Ajker Patrika

চাহিদার দ্বিগুণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ খাতে বছরজুড়ে লোডশেডিং, তীব্র জ্বালানি সংকট

সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২: ২৭
চাহিদার দ্বিগুণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ খাতে বছরজুড়ে লোডশেডিং, তীব্র জ্বালানি সংকট

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার খাত। সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে এই খাতে সফলতা উদ্‌যাপন করেছে। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা বলা হয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া ছিল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। ১৫ বছরে দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি করা হচ্ছে। লোডশেডিং জাদুঘরে পাঠানোর কথাও বলা হয়েছে। যদিও বছরজুড়ে গ্রামের পাশাপাশি রাজধানীতেও নাগরিকদের তীব্র লোডশেডিং সহ্য করতে হয়েছে।

এ বছর বাণিজ্যিক উৎপাদনে এসেছে আলোচিত ভারতের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজে গতি আনতেও চলছে তোড়জোড়। 

এরপরও সবকিছু ছাপিয়ে ২০২৩ সাল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য সুখকর ছিল না। বছরটি শুরুই হয়েছে পরপর তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। রেকর্ড পরিমাণ দাম বেড়েছে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের। বছরব্যাপী গ্যাস, জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুতের দীর্ঘ ও ঘন ঘন লোডশেডিং সহ্য করতে হয়েছে দেশের মানুষকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে গ্রাম ও শহরে। গ্রামের লোডশেডিং ছাড়িয়ে গিয়েছিল ১২-১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত। খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তখন চলমান লোডশেডিংকে ‘অসহনীয়’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। 

বিদ্যুৎ খাতের মেগা প্রকল্প—পায়রা, রামপাল ও আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে লোডশেডিং কমার আশা ছিল সরকারের। একই সঙ্গে ছিল নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি। 

তবে বাস্তবে তা হয়নি। জ্বালানি সংকটে মাসের পর মাস বন্ধ ছিল রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ডলার সংকটে বিল দিতে না পারায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধের ঘটনাও ঘটেছে। 

ডলার-সংকট থাকায় তেলের আমদানি বিল পরিশোধ করতে না পারার ঘটনা ছিল বছরজুড়ে আলোচিত। ডলার-সংকটের ছায়া পড়েছে এলএনজি আমদানিতেও। এর প্রভাব পড়েছে শিল্পকারখানার উৎপাদনে। 

সরকারি হিসাবে, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণের বেশি। এরপরও গ্রীষ্মকালজুড়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, গ্রীষ্মে সারা দেশে লোডশেডিং ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছেছে। 

লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গ্রাহকের রোষানলে পড়তে হয়েছে বিদ্যুৎকর্মীদের। ভাঙচুর হয়েছে বিদ্যুৎ অফিস। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাকিতে কয়লা ও এলএনজি এনে উৎপাদন সচল রাখার চেষ্টা ছিল। তবে বকেয়া বেশি হয়ে গেলে সরবরাহকারীরা কয়লা ও এলএনজি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে অবনতি হতে থাকে লোডশেডিং পরিস্থিতির। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ‘বৃষ্টি কামনা’ও করেছে! 

বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান গত ৬ জুন আজকের পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘দেশে ভয়াবহ গরম পড়ছে। গরম না কমলে চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের আশা, এই মাসের ১০-১২ তারিখের দিকে বৃষ্টিপাত হতে পারে। এরপর হয়তো লোডশেডিং একটু কমতে পারে।’ 

লোডশেডিং পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধের প্রস্তাবও দেন। 

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশে বিদ্যুতের দৈনিক গড় চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট। আর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। সে হিসাবে উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণের বেশি।

এরপরও কেন লোডশেডিং, এ প্রশ্নে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, এই খাতে যা হয়েছে, তা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো! জ্বালানি সংস্থানের কোনো খবর নেই। কিন্তু স্থাপন করা হয়েছে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র। নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাস ও কয়লা উত্তোলন করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মেটানোর জন্য ছিল না তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া দিতে হয়েছে হাজার কোটি টাকা। 

বছরজুড়ে ডলার-সংকট
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর। বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ালে এই খাতের ভঙ্গুরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। আবাসিক ও শিল্পে দেখা দেয় তীব্র গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট। 

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে সরকারকে একসময় আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভে হাত দিতে হয়েছে। একপর্যায়ে জ্বালানি তেল, কয়লা ও এলএনজির দাম মেটানো আর সম্ভব হয়নি। নির্ধারিত সময়ে বিল দিতে না পারায় জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়েছিল পেট্রোবাংলা ও বিপিসিকে। একই সঙ্গে এসেছে সরবরাহ বন্ধের হুমকিও। জ্বালানি বিভাগের এক সূত্র আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছে, জ্বালানি পণ্য বাবদ সরবরাহকারীদের পাওনার পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি ডলার। 

আদানির বিদ্যুৎ
চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন—সবকিছুতেই আদানির ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর আগে শুল্ক-কর ছাড় নিয়ে লুকোচুরি ও কয়লার অতিরিক্ত দাম নির্ধারণের মতো অভিযোগ উঠেছিল আদানির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে অনেকটা নীরবেই গত ৬ মার্চ আদানির ঝাড়খন্ডের গড্ডায় অবস্থিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগ প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বিষয়টি স্বীকার করে। 

এর এক মাস পর ৬ এপ্রিল এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটও বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর বিষয়টি নজরে আসে ভারতের মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ অব ইন্ডিয়া লিমিটেডকে লেখা আদানির চিঠির সূত্রে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের বিপক্ষে সেমির আগেই ধাক্কা খেল অস্ট্রেলিয়া

পরমাণু শক্তিধর হতে চেয়েছিল তাইওয়ান, সিআইএ এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপ্নভঙ্গ

এলপি গ্যাস, তেল, আটাসহ বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট তুলে দিল এনবিআর

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: রিজার্ভ-ডেতেও সেমিফাইনাল না হলে হৃদয়বিদারক সমীকরণ

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত