া সন্তানের লেহাপড়া করাইছি গো, সবুজের মা

জসিম উদ্দিন, নীলফামারী
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৪, ১৯: ৪৬
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৪, ২০: ১৫

‘আহারে আমার পুত্র কো, আমার বেটা কো। আমাক বেটা আইনা দেও বাবা। ও বাবারে আমার বাবাক আইনা দেও। দয়াল আল্লাহ আমার বেটাক দেও গো আমার বেটাক। আমি কত দুঃখিনী মাও, আমি কত দুঃখ-কষ্ট কইরা বেটাক লেখাপড়া করাইছি। আমার বেটাক দেও গো আমার বেটাক।’ 

এভাবেই আহাজারি করে কথাগুলো বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে নিহত ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী সবুজ আলীর মা সূর্য বানু। নিহত সবুজের বাড়ি নীলফামারী জেলা সদরের চওড়াবড়গাছা ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার আরাজী দলুয়া গ্রামে। বাবা আব্দুর রহিম বাদশা ভ্যানচালক এবং সূর্য বানু কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। দুজনের সামান্য আয়ে ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন ঢাকা কলেজে। স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলে লেখাপড়া করে ধরবে সংসারের হাল। কিন্তু নিমেষেই সে স্বপ্ন নিভে গেল মা–বাবার। 

পারিবারিক সূত্র জানায়, একমাত্র বাড়ির ভিটের আট শতক জমি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ নেই পরিবারে। বাবার ভ্যান চালানোর আয়ে চলে তাঁদের পরিবার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে সবুজ আলী তৃতীয়। সবার বড় ভাই সুজাব আলী একজন প্রতিবন্ধী। মেজ ভাই নূর নবী ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করে সংসার খরচে কিছুটা জোগান দেন। একমাত্র বোন বাছিরণ বেগমের বিয়ে হয়েছে। সবুজ আলী ঢাকা কলেজে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স শেষে ভর্তি হয়েছেন মাস্টার্সে। তাঁর ছোট ভাই শাহ সুলতান পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়ে এইচএসসিতে।

আজ বুধবার দুপুরে জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে সবুজ আলীর বাড়িতে গেলে দেখা যায় শোকের মাতম। ছেলের শোকে মা সূর্য বানু শয্যাশায়ী। ছেলের স্মৃতিতে মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল নানা প্রলাপ। তাঁর বাবা আব্দুর রহিম বাদশা বাড়িতে নেই। 

প্রতিবেশীরা জানান, দুই মাস আগে সবুজের টাকার প্রয়োজনে বাবার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বনের ব্যাটারিচালিত ভ্যানটি বিক্রি করেছেন তিনি। এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি শ্রমিকের কাজে রয়েছেন ঢাকার মানিকগঞ্জ জেলায়। সবুজের মৃত্যুর খবর বাড়িতে এলেও মোবাইল ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর বাবাকে।

সবুজের মা সূর্য বানু বলেন, ‘আমার বাবার হ্যাতে (সাথে) কয়দিন কথা কইনা। নাতি নইয়া (মেয়ের ছেলে) একদিন কথা কইছি, আর কথা কয় নাই আমার বাবা। কালকে ফোন দিছি, হ্যার ফোন বন্ধ, দুইবার ফোন দিছি, ফোন বন্ধ। রাইত ২টার সময় মানুষ এইহানদি হাঁটা-চলা করতাছে, একটা চেংড়া আইসা আমাক ডাক দিছে। আমার বড় বেটার নাম্বার চায়। নাম্বার চাইস ক্যা, কয় যে সবুজের কাছে কি ফোন দিছিলেন। বলি ফোনতো দিছিলাম দুইবার, ফোন বন্ধ দেহাইছে। বলি ক্যারে, সবুজের কি হইছে? তখনতো আমার মনে ডাং (শঙ্কা) পইরা গেল।’

সূর্য বানু আরও বলেন, ‘আমার সবুজ বেটা যদি এক দিন ফোন না ধরে, আমি পাগল হয়া যাই। এমনে আমার ওই সন্তান, আমি মাও যেই দিনেই হ্যারে মনে করি ওই দিনেই আমার বেটা ফোন দেয়। কালকা থাইকা ফোন পাইনাই, সারা রাইত ঘুমাই নাই। আমি কানতাছি আল্লার কাছে, আমার বেটা ফোন ধরল না, কহন রাইত পোহাইব, আমি কার কাছে যামু। কার কাছে যায়া আমার বেটার খোঁজখবর নিমু। হের লাইগা আল্লাহ-বিল্লা করতাছি কহন রাইত পোহাইব। তার মধ্যে রাইত দুইটার সময় ওই মোবাইল নাম্বারের লাইগা আইছে।’ 

দুঃখ–কষ্টের কথায় বলেন, ‘আমার চোহে সমস্যা, হাঁটতে পারি না তাও সন্তানেক আমি তদবির করছি। আহারে কইলজার টুকরা, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ কইরা খিলায়া আমি সন্তানের লেহাপড়া করাইছি গো। আমার এই সন্তানের বিচার আমি চাই, ন্যায্য বিচার আমি চাই। আমার সন্তানকে কী করল, আমার সন্তান আমি চাই, আমার বেটা চাই। আমার সন্তান কোনোদিন গ্রামে নারাই করে নাই, আমার সবুজ শান্ত।’ 

সবুজের ছোট ভাই শাহ সুলতান জানান, ১৩ জুলাই সকাল পৌনে ৮টার দিকে শেষ কথা হয়েছিল পরিবারের সঙ্গে। সেদিন নিজে ফোন করে মাসহ সবার খোঁজখবর নিয়েছেন। জানিয়েছিলেন ভালো থাকার কথা। 

চওড়াবড়গাছা ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘সবুজ আলী আমার প্রতিবেশী। তাঁর বাবা ভ্যান চালিয়ে অনেক কষ্টে ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগান দিচ্ছিলেন। ছেলের মাস্টার্স ভর্তির জন্য টাকার প্রয়োজনে দুই মাস আগে সে ভ্যানটি বিক্রি করে দেন। এরপর সংসার চালাতে দিনমজুরির কাজে বর্তমানে রয়েছেন মানিকগঞ্জ জেলায়। ছেলের মৃত্যুর খবর দেওয়ার জন্য আমরা মোবাইল ফোনে তাঁকে চেষ্টা করেও পাচ্ছি না।’ 

হাফিজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সবুজ শান্ত স্বভাবের। এলাকায় তাঁকে সকলে ভালো ছেলে হিসেবে চিনে। লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সে স্বপন আর পূরণ হলো না পরিবারের।’ 

প্রতিবেশী অনার্সপড়ুয়া শিক্ষার্থী কাওছার আলী বলেন, ‘সবুজ আলী আমার এলাকার বড় ভাই। তিনি ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজে। সম্প্রতি অনার্স পর্ব শেষে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন বলে আমি জানি। কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের ২০৫ নম্বর কক্ষে থেকে লেখাপড়া করতেন। পাশাপাশি একটি ফটোস্ট্যাট দোকানে কাজ করতেন।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত