আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা
মসলাজাতীয় একটি প্রাচীনতম ফসল আদা; যা বাণিজ্যিকভাবে প্রথম মসলাজাতীয় পণ্য হিসেবে এশিয়া থেকে ইউরোপে রপ্তানি হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমানরা এটি ব্যবহার করত। মুখরোচক রান্নায় আদার জুড়ি মেলা ভার। তাই তো প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে রান্নায় আদার ব্যবহার হয়ে আসছে। এর ভেষজ গুণও উপেক্ষার নয়। চিকিৎসার অন্যতম উপকরণ হিসেবে চীনে আদার প্রচলন ঘটে দুই হাজার বছর আগে।
এখন সময় বদলেছে। বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে। আগের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও টিকে আছে আদার প্রচলন। বরং আধুনিকতার এই সময়ে আদার ব্যবহার, ক্ষেত্র এবং ভোক্তা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। এ কারণে বিশ্বজুড়ে রান্নার উপকরণের বাইরেও আদার ব্যবহার রূপান্তর হচ্ছে। আচার, পানীয় তৈরিসহ খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে এর হরেক ব্যবহারের পাশাপাশি ওষুধ এবং সুগন্ধিশিল্পেও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে আদা।
দেশীয় বাস্তবতা
বৈশ্বিক বাস্তবতার ছাপ দেশেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আদার ব্যবহার এবং ভোগ—উভয়ই বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বিশ্বের আদা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অন্যদিকে কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আদার জেনেরিক নাম জিঙ্গিবার, যা মসলার সংস্কৃত নাম সিঙ্গাবেরা এবং গ্রিক জিঙ্গিবেরিস থেকে উদ্ভূত। দেশে এই মসলাজাতীয় পণ্যের চাহিদা বছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার টন, কিন্তু উৎপাদিত হয় তার অর্ধেক। আবার উৎপাদন পর্যায়ে মাটিবাহিত রোগ এবং উৎপাদন-পরবর্তী সংরক্ষণের অভাবে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। সব মিলিয়ে প্রতিবছর চাহিদার ঘাটতি পড়ে ৬০ শতাংশের মতো; যা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়; যার ৬০ শতাংশই আসে চীন থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত চার অর্থবছরের হিসাবে চাহিদা পূরণে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার টন আদা আমদানি করতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৬ হাজার টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৪১ হাজার টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯১ হাজার টন আদা আমদানি হয়েছে। গত রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি আদা বিক্রি হয়েছে ২৬০ থেকে ৩০০ টাকায়। সারা বছর এর প্রতি কেজির গড় মূল্য ২০০ টাকা বিবেচনায় নেওয়া হলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং আমদানি মিলিয়ে দেশে চাহিদার ৪ লাখ ৮০ হাজার টন আদার বাজারমূল্য ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
বাধা যেখানে
দেশে আদার ঘাটতির অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন কম। অভাব রয়েছে আদা চাষের উপযোগী জমিরও। এটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। প্রায় ১০ মাস সময় লাগে। এত সময় ধরে আদা চাষে অনাগ্রহী কৃষক। তাঁরা একই সময় ওই জমিতে ৩-৪টি অন্য ফসল ফলাতে পারেন, যা লাভজনক। অন্যদিকে তদুপরি দেশীয় প্রেক্ষাপটে জমিতে আদার কন্দপচা রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। এর কারণে কোনো কোনো বছর আদার ফলন ৫০-৮০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়। তখন স্থানীয় বাজারে সরবরাহে বড় ঘাটতি তৈরি হয় এবং দাম চলে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে।
আছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ
এসব সমস্যা মোকাবিলা ও ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন বারি-১, বারি-২, ও বারি-৩ নামে তিনটি উচ্চফলনশীল আদার জাত; যার প্রতি হেক্টরে ফলন ৩০-৩৯ টন। গবেষকেরা বলছেন, বস্তায় আদা চাষের সুবিধা হলো, আবাদি জমির প্রয়োজন হবে না। যেকোনো পতিত জায়গায় চাষ করা যাবে। যেমন বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পাশে, অফিসে, যেখানে নতুন বাগান হচ্ছে, যেখানে ছায়া কম, সেসব জায়গায় চাষ করা যাবে। জুন-জলাই মাস আদা চাষের উপযুক্ত সময়। ফলনও পাওয়া যাবে চাষের ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যে। প্রাকৃতিক যেকোনো বিপর্যয়ে বস্তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে একই জায়গায় বারবার মাটির মিশ্রণ তৈরি করে আদাবীজ রোপণ করা যায়। শুধু বস্তা কিনতে হবে। চার-পাঁচ টাকা দাম। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ও জৈব সার, ছাই ব্যবহার করে মিশ্রণ করা যেতে পারে।
বস্তায় আদা চাষের সুবিধা সম্পর্কে বগুড়ায় অবস্থিত শিবগঞ্জের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশিকুল ইসলাম নিরু বলেন, ‘মাটিতে আদা চাষে বিদ্যমান অসুবিধার সমাধান মিলেছে বস্তায় আদা চাষে। এই অভিনব পদ্ধতি দেখাচ্ছে ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা। দিচ্ছে স্বনির্ভরতা অর্জনের হাতছানি। দেশে সাড়ে তিন কোটির মতো বসতবাড়ি রয়েছে। এসব বাড়িতে ১০ বস্তা করে আদা চাষ করা হলেও সাড়ে ৩৫ কোটি বস্তা হবে। প্রতি বস্তায় ১ কেজি আদা উৎপাদিত হলেও আমাদের চাহিদা মিটে যাবে; যা প্রতিবছর সাশ্রয় করতে পারে কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি ব্যয়।’
বাড়ছে জনপ্রিয়তা
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে অনানুষ্ঠানিক ও স্বল্প পরিসরে বস্তায় আদার চাষ শুরু হলেও বছর দুয়েক হলো এর জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এরই মধ্যে বস্তায় আদা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে নেওয়া হয়েছে সরকারি প্রকল্প। দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ, বস্তা, বীজ, সার ইত্যাদি। এ ছাড়া কম খরচে অধিক মুনাফা হওয়ায় ব্যক্তি উদ্যোগেও এখন বস্তায় আদা চাষে ঝুঁকছেন অনেকে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে এ পদ্ধতিতে আদার চাষ শিখছেন অনেক তরুণ। যার মাধ্যমে এর চাষাবাদ পদ্ধতি ছড়িয়ে গেছে দেশের সর্বত্র। বাড়ছে আগ্রহ। উৎপাদনে কমছে জমিনির্ভরতা।
এ প্রসঙ্গে মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে জানান, প্রকল্পের অধীনে এ নিয়ে দুই বছর বস্তায় আদা চাষ হয়েছে। এ বছর প্রকল্প ও ব্যক্তি উদ্যোগ মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ বস্তায় আদা চাষ হয়েছে; যা থেকে প্রায় ১০ হাজার টন আদা উৎপাদিত হবে। এটি কেবল সরকারি হিসাব। এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে বস্তায় আদা চাষ করছেন। আগে এ-সম্পর্কিত কোনো জরিপ করা হয়নি। তবে পরিসংখ্যান না থাকলেও সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, উৎপাদন ছিল অনেক কম; যা এখন সারা দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।
এ পদ্ধতির চর্চা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ওপর চাপ কমিয়ে স্থানীয় আদার চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
খরচ কম, মুনাফা বেশি
মসলার গবেষক ড. আশিকুল ইসলাম নিরু বলেন, বস্তায় আদা চাষে উৎপাদন খরচ অনেক কম। এক বস্তায় ৫০-৬০ গ্রাম বীজ হলেই হয়, আর চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক বস্তায় খরচ ৫০ থেকে ৬০ টাকা। কিন্তু আদার ফলন যদি প্রতি বস্তায় এক কেজি হলেও কৃষক ন্যূনতম ২০০ টাকায় তা বিক্রি করতে পারবেন। অর্থাৎ মুনাফা ১৫০ টাকা। আর ১৫০ টাকায় বিক্রি করলেও ১০০ টাকা লাভ হবে।
সফলতার গল্প
ছোটবেলা থেকে শখের বশে পশুপাখি লালনপালনসহ কৃষিকাজে বেশ মনোযোগী সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের গন্ধর্বপুর গ্রামের তরুণ ফখরুল ইসলাম। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে ভিডিও দেখে আগ্রহী হই। পরে উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের সহযোগিতায় প্রথমবার বাড়ির আঙিনায় ২৬০টি বস্তায় আদা চাষ করেছি। প্রতি বস্তায় ৩০ টাকা হিসাবে প্রায় ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে আদাগাছের যে ফলন দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, প্রতি বস্তায় দেড় কেজি আদা পাওয়া যাবে। উৎপাদিত হবে প্রায় ৪০০ কেজি। স্থানীয় বাজারে বর্তমানে আদার দাম কেজিতে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আশা করছি, এতে প্রায় ৭০ হাজার টাকার বেশি লাভ হবে।’
৪৫০ বস্তায় ১৫ কেজি আদা রোপণ করেছেন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের মাড়িয়া গ্রামের উজ্জ্বল শেখ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন ২ ফুটের বেশি লম্বা হয়েছে গাছ। প্রতি বস্তায় ১ কেজি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে ১২টি ব্লকে ২৫ জন কৃষক প্রায় দেড় হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছেন। প্রতি বস্তায় দুই কেজির বেশি আদার ফলন হতে পারে। এতে প্রায় তিন হাজার কেজি আদা উৎপাদিত হবে।
ফুলজোড় নদীর নুরনগর তালপট্টি চরের কৃষক লিটন আলী শেখ আজকের পত্রিকাকে বলেন, একদিকে জমিতে ভিন্ন ফসল এবং খালি পড়ে থাকা জায়গায় বস্তায় আদা চাষ করায় বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আদার পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি ব্যবহার
আদায় রয়েছে পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন এ, বি৬, ই ও সি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট। এ ছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম আদায় রয়েছে ক্যালরি ৮০, প্রোটিন ১.৮২ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১৭.৮ গ্রাম (ডায়েটারি ফাইবার ২ গ্রাম), টোটাল ফ্যাট ০.৭৫ গ্রাম, মিনারেল ৭৮.৯ গ্রাম। এসব কারণে সব বয়সী মানুষ আদা খেতে পারেন, বিশেষ করে শিশুদের জন্য আদা-মধু-পানি সুস্থ দেহ ও সতেজ মনের জন্য খুবই কার্যকর। অন্যদিকে ভেষজ ওষুধ হিসেবে দেশে আদার বহুল ব্যবহার রয়েছে। মুখের রুচি বাড়াতে ও বদহজম রোধে আদা শুকিয়ে চিবিয়ে খাওয়া হয়। এ ছাড়া সর্দি, কাশি, আমাশয়, জন্ডিস, পেট ফাঁপায় আদা চিবিয়ে বা রস করে খাওয়া হয়। হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা বজায় রাখার পাশাপাশি অনেক গোপন সমস্যা দূর করতেও সহায়ক আদা।
[প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছেন জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি ও কামারখন্দ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি।]
মসলাজাতীয় একটি প্রাচীনতম ফসল আদা; যা বাণিজ্যিকভাবে প্রথম মসলাজাতীয় পণ্য হিসেবে এশিয়া থেকে ইউরোপে রপ্তানি হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমানরা এটি ব্যবহার করত। মুখরোচক রান্নায় আদার জুড়ি মেলা ভার। তাই তো প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে রান্নায় আদার ব্যবহার হয়ে আসছে। এর ভেষজ গুণও উপেক্ষার নয়। চিকিৎসার অন্যতম উপকরণ হিসেবে চীনে আদার প্রচলন ঘটে দুই হাজার বছর আগে।
এখন সময় বদলেছে। বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে। আগের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও টিকে আছে আদার প্রচলন। বরং আধুনিকতার এই সময়ে আদার ব্যবহার, ক্ষেত্র এবং ভোক্তা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। এ কারণে বিশ্বজুড়ে রান্নার উপকরণের বাইরেও আদার ব্যবহার রূপান্তর হচ্ছে। আচার, পানীয় তৈরিসহ খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে এর হরেক ব্যবহারের পাশাপাশি ওষুধ এবং সুগন্ধিশিল্পেও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে আদা।
দেশীয় বাস্তবতা
বৈশ্বিক বাস্তবতার ছাপ দেশেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আদার ব্যবহার এবং ভোগ—উভয়ই বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বিশ্বের আদা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অন্যদিকে কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আদার জেনেরিক নাম জিঙ্গিবার, যা মসলার সংস্কৃত নাম সিঙ্গাবেরা এবং গ্রিক জিঙ্গিবেরিস থেকে উদ্ভূত। দেশে এই মসলাজাতীয় পণ্যের চাহিদা বছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার টন, কিন্তু উৎপাদিত হয় তার অর্ধেক। আবার উৎপাদন পর্যায়ে মাটিবাহিত রোগ এবং উৎপাদন-পরবর্তী সংরক্ষণের অভাবে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। সব মিলিয়ে প্রতিবছর চাহিদার ঘাটতি পড়ে ৬০ শতাংশের মতো; যা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়; যার ৬০ শতাংশই আসে চীন থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত চার অর্থবছরের হিসাবে চাহিদা পূরণে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার টন আদা আমদানি করতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৬ হাজার টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৪১ হাজার টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯১ হাজার টন আদা আমদানি হয়েছে। গত রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি আদা বিক্রি হয়েছে ২৬০ থেকে ৩০০ টাকায়। সারা বছর এর প্রতি কেজির গড় মূল্য ২০০ টাকা বিবেচনায় নেওয়া হলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং আমদানি মিলিয়ে দেশে চাহিদার ৪ লাখ ৮০ হাজার টন আদার বাজারমূল্য ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
বাধা যেখানে
দেশে আদার ঘাটতির অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন কম। অভাব রয়েছে আদা চাষের উপযোগী জমিরও। এটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। প্রায় ১০ মাস সময় লাগে। এত সময় ধরে আদা চাষে অনাগ্রহী কৃষক। তাঁরা একই সময় ওই জমিতে ৩-৪টি অন্য ফসল ফলাতে পারেন, যা লাভজনক। অন্যদিকে তদুপরি দেশীয় প্রেক্ষাপটে জমিতে আদার কন্দপচা রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। এর কারণে কোনো কোনো বছর আদার ফলন ৫০-৮০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়। তখন স্থানীয় বাজারে সরবরাহে বড় ঘাটতি তৈরি হয় এবং দাম চলে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে।
আছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ
এসব সমস্যা মোকাবিলা ও ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন বারি-১, বারি-২, ও বারি-৩ নামে তিনটি উচ্চফলনশীল আদার জাত; যার প্রতি হেক্টরে ফলন ৩০-৩৯ টন। গবেষকেরা বলছেন, বস্তায় আদা চাষের সুবিধা হলো, আবাদি জমির প্রয়োজন হবে না। যেকোনো পতিত জায়গায় চাষ করা যাবে। যেমন বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পাশে, অফিসে, যেখানে নতুন বাগান হচ্ছে, যেখানে ছায়া কম, সেসব জায়গায় চাষ করা যাবে। জুন-জলাই মাস আদা চাষের উপযুক্ত সময়। ফলনও পাওয়া যাবে চাষের ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যে। প্রাকৃতিক যেকোনো বিপর্যয়ে বস্তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে একই জায়গায় বারবার মাটির মিশ্রণ তৈরি করে আদাবীজ রোপণ করা যায়। শুধু বস্তা কিনতে হবে। চার-পাঁচ টাকা দাম। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ও জৈব সার, ছাই ব্যবহার করে মিশ্রণ করা যেতে পারে।
বস্তায় আদা চাষের সুবিধা সম্পর্কে বগুড়ায় অবস্থিত শিবগঞ্জের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশিকুল ইসলাম নিরু বলেন, ‘মাটিতে আদা চাষে বিদ্যমান অসুবিধার সমাধান মিলেছে বস্তায় আদা চাষে। এই অভিনব পদ্ধতি দেখাচ্ছে ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা। দিচ্ছে স্বনির্ভরতা অর্জনের হাতছানি। দেশে সাড়ে তিন কোটির মতো বসতবাড়ি রয়েছে। এসব বাড়িতে ১০ বস্তা করে আদা চাষ করা হলেও সাড়ে ৩৫ কোটি বস্তা হবে। প্রতি বস্তায় ১ কেজি আদা উৎপাদিত হলেও আমাদের চাহিদা মিটে যাবে; যা প্রতিবছর সাশ্রয় করতে পারে কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি ব্যয়।’
বাড়ছে জনপ্রিয়তা
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে অনানুষ্ঠানিক ও স্বল্প পরিসরে বস্তায় আদার চাষ শুরু হলেও বছর দুয়েক হলো এর জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এরই মধ্যে বস্তায় আদা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে নেওয়া হয়েছে সরকারি প্রকল্প। দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ, বস্তা, বীজ, সার ইত্যাদি। এ ছাড়া কম খরচে অধিক মুনাফা হওয়ায় ব্যক্তি উদ্যোগেও এখন বস্তায় আদা চাষে ঝুঁকছেন অনেকে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে এ পদ্ধতিতে আদার চাষ শিখছেন অনেক তরুণ। যার মাধ্যমে এর চাষাবাদ পদ্ধতি ছড়িয়ে গেছে দেশের সর্বত্র। বাড়ছে আগ্রহ। উৎপাদনে কমছে জমিনির্ভরতা।
এ প্রসঙ্গে মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে জানান, প্রকল্পের অধীনে এ নিয়ে দুই বছর বস্তায় আদা চাষ হয়েছে। এ বছর প্রকল্প ও ব্যক্তি উদ্যোগ মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ বস্তায় আদা চাষ হয়েছে; যা থেকে প্রায় ১০ হাজার টন আদা উৎপাদিত হবে। এটি কেবল সরকারি হিসাব। এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে বস্তায় আদা চাষ করছেন। আগে এ-সম্পর্কিত কোনো জরিপ করা হয়নি। তবে পরিসংখ্যান না থাকলেও সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, উৎপাদন ছিল অনেক কম; যা এখন সারা দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।
এ পদ্ধতির চর্চা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ওপর চাপ কমিয়ে স্থানীয় আদার চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
খরচ কম, মুনাফা বেশি
মসলার গবেষক ড. আশিকুল ইসলাম নিরু বলেন, বস্তায় আদা চাষে উৎপাদন খরচ অনেক কম। এক বস্তায় ৫০-৬০ গ্রাম বীজ হলেই হয়, আর চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক বস্তায় খরচ ৫০ থেকে ৬০ টাকা। কিন্তু আদার ফলন যদি প্রতি বস্তায় এক কেজি হলেও কৃষক ন্যূনতম ২০০ টাকায় তা বিক্রি করতে পারবেন। অর্থাৎ মুনাফা ১৫০ টাকা। আর ১৫০ টাকায় বিক্রি করলেও ১০০ টাকা লাভ হবে।
সফলতার গল্প
ছোটবেলা থেকে শখের বশে পশুপাখি লালনপালনসহ কৃষিকাজে বেশ মনোযোগী সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের গন্ধর্বপুর গ্রামের তরুণ ফখরুল ইসলাম। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে ভিডিও দেখে আগ্রহী হই। পরে উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের সহযোগিতায় প্রথমবার বাড়ির আঙিনায় ২৬০টি বস্তায় আদা চাষ করেছি। প্রতি বস্তায় ৩০ টাকা হিসাবে প্রায় ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে আদাগাছের যে ফলন দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, প্রতি বস্তায় দেড় কেজি আদা পাওয়া যাবে। উৎপাদিত হবে প্রায় ৪০০ কেজি। স্থানীয় বাজারে বর্তমানে আদার দাম কেজিতে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আশা করছি, এতে প্রায় ৭০ হাজার টাকার বেশি লাভ হবে।’
৪৫০ বস্তায় ১৫ কেজি আদা রোপণ করেছেন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের মাড়িয়া গ্রামের উজ্জ্বল শেখ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন ২ ফুটের বেশি লম্বা হয়েছে গাছ। প্রতি বস্তায় ১ কেজি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে ১২টি ব্লকে ২৫ জন কৃষক প্রায় দেড় হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছেন। প্রতি বস্তায় দুই কেজির বেশি আদার ফলন হতে পারে। এতে প্রায় তিন হাজার কেজি আদা উৎপাদিত হবে।
ফুলজোড় নদীর নুরনগর তালপট্টি চরের কৃষক লিটন আলী শেখ আজকের পত্রিকাকে বলেন, একদিকে জমিতে ভিন্ন ফসল এবং খালি পড়ে থাকা জায়গায় বস্তায় আদা চাষ করায় বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আদার পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি ব্যবহার
আদায় রয়েছে পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন এ, বি৬, ই ও সি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট। এ ছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম আদায় রয়েছে ক্যালরি ৮০, প্রোটিন ১.৮২ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১৭.৮ গ্রাম (ডায়েটারি ফাইবার ২ গ্রাম), টোটাল ফ্যাট ০.৭৫ গ্রাম, মিনারেল ৭৮.৯ গ্রাম। এসব কারণে সব বয়সী মানুষ আদা খেতে পারেন, বিশেষ করে শিশুদের জন্য আদা-মধু-পানি সুস্থ দেহ ও সতেজ মনের জন্য খুবই কার্যকর। অন্যদিকে ভেষজ ওষুধ হিসেবে দেশে আদার বহুল ব্যবহার রয়েছে। মুখের রুচি বাড়াতে ও বদহজম রোধে আদা শুকিয়ে চিবিয়ে খাওয়া হয়। এ ছাড়া সর্দি, কাশি, আমাশয়, জন্ডিস, পেট ফাঁপায় আদা চিবিয়ে বা রস করে খাওয়া হয়। হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা বজায় রাখার পাশাপাশি অনেক গোপন সমস্যা দূর করতেও সহায়ক আদা।
[প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছেন জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি ও কামারখন্দ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি।]
আসন্ন পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে সরকার। পাশাপাশি রোজার ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ এই পণ্যের ওপর থাকা অগ্রিম করও পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আজ বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে। তবে খেজুর আমদানির অযৌক্তিক ট্যারিফ ভ্যালু...
৩ ঘণ্টা আগেদেশের বাজারে ফের সোনার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ২২ ক্যারেট সোনার ভরির নতুন দাম ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৩ টাকা। দাম বৃদ্ধির কারণ ও বিস্তারিত জানতে পড়ুন।
৩ ঘণ্টা আগেপুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন জুতা প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক তিন কোম্পানির কাছে প্রস্তুতকৃত চামড়া বিক্রি করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এপেক্স ট্যানারি লিমিটেড। এ লক্ষ্যে শিগগিরই হবে চুক্তি। চুক্তির আওতায় বছরে ১৬ কোটি টাকার চামড়া বিক্রি করবে এপেক্স ট্যানারি।
৩ ঘণ্টা আগেফলজাত পণ্য রপ্তানির জন্য বিশেষ সুবিধা দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলজাত পাল্প থেকে প্রস্তুত করা জুস ও ড্রিংকস রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানিকারকেরা এখন মোট রপ্তানি আয়ের ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাবেন। আজ বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ
৩ ঘণ্টা আগে