মেজর (অব.) এ টি এম হামিদুল হোসেন তারেক
৭ মার্চের পর বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে গোটা জাতি সংগঠিত হয়, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একেবারে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে পৃথিবীর বুকে তা জন্ম দিয়েছে জনযুদ্ধের ইতিহাস। সেই জনযুদ্ধ ধীরে ধীরে এর মৌলিকতা হারিয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। এতে জনযোদ্ধাদের প্রকৃত ঘটনা বিস্মৃতির অতলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমার নিজের দেখা সেই জনযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় বিরল গৌরবোজ্জ্বল অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সৈয়দপুরে অবস্থিত পাকিস্তানের সেনাছাউনির ওপর গেরিলা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ২০ জনের একটি দল বাছাই করা হলো। সৈয়দপুর যেতে হলে পার্বতীপুর হয়ে যেতে হবে, তাই পথিমধ্যে সৈয়দপুর পার্বতীপুর রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য দু-তিনটি রেলসেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেওয়া হলো। দলের মধ্যে পানিকাটা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে স্পেশাল ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করলাম।
ওরা হলো মোফাজ্জল, দোহা, ইয়াহিয়া ও হরমুজ। ইতিমধ্যে আমি দলের সব সদস্যকে পুরোপুরি আসন্ন অপারেশন সম্পর্কে বুঝিয়ে দিলাম এবং ক্যাম্প অ্যাডজুট্যান্ট মোহসীন ভাইয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাইন ও বিস্ফোরক নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হলাম। পরদিন সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে বড়াহার ক্যাম্প থেকে রওনা দিলাম। ডাঙ্গারহাট পার হয়ে এক শরণার্থীশিবিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে দু-চারজন শরণার্থী বেরিয়ে এল। আমরা দাঁড়ালাম। এক বয়স্ক লোক এলেন। আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন এবং বললেন, ‘ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো, বাবা।’ তাঁকে সালাম করে এগিয়ে গেলাম বর্ডারের দিকে। রাতের গভীরে বর্ডার পার হয়েও সাত-আট মাইল ভেতরে চলে এলাম এবং সে রাতের মতো একটি পরিত্যক্ত হিন্দুবাড়িতে আশ্রয় নিলাম। সকালে দু-চারজন লোকের সঙ্গে কথা বললাম এলাকা সম্পর্কে। ওরাই দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করে দিল। রাত দুইটার দিকে আমরা এসে পৌঁছলাম টাস্কেরহাট নামের এক গ্রামে। টাস্কেরহাট হয়ে পার্বতীপুর রেললাইন গেছে। এ ব্রিজে বিস্ফোরক লাগাতে এবং বিস্ফোরণ ঘটাতে অনেক সময়ের দরকার। এ ছাড়া ভোর পাঁচটায় প্রথম ট্রেনটি যাবে। সুতরাং পরিস্থিতি ভেবেচিন্তে আমরা স্থির করলাম, আজ পাশের গ্রামেই থেকে যাব। পরদিন রাতে ব্রিজটা উড়িয়ে দেব। ব্রিজ থেকে হাজার গজ দূরেই গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম আমরা। বাইরে দুজনকে পালাক্রমে পাহারা দিতে বলে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল ৯টার দিকে ঘুম ভাঙল। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের অনেকে এরই মধ্যে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়েছে। এদিক-ওদিক থেকে উঁকি মারছে কৌতূহলপ্রিয় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। বউ-ঝিয়েরাও দু-একজন লম্বা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে আমাদের অবাক দৃষ্টি মেলে দেখছে। দু-একজন গ্রামবাসী এল দেখা করতে। একজন অকারণে দুটো কুকুরকে লাথি মারল। দেখলাম লোকটার মাথায় টুপি। হঠাৎ করে আমার মাথায় চিন্তা এল। জামায়াতে ইসলামীর গ্রামে এলাম না তো? আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য একটা খাসি জবাই করল তারা। আমরাও নিজেদের অস্ত্রগুলো পরিষ্কার করলাম। পালা করে অনেক দিন পর গ্রামের পানা পুকুরের শীতল পানিতে গোসল করলাম।
দুপুরের খাবার খেতে যখন বসলাম, তখন বেলা প্রায় তিনটা। সবে ভাত-মাংস নিয়ে বসেছি। এমন সময় গ্রামের চারদিক থেকে গুলি শুরু হয়ে গেল। খাবার ফেলে দিয়ে সবাই অস্ত্র তুলে নিয়ে গ্রামের বাড়িগুলোর আনাচকানাচে পজিশন নিলাম। আমার এক সঙ্গী এসে খবর দিল, পাকিস্তানি সেনারা চারদিক দিয়ে আমাদের ঘিরে ফেলেছে এবং সঙ্গে এই গ্রামের জামায়াতের দুজন সদস্য আছেন। গুলির উত্তর এবং প্রত্যুত্তর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পজিশন আমি বুঝে গেলাম। রেলব্রিজ, টাস্কেরহাট বাজারের রাস্তা এবং আমবাগান এলাকায় ওরা পজিশন নিয়েছে।
ইয়াহিয়া ও তার দলকে রেলব্রিজের দিকের শত্রুকে ঠেকাতে বললাম। আমার ভাই খালেদকে দায়িত্ব দিলাম টাস্কেরহাট বাজারের পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলি করতে, যাতে তারা গ্রামের মধ্যে ঢুকতে না পারে। দোহা ও মোফাজ্জলকে দায়িত্ব দিলাম তার দল নিয়ে আমবাগানের দিকটা সামলাতে। পাকিস্তানি সেনারা আমবাগান অতিক্রম করে প্রায় গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছে; কিন্তু দোহা ও মোফাজ্জলের দলের এলএমজি ও এসএলআরের বৃষ্টির মতো গুলিতে পাকিস্তানি সেনারা আমবাগান ছেড়ে পাকা রাস্তায় চলে গেল। যাওয়ার সময় ফেলে গেল দুজন মৃত সৈনিক।
বেলা তখন সাড়ে তিনটা। দিনের বেলায় আমাদের পালানোর উপায় নেই। ওরা দেখেশুনে গুলি করবে। তা ছাড়া, পেছনে বিরাট একটা বিল। বিলের বুকপানি দিয়ে আমাদের পালাতে হবে। দিনের বেলা এভাবে যাওয়া আত্মহত্যার শামিল। যেভাবেই হোক, সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে। দৌড়ে প্রতিটি দলের কাছে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলাম। আরও বললাম, পাকিস্তানি সেনাদের না দেখা পর্যন্ত মিছামিছি কেউ যেন গুলি শেষ না করে। আমাদের গুলি শেষ হলেই ওরা আক্রমণ করবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের এই গুলি দিয়ে টিকে থাকতে হবে। ছেলেরা সবাই এ কথার মূল্য মর্মে মর্মে বুঝতে পারল।
আমাদের দলের একজনকে টু-ইঞ্চি-মর্টারটা বসিয়ে টাস্কেরহাট ও আমবাগানের ওপর ফায়ার করতে বললাম। পরপর দুটো করে চারটা গোলা ওদের পজিশনে পড়ার পর ওদের গুলির বেগ কমে গেল। তবে আমাদের একটু নড়াচড়ার আভাস পেলেই গুলি করছে। বুঝতে পারলাম, গ্রামে এগিয়ে আসার সাহস ওই হানাদারদের আর নেই। গ্রামের লোক ইতিমধ্যে কে যে কোথায় লুকিয়েছে, বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ দেখি একজন গ্রাম্য বধূ আমার দিকে দৌড়ে আসছে। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, কাছে এসো না, গুলি হচ্ছে, গুলি লাগবে। কিন্তু সে শুনল না। এই বৃষ্টির মতো গোলাগুলির মধ্যেও সে চলে এল। তার দিকে তাকিয়ে দেখি একদম সদ্যবিবাহিত একজন গ্রাম্য বধূ। মনে হয়, দু-চার দিন হলো তার বিয়ে হয়েছে। কারণ, তখনো তার পায়ে লাল আলতা, হাতে মেহেদির রং জ্বলজ্বল করছে। কাছে এসে আমাকে আঙুল দিয়ে ডান দিকের একটা পুকুরের পাড় দেখিয়ে বলল: ‘ওদিক দিয়ে খানসেনারা আসছে। আপনারা এদিকে আসুন।’ এবার সে এই প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে অসমসাহসে প্রায় ক্রল করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে লাগল। এবাড়ি-ওবাড়ি এবং ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে গ্রামের পেছনে নিয়ে এল।
পেছনে এসে দেখি, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আশ্রয়দাতা সেই মুনশি। সে নিজের হাত উঁচিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে পাকিস্তানি সেনাদের তার দিকে আসতে বলছে। চিৎকার করে বলছে, ‘ইঁধারছে আঁও, পিছে ছে মুক্তিকো ঘের লও।’ আমার সঙ্গে ছিল সহযোদ্ধা মনসুর। সে মুক্তিযুদ্ধের আগে এই পার্বতীপুর এলাকার দুর্ধর্ষ এক ডাকাত দলের সর্দার ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে ডাকাতি ছেড়ে তার দলের সদস্য ও অস্ত্র নিয়ে আমার দলে যোগদান করে। সে এখন অসমসাহসী যোদ্ধা। সব সময় তরবারি কোমরে ঝুলিয়ে রাখে। এটাই তার একটা গর্ব। আমি মনসুরকে ইশারা করতেই মনসুর তার খোলা তরবারি বনবন করে ঘুরিয়ে এক কোপে মুনশির মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে ফেলে। মাথাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমাদের গাইড করে যে সাহসী নববধূটি নিয়ে এসেছিল, তখনো সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে।
গোলাগুলির কোনো ভয়ডর নেই ওর। উৎসাহের সঙ্গে আরও আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় হানাদার বাহিনীর অবস্থান। এরপর বধূটি সামনে এগিয়ে গেল মাটিতে পড়ে থাকা মুনশির কাটা মুণ্ডুর কাছে। আমাদের অবাক করে দিয়ে সে এক লাথিতে কাটা মুণ্ডুটা পাশের এক পানিভর্তি খাদে ফেলে দিল। এবার পড়ে থাকা দেহটির ওপর থুতু ছিটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল: ‘বেটা রাজাকার, আর এই রাজাকারটা হচ্ছে আমার শ্বশুর। এ-ই খবর দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আনছে।’
আমরা তখন অবাক হয়ে দেখছি এই অচেনা নববধূকে। দেখছি অকুতোভয় একজন স্বাধীনতাকামী বাঙালি নারীকে। নববধূটি এবার আকাশের দিকে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল: ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’। আমরা তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিতে লাগলাম। একটু পর অবাক করা এক কাণ্ড ঘটল। আশপাশের প্রতিটি গ্রাম থেকেই জয় বাংলা স্লোগান শোনা যেতে লাগল। সেই স্লোগান ক্রমেই উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে লাগল।
মেজর (অব.) এ টি এম হামিদুল হোসেন তারেক, বীর বিক্রম,বীর মুক্তিযোদ্ধা
৭ মার্চের পর বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে গোটা জাতি সংগঠিত হয়, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একেবারে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে পৃথিবীর বুকে তা জন্ম দিয়েছে জনযুদ্ধের ইতিহাস। সেই জনযুদ্ধ ধীরে ধীরে এর মৌলিকতা হারিয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। এতে জনযোদ্ধাদের প্রকৃত ঘটনা বিস্মৃতির অতলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমার নিজের দেখা সেই জনযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় বিরল গৌরবোজ্জ্বল অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সৈয়দপুরে অবস্থিত পাকিস্তানের সেনাছাউনির ওপর গেরিলা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ২০ জনের একটি দল বাছাই করা হলো। সৈয়দপুর যেতে হলে পার্বতীপুর হয়ে যেতে হবে, তাই পথিমধ্যে সৈয়দপুর পার্বতীপুর রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য দু-তিনটি রেলসেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেওয়া হলো। দলের মধ্যে পানিকাটা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে স্পেশাল ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করলাম।
ওরা হলো মোফাজ্জল, দোহা, ইয়াহিয়া ও হরমুজ। ইতিমধ্যে আমি দলের সব সদস্যকে পুরোপুরি আসন্ন অপারেশন সম্পর্কে বুঝিয়ে দিলাম এবং ক্যাম্প অ্যাডজুট্যান্ট মোহসীন ভাইয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাইন ও বিস্ফোরক নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হলাম। পরদিন সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে বড়াহার ক্যাম্প থেকে রওনা দিলাম। ডাঙ্গারহাট পার হয়ে এক শরণার্থীশিবিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে দু-চারজন শরণার্থী বেরিয়ে এল। আমরা দাঁড়ালাম। এক বয়স্ক লোক এলেন। আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন এবং বললেন, ‘ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো, বাবা।’ তাঁকে সালাম করে এগিয়ে গেলাম বর্ডারের দিকে। রাতের গভীরে বর্ডার পার হয়েও সাত-আট মাইল ভেতরে চলে এলাম এবং সে রাতের মতো একটি পরিত্যক্ত হিন্দুবাড়িতে আশ্রয় নিলাম। সকালে দু-চারজন লোকের সঙ্গে কথা বললাম এলাকা সম্পর্কে। ওরাই দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করে দিল। রাত দুইটার দিকে আমরা এসে পৌঁছলাম টাস্কেরহাট নামের এক গ্রামে। টাস্কেরহাট হয়ে পার্বতীপুর রেললাইন গেছে। এ ব্রিজে বিস্ফোরক লাগাতে এবং বিস্ফোরণ ঘটাতে অনেক সময়ের দরকার। এ ছাড়া ভোর পাঁচটায় প্রথম ট্রেনটি যাবে। সুতরাং পরিস্থিতি ভেবেচিন্তে আমরা স্থির করলাম, আজ পাশের গ্রামেই থেকে যাব। পরদিন রাতে ব্রিজটা উড়িয়ে দেব। ব্রিজ থেকে হাজার গজ দূরেই গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম আমরা। বাইরে দুজনকে পালাক্রমে পাহারা দিতে বলে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল ৯টার দিকে ঘুম ভাঙল। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের অনেকে এরই মধ্যে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়েছে। এদিক-ওদিক থেকে উঁকি মারছে কৌতূহলপ্রিয় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। বউ-ঝিয়েরাও দু-একজন লম্বা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে আমাদের অবাক দৃষ্টি মেলে দেখছে। দু-একজন গ্রামবাসী এল দেখা করতে। একজন অকারণে দুটো কুকুরকে লাথি মারল। দেখলাম লোকটার মাথায় টুপি। হঠাৎ করে আমার মাথায় চিন্তা এল। জামায়াতে ইসলামীর গ্রামে এলাম না তো? আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য একটা খাসি জবাই করল তারা। আমরাও নিজেদের অস্ত্রগুলো পরিষ্কার করলাম। পালা করে অনেক দিন পর গ্রামের পানা পুকুরের শীতল পানিতে গোসল করলাম।
দুপুরের খাবার খেতে যখন বসলাম, তখন বেলা প্রায় তিনটা। সবে ভাত-মাংস নিয়ে বসেছি। এমন সময় গ্রামের চারদিক থেকে গুলি শুরু হয়ে গেল। খাবার ফেলে দিয়ে সবাই অস্ত্র তুলে নিয়ে গ্রামের বাড়িগুলোর আনাচকানাচে পজিশন নিলাম। আমার এক সঙ্গী এসে খবর দিল, পাকিস্তানি সেনারা চারদিক দিয়ে আমাদের ঘিরে ফেলেছে এবং সঙ্গে এই গ্রামের জামায়াতের দুজন সদস্য আছেন। গুলির উত্তর এবং প্রত্যুত্তর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পজিশন আমি বুঝে গেলাম। রেলব্রিজ, টাস্কেরহাট বাজারের রাস্তা এবং আমবাগান এলাকায় ওরা পজিশন নিয়েছে।
ইয়াহিয়া ও তার দলকে রেলব্রিজের দিকের শত্রুকে ঠেকাতে বললাম। আমার ভাই খালেদকে দায়িত্ব দিলাম টাস্কেরহাট বাজারের পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলি করতে, যাতে তারা গ্রামের মধ্যে ঢুকতে না পারে। দোহা ও মোফাজ্জলকে দায়িত্ব দিলাম তার দল নিয়ে আমবাগানের দিকটা সামলাতে। পাকিস্তানি সেনারা আমবাগান অতিক্রম করে প্রায় গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছে; কিন্তু দোহা ও মোফাজ্জলের দলের এলএমজি ও এসএলআরের বৃষ্টির মতো গুলিতে পাকিস্তানি সেনারা আমবাগান ছেড়ে পাকা রাস্তায় চলে গেল। যাওয়ার সময় ফেলে গেল দুজন মৃত সৈনিক।
বেলা তখন সাড়ে তিনটা। দিনের বেলায় আমাদের পালানোর উপায় নেই। ওরা দেখেশুনে গুলি করবে। তা ছাড়া, পেছনে বিরাট একটা বিল। বিলের বুকপানি দিয়ে আমাদের পালাতে হবে। দিনের বেলা এভাবে যাওয়া আত্মহত্যার শামিল। যেভাবেই হোক, সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে। দৌড়ে প্রতিটি দলের কাছে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলাম। আরও বললাম, পাকিস্তানি সেনাদের না দেখা পর্যন্ত মিছামিছি কেউ যেন গুলি শেষ না করে। আমাদের গুলি শেষ হলেই ওরা আক্রমণ করবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের এই গুলি দিয়ে টিকে থাকতে হবে। ছেলেরা সবাই এ কথার মূল্য মর্মে মর্মে বুঝতে পারল।
আমাদের দলের একজনকে টু-ইঞ্চি-মর্টারটা বসিয়ে টাস্কেরহাট ও আমবাগানের ওপর ফায়ার করতে বললাম। পরপর দুটো করে চারটা গোলা ওদের পজিশনে পড়ার পর ওদের গুলির বেগ কমে গেল। তবে আমাদের একটু নড়াচড়ার আভাস পেলেই গুলি করছে। বুঝতে পারলাম, গ্রামে এগিয়ে আসার সাহস ওই হানাদারদের আর নেই। গ্রামের লোক ইতিমধ্যে কে যে কোথায় লুকিয়েছে, বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ দেখি একজন গ্রাম্য বধূ আমার দিকে দৌড়ে আসছে। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, কাছে এসো না, গুলি হচ্ছে, গুলি লাগবে। কিন্তু সে শুনল না। এই বৃষ্টির মতো গোলাগুলির মধ্যেও সে চলে এল। তার দিকে তাকিয়ে দেখি একদম সদ্যবিবাহিত একজন গ্রাম্য বধূ। মনে হয়, দু-চার দিন হলো তার বিয়ে হয়েছে। কারণ, তখনো তার পায়ে লাল আলতা, হাতে মেহেদির রং জ্বলজ্বল করছে। কাছে এসে আমাকে আঙুল দিয়ে ডান দিকের একটা পুকুরের পাড় দেখিয়ে বলল: ‘ওদিক দিয়ে খানসেনারা আসছে। আপনারা এদিকে আসুন।’ এবার সে এই প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে অসমসাহসে প্রায় ক্রল করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে লাগল। এবাড়ি-ওবাড়ি এবং ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে গ্রামের পেছনে নিয়ে এল।
পেছনে এসে দেখি, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আশ্রয়দাতা সেই মুনশি। সে নিজের হাত উঁচিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে পাকিস্তানি সেনাদের তার দিকে আসতে বলছে। চিৎকার করে বলছে, ‘ইঁধারছে আঁও, পিছে ছে মুক্তিকো ঘের লও।’ আমার সঙ্গে ছিল সহযোদ্ধা মনসুর। সে মুক্তিযুদ্ধের আগে এই পার্বতীপুর এলাকার দুর্ধর্ষ এক ডাকাত দলের সর্দার ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে ডাকাতি ছেড়ে তার দলের সদস্য ও অস্ত্র নিয়ে আমার দলে যোগদান করে। সে এখন অসমসাহসী যোদ্ধা। সব সময় তরবারি কোমরে ঝুলিয়ে রাখে। এটাই তার একটা গর্ব। আমি মনসুরকে ইশারা করতেই মনসুর তার খোলা তরবারি বনবন করে ঘুরিয়ে এক কোপে মুনশির মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে ফেলে। মাথাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমাদের গাইড করে যে সাহসী নববধূটি নিয়ে এসেছিল, তখনো সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে।
গোলাগুলির কোনো ভয়ডর নেই ওর। উৎসাহের সঙ্গে আরও আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় হানাদার বাহিনীর অবস্থান। এরপর বধূটি সামনে এগিয়ে গেল মাটিতে পড়ে থাকা মুনশির কাটা মুণ্ডুর কাছে। আমাদের অবাক করে দিয়ে সে এক লাথিতে কাটা মুণ্ডুটা পাশের এক পানিভর্তি খাদে ফেলে দিল। এবার পড়ে থাকা দেহটির ওপর থুতু ছিটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল: ‘বেটা রাজাকার, আর এই রাজাকারটা হচ্ছে আমার শ্বশুর। এ-ই খবর দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আনছে।’
আমরা তখন অবাক হয়ে দেখছি এই অচেনা নববধূকে। দেখছি অকুতোভয় একজন স্বাধীনতাকামী বাঙালি নারীকে। নববধূটি এবার আকাশের দিকে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল: ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’। আমরা তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিতে লাগলাম। একটু পর অবাক করা এক কাণ্ড ঘটল। আশপাশের প্রতিটি গ্রাম থেকেই জয় বাংলা স্লোগান শোনা যেতে লাগল। সেই স্লোগান ক্রমেই উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে লাগল।
মেজর (অব.) এ টি এম হামিদুল হোসেন তারেক, বীর বিক্রম,বীর মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪