লোকজ কাহিনি থেকে জনপ্রিয় উর্দু ধারার দিকে যাত্রা

অনুপম হায়াৎ 
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪: ৪৮
Thumbnail image

এফডিসি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া শুরু করল। এটি ছিল অন্যতম মাইলফলক। ইন্ডাস্ট্রি, চলচ্চিত্রের ভাষা, বিষয়বস্তু—সবকিছু পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হলো এর মধ্য দিয়ে। তখন পর্যন্ত কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ বা লাহোরের ছবিতে ব্যবহৃত ভাষাকাঠামো, চিন্তাচেতনা, পরিবেশ ইত্যাদি জায়গা পেত এ দেশের চলচ্চিত্রে। এই প্রথম লোকজ ও গ্রামীণ জীবনের কাহিনি নিয়ে ছবি নির্মাণ শুরু হলো। 

 ‘আসিয়া’র মাধ্যমে এটা শুরু হয়। কেউ যদি চলচ্চিত্রটি দেখে থাকেন তাহলে দেখবেন, এখানে কতগুলো সিম্বল আছে। এর পরিচালক ছিলেন ফতেহ লোহানি। নাজির আহমেদ ছিলেন কাহিনিকার। ছবিটির গানে সুরারোপ করেছেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন সমর দাস ও আব্দুল আহাদ। এটা এক বিশাল ব্যাপার। পূর্ববঙ্গের যে লোকজ ঐতিহ্য, সে বিষয়গুলো ফুটে উঠল। গানগুলোও তাই। এই ছবির মাধ্যমে একটা নতুন ধারার সৃষ্টি হলো। 

এ জে কারদার ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ সিনেমায় খান আতাউর রহমান ও তৃপ্তি মিত্রএরপর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবির চরিত্র ‘হিন্দু’ বলে পাকিস্তান সরকার তা নির্মাণের অনুমতি দিল না। মুসলমান চরিত্র তৈরি করা হলো। উর্দু ভাষায় নির্মিত হলো। নাম দেওয়া হলো ‘জাগো হুয়া সাভেরা’। এই ছবি ঢাকার চলচ্চিত্রের জন্য এক ইতিহাস। 

 ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের অসাধারণ সব কলাকুশলীর মিলন ঘটেছিল। ছবিটি নির্মিত হয়েছিল উপমহাদেশের রাজনীতিরও এক ক্রান্তিকালে। বাংলা সাহিত্যের অনন্য লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। পরিচালনা করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানেরই নামজাদা চলচ্চিত্রকার এ জে কারদার। আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছবির সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। প্রধান চরিত্রে ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভিনেতা খান আতাউর রহমান, কাজী খালেক ও শেখ লতিফ। আতাউর রহমান ও কাজী খালেকের পাশাপাশি শেখ লতিফের চরিত্রটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে বিদেশি সাংবাদিকরাও এই চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ভদ্রলোক এখন মৃত্যুশয্যায়। এই ছবির কলাকুশলীদের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র তিনিই এখনো বেঁচে আছেন। ছবিটিতে ছিলেন কলকাতার গণনাট্য সংস্থার বিখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। সংগীত পরিচালনায় ভারতের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ তিমির বরণ। ক্যামেরায় ছিলেন অস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক ওয়াল্টার লাসালি। সব মিলিয়ে বলতে হয়, এক মহাযোগই ঘটেছিল এই ছবিতে। ছবিটি মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেয়েছিল, প্রতিযোগিতাও করেছিল অস্কারের জন্য। 

এফডিসির প্রাথমিক অবস্থায় বেশ কিছু ভালো ছবি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এফডিসি প্রতিষ্ঠা না করলে বাংলাদেশের মানুষের জীবন, ভাষা, সমাজের এত ব্যাপক প্রকাশ বা এর ভাষ্য প্রতিষ্ঠা পেত না। 

ভাষা তো বিষয়বস্তু অনুসারে আসে। মরুভূমিতে নিশ্চয়ই জাল ফেলার দৃশ্য দেখানো হবে না। নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলে স্থানীয় কলাকুশলীরা নিজেদের ভাষা বলা শুরু করল। ‘আসিয়া’, ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রগুলো খুবই ভালো চলল। ছবিগুলোয় আমাদের এই বাংলার চিত্রটাই কোনো না কোনোভাবে ফুটে উঠল।

এ সময় জহির রায়হান চলচ্চিত্রে জড়িত হন। জহির রায়হান ‘কখনো আসেনি’ নামে একদম বাস্তববাদী ছবি তৈরি করেন। ‘কখনো আসেনি’ ছবি দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা নিয়ে আসেন জহির রায়হান। এই চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘দেশের জনগণ বিশ বছর পরে যে ছবি দেখবে বলে আশা করেছিল, বিশ বছর আগেই দেশের তরুণেরা সেই ছবি উপহার দিল।’ 

এহতেশাম পরিচালিত ‘চান্দা’ সিনেমা একটি মাইলফলক হয়ে আছেষাটের দশকের আরও একটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘নদী ও নারী’। চলচ্চিত্রের এক নতুন ভাষা তৈরি হয় এই ছবির মাধ্যমে। হুমায়ূন কবিরের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেন সাদেক খান। ১৯৬৫ সালের ৩০ জুলাই মুক্তি পায় ছবিটি। 

সাদেক খানের পরিচালনায় প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেন আবদুল খালেক ও রওশন আরা। আরও ছিলেন সুভাষ দত্ত, মাসুদ খান ও গোলাম মুস্তাফা। প্রধান সহকারী ও শিল্প নির্দেশক হিসেবে ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। আবেদ হোসেন খানের সংগীত পরিচালনায় গানে কণ্ঠ দেন আবদুল আলীম ও নীনা হামিদ। চিত্রগ্রহণে ছিলেন উইলিয়াম। ‘নদী ও নারী’র জন্য নির্মাতার শ্রম প্রতিটি দৃশ্যে বোঝা যায়। নতুন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সম্পূর্ণ আউটডোর চিত্রায়ণ নিশ্চয় অনেক ব্যয় ও শ্রমের ছিল। 

এত সব চেষ্টা আর শ্রম কিন্তু সফলতা পাচ্ছিল না। বিদেশি, বিশেষ করে উর্দু ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের নতুন ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াতে পারছিল না। সুচিত্রা সেন, নিলু, মেরিলিন মনরোর সঙ্গে আমাদের নতুন নায়িকা সুমিতা দেবী, শবনম, রওশন আরাদের জনপ্রিয়তায় পাল্লা দিতে হতো। এই অবস্থায় আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ছবিগুলো ফ্লপ হওয়া শুরু হলো। তখন নির্মাতারা চিন্তা করলেন, যদি আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারটা ধরতে পারি, তাহলে ইন্ডাস্ট্রিটা টিকে থাকবে। 

বাঙালি পরিচালকেরাও উর্দু ভাষায় ছবি নির্মাণ শুরু করলেন। এর মধ্যে এহতেশাম বানালেন ‘চান্দা’, যা সুপারডুপার হিট হলো পুরো পাকিস্তানে। শুরু হলো নাচেগানে ভরা অদ্ভুত একধরনের ছবির জোয়ার। যে আব্দুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’ বানিয়েছেন, তিনিও উর্দু ভাষায় ছবি নির্মাণ শুরু করলেন। জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’, ‘কাচের দেয়াল’-এর মতো ছবি ফ্লপ হলো। জহির রায়হানও তখন উর্দু ভাষায় ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করলেন। এটি কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি। অবাক কাণ্ড! আমাদের এখানে কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না, তার পরও তাঁরা নানা রকমের কসরত করে ছবিটা তৈরি করলেন। উর্দু ভাষায় ছবি তৈরির জোয়ার এল।

অনুপম হায়াৎ: চলচ্চিত্র গবেষক ও বিশ্লেষক। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাবেক সদস্য। 

(অনুলিখন: মীর রাকিব হাসান)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত