তাসনীম হাসান ও মিনহাজ তুহিন, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একেবারে দক্ষিণেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের অবস্থান। হরেক রকম গাছ আর দেশীয় অর্কিডের বিশাল সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত এই মনোরম বাগান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। বন্ধুদের নিয়ে তাই অনেকে ঘুরতে যান সেখানে। কিন্তু আনন্দের সময়টুকু হঠাৎ বিস্বাদে ভরে উঠতে পারে সংঘবদ্ধ চক্রের উপস্থিতিতে। ১৭ জুলাই রাতে এমন এক চক্রের কবলে পড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী।
ছাত্রলীগের ছায়াতলে থাকা এই চক্রের সদস্যদের কেউ পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউবা কলেজে। সেদিন তাঁরা টাকা আর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে থামেননি। তাঁরা ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করা হয়। পরে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ঘটনাটি কাউকে না বলার হুমকিও দেন। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। এর এক দিন পর বুধবার তিনি মামলা করেন হাটহাজারী থানায়।
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর অভিযান চালিয়ে শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আজিম হোসাইন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের নুরুল আবসার বাবু, হাটহাজারী কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের নুর হোসেন শাওন, মাসুদ রানা এবং একই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মোহাম্মদ সাইফুল নামের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে তাঁদের আমলনামা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সন্তান; পাশাপাশি যুক্ত আছেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা আর রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগের এই কর্মীরা গড়ে তোলেন একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। এই চক্রের মাথা ছিলেন আজিম হোসাইন।
সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, র্যাবের হাতে আটক পাঁচজন ও পলাতক অন্যজন দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফরেস্ট্রি এলাকা, জীববিজ্ঞান অনুষদ এলাকায় অপকর্ম করে আসছেন; বিশেষ করে সন্ধ্যা হলেই সক্রিয় হয়ে উঠতেন তাঁরা। মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে চক্কর দেওয়া শুরু করতেন। তাঁদের একটি গ্রুপ লেডিস ঝুপড়ি এলাকা থেকে নজরদারি শুরু করতেন। ওই ঝুপড়ি থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে কাউকে যেতে দেখলেই মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁদের অনুসরণ করতেন। পরে বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় পৌঁছালেই সুযোগ বুঝে তাঁদের সবকিছু হাতিয়ে নিতেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে মাদক কারবারের সঙ্গেও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
কলেজেই ছিনতাইয়ে হাত পাকান তাঁরা
জড়িত ব্যক্তিরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি কলেজে একসঙ্গে পড়েছেন। তখন থেকেই তাঁরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আজিম কলেজে পড়া অবস্থায় ২০১৭ সালে ফরেস্ট্রি এলাকায় এক ছাত্রীর মোবাইল ফোন ও সোনার চেইন ছিনতাই করে ধরা পড়েন। পরবর্তী সময়ে থানায় নিয়ে গেলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সন্তান
র্যাবের হাতে আটক পাঁচজনের মধ্যে চারজনের বাসা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে। মূল হোতা আজিমের বাসা ঘটনাস্থলের অদূরে বোটানিক্যাল গার্ডেন-সংলগ্ন ইসলামিয়া কলোনিতে। তাঁর বাবা মো. আমির হোসেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মালি। নুরুল আবসার বাবুর বাসা বিজ্ঞান অনুষদের পাশের হিল বটম কলোনিতে। তাঁর বাবা বেলায়েত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাপ্রহরী। মাসুদ রানার বাড়ি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পাশের প্রবাসী কলোনিতে। তাঁর বাবা আবদুল মান্নান রেজিস্ট্রার অফিসের স্টোর শাখার কর্মচারী। নুর হোসেন শাওনের বাসাও প্রবাসী কলোনিতে। তাঁর বাবা জাভেদ হোসেন পরিবহন দপ্তরের বাসচালক।
ছাত্রলীগের নেতাদের ছায়ায় বলীয়ান তাঁরা
বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই প্রায় তিন বছর। আছেন শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তবে এই দুই নেতার দুটি পক্ষ ছাড়াও ক্যাম্পাসে সক্রিয় আছে ছাত্রলীগের আরও কয়েকটি পক্ষ। আজিম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারী বলে জানা গেছে। রুবেলের বিভিন্ন বাইক শোডাউনে তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত। ঘটনার পর রুবেলের সঙ্গে আজিমের তোলা একাধিক ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তবে এখন আজিমকে নিজের অনুসারী মানতে নারাজ ছাত্রলীগের সভাপতি।
ঘটনার পর ওই ছাত্রীর বন্ধুরা অভিযোগ করেছিলেন, ঘটনার শিকার ছাত্রীকে প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দিতে বাধা দেন ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল। এ জন্য ঘটনার দুই দিন পর ওই ছাত্রী অভিযোগ দেন প্রক্টরের কাছে। অবশ্য রুবেল দাবি করে আসছেন, তিনি ছাত্রীকে অভিযোগ দিতে বাধা দেননি।
জড়িত অন্যদের মধ্যে তিনজন (মাসুদ, শাওন, বাবু) শাখা ছাত্রলীগের ভিএক্স (ভার্সিটি এক্সপ্রেস) পক্ষের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়ের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও ভিএক্স গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁরা ভিএক্স পক্ষের কলেজ শাখার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ভিএক্সের নেতা দুর্জয়ের সঙ্গে তাঁদের ছবিও দেখা গেছে। যদিও নিজের কর্মীর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন দুর্জয়। তিনি বলেন, ‘কলেজের ছাত্র কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করবে?’
রেজাউল হক রুবেল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আজিম সিএফসি (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার) পক্ষের কর্মী। আর আমি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। আর বাকিরা ভিএক্স গ্রুপের কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও তারা ভিএক্সের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়।’
দুজন বহিষ্কার
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আজিম ও নুরুল আবসার বাবুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ, রেসিডেন্স ও ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হাটহাজারী কলেজের দুই ছাত্রের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর শাস্তির আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান।
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ
অপরাধীদের শনাক্ত করতে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দিকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান দাবি করেছেন, যৌন নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর বক্তব্যে গরমিলের কারণে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তে দেরি হয়েছে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তার অভিযোগে প্রথমে বলেছিল যে তাকে প্রীতিলতা হলের পাশ থেকে অভিযুক্তরা টেনেহিঁচড়ে আড়ালে নিয়ে যায়। কিন্তু তদন্ত চলাকালে সে জানিয়েছে, ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের পেছনের গলি বা ছোট রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় বন্ধুসহ বসে ছিল। সেখানে গিয়ে অভিযুক্তরা তাঁদের মারধর ও অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। ঘটনাস্থল মূল রাস্তা থেকে ভেতরে হওয়ায় সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না।’
যৌন নিপীড়নের বিচার হয় না
২০১৮ সালে ‘যৌন হয়রানি নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র’ নামের সাত সদস্যের কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের নির্দেশনায় ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ সদস্যের একটি ‘অভিযোগ কমিটি’ গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক কাজী শামীমা সুলতানা (পদার্থ বিভাগ)। এ পর্যন্ত এই কমিটিতে তিনটি অভিযোগ জমা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো ছিল খালেদা জিয়া হলের ছাত্রীকে হেনস্তা, ফরেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষকের হাতে ছাত্রী হেনস্তা এবং ছাত্রলীগের চার কর্মীর কাছে দুই ছাত্রী হেনস্তা। কিন্তু অভিযোগগুলোর একটিও এখন পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সারা দেশের ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে হত্যা, ধর্ষণ, র্যাগিং, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ বারবার এসেছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে ২৪ জন শিক্ষার্থী খুনের শিকার হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ঢাকায় ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দিনদুপুরে কুপিয়ে দরজি দোকানদার বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি সংগঠনের বিরোধীপক্ষের হামলায় আহত হয়ে এক দিন পর মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে শেরেবাংলা হলে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে শাহ পরান (রা.)-এর মাজার থেকে ফেরার পথে স্বামীর কাছ থেকে তুলে মুরারিচাঁদ কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণ করা হয় এক নারীকে। এ ঘটনায় ছয়জনকে আসামি করে মামলা করা হয়, যাঁদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, কেউ ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে কোনো অপকর্ম করলে ছাত্রলীগ সব সময়ের মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিও অনুরোধ থাকবে দোষীদের যেন শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একেবারে দক্ষিণেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের অবস্থান। হরেক রকম গাছ আর দেশীয় অর্কিডের বিশাল সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত এই মনোরম বাগান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। বন্ধুদের নিয়ে তাই অনেকে ঘুরতে যান সেখানে। কিন্তু আনন্দের সময়টুকু হঠাৎ বিস্বাদে ভরে উঠতে পারে সংঘবদ্ধ চক্রের উপস্থিতিতে। ১৭ জুলাই রাতে এমন এক চক্রের কবলে পড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী।
ছাত্রলীগের ছায়াতলে থাকা এই চক্রের সদস্যদের কেউ পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউবা কলেজে। সেদিন তাঁরা টাকা আর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে থামেননি। তাঁরা ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করা হয়। পরে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ঘটনাটি কাউকে না বলার হুমকিও দেন। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। এর এক দিন পর বুধবার তিনি মামলা করেন হাটহাজারী থানায়।
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর অভিযান চালিয়ে শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আজিম হোসাইন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের নুরুল আবসার বাবু, হাটহাজারী কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের নুর হোসেন শাওন, মাসুদ রানা এবং একই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মোহাম্মদ সাইফুল নামের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে তাঁদের আমলনামা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সন্তান; পাশাপাশি যুক্ত আছেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা আর রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগের এই কর্মীরা গড়ে তোলেন একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। এই চক্রের মাথা ছিলেন আজিম হোসাইন।
সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, র্যাবের হাতে আটক পাঁচজন ও পলাতক অন্যজন দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফরেস্ট্রি এলাকা, জীববিজ্ঞান অনুষদ এলাকায় অপকর্ম করে আসছেন; বিশেষ করে সন্ধ্যা হলেই সক্রিয় হয়ে উঠতেন তাঁরা। মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে চক্কর দেওয়া শুরু করতেন। তাঁদের একটি গ্রুপ লেডিস ঝুপড়ি এলাকা থেকে নজরদারি শুরু করতেন। ওই ঝুপড়ি থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে কাউকে যেতে দেখলেই মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁদের অনুসরণ করতেন। পরে বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় পৌঁছালেই সুযোগ বুঝে তাঁদের সবকিছু হাতিয়ে নিতেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে মাদক কারবারের সঙ্গেও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
কলেজেই ছিনতাইয়ে হাত পাকান তাঁরা
জড়িত ব্যক্তিরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি কলেজে একসঙ্গে পড়েছেন। তখন থেকেই তাঁরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আজিম কলেজে পড়া অবস্থায় ২০১৭ সালে ফরেস্ট্রি এলাকায় এক ছাত্রীর মোবাইল ফোন ও সোনার চেইন ছিনতাই করে ধরা পড়েন। পরবর্তী সময়ে থানায় নিয়ে গেলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সন্তান
র্যাবের হাতে আটক পাঁচজনের মধ্যে চারজনের বাসা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে। মূল হোতা আজিমের বাসা ঘটনাস্থলের অদূরে বোটানিক্যাল গার্ডেন-সংলগ্ন ইসলামিয়া কলোনিতে। তাঁর বাবা মো. আমির হোসেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মালি। নুরুল আবসার বাবুর বাসা বিজ্ঞান অনুষদের পাশের হিল বটম কলোনিতে। তাঁর বাবা বেলায়েত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাপ্রহরী। মাসুদ রানার বাড়ি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পাশের প্রবাসী কলোনিতে। তাঁর বাবা আবদুল মান্নান রেজিস্ট্রার অফিসের স্টোর শাখার কর্মচারী। নুর হোসেন শাওনের বাসাও প্রবাসী কলোনিতে। তাঁর বাবা জাভেদ হোসেন পরিবহন দপ্তরের বাসচালক।
ছাত্রলীগের নেতাদের ছায়ায় বলীয়ান তাঁরা
বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই প্রায় তিন বছর। আছেন শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তবে এই দুই নেতার দুটি পক্ষ ছাড়াও ক্যাম্পাসে সক্রিয় আছে ছাত্রলীগের আরও কয়েকটি পক্ষ। আজিম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারী বলে জানা গেছে। রুবেলের বিভিন্ন বাইক শোডাউনে তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত। ঘটনার পর রুবেলের সঙ্গে আজিমের তোলা একাধিক ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তবে এখন আজিমকে নিজের অনুসারী মানতে নারাজ ছাত্রলীগের সভাপতি।
ঘটনার পর ওই ছাত্রীর বন্ধুরা অভিযোগ করেছিলেন, ঘটনার শিকার ছাত্রীকে প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দিতে বাধা দেন ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল। এ জন্য ঘটনার দুই দিন পর ওই ছাত্রী অভিযোগ দেন প্রক্টরের কাছে। অবশ্য রুবেল দাবি করে আসছেন, তিনি ছাত্রীকে অভিযোগ দিতে বাধা দেননি।
জড়িত অন্যদের মধ্যে তিনজন (মাসুদ, শাওন, বাবু) শাখা ছাত্রলীগের ভিএক্স (ভার্সিটি এক্সপ্রেস) পক্ষের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়ের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও ভিএক্স গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁরা ভিএক্স পক্ষের কলেজ শাখার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ভিএক্সের নেতা দুর্জয়ের সঙ্গে তাঁদের ছবিও দেখা গেছে। যদিও নিজের কর্মীর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন দুর্জয়। তিনি বলেন, ‘কলেজের ছাত্র কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করবে?’
রেজাউল হক রুবেল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আজিম সিএফসি (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার) পক্ষের কর্মী। আর আমি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। আর বাকিরা ভিএক্স গ্রুপের কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও তারা ভিএক্সের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়।’
দুজন বহিষ্কার
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আজিম ও নুরুল আবসার বাবুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ, রেসিডেন্স ও ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হাটহাজারী কলেজের দুই ছাত্রের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর শাস্তির আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান।
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ
অপরাধীদের শনাক্ত করতে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দিকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান দাবি করেছেন, যৌন নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর বক্তব্যে গরমিলের কারণে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তে দেরি হয়েছে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তার অভিযোগে প্রথমে বলেছিল যে তাকে প্রীতিলতা হলের পাশ থেকে অভিযুক্তরা টেনেহিঁচড়ে আড়ালে নিয়ে যায়। কিন্তু তদন্ত চলাকালে সে জানিয়েছে, ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের পেছনের গলি বা ছোট রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় বন্ধুসহ বসে ছিল। সেখানে গিয়ে অভিযুক্তরা তাঁদের মারধর ও অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। ঘটনাস্থল মূল রাস্তা থেকে ভেতরে হওয়ায় সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না।’
যৌন নিপীড়নের বিচার হয় না
২০১৮ সালে ‘যৌন হয়রানি নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র’ নামের সাত সদস্যের কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের নির্দেশনায় ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ সদস্যের একটি ‘অভিযোগ কমিটি’ গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক কাজী শামীমা সুলতানা (পদার্থ বিভাগ)। এ পর্যন্ত এই কমিটিতে তিনটি অভিযোগ জমা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো ছিল খালেদা জিয়া হলের ছাত্রীকে হেনস্তা, ফরেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষকের হাতে ছাত্রী হেনস্তা এবং ছাত্রলীগের চার কর্মীর কাছে দুই ছাত্রী হেনস্তা। কিন্তু অভিযোগগুলোর একটিও এখন পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সারা দেশের ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে হত্যা, ধর্ষণ, র্যাগিং, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ বারবার এসেছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে ২৪ জন শিক্ষার্থী খুনের শিকার হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ঢাকায় ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দিনদুপুরে কুপিয়ে দরজি দোকানদার বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি সংগঠনের বিরোধীপক্ষের হামলায় আহত হয়ে এক দিন পর মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে শেরেবাংলা হলে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে শাহ পরান (রা.)-এর মাজার থেকে ফেরার পথে স্বামীর কাছ থেকে তুলে মুরারিচাঁদ কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণ করা হয় এক নারীকে। এ ঘটনায় ছয়জনকে আসামি করে মামলা করা হয়, যাঁদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, কেউ ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে কোনো অপকর্ম করলে ছাত্রলীগ সব সময়ের মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিও অনুরোধ থাকবে দোষীদের যেন শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১৭ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১৭ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১৭ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
২১ দিন আগে