Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /তৈরি পোশাকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে নজর যুক্তরাষ্ট্রের, বাংলাদেশের জন্য কতটা শঙ্কার

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ১৪: ১৩
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেড ইন আমেরিকা’ উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পোশাক খুচরা বিক্রেতাকে টি-শার্ট থেকে শুরু করে কোট-স্যুট পর্যন্ত দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করছে। মার্কিন প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তবে সীমিত উৎপাদন সক্ষমতা, শ্রম ও উপকরণের ওপর শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বড় পরিসরে উৎপাদন স্থানান্তর করা কঠিন হবে, ফলে আমেরিকায় তৈরি পোশাকের দাম বেড়ে যাবে। আর এ কারণেই খুব শিগগির বাংলাদেশসহ বিশ্ববাজার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক কেনার বিষয়টি সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই।

বৈশ্বিক চেইনশপ ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহীর উপস্থিতিতে গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রিটেইল শপের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর জন্য করপোরেট কর হার ২১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বৈঠকে তিনি আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের পক্ষেও সাফাই গেয়েছেন এবং বলেছেন, এই শুল্ক আরও বাড়ানো হতে পারে।

নিউজার্সির নিউওয়ার্কভিত্তিক পুরুষদের শার্ট প্রস্তুতকারী কোম্পানি গামবার্ট শার্টমেকার্সের মালিক ও প্রধান নির্বাহী মিক গামবার্ট বলেন, ‘আমরা (যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা) ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে প্রচুর (উৎপাদনের) অনুরোধ পাচ্ছি।’ গামবার্টের প্রতিষ্ঠান খুচরা বিক্রেতা চেইনশপ নর্ডস্ট্রমের তিনটি শোরুমে বোতামযুক্ত সুতি শার্ট সরবরাহ করে। গামবার্ট জানান, নর্ডস্ট্রম আগামী জুনের শেষের মধ্যে সরবরাহ বাড়িয়ে ৫০টি স্টোরে পণ্য পৌঁছানোর অনুরোধ করেছে।

ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বেসরকারি খুচরা বিক্রেতা রিফরমেশনের পরিচালনা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাথলিন ট্যালবট বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের সরবরাহকারীদের আরও বেশি অর্ডার দিচ্ছেন এবং নিউইয়র্ক ও নেভাডার মতো অঙ্গরাজ্যের কথাও বিবেচনা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি দেশীয় উৎপাদনে পুনর্জাগরণ বা বিনিয়োগের চেষ্টার চেতনাকে সমর্থন করি, তবে এটি সময়সাপেক্ষ।’

ট্যালবট বলেন, ‘এপ্রিল মাসে কার্যকর হতে যাওয়া মেক্সিকোর আমদানির ওপর ট্রাম্পের পরিকল্পিত শুল্ক তাদের সরবরাহ শৃঙ্খল পুনর্বিন্যাসে বাধ্য করেছে।’ ট্যালবটের প্রতিষ্ঠান রিফরমেশন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় ৫০টিরও বেশি আউটলেটে এবং অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে। এই প্রতিষ্ঠান মেক্সিকোর ছয়টি কারখানা থেকে পোশাক সংগ্রহ করে থাকে।

নিউইয়র্কভিত্তিক ফেরারা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের প্রধান নির্বাহী জো ফেরারা বলেন, আগের তুলনায় আরও বেশি খুচরা বিক্রেতা উল কোট ও ব্লেজারের মতো পণ্যগুলোর দ্রুত উৎপাদনের জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ফেরারা ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাশন ব্র্যান্ড রাল্ফ লরেন ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য পোশাক তৈরি করে।

আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি স্টিভ লামার বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনে সামান্য বৃদ্ধি দেখতে পাব বলে আশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি, দক্ষতা, উপকরণ ও অবকাঠামো নেই, যা বড় পরিসরে পোশাক ও জুতা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন।’

আমেরিকানরা সাধারণত চীন ও এশিয়ায় তৈরি সস্তা পোশাক কিনতে অভ্যস্ত। লামারের সংগঠনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া পোশাক ও জুতার ৯৭ শতাংশই আমদানি করা হয়। চীন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পোশাক সরবরাহকারী, যদিও গত ১৫ বছরে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চীনের অংশীদারত্ব কিছুটা কমেছে।

মিয়ামি ইউনিভার্সিটি অব ওহাইওর সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াও জিন বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক উৎপাদন খাত সংকুচিত হয়েছে। কারণ ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য স্বল্প মজুরির দেশে উৎপাদন স্থানান্তর করেছে, যা তাদের খরচ ও দাম কমিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে।

ইয়াও জিন বলেন, ‘পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে খুব সামান্য কর্মসংস্থানই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসবে। কারণ, আমাদের শ্রমবাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়।’

গামবার্টের কাছে ৩০০ থেকে ৫০০ ডলার মূল্যের শার্টের অতিরিক্ত অর্ডার আসছে, যা প্রতিষ্ঠানটির ১০০ জন কর্মীর কারখানার জন্য বড় প্রবৃদ্ধি। তিনি বলেন, ‘এটি আমার ব্যবসার জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক একটি দিক হবে।’ তাঁর কারখানার প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মী প্রতি ঘণ্টায় নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের বেঁধে দেওয়া ন্যূনতম আয় ১৫ দশমিক ৪৯ ডলারের চেয়ে বেশি আয় করেন।

তবে গামবার্ট শার্টমেকার্সের সীমিত উৎপাদন সক্ষমতার কারণে তিনি নতুন খুচরা গ্রাহকদের বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই অতিরিক্ত চাপ নিতে চাই না এবং বিদ্যমান গ্রাহকদের হারাতে চাই না।’ তিনি জানান, তাঁর প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলো হলো—চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারতের শার্ট কারখানা।

আরেকটি সমস্যা হলো বোতাম, কাপড় ও জিপারের মতো উপকরণ আমদানি করতে হয় এবং এগুলো ট্রাম্পের শুল্কের আওতায় পড়ে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় ফ্যাব্রিক সরবরাহকারী। গামবার্ট জানান, চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের কারণে তাঁর বোতামের খরচ ১৮ শতাংশ বেড়েছে।

লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক ফুটওয়্যার ও লেদার গুডস প্রস্তুতকারী লা লা ল্যান্ড প্রোডাকশন অ্যান্ড ডিজাইনের প্রধান নির্বাহী আলেকজান্ডার জার বলেন, ক্রীড়া পোশাক ব্র্যান্ডগুলো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রে স্নিকার ও রানিং শু তৈরি করার জন্য।

তিনি তাঁর ৬০ হাজার বর্গফুটের কারখানায় নতুন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহের পরিকল্পনা করছেন। বিনিয়োগকারীদের কাছে উত্থাপিত এক প্রতিবেদনে লা লা ল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনের এমন এক উপায় উপস্থাপন করেছে, যাতে ব্র্যান্ডগুলো ‘অনিশ্চিত শুল্ক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবজনিত সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যয় এড়াতে পারবে।’

জার বলেন, ‘যদিও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত জুতা উৎপাদন বৈশ্বিক দামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, তবে সঠিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদন উল্লেখযোগ্য সুবিধা দিতে পারে।’ তবে তিনি জানান, তাঁর কারখানার বেশির ভাগ জুতা উচ্চমূল্যের বা সীমিত সংস্করণের হবে।

ক্রীড়া পোশাক ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস বলেছে, তারা তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে কোনো পরিবর্তন আনতে চায় না। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব টেক্সটাইল অর্গানাইজেশনের সভাপতি কিম গ্লাস চীন থেকে আমদানি করা পোশাকের ওপর ট্রাম্পের শুল্কের পক্ষে মত দেন। তবে তিনি বলেন, মেক্সিকো ও কানাডার ওপর শুল্ক আরোপ শিল্পের জন্য ক্ষতিকর, যা বিভিন্ন উৎপাদন পর্যায়ে মার্কিন সুতি ও উলের কাপড় রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল।

কিম গ্লাস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতকারকদের বিকাশ ও বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত