চরম অস্থিরতার মধ্যেও মুখ ফেরায়নি পোশাক খাতের অধিকাংশ বিদেশি ক্রেতা: জরিপ  

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২: ১১
Thumbnail image

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ক্রয়াদেশ বা বায়না বাতিল করেনি বিশ্বের অধিকাংশ পোশাক ক্রেতা। মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টারের (বিএইচআরআরসি) জরিপ অনুসারে, ২০টি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি আন্তর্জাতিক ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ক্রয় অব্যাহত রেখেছে। 

শীর্ষ ১৫ আন্তর্জাতিক ক্রেতার পাশাপাশি পাঁচটি স্ট্র্যাটেজিক কোম্পানির কাছে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে ২০টি ব্র্যান্ডের সঙ্গেও যোগাযোগ করে প্রতিষ্ঠানটি। এগুলোর মধ্যে ১১টি ব্র্যান্ড ও দুটি কোম্পানি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তবে সাতটি ব্র্যান্ড বা কোম্পানি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। 

এর মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে এবং বিএইচআরআরসিকে জানিয়েছে, অস্থিরতার সময়ে বাংলাদেশে থেকে ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করেনি তারা। ওই সময়ে কোনো ব্র্যান্ড বা কোম্পানি জরিমানাও করেনি কারখানার মালিকদের। আর একটি প্রতিষ্ঠান সব প্রশ্নের জবাব দিলেও স্থানান্তরসংক্রান্ত কোনো তথ্য দেয়নি। 

এসব ব্র্যান্ড হলো অ্যাডিডাস, আসডা, সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএম, ইনডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, নেক্সট, পুমা, পিভিএইচ কর্প, টেসকো, প্রিমার্ক এবং ওয়ালমার্ট। 

কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে বাংলাদেশে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করছে, ক্রয়বাজারে দায়িত্বশীলতা বজায় রেখেছিল, সরবরাহকারী এবং ক্ষতিগ্রস্ত গার্মেন্টস কর্মীদের সহায়তা করেছে, সে সম্পর্কে তথ্য চেয়েছিল বিএইচআরআরসি। 

জবাবে বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড ক্রয়বাজারে দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা এবং শ্রমিক কল্যাণের ওপর বিক্ষোভের প্রভাব সম্পর্কে তথ্য দিতে অনিচ্ছুক ছিল। তবে জরিপ করা ১৩টি ব্র্যান্ড জানিয়েছে, আন্দোলনের কারণে সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটলে তারা বিলম্বে পণ্য পৌঁছানোর জন্য জরিমানা আরোপ করেনি। 

রিসোর্স সেন্টার শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের ওপর ব্র্যান্ডগুলোর নজরদারির পদ্ধতি এবং জুলাই-আগস্টে সময়মতো পূর্ণাঙ্গ মজুরি প্রদান সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছে। এতে দেখা গেছে, সাত ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান—গ্যাপ, পুমা, পিভিএইচ, প্রিমার্ক, টেসকো, নেক্সট এবং এইচঅ্যান্ডএম জুলাই মাসের পূর্ণ বেতন সময়মতো প্রদানের বিষয়ে রিপোর্ট করেছে। অপরদিকে অ্যাডিডাস, আসডা এবং এমঅ্যান্ডএস জুলাই-আগস্টের মজুরি দেওয়া নিয়ে রূপরেখা দিয়েছে। কিন্তু তারা নিশ্চিত করেনি, সময়মতো পূর্ণ মজুরি দেওয়া হয়েছে কি না। আর সিঅ্যান্ডএ, ইনডিটেক্স এবং ওয়ালমার্ট এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। 

আন্দোলনের সময় আসডা একটি বিকল্প সাপ্লাই চেইন ফাইন্যান্স অফার করেছে। এমঅ্যান্ডএস নগদ প্রবাহের সমস্যাগুলো সহজ করার জন্য ভেন্ডর ফাইন্যান্স ও লেটার অব ক্রেডিটের মতো বিকল্প সুবিধা দিয়েছে। সিঅ্যান্ডএ সরবরাহকারীদের কম-সুদ বা বিনা সুদে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে এবং ডেলিভারির চ্যালেঞ্জগুলো প্রশমিত করতে বিমান চালানের খরচও দিয়েছে। 

প্রাইমার্ক সরবরাহকারীদের উৎপাদন ব্যাঘাত কাটিয়ে উঠতে উৎপাদন এবং ডেলিভারির সময়সীমা বাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি দেরিতে পণ্য সরবরাহের জন্য জরিমানাও করেনি এবং বিভিন্ন অনার্থিক সহায়তা দিয়েছে। 

পোশাকশিল্প বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, পরোক্ষ ক্ষতি আরও বেশি; কারণ, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। ব্যয়বহুল বিমান চালানের কারণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে ক্রেতারা। 

শ্রমিকদের ওপর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করানো হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি পূরণ করতে বা অর্ডার বাতিল এড়াতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। কারখানায় পৌঁছানোর জন্য শ্রমিকদের পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং মজুরি না দেওয়া বা দেরিতেও দেওয়া হয়েছে। 

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বিএইচআরআরসিকে জানিয়েছিলেন, পণ্য সরবরাহে দেরি হওয়ার কারণে বেশ কিছু ব্র্যান্ড মূল্যছাড় দাবি করেছে, যা মিটিয়েছেন উৎপাদকেরা। যার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। আবার সরবরাহের সময় ঠিক রাখার জন্য বাড়তি পরিবহন খরচ, জরুরিভাবে পণ্য পাঠানোর জন্য উচ্চ বিমান ভাড়া গুনতে হচ্ছে উৎপাদকদের। অন্যদিকে কারখানার মালিকেরা ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছেন, যাতে পণ্য সরবরাহে দেরির জন্য জরিমানা করা না হয়। 

ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে তিনি বলেন, ‘বড় ব্র্যান্ডগুলো খুবই কৌশলী। তারা ঘোষণা দিয়ে অর্ডার বাতিল করবে না। কাঁচামাল ক্রয়, উৎপাদন পর্যায় এবং চালানের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণেও দ্রুত অর্ডার বাতিল না হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বিমান চালানে ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক কারখানা সম্প্রতি সমস্যায় পড়েছে।’ 

তিনি বলেন, প্রতি কেজিতে বিমানভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬-৭ ডলার, এক মাস আগেও এটি মাত্র আড়াই ডলার ছিল। 

তিনি আরও বলেছেন, ‘গত মাসে অর্ডার প্লেসমেন্ট ধীরগতির ছিল। ছোট কারখানা থেকে ছোট ক্রেতারা বায়না বাতিল করায় এমনটি হতে পারে। একবার ছোট কারখানাগুলো কোনো ক্রেতা হারিয়ে ফেললে তাদের ফিরিয়ে আনা কঠিন।’ 

মজুরি বকেয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কিছু কারখানা এখনো মজুরি পরিশোধ করতে পারেনি; কারণ, তারা আকারে ছোট এবং নতুন ক্রয়াদেশ পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আর এখন কোনো ব্যাংকও ঋণসহায়তা দিচ্ছে না।’ 

বাংলাদেশের শিল্প পুলিশের সূত্রের বরাত দিয়ে বিএইচআরআরসি জানিয়েছে, তাদের আওতাধীন প্রায় ৭০টি কারখানা রয়েছে, যারা জুলাই মাসের মজুরি পরিশোধ করেনি। আর গত বুধবার পর্যন্ত আগস্টের মজুরি পরিশোধ করেনি ৯৩ শতাংশ কারখানা। 

আইপি সূত্র এবং শ্রমিকনেতাদের মতে, বেশির ভাগ শ্রমিক ২৯ আগস্ট থেকে মজুরি বকেয়া, উপস্থিতি, টিফিন, রাতের বিলসহ বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করেছেন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে তাঁরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি যুক্ত করেছেন। 

অন্যদিকে, কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে হওয়া ক্ষতি পোষাতে সরকারের কাছে এক বছরের জন্য ‘সফট লোন’ চেয়েছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত