মারুফ রসূল
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার জন্যই কেবল হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত হয়নি; কার্যত এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আদর্শিক যাত্রাপথের মানচিত্রটাই বদলে ফেলা হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এসেছিল, কেবল ক্ষমতা দখলই তাদের উদ্দেশ্য ছিল—এটুকু বললে আসলে অর্ধেকটা বলা হয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আদর্শিক ঘোষণাপত্রটি বাতিল করে দেওয়া। সুতরাং কেবল ‘কতিপয় বিপথগামী’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল’ সেনা-কর্মকর্তার নির্মমতায় বাংলার মানুষ তার প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছেন, অঙ্কটি আমার কাছে এত সরল কোনো দিনই মনে হয়নি। অথচ কী আশ্চর্য! গত সাড়ে চার দশকের অধিক সময় ধরে, প্রতিটি ১৫ আগস্টের ব্যথাতুর স্মরণে, আমরা কেবল ঘটনার উপরিতলটিই দেখে এসেছি। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার অনেকাংশেই সম্পন্ন হয়েছে, বিচারের রায় কার্যকরের যেটুকু বাকি আছে, সে বিষয়েও সরকারি তৎপরতার সংবাদ আমরা মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে পড়ি; কিন্তু এ নির্মমতার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, হোক তা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, তাদের বিষয়ে আমাদের ইতিহাস কতটুকু সচেতন?
জানি, প্রসঙ্গটি আজ আমি যত সহজে উত্থাপন করলাম, ১৩-১৪ বছর আগেও তা এমন সহজ ছিল না। যে হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধের জন্য সংসদ ডেকে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, যে পিশাচ হত্যাকারীদের অন্যতম রক্ষক ছিল খোদ রাষ্ট্র, যে হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দিতে অবৈধ সামরিক সরকার ও তাদের তল্পিবাহকদের মদদে একের পর এক মিথ্যাচার সাজানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রীয় অপতৎপরতায় সেগুলোকে জারি রাখা হয়েছিল দশকের পর দশক, সেই ষড়যন্ত্রের ঠিকুজি-কুষ্ঠি খুঁজে বের করলে অনেক ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চেহারাটি বেরিয়ে আসবে। বোধ করি এ কারণেই, আইনমন্ত্রীর একাধিক প্রতিশ্রুতি এমনকি আদালতে রিট করা সত্ত্বেও পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রগুলো খুঁজে বের করার স্বাধীন তদন্ত কমিশনটি আজও গঠিত হয়নি।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্রগুলো খুঁজে বের করার অনেকগুলো সূত্র আজ হাতের কাছেই পাওয়া যায়। ইতিহাসের নৃশংসতম এ দুটো হত্যাকাণ্ডের বিচারিক রায় ছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার নথিপত্র ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসন্ধানও আজকের দিনে খুব একটা কঠিন কাজ নয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়ার যে দীর্ঘ চড়াই-উতরাই, তা থেকেও নানা ধরনের সূত্র পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এ সূত্রগুলোর আদলে সমীকরণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কোথায়? অনেকেই হয়তো বলবেন, সামনে তো সময় আছে; কিন্তু আমার সবিনয় নিবেদন, সময় আসলে নেই; আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, নির্ধারিত সময় বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। আরও যেটুকু যাবে, তাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছুই হবে না।
আমার এ আশঙ্কার মূল কারণ হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে দেশি-বিদেশি এমন কিছু প্রতিষ্ঠান জড়িত, যেগুলো আজকের দিনেও খুব ভালোভাবেই ক্রিয়াশীল। খোদ রাষ্ট্রীয় যে প্রতিষ্ঠান আর তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর নানামাত্রিক ব্যর্থতার আলোচনা বিভিন্ন সময়ে করা হয়, তারা তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকছে না। আজ বাংলাদেশে এমন একটি সময় চলছে, যেখানে সবাই দেখি আওয়ামী লীগের জান-লড়িয়ে-দেওয়া সমর্থক। আগে যাঁরা বিএনপি-জামায়াত থেকে নির্বাচন করতেন, এখন তাঁরা নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেন। এসব ডালভাততুল্য উদাহরণ দিলে আজকাল পাঠক হাসেন। সরকারি দপ্তর থেকে স্বাধীন ব্যবসাদার, যানবাহনচালক থেকে সহযাত্রী, সেনানিবাস থেকে আদালতপাড়া—সবখানেই আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে আলোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা প্রায় সবাই বংশপরম্পরায় আওয়ামী লীগেরই সমর্থক। এমনকি ছোটবেলায় যাঁদের তীব্র আওয়ামীবিরোধী হিসেবেই চিনেছিলাম, বড়বেলায় তাঁদের মুজিব কোটের বাহার দেখে চোখ কপালে আটকে আছে বহুদিন। কিন্তু সেটা আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার বক্তব্য হলো, সর্বস্তরে এত এত আওয়ামী লীগার, তবু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসসংক্রান্ত নথিপত্র খুঁজতে গেলে আজও ভিরমি খেতে হয় কেন? সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন বা বিচারিক নথিপত্রের কথা নাহয় বাদই দিলাম, সংবাদপত্রের যে স্থানে যে প্রতিবেদনটি থাকার কথা ছিল, খুঁজে দেখবেন, অনেক ক্ষেত্রে সেটাও নেই, কেউ কেটে নিয়ে গেছে।
এই যে প্রমাণ লোপাটের রাজনীতি, এ কিন্তু আজকের নয়; পঁচাত্তরের পর থেকেই শুরু হয়েছে এবং তা আজও চলছে। আরও ভয়ংকর হলো, এই অপরাজনীতির এ অংশটি কিন্তু রাজনীতিবিদেরা করছেন না, করছেন তাঁরাই, রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলালে যাঁদের আচরণ বদলে যায়। খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় কারা যোগ দিয়েছিলেন, এ তথ্যটি আপনি গুগল করলেই পাবেন; কিন্তু সে সময় তথ্য বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের তালিকা অতটা সহজে পাবেন না। আমরা জানি, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই অন্ধকারময় সকালে বাংলাদেশ বেতার এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বেশ কিছু ভূমিকা আছে। আজ পর্যন্ত বেতার বা টেলিভিশন সে সময়ের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের নাম প্রকাশ করেছে কি? আমরা কি জানি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশের ডিসি-এসপিদের ভূমিকা কী ছিল? রাতারাতি যে সাংবাদিকেরা ভোল পাল্টে ছিলেন, তাঁদের খাস তালিকা আছে কোথাও? বিচার বিভাগ কিংবা সামরিক প্রশাসনের তৎকালীন নথি, সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম, সরকার চাইলেই কি পাবে? তার মানে এটা নয় যে তৎকালীন বিভিন্ন প্রশাসনের সব স্তরের সবাই এ হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকে বাধ্য হয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করেছেন; কিন্তু ওই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কেন সেদিন কেবলই বার্তাবাহকের ভূমিকা নিয়েছিল? কতগুলো বন্দুকধারী নরপিশাচের সামনে সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে পুলিশ, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, বেসামরিক প্রশাসন সবাই ঠুঁটো জগন্নাথ বনে গিয়েছিলেন! আমাদের বিচার বিভাগ সংবিধানের কী যত্নটাই না সেদিন করেছিল! উপরাষ্ট্রপতি জীবিত থাকতে খুনি মোশতাককে রাষ্ট্রপতির শপথ পড়িয়েছিলেন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো একদিন গঠিত সেই স্বাধীন কমিশন কি এসব তথ্য বের করে আনতে পারবে? সময় গেলে সাধন হবে কি?
বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত প্রথম তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে। একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের উদ্যোগ অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিতে হবে; কিন্তু আমি যতটুকু বুঝি, অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে কাজ করতে কোনো বাধা নেই। কাজটি হয়তো পূর্ণাঙ্গ হবে না, কিন্তু প্রদীপের সলতেটা তো পাকানো হবে। আজ বঙ্গবন্ধুর ওপর নানা গবেষণাধর্মী বই লেখা হচ্ছে, অনেক প্রণম্য অগ্রজ গবেষকেরাও লিখছেন। কিন্তু এ বিষয়গুলো উঠে আসছে কই? এখন অনেক বই পাওয়া গেলেও ১৯৭৫-৯৬ পর্যন্ত বা ২০০১-০৭ পর্যন্ত এ বিষয়ে কী ধরনের বইপত্র বেরিয়েছে এবং বেরোলে তার বয়ানগুলো কী ছিল, তার অনুসন্ধানও কিন্তু জরুরি।
পঁচাত্তরের আকাশে শ্রাবণের যে মেঘ ছিল, আজও সে মেঘ কাটেনি। তা না হলে বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কাটছাঁট করে জাতীয় সংসদে পাঠানো হয় আর সংসদও সেটা প্রচার করে? এ তো সেদিনের ঘটনা; কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে কি আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি? তাদের মোটিভটা খুঁজে বের করতে পেরেছি? অন্য অনেক ঘটনার মতো এটাও চাপা পড়ে গেছে। রোগ সারানোর জন্য আগে তো রোগটা চিহ্নিত করতে হবে, তারপর না দাওয়াই।
মারুফ রসূল, লেখক ও ব্লগার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার জন্যই কেবল হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত হয়নি; কার্যত এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আদর্শিক যাত্রাপথের মানচিত্রটাই বদলে ফেলা হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এসেছিল, কেবল ক্ষমতা দখলই তাদের উদ্দেশ্য ছিল—এটুকু বললে আসলে অর্ধেকটা বলা হয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আদর্শিক ঘোষণাপত্রটি বাতিল করে দেওয়া। সুতরাং কেবল ‘কতিপয় বিপথগামী’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল’ সেনা-কর্মকর্তার নির্মমতায় বাংলার মানুষ তার প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছেন, অঙ্কটি আমার কাছে এত সরল কোনো দিনই মনে হয়নি। অথচ কী আশ্চর্য! গত সাড়ে চার দশকের অধিক সময় ধরে, প্রতিটি ১৫ আগস্টের ব্যথাতুর স্মরণে, আমরা কেবল ঘটনার উপরিতলটিই দেখে এসেছি। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার অনেকাংশেই সম্পন্ন হয়েছে, বিচারের রায় কার্যকরের যেটুকু বাকি আছে, সে বিষয়েও সরকারি তৎপরতার সংবাদ আমরা মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে পড়ি; কিন্তু এ নির্মমতার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, হোক তা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, তাদের বিষয়ে আমাদের ইতিহাস কতটুকু সচেতন?
জানি, প্রসঙ্গটি আজ আমি যত সহজে উত্থাপন করলাম, ১৩-১৪ বছর আগেও তা এমন সহজ ছিল না। যে হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধের জন্য সংসদ ডেকে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, যে পিশাচ হত্যাকারীদের অন্যতম রক্ষক ছিল খোদ রাষ্ট্র, যে হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দিতে অবৈধ সামরিক সরকার ও তাদের তল্পিবাহকদের মদদে একের পর এক মিথ্যাচার সাজানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রীয় অপতৎপরতায় সেগুলোকে জারি রাখা হয়েছিল দশকের পর দশক, সেই ষড়যন্ত্রের ঠিকুজি-কুষ্ঠি খুঁজে বের করলে অনেক ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চেহারাটি বেরিয়ে আসবে। বোধ করি এ কারণেই, আইনমন্ত্রীর একাধিক প্রতিশ্রুতি এমনকি আদালতে রিট করা সত্ত্বেও পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রগুলো খুঁজে বের করার স্বাধীন তদন্ত কমিশনটি আজও গঠিত হয়নি।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্রগুলো খুঁজে বের করার অনেকগুলো সূত্র আজ হাতের কাছেই পাওয়া যায়। ইতিহাসের নৃশংসতম এ দুটো হত্যাকাণ্ডের বিচারিক রায় ছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার নথিপত্র ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসন্ধানও আজকের দিনে খুব একটা কঠিন কাজ নয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়ার যে দীর্ঘ চড়াই-উতরাই, তা থেকেও নানা ধরনের সূত্র পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এ সূত্রগুলোর আদলে সমীকরণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কোথায়? অনেকেই হয়তো বলবেন, সামনে তো সময় আছে; কিন্তু আমার সবিনয় নিবেদন, সময় আসলে নেই; আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, নির্ধারিত সময় বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। আরও যেটুকু যাবে, তাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছুই হবে না।
আমার এ আশঙ্কার মূল কারণ হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে দেশি-বিদেশি এমন কিছু প্রতিষ্ঠান জড়িত, যেগুলো আজকের দিনেও খুব ভালোভাবেই ক্রিয়াশীল। খোদ রাষ্ট্রীয় যে প্রতিষ্ঠান আর তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর নানামাত্রিক ব্যর্থতার আলোচনা বিভিন্ন সময়ে করা হয়, তারা তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকছে না। আজ বাংলাদেশে এমন একটি সময় চলছে, যেখানে সবাই দেখি আওয়ামী লীগের জান-লড়িয়ে-দেওয়া সমর্থক। আগে যাঁরা বিএনপি-জামায়াত থেকে নির্বাচন করতেন, এখন তাঁরা নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেন। এসব ডালভাততুল্য উদাহরণ দিলে আজকাল পাঠক হাসেন। সরকারি দপ্তর থেকে স্বাধীন ব্যবসাদার, যানবাহনচালক থেকে সহযাত্রী, সেনানিবাস থেকে আদালতপাড়া—সবখানেই আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে আলোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা প্রায় সবাই বংশপরম্পরায় আওয়ামী লীগেরই সমর্থক। এমনকি ছোটবেলায় যাঁদের তীব্র আওয়ামীবিরোধী হিসেবেই চিনেছিলাম, বড়বেলায় তাঁদের মুজিব কোটের বাহার দেখে চোখ কপালে আটকে আছে বহুদিন। কিন্তু সেটা আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার বক্তব্য হলো, সর্বস্তরে এত এত আওয়ামী লীগার, তবু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসসংক্রান্ত নথিপত্র খুঁজতে গেলে আজও ভিরমি খেতে হয় কেন? সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন বা বিচারিক নথিপত্রের কথা নাহয় বাদই দিলাম, সংবাদপত্রের যে স্থানে যে প্রতিবেদনটি থাকার কথা ছিল, খুঁজে দেখবেন, অনেক ক্ষেত্রে সেটাও নেই, কেউ কেটে নিয়ে গেছে।
এই যে প্রমাণ লোপাটের রাজনীতি, এ কিন্তু আজকের নয়; পঁচাত্তরের পর থেকেই শুরু হয়েছে এবং তা আজও চলছে। আরও ভয়ংকর হলো, এই অপরাজনীতির এ অংশটি কিন্তু রাজনীতিবিদেরা করছেন না, করছেন তাঁরাই, রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলালে যাঁদের আচরণ বদলে যায়। খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় কারা যোগ দিয়েছিলেন, এ তথ্যটি আপনি গুগল করলেই পাবেন; কিন্তু সে সময় তথ্য বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের তালিকা অতটা সহজে পাবেন না। আমরা জানি, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই অন্ধকারময় সকালে বাংলাদেশ বেতার এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বেশ কিছু ভূমিকা আছে। আজ পর্যন্ত বেতার বা টেলিভিশন সে সময়ের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের নাম প্রকাশ করেছে কি? আমরা কি জানি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশের ডিসি-এসপিদের ভূমিকা কী ছিল? রাতারাতি যে সাংবাদিকেরা ভোল পাল্টে ছিলেন, তাঁদের খাস তালিকা আছে কোথাও? বিচার বিভাগ কিংবা সামরিক প্রশাসনের তৎকালীন নথি, সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম, সরকার চাইলেই কি পাবে? তার মানে এটা নয় যে তৎকালীন বিভিন্ন প্রশাসনের সব স্তরের সবাই এ হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকে বাধ্য হয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করেছেন; কিন্তু ওই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কেন সেদিন কেবলই বার্তাবাহকের ভূমিকা নিয়েছিল? কতগুলো বন্দুকধারী নরপিশাচের সামনে সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে পুলিশ, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, বেসামরিক প্রশাসন সবাই ঠুঁটো জগন্নাথ বনে গিয়েছিলেন! আমাদের বিচার বিভাগ সংবিধানের কী যত্নটাই না সেদিন করেছিল! উপরাষ্ট্রপতি জীবিত থাকতে খুনি মোশতাককে রাষ্ট্রপতির শপথ পড়িয়েছিলেন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো একদিন গঠিত সেই স্বাধীন কমিশন কি এসব তথ্য বের করে আনতে পারবে? সময় গেলে সাধন হবে কি?
বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত প্রথম তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে। একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের উদ্যোগ অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিতে হবে; কিন্তু আমি যতটুকু বুঝি, অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে কাজ করতে কোনো বাধা নেই। কাজটি হয়তো পূর্ণাঙ্গ হবে না, কিন্তু প্রদীপের সলতেটা তো পাকানো হবে। আজ বঙ্গবন্ধুর ওপর নানা গবেষণাধর্মী বই লেখা হচ্ছে, অনেক প্রণম্য অগ্রজ গবেষকেরাও লিখছেন। কিন্তু এ বিষয়গুলো উঠে আসছে কই? এখন অনেক বই পাওয়া গেলেও ১৯৭৫-৯৬ পর্যন্ত বা ২০০১-০৭ পর্যন্ত এ বিষয়ে কী ধরনের বইপত্র বেরিয়েছে এবং বেরোলে তার বয়ানগুলো কী ছিল, তার অনুসন্ধানও কিন্তু জরুরি।
পঁচাত্তরের আকাশে শ্রাবণের যে মেঘ ছিল, আজও সে মেঘ কাটেনি। তা না হলে বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কাটছাঁট করে জাতীয় সংসদে পাঠানো হয় আর সংসদও সেটা প্রচার করে? এ তো সেদিনের ঘটনা; কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে কি আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি? তাদের মোটিভটা খুঁজে বের করতে পেরেছি? অন্য অনেক ঘটনার মতো এটাও চাপা পড়ে গেছে। রোগ সারানোর জন্য আগে তো রোগটা চিহ্নিত করতে হবে, তারপর না দাওয়াই।
মারুফ রসূল, লেখক ও ব্লগার
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪