সাক্ষাৎকার

এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে: সাক্ষাৎকারে এফবিসিসিআই সভাপতি

২০১৪ সালের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে হরতাল ও অবরোধের মতো কোনো রাজনৈতিক বাধা আসেনি।। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সংঘাতের পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। এরই মধ্যে এক দিনের হরতাল পালিত হয়েছে। ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর তিন দিনের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলছে।

একই সময়ে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা আন্দোলনে নেমেছেন। বর্তমান ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকেরা।

রাজনৈতিক সহিংসতায় এরই মধ্যে পুলিশসহ প্রায় ১০ জন এবং শ্রমিক অসন্তোষে অন্তত দুইজন নিহত হয়েছেন। শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও উদ্বেগ জানিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা–বাণিজ্যের সার্বিক বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলমের সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সাজ্জাদ হোসেন। 

এফবিসিসিআই সভাপতি মনে করছেন, হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি চলতে থাকলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও বড় সংকটে পড়বে। 

আজকের পত্রিকা: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে বিরোধী দলগুলো হরতাল–অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? 

মাহবুবুল আলম: ২০১৪ সালের পর থেকে দেশ হরতাল, অবরোধ-মুক্ত ছিল। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক ছিল। কয়েক দিন আগেও এফবিসিসিআই সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যাতে তারা হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে বিরত থাকে। 

অর্থনীতির সব সূচক বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, ২০১৩-১৪ সালের দিকে এক দিনের হরতালে দৈনিক অর্থনৈতিক ক্ষতি ২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান দেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় এখন এক দিন হরতাল হলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। আমাদের বর্তমান অর্থনীতির আকার ৪৫৭ বিলিয়ন ডলার। আমরা এখন দেশের অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারে নিতে চাই। এই অবস্থায় হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি চললে আমাদের অর্থনীতি ভয়ানক ক্ষতির মুখে পড়বে। 

এই হরতাল ও অবরোধের কারণে আমাদের সরবরাহ চেইনও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত— রপ্তানি ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। একদিকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ অন্যদিকে হামাস–ইসরায়েল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যও অস্থিশীল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতে চাপে আছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে যদি রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। 

আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশে এখন যেই সমস্যা আছে সেটা রাজনৈতিক। এই সমস্যা নিরসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এগিয়ে আসার জন্য বলছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। এই ব্যাপারে আপনার মতামত কী? 

মাহবুবুল আলম: সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান হচ্ছে, আমরা দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাই। আমরা চাই, দেশে একটা সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসুক। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করুক। দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য সব দলের দায়িত্ব আছে। আমি মনে করি, এখানে সরকারের দায়িত্বটা বেশি। তবে সরকারের পাশাপাশি যারা বিরোধী দলে আছে তাদেরও দায়িত্ব আছে। আমি মনে করি, দেশে রাজনৈতিক সহিষ্ণু পরিবেশ থাকা উচিত, যাতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত না হয়। আমার আশা, সরকার এই দিকে দৃষ্টি দেবে এবং দেশের ব্যবসায়ীদেরই ব্যবসা পরিচালনা করতে সহায়ক পরিবেশ দেবে। বিরোধী দলের উচিত, হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে বিরত থাকা। 

আজকের পত্রিকা: হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি যদি ভবিষ্যতেও চলতে থাকে তাহলে পণ্য সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ ভোক্তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হলে রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

মাহবুবুল আলম: যেকোনো দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে বিদেশিদের কাছে ইতিবাচক ধারণা যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগ, রপ্তানি ক্রয়াদেশ। যদি কোনো ক্রেতা মনে করে আমি পণ্য কেনার জন্য অর্ডার দিলেও রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ঠিকমতো পণ্য পাব না, তাহলে তারা আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আমাদের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের এই রাজনৈতিক সহিংসতার মাঝে দেশের ভাবমূর্তি ধরে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই ভাবমূর্তি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমি আগেও বলেছি। আবারও বলছি। 

অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ও রপ্তানির চাহিদা মেটাতে আমাদের অনেক জিনিস আমদানি করতে হয়। যদি অবরোধ ও হরতালের মতো পরিস্থিতির কারণে বন্দর  থেকে পণ্য আনা–নেওয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে অর্থনীতি সার্বিকভাবে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দিন শেষে জিনিসের দাম বাড়বে, ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

আজকের পত্রিকা: আপনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনৈতিক কারণে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা–বাণিজ্য সচল রাখার জন্য সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলাপ করার কথা ভেবেছেন কি না?

মাহবুবুল আলম: ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ নিয়ে দুই দলের প্রতি আমাদের আহ্বান ছিল— তারা সভা–সমাবেশ করে নিজেদের বক্তব্য পেশ করবে। কিন্তু এর মধ্যে হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি চলে এসেছে। আমরা এখন দেখছি, এই রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণটা কী রকম। আমরা যদি দেখি, ভবিষ্যতে আরও কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচি আসছে, তাহলে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্ষদসহ অন্যান্য ব্যবসায়িক সংগঠনের সঙ্গে বসে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেব। 

আজকের পত্রিকা: শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নিয়ে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। পোশাক খাতে শ্রমিকদের আন্দোলন চলতে থাকলে রপ্তানি ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। শ্রমিকদের দাবি–দাওয়ার বিষয়ে আপনার মতামত কী? 

মাহবুবুল আলম: তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির চলমান আন্দোলন নিয়ে আমি বিজিএমইএর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। ন্যূনতম মজুরির বিষয়টি সুরাহা করার জন্য বিজিএমইএ শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রোববার (২৯ অক্টোবর) থেকে ধারাবাহিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সকল পক্ষ একটা যৌক্তিক সমাধানে আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি আশা করি, সবাই পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে একটা সমাধানে আসবে। 

আজকের পত্রিকা: মজুরি বোর্ডে তৈরি পোশাক খাতের মালিক প্রতিনিধি বর্তমান ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪০০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। যেই মজুরি বিজিএমইএ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি দিয়ে ঢাকা, গাজীপুর, আশুলিয়া ও চট্টগ্রামের মতো শহরে ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব? 

মাহবুবুল আলম: আমি তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কোনো হোমওয়ার্ক করিনি। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অন্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে ১০ হাজার ৪০০ টাকা বেশি না। এই অবস্থায় অবশ্যই আমি চাইব, শ্রমিকেরা যাতে তাদের ন্যায্য মজুরিটা পায়। আমার আশা, শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে সব পক্ষ তাদের বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখবে। একই সঙ্গে বর্তমানে পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ, আনুষঙ্গিক খরচ এবং ব্যাংক ঋণ— এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। তৈরি পোশাক খাতের ওপর আমাদের রপ্তানি নির্ভর করছে। মালিকদের স্বার্থও অক্ষুণ্ন রেখে শ্রমিকদের মজুরি যথাযথভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে এই খাতে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। 

আজকের পত্রিকা: দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদেশিদের মনোভাব কী দেখছেন; বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের। 

মাহবুবুল আলম: আমরা অনেক দিন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে ছিলাম। গত দুই দিনে পরিস্থিতিটা হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে গেল। আমি এখনো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে ইতিবাচক–নেতিবাচক তেমন কিছুই শুনিনি। তবে তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। এত তাড়াতাড়ি তারা প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। একটু সময় লাগবে। আমি আশা করি, বর্তমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সব দলের নেতাদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। একটা সমঝোতায় তাঁরা আসবেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত