স্বাধীনতা নিজেই একটা বড় প্রাপ্তি

যতীন সরকার
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২: ২৯
Thumbnail image

স্বাধীনতা নিজেই একটা বড় প্রাপ্তি। আমরা এমন একটা রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়ে গিয়েছিলাম; যে রাষ্ট্রটি আসলে অমানবিক। এই অমানবিক রাষ্ট্রের হাত থেকে আমরা রক্তের মূল্যে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই অর্জনটাকে কোনোমতেই ছোট করে দেখা চলে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, স্বাধীনতা নিজে একটা অর্জন হলেও আমাদের এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে কথা বলেছিলেন সংগ্রামের আগে—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমরা মুক্তির সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম বলেই আমার মনে হয়েছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে।

কিন্তু এর চার বছর যেতে না যেতেই স্বাধীনতার মহান স্থপতি যেভাবে নিহত হলেন এবং এরপর যারা এই দেশের হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে বসল; তারা যেভাবে আমাদের স্বাধীনতার রক্তমানিক অপহরণ করে নিয়ে গেছে, সেই অপহৃত বিষয়গুলো কি আমরা এখনো পুরো উদ্ধার করতে পেরেছি? যদি তন্নিষ্ঠ দৃষ্টিতে বিচার করি, তাহলে দেখব, আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ অনেকটাই হারিয়ে গেছে। যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা। যদিও এখনো বলা হয়ে থাকে, আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা আছে; কিন্তু আরেক দিক দিয়ে একটি বিশেষ ধর্ম রাষ্ট্রধর্মরূপে বহাল আছে, যেটা স্বাধীনতাবিরোধীরাই সমন করেছিল। সেই রাষ্ট্রধর্ম বহাল থাকবে; আবার আমরা বলব যে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ; এই যে গোঁজামিল, এই গোঁজামিলের অবসান না-হলে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার প্রকৃত প্রাপ্তি আমরা পেয়ে গেলাম—আমরা এমন কথা বলতে পারি না। কাজেই প্রকৃত স্বাধীনতার মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হলে সেই গোঁজামিলের অবসান হওয়া চাই। হ্যাঁ, স্বাধীনতার পর আমাদের অনেক যে প্রাপ্তি হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞা করা হতো, আমরা সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমাদের সম্পদ অনেক বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি ঘটেছে অনেক বড়। কিন্তু এরপরও কথা থাকে—এই প্রবৃদ্ধি কার ঘরে কতখানি গেছে। বর্তমানে যদি বলি, শুধু আমি-ই নই, সবাই বলে: ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এই যে ধনী-গরিবের মধ্যে যে খেলা—ধনীর আরও ধনী হওয়া, গরিবের আরও গরিব হওয়া, এটি বন্ধ করার ব্যাপারটিও কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ছিল। আমরা যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলাম, তার মধ্যে একটি সমাজতন্ত্র। এ কথা ঠিক, বাংলাদেশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়নি ঠিকই; কিন্তু সমাজতন্ত্র অভিমুখী যে যাত্রা অর্থাৎ, বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, সেটিও আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ছিল এবং সেটা আমরা আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু এখন সংবিধানে সমাজতন্ত্র লেখা থাকলেও বাস্তবে তা কোথায় উবে গেছে, তার কোনো ঠিক নেই। বাস্তবে লুটপাটতন্ত্রীরাই বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। কাজেই সেই লুটপাটতন্ত্রীদের হাত থেকে যদি আমরা মুক্ত হতে না পারি, তাহলে আমাদের স্বাধীনতার প্রাপ্তি সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা বললেও বলতে হয়, অপ্রাপ্তির বিষয়টি গৌণ হয় না। কাজেই এবার বিজয় দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যা আমরা হারিয়েছি, সেই হারানো সম্পদ আমাদের ফিরে পেতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত যে মূল চার নীতি, তা প্রকৃত অর্থেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই সঙ্গে লুটপাটতন্ত্রীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে এবং এটা করাটাই এখনকার বড় লড়াই। বঙ্গবন্ধুর কথা ধরে আবারও বলি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়ী হলেও আমরা যে মুক্তির সংগ্রামে অনেক পিছিয়ে পড়েছি, এই বেদনাদায়ক সত্যটি স্বীকার না-করে পারা যায় না। আজ আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক—পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে যাব। আমাদের সেই হারানো মূল্যবোধগুলো ফিরে পাব। সত্যিকার অর্থেই যে মুক্তি, সেটি আমরা অর্জন করব এবং এই মুক্তির লক্ষ্য সংঘটিত হওয়ার জন্য আমি বলি প্রকৃত প্রস্তাবে সেই যে চারটি মূলনীতি; যার ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের প্রথম অসাধারণ সংবিধানটি রচনা করেছিলাম; যে সংবিধান রচনা হয়েছিল কালি দিয়ে নয়, অজস্র শহীদের রক্তে, সেই সংবিধানটিকে যথার্থ অর্থে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এই ফিরিয়ে আনার জন্য আজকের যে নতুন প্রজন্ম, সেই নতুন প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে আসতে হবে।

নতুন প্রজন্ম যদি সামনে এগিয়ে না-আসে, তারা যদি প্রকৃত মুক্তির সংগ্রাম শুরু না করে, তাহলে আমাদের স্বাধীনতার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঘরেই থেকে যাবে। আমার প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্ম আমাদের হারানো সম্পদ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবে। তবে এটাও ঠিক, নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা স্বাধীনতার যে ইতিহাস, তার মূল্যবোধ, এটা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতার দায় আমরা অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কেউ-ই এড়িয়ে যেতে পারি না। নতুন প্রজন্ম আজ ঢাকা শহরে যে রাস্তায় নেমেছে, রাস্তায় নেমে নিরাপদ সড়কের যে দাবি তুলেছে—এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, নতুন প্রজন্ম এখনো যেকোনো সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু স্বাধীনতার সময় যে তরুণ প্রজন্ম সংগ্রাম করেছিল, সেই ধারাটা নানা কারণে বজায় থাকেনি। এটা বজায় রাখার জন্য আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই দায়িত্ব পালন করলে তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত ও সচেতন হয়ে উঠবে। শিক্ষিত করা বলতে আমি এই বুঝি, স্কুল-কলেজে তারা পড়বে; পড়বেই। ‘ছাত্রনং অধ্যয়ং তপ’ এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু অধ্যয়ন কেবল কতগুলো সূত্র বা ফর্মুলা মুখস্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। অধ্যয়নটা হতে হবে আমাদের যে সমাজ, সেই সমাজ মানসের গভীরে যা আছে, যেগুলো আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নেই; সেগুলোকেই আত্মস্থ করা। তাহলেই তারা বর্তমানে তাদের অনেকের ওপর চেপে বসা পাকিস্তানি ভূতের কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে। এবং আমাদের দেশটা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়ে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা, তা-ও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।

যতীন সরকার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত