আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা
১ কেজি চা-পাতায় কত কাপ চা তৈরি করা যায়, তা মূলত নির্ভর করে চায়ের পাতার মান, ব্যবহৃত চায়ের পরিমাণ এবং পানির পরিমাণের ওপর। চায়ের স্বাদ ও ঘনত্বের জন্য এই তিনটি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাধারণত এক কাপ চায়ের জন্য ১ থেকে ২ চা-চামচ চা-পাতা ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি চা-চামচের ওজন প্রায় ২ গ্রাম। সুতরাং যদি প্রতি কাপ চায়ে ৪ গ্রাম চা-পাতা (২ চা-চামচ) ব্যবহার করা হয়, তাহলে ১ কেজি (১০০০ গ্রাম) চা-পাতা থেকে গড়ে ২৫০ কাপ চা তৈরি করা সম্ভব। এটি একটি গড় হিসাব, যেহেতু ব্যবহৃত চায়ের পরিমাণ এবং পানি গরম করার পদ্ধতি অনুযায়ী এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে বা কমতে পারে।
চা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশে চা ভোগের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৫০ লাখ কেজি। এই চা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়—‘বেস্ট’, ‘গুড’ এবং ‘সাধারণ’ চা। দেশীয় চা ভোগের এই পরিমাণের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে ২ লাখ ৬০ হাজার ২৭৪ কেজি চা ব্যবহৃত হয়েছে, যা থেকে ভোক্তারা মোট ৬ কোটি ৫০ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ কাপ চা পান করেছে। আর বছরের শেষে সারা বছর চা পান হয়েছে ২ হাজার ৩৭৫ কোটি কাপ।
চা বিক্রির মূল্য ভিন্ন ভিন্ন স্থান ও মান অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। সাধারণত প্রতি কাপ চায়ের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত রাখা হয়। কিছু জায়গায়, বিশেষত শহরাঞ্চলে, চায়ের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত হয়। স্থানভেদে এই দাম আরও বেশি। চায়ের দামভেদে গড় মূল্য যদি ৮ টাকা ধরা হয়, তাহলে ভোক্তাদের দৈনিক চা পানে ব্যয় হয়েছে ৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ সারা দেশে বছরজুড়ে চায়ের অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকার।
চা শুধু অভ্যর্থনার পানীয়ই নয়, এর ঔষধি গুণও রয়েছে। চায়ে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদ্যন্ত্রের সক্রিয়তা বাড়ায়, রক্তনালি সুস্থ রাখে এবং শরীর সতেজ ও উৎফুল্ল রাখে। এর ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। বিভিন্ন ধরনের চায়ে বিভিন্ন ভেষজ গুণ থাকে। এ ছাড়া চায়ের নানা ব্যবহার রয়েছে; যেমন গাছের সার হিসেবে, কাপড়ের রং ধরে রাখতে, জুতার দুর্গন্ধ দূর করতে, কার্পেট ও কাচ পরিষ্কার করতে, এমনকি রূপচর্চায়ও চা ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহ্যের গৌরবেও সংকটের ছায়া
এভাবে বাংলাদেশের চা-শিল্প শুধু একটি অর্থনৈতিক খাত নয়, বরং এটি দেশের ঐতিহ্যের অংশ, যার বয়স ১৮৪ বছর। দীর্ঘ এই যাত্রায় চায়ের উৎপাদন ধাপে ধাপে বেড়েছে এবং গত বছর রেকর্ড ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। তবে উৎপাদনে এই সাফল্য কাগজে-কলমে গর্ব করার মতো হলেও বাস্তবে সমস্যা অনেক। সরকারি পরিকল্পনার অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতি এবং মালিকদের উদাসীনতার কারণে শিল্পটি এখন সমস্যায় পড়েছে এবং তা পুরোপুরি কার্যকরভাবে কাজ করছে না।
এই সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে বহুমুখী জটিলতা সৃষ্টি করছে। এর প্রভাব পড়েছে চা রপ্তানিতে। মানসম্পন্ন চায়ের উৎপাদন বাড়াতে না পারায় গত এক দশকে বাংলাদেশি চায়ের ঐতিহ্য ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। ২০২২ সালে চায়ের রপ্তানি মাত্র ১ শতাংশে পৌঁছেছিল। আর গত ২২ বছরে অন্তত ১৩ গুণ কমেছে রপ্তানি। দেশি-বিদেশি অন্তত ২২টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানিতে জড়িত থাকলেও এখন তাদের অনেকে রপ্তানিতে নেই।
অদ্ভুতভাবে, চায়ের উৎপাদনে উদ্বৃত্ত থাকার পরেও দেশে চা আমদানির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩ সালে ২ লাখ ৮৮ হাজার কেজি চা আমদানি হয়েছে। দেশে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় উদ্যোক্তারা নিলামে চায়ের প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না। ২০২৩ সালে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ছিল ২৭১ টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ২৯৭ টাকা এবং বর্তমানে তা ৩০০ টাকার কাছাকাছি। কেনিয়ায় প্রতি হেক্টরে চায়ের গড় উৎপাদন ৪ হাজার কেজি, সেখানে বাংলাদেশে তা মাত্র ১ হাজার ৫০০ কেজি। অর্থাৎ দেশে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান। চা বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাসে নিলামে ‘বেস্ট’ ক্যাটাগরি চায়ের কেজি ২৮০-৩৩০ টাকা, ‘গুড’ ক্যাটাগরি ২৪৫-২৭০ টাকা এবং সাধারণ চায়ের কেজি ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ফলে রপ্তানির জন্য মানসম্পন্ন চা উৎপাদনে আগ্রহ কমে গেছে, যা উদ্যোক্তাদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে অনেক চা-বাগান লোকসানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর এতে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনমানেও উন্নতির অভাব দেখা যাচ্ছে।
এদিকে, বাগানমালিকেরা নিলামে কম দাম পেলেও তাঁদের উৎপাদিত চা বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে, ফলে ক্রেতারা বাড়তি খরচে চা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমানে সাধারণ মানের চা খোলাবাজারে ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর কোম্পানির প্যাকেটজাত চায়ের দাম ৫০০ টাকার বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে চা-শিল্পের ভবিষ্যৎ সংকটে পড়বে।
বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, ‘শ্রমিকের বেতন, ডিজেল, গ্যাস ও অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়েছে। সে তুলনায় নিলাম মূল্য না বেড়ে বরং কমে গেছে; যা চা-শিল্পের জন্য উদ্বেগজনক। যদি নিলাম মূল্য না বাড়ে, তাহলে একে একে বাগানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এরই মধ্যে ন্যাশনাল টিয়ের ১২টি বাগান বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও অনেক বাগান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। যদি সরকার সহায়তা না দেয়, তবে চা-শিল্পের হাজারো শ্রমিকের জীবিকা এবং তাঁদের পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিলামে চায়ের দাম কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে ভোক্তাদের কাছে চায়ের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন ও চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিও আছে। এর ফলে বাজারে চায়ের দাম সঠিকভাবে নির্ধারণ হচ্ছে না, যা চা-শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
দেশে চা-বাগানের চিত্র
চলতি বছরের ১১ আগস্ট প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬৯টি চা-বাগান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশি চা-বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়, ৯০টি। এ ছাড়া হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, খাগড়াছড়িতে ১টি, রাঙামাটিতে ২টি, পঞ্চগড়ে ৯টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা-বাগান রয়েছে। এই চা-বাগানগুলো দেশের চা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
দাম ও মানোন্নয়নে যে বিতর্ক
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব (উপসচিব) মিনহাজুর রহমান জানিয়েছেন, ২০২১ সালে চা-শ্রমিকদের মজুরি প্রতি কেজিতে ৮ টাকা ৫০ পয়সা বাড়ে, যা অনেক চা-বাগানমালিকের জন্য আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চা উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি এবং আর্থিক সংকটের প্রভাবে উত্তরবঙ্গের চায়ের গুণগত মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) সুমন শিকদার জানিয়েছেন, ভালো মানের চা উৎপাদন নিশ্চিত করতে বোর্ড বিভিন্ন পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে। তবে চায়ের গুণগত মান উন্নত করার মূল দায়িত্ব বাগানমালিকদের। তিনি উল্লেখ করেন, বাগানমালিকেরা যদি উৎপাদনের মান উন্নত করেন, তাহলে নিলামে চায়ের ভালো দাম পাওয়া সম্ভব।
অন্যদিকে বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, ‘যদি ভালো মানের চা উৎপাদন করি, তাহলে উৎপাদন কমে যাবে, কিন্তু দাম বাড়বে।’
দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হলে দেশে চায়ের দাম অনেক কমাতে হবে, কিন্তু সেটি সম্ভব নয়।’
আছে মজুরি বিতর্কও
চা-শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে, বিশেষত অন্য খাতের তুলনায় কম মজুরি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে। তবে বাংলাদেশ চা সংসদ মনে করে, অন্য শিল্পের সঙ্গে চা-শিল্পের মজুরি তুলনা করা সঠিক নয়। কামরান টি রহমান বলেন, চা-শিল্পে শ্রমিকদের ‘ইন ক্যাশ অ্যান্ড ইন কাইন্ড’ মজুরি দেওয়া হয়। বর্তমানে ১৭৮ টাকা ক্যাশ দেওয়া হয়, পাশাপাশি রেশন হিসেবে ২ টাকা কেজিতে চাল বা গম, বাসস্থানের সুবিধা ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
কামরান টি রহমান আরও বলেন, এই খাতে একজন শ্রমিক অবসরে যাওয়ার পর আজীবন রেশন পান এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যও একসঙ্গে কাজ করতে পারেন, যা অন্য শিল্পে সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ পরেশ কালিন্দি বলেন, মালিকপক্ষের দাবি করা ৫৭০ টাকা মজুরি ভিত্তিহীন। তাঁর মতে, শ্রম আইনের অধীনে বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধার মূল্য মজুরির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
আশার আলো খুঁজতে হবে
চা-শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সঠিক নীতিমালা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রপ্তানি বাজার পুনরুদ্ধারে জোর দিলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। চলমান সংকট উত্তরণে প্রস্তাব করা হয়েছে কিছু কার্যকর উদ্যোগের। উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে গুণগত মান উন্নত করার পাশাপাশি রপ্তানিমুখী চা উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে আইন সহজ করা এবং সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। এসব উদ্যোগই চা-শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার মূল চাবিকাঠি হতে পারে।
১ কেজি চা-পাতায় কত কাপ চা তৈরি করা যায়, তা মূলত নির্ভর করে চায়ের পাতার মান, ব্যবহৃত চায়ের পরিমাণ এবং পানির পরিমাণের ওপর। চায়ের স্বাদ ও ঘনত্বের জন্য এই তিনটি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাধারণত এক কাপ চায়ের জন্য ১ থেকে ২ চা-চামচ চা-পাতা ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি চা-চামচের ওজন প্রায় ২ গ্রাম। সুতরাং যদি প্রতি কাপ চায়ে ৪ গ্রাম চা-পাতা (২ চা-চামচ) ব্যবহার করা হয়, তাহলে ১ কেজি (১০০০ গ্রাম) চা-পাতা থেকে গড়ে ২৫০ কাপ চা তৈরি করা সম্ভব। এটি একটি গড় হিসাব, যেহেতু ব্যবহৃত চায়ের পরিমাণ এবং পানি গরম করার পদ্ধতি অনুযায়ী এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে বা কমতে পারে।
চা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশে চা ভোগের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৫০ লাখ কেজি। এই চা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়—‘বেস্ট’, ‘গুড’ এবং ‘সাধারণ’ চা। দেশীয় চা ভোগের এই পরিমাণের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে ২ লাখ ৬০ হাজার ২৭৪ কেজি চা ব্যবহৃত হয়েছে, যা থেকে ভোক্তারা মোট ৬ কোটি ৫০ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ কাপ চা পান করেছে। আর বছরের শেষে সারা বছর চা পান হয়েছে ২ হাজার ৩৭৫ কোটি কাপ।
চা বিক্রির মূল্য ভিন্ন ভিন্ন স্থান ও মান অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। সাধারণত প্রতি কাপ চায়ের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত রাখা হয়। কিছু জায়গায়, বিশেষত শহরাঞ্চলে, চায়ের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত হয়। স্থানভেদে এই দাম আরও বেশি। চায়ের দামভেদে গড় মূল্য যদি ৮ টাকা ধরা হয়, তাহলে ভোক্তাদের দৈনিক চা পানে ব্যয় হয়েছে ৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ সারা দেশে বছরজুড়ে চায়ের অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকার।
চা শুধু অভ্যর্থনার পানীয়ই নয়, এর ঔষধি গুণও রয়েছে। চায়ে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদ্যন্ত্রের সক্রিয়তা বাড়ায়, রক্তনালি সুস্থ রাখে এবং শরীর সতেজ ও উৎফুল্ল রাখে। এর ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। বিভিন্ন ধরনের চায়ে বিভিন্ন ভেষজ গুণ থাকে। এ ছাড়া চায়ের নানা ব্যবহার রয়েছে; যেমন গাছের সার হিসেবে, কাপড়ের রং ধরে রাখতে, জুতার দুর্গন্ধ দূর করতে, কার্পেট ও কাচ পরিষ্কার করতে, এমনকি রূপচর্চায়ও চা ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহ্যের গৌরবেও সংকটের ছায়া
এভাবে বাংলাদেশের চা-শিল্প শুধু একটি অর্থনৈতিক খাত নয়, বরং এটি দেশের ঐতিহ্যের অংশ, যার বয়স ১৮৪ বছর। দীর্ঘ এই যাত্রায় চায়ের উৎপাদন ধাপে ধাপে বেড়েছে এবং গত বছর রেকর্ড ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। তবে উৎপাদনে এই সাফল্য কাগজে-কলমে গর্ব করার মতো হলেও বাস্তবে সমস্যা অনেক। সরকারি পরিকল্পনার অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতি এবং মালিকদের উদাসীনতার কারণে শিল্পটি এখন সমস্যায় পড়েছে এবং তা পুরোপুরি কার্যকরভাবে কাজ করছে না।
এই সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে বহুমুখী জটিলতা সৃষ্টি করছে। এর প্রভাব পড়েছে চা রপ্তানিতে। মানসম্পন্ন চায়ের উৎপাদন বাড়াতে না পারায় গত এক দশকে বাংলাদেশি চায়ের ঐতিহ্য ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। ২০২২ সালে চায়ের রপ্তানি মাত্র ১ শতাংশে পৌঁছেছিল। আর গত ২২ বছরে অন্তত ১৩ গুণ কমেছে রপ্তানি। দেশি-বিদেশি অন্তত ২২টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানিতে জড়িত থাকলেও এখন তাদের অনেকে রপ্তানিতে নেই।
অদ্ভুতভাবে, চায়ের উৎপাদনে উদ্বৃত্ত থাকার পরেও দেশে চা আমদানির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩ সালে ২ লাখ ৮৮ হাজার কেজি চা আমদানি হয়েছে। দেশে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় উদ্যোক্তারা নিলামে চায়ের প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না। ২০২৩ সালে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ছিল ২৭১ টাকা, যা ২০২১ সালে ছিল ২৯৭ টাকা এবং বর্তমানে তা ৩০০ টাকার কাছাকাছি। কেনিয়ায় প্রতি হেক্টরে চায়ের গড় উৎপাদন ৪ হাজার কেজি, সেখানে বাংলাদেশে তা মাত্র ১ হাজার ৫০০ কেজি। অর্থাৎ দেশে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান। চা বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাসে নিলামে ‘বেস্ট’ ক্যাটাগরি চায়ের কেজি ২৮০-৩৩০ টাকা, ‘গুড’ ক্যাটাগরি ২৪৫-২৭০ টাকা এবং সাধারণ চায়ের কেজি ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ফলে রপ্তানির জন্য মানসম্পন্ন চা উৎপাদনে আগ্রহ কমে গেছে, যা উদ্যোক্তাদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে অনেক চা-বাগান লোকসানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর এতে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনমানেও উন্নতির অভাব দেখা যাচ্ছে।
এদিকে, বাগানমালিকেরা নিলামে কম দাম পেলেও তাঁদের উৎপাদিত চা বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে, ফলে ক্রেতারা বাড়তি খরচে চা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমানে সাধারণ মানের চা খোলাবাজারে ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর কোম্পানির প্যাকেটজাত চায়ের দাম ৫০০ টাকার বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে চা-শিল্পের ভবিষ্যৎ সংকটে পড়বে।
বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, ‘শ্রমিকের বেতন, ডিজেল, গ্যাস ও অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়েছে। সে তুলনায় নিলাম মূল্য না বেড়ে বরং কমে গেছে; যা চা-শিল্পের জন্য উদ্বেগজনক। যদি নিলাম মূল্য না বাড়ে, তাহলে একে একে বাগানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এরই মধ্যে ন্যাশনাল টিয়ের ১২টি বাগান বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও অনেক বাগান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। যদি সরকার সহায়তা না দেয়, তবে চা-শিল্পের হাজারো শ্রমিকের জীবিকা এবং তাঁদের পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিলামে চায়ের দাম কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে ভোক্তাদের কাছে চায়ের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন ও চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিও আছে। এর ফলে বাজারে চায়ের দাম সঠিকভাবে নির্ধারণ হচ্ছে না, যা চা-শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
দেশে চা-বাগানের চিত্র
চলতি বছরের ১১ আগস্ট প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬৯টি চা-বাগান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশি চা-বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়, ৯০টি। এ ছাড়া হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, খাগড়াছড়িতে ১টি, রাঙামাটিতে ২টি, পঞ্চগড়ে ৯টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা-বাগান রয়েছে। এই চা-বাগানগুলো দেশের চা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
দাম ও মানোন্নয়নে যে বিতর্ক
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব (উপসচিব) মিনহাজুর রহমান জানিয়েছেন, ২০২১ সালে চা-শ্রমিকদের মজুরি প্রতি কেজিতে ৮ টাকা ৫০ পয়সা বাড়ে, যা অনেক চা-বাগানমালিকের জন্য আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চা উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি এবং আর্থিক সংকটের প্রভাবে উত্তরবঙ্গের চায়ের গুণগত মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) সুমন শিকদার জানিয়েছেন, ভালো মানের চা উৎপাদন নিশ্চিত করতে বোর্ড বিভিন্ন পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে। তবে চায়ের গুণগত মান উন্নত করার মূল দায়িত্ব বাগানমালিকদের। তিনি উল্লেখ করেন, বাগানমালিকেরা যদি উৎপাদনের মান উন্নত করেন, তাহলে নিলামে চায়ের ভালো দাম পাওয়া সম্ভব।
অন্যদিকে বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, ‘যদি ভালো মানের চা উৎপাদন করি, তাহলে উৎপাদন কমে যাবে, কিন্তু দাম বাড়বে।’
দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হলে দেশে চায়ের দাম অনেক কমাতে হবে, কিন্তু সেটি সম্ভব নয়।’
আছে মজুরি বিতর্কও
চা-শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে, বিশেষত অন্য খাতের তুলনায় কম মজুরি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে। তবে বাংলাদেশ চা সংসদ মনে করে, অন্য শিল্পের সঙ্গে চা-শিল্পের মজুরি তুলনা করা সঠিক নয়। কামরান টি রহমান বলেন, চা-শিল্পে শ্রমিকদের ‘ইন ক্যাশ অ্যান্ড ইন কাইন্ড’ মজুরি দেওয়া হয়। বর্তমানে ১৭৮ টাকা ক্যাশ দেওয়া হয়, পাশাপাশি রেশন হিসেবে ২ টাকা কেজিতে চাল বা গম, বাসস্থানের সুবিধা ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
কামরান টি রহমান আরও বলেন, এই খাতে একজন শ্রমিক অবসরে যাওয়ার পর আজীবন রেশন পান এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যও একসঙ্গে কাজ করতে পারেন, যা অন্য শিল্পে সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ পরেশ কালিন্দি বলেন, মালিকপক্ষের দাবি করা ৫৭০ টাকা মজুরি ভিত্তিহীন। তাঁর মতে, শ্রম আইনের অধীনে বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধার মূল্য মজুরির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
আশার আলো খুঁজতে হবে
চা-শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সঠিক নীতিমালা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রপ্তানি বাজার পুনরুদ্ধারে জোর দিলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। চলমান সংকট উত্তরণে প্রস্তাব করা হয়েছে কিছু কার্যকর উদ্যোগের। উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে গুণগত মান উন্নত করার পাশাপাশি রপ্তানিমুখী চা উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে আইন সহজ করা এবং সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। এসব উদ্যোগই চা-শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার মূল চাবিকাঠি হতে পারে।
ভারতীয় বিলিয়নিয়ার গৌতম আদানির সঙ্গে টোটালএনার্জির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আদানি এখন ঘুষ কেলেঙ্কারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত। এতে টোটালএনার্জির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে।
৩০ মিনিট আগেগত ১৫ বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ৮ বিমানবন্দর ঘিরে নেওয়া হয় ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্প। যাত্রীধারণ সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সেবার মানোন্নয়নে নেওয়া এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা ছিল প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। তবে নকশায় ভুল, সংযোজন-বিয়োজনসহ নানা কারণে কাজ শুধু পিছিয়েই গেছে। এতে দফায় দফায় বেড়েছে ব্যয়।
১ ঘণ্টা আগেস্কয়ার হাসপাতাল ‘বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সচেতনতা সপ্তাহ (১৮-২৪ নভেম্বর) ’ উপলক্ষে একটি বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করেছে। গত ২০ নভেম্বর এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
২ ঘণ্টা আগেটি কে গ্রুপের তত্ত্বাবধানে শুরু হচ্ছে পুষ্টি ‘ভার্সেস অব লাইট’ হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা। গতকাল শনিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। টি কে গ্রুপ আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা দেশের উদীয়মান তরুণ-কিশোর হাফেজদের অসাধারণ প্রতিভা ও কোরআন তিলাওয়াতের দক্ষতাকে সম্ম
২ ঘণ্টা আগে